× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইউ টার্ন

বাসার তাসাউফ

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:২২ পিএম

অলংকরণ : গুপু ত্রিবেদী

অলংকরণ : গুপু ত্রিবেদী

ইউ টার্ন শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় পলিটিক্সে। মোগল আমলে মীর জাফর আলী খান বোধ হয় সর্বপ্রথম ইউ টার্ন নিয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে তার নেওয়া ইউ টার্ন আদতে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে।

সাধারণত ইউ টার্ন বলতে আমি বুঝি, সোজা রাস্তায় চলা কোনো যানবাহনের বাঁক বদলে অন্য দিকে যাওয়া। মানুষও এমনটি করে। মানুষের বেলায় ইউ টার্ন না বলে বলা হয়, পল্টি লওয়া বা পল্টিবাজি।

রুকিয়ার সঙ্গে দেখা না হলে পল্টিবাজি সম্পর্কে আমার ধারণা অসম্পূর্ণ থাকত।

শীতের ছুটিতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমি কক্সবাজার বেড়াতে এসেছি আর রুকিয়া এসেছে তার স্বামীকে নিয়ে। সি গাল হোটেলের ডিলাক্স হিল সাইডের একটি রুমে আমরা উঠেছি। তবে এমন বিলাসবহুল রুমে মাঝরাতে এসে শুধু ঘুমানোর সময়টা বেশিক্ষণ অবস্থান করা হয় না। চার দিন ধরে পুরো কক্সবাজার চষে বেড়াচ্ছি আমরা। অফিস থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়েছি। চার দিন শেষ। আগামীকালই ফিরত হবে। সকালে দোলা মনে করিয়ে দিল, ‘সমুদ্র দেখতে এসে সূর্যাস্ত না দেখেই চলে যাবা?’

আরে তাই তো!’ যেন হঠাৎ মনে পড়ল আমার।

ঠিক করলাম, আজ বিকালে অন্য কোথাও যাব না। সোজা সৈকতে চলে যাব। আবিরের রঙে যখন রাঙা হয়ে উঠবে পশ্চিম দিগন্ত, তখন সূর্যটা কীভাবে তার গহ্বরে হারিয়ে যায় তা দেখব।

দোলা শাড়ি পরেছে। মেরুন রঙের। আমি পরেছি পাঞ্জাবি। কফি রঙের। দোলার শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পাওয়া যায়নি। তাই দুজনের পোশাকের রঙ ম্যাচিং হয়নি। তবে মেরুনের সঙ্গে কফি রঙ কিছুটা মিল আছে। তা- পরে সৈকতে চলে এলাম। এখানে এসে বালির ওপর দাঁড়িয়ে দিগন্তের গহ্বরে ডুবতে থাকা সূর্যটা দেখে মনে হলো, আবিররঙা দিগন্তের বিশাল ক্যানভাসে কোনো শিল্পী একটা লাল বৃত্ত এঁকে রেখেছেন।

পায়ের নিচে বালি, মাঝখানে বিশাল সমুদ্র, নীল জলরাশি, ঊর্মিমালা, সমুদ্র দিগন্তের মিলনরেখায় লাল সূর্যÑ আহা! কী চমৎকার দৃশ্য! মুঠোফোনের ক্যামেরায় দৃশ্যটা ধারণ করার পরও মন তুষ্ট হলো না। ভ্যান গগের মতো শিল্পী হলে এখনই একটি ছবি আঁকতে বসে যেতাম। কিছু দৃশ্য আছে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখার পরও মন তুষ্ট হয় না। মজাদার কোনো খাবার খাওয়ার পর যেমন জিবে স্বাদসুধা লেগে থাকে, তেমনই।

সমুদ্রের ঊর্মিমালার গর্জন, হিমশীতল হাওয়া, রক্তিম সূর্যের নিমীলন আর বালির ওপরে হেঁটে চলার পর ফুটে ওঠা পায়ের রেখাÑ এসব দৃশ্য যদি অমর করে রাখা যেত! কথা ভাবতে ভাবতে আমি এদিক-ওদিক হাঁটছিলাম। অন্য প্রান্তে, দোলা স্থির দাঁড়িয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরা অন করে নিবিষ্ট মনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্যাস্তের দৃশ্য ধারণ করতে চায়। এজন্য একবারও অন্য দিকে চোখ সরায় না সে।

আরে বাদল! কবে এলে এখানে?’

হঠাৎ কোনো মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম রুকিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে সমুদ্রের নীল জলের মতো নীল রঙের শাড়ি আর কপালে ডুবতে থাকা সূর্যের মতো লাল টিপ। আমি একবার সমুদ্রের ওপারের লাল সূর্যটা দেখি আরেকবার দেখি রুকিয়ার কপালের টিপ। কোনটা সূর্য পার্থক্য করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো।

দোলা অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সূর্য, সমুদ্র সৈকতের মনোরম দৃশ্যগুলো তার মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত। সূর্যটা তখনও দিগন্তের গহ্বরে ডুব দেয়নি। একবার দোলাকে দেখে নিয়ে আমি আবার রুকিয়ার দিকে চোখ ফেরালাম।

কপালে সূর্যের মতো লাল টিপ আর রসুনের খোসার মতো পাতলা ফরসা পায়ের নখÑ রুকিয়ার আপাদমস্তক অবলোকন করে একটু চমকে উঠলাম। তবে রুকিয়া! মাথার চুল দুই ভাগ করে কলাবেণি বেঁধে সাদা ইউনিফর্ম পরে ক্লাসে আসত যে মেয়েটা, যার হাতে থাকত হ্যান্ডনোট লেখার ডায়েরি, সেই মেয়ের হাত ধরে এখন দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট অথচ ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে। মেয়েটি দেখতে অবিকল রুকিয়ার মতো। বিকালের শেষ আলো এসে যখন মেয়েটির মুখে পড়ল মনে হলো, রুকিয়ার মুখটাই যেন তার মুখের ওপর বসানো। মেয়েটি যে রুকিয়ারই সন্তান, চেহারার মিল দেখে বুঝতে বাকি রইল না।

মেয়ের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার তাকালাম মায়ের মুখের দিকে। সাত-আট বছর আগের রুকিয়ার সঙ্গে বিস্তর ব্যবধান পেলাম। রুকিয়ার মাঝে কৈশোর অনুত্তীর্ণ সেই চঞ্চলতা নেই। এক রকম গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভুলটা আমারই হয়েছে। আমি তো পড়ে আছি সাত-আট বছর আগের রুকিয়াকে নিয়ে। ঝরনা যেমন নদী হয়, রুকিয়াও যে মেয়ে থেকে নারী হয়ে গেছে, তা আমার বোধে ছিল না। তবে নারী হয়ে ওঠার পর রুকিয়া আরও সুন্দর হয়েছে।

রুকিয়ার পরনে নীল রঙের শাড়ি আর কপালে লাল টিপ, ম্যাচিং হয়নি। রুকিয়া এমনই। কখনও ম্যাচ করে পোশাক পরে না। তার শরীরে যেকোনো পোশাক ম্যাচিং হয়ে যায়। সে কখনও আয়োজন করে সাজে না। তার সাজ বলতে বড়জোর চোখে একরত্তি কাজল পরে, কলেজে পড়ার সময় দেখেছি। কাজল পরলে তার চোখের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। একবার তাকে বলেছিলামও কথা। এরপর তাকে আর কখনও কাজল পরতে দেখিনি।

‘...বরং পায়ে আলতা পরলে তোমাকে বেশ লাগে।

কথাটাও বলেছিলাম।

এরপর পায়ে নিয়মিত আলতা পরত রুকিয়া। নূপুরের নিক্বণ ধ্বনি সমেত রক্তরঙা আলতা পায়ে যখন সে কলেজের সবুজ তৃণের গালিচা বিছানো পথে হাঁটত; আমার মাঝে এক ধরনের দোল তৈরি হতো। সেই দোলের দোলায় দোলায়মান থাকতাম আমি অনিমেষ, অনিমিখ।

নীল শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ যায় না। কিন্তু রুকিয়াকে মন্দ লাগছে না। আজ চোখে কাজল পরেছে। সেকি স্বামীর পছন্দে কাজল পরা শুরু করেছে? আর কী কী পছন্দ করে তার স্বামী? পায়ে আলতা পরা পছন্দ করে কি? শাড়ির নিচের পাড়ে ঢেকে আছে রুকিয়ার পা। তাই পায়ে আলতা পরেছে কি না দেখতে পেলাম না। রুকিয়ার চোখজোড়া অবিরাম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বারবার পায়ের দিকে তাকাতে অস্বস্তি লাগছে। তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।

রুকিয়া করমর্দনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু আমি তার হাতটা ধরতে একটু ইতস্তত করলাম। ইতস্তত করার নেপথ্যে একটা কারণ আছে। দোলা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে একজন মেয়ের সঙ্গে স্বামীকে করমর্দন করতে দেখে কোনো স্ত্রী খুশি হবে না। খুশি হওয়ার কথাও না। তাই রুকিয়ার সঙ্গে আমি করমর্দনও করলাম না।

রুকিয়া আগের চেয়ে একটু মোটা হয়েছে। শরীর বদলে যাওয়া, পোশাক-আশাক, কানে, গলায়, হাতে দামি অলংকারের চাকচিক্য দেখে বুঝতে পারলাম তার স্বামী বেশ ধনাঢ্য ব্যক্তি। রুকিয়া তাহলে সুখেই আছে? আমি তার সুখে থাকার কথা ভাবছিলাম যখন ঠিক তখন সে আমার কুশল জানতে চাইল, ‘কেমন আছো তুমি?’

আমি মৃদ কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘ভালো আছি।

কবে এসেছ এখানে? সঙ্গে আর কে এসেছে? বউ নিয়ে এসেছ বুঝি?’

হ্যাঁ, আমার সঙ্গে বউ এসেছে। তোমার বর আসেনি?’

এসেছে তো।বলেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বামীকে হাতের ইশারায় আমাদের কাছে ডাকল। সমুদ্রসৈকতের সাদা ফেনিল জলরাশি আর দূরের আবছা আলোয় তার স্বামীকে অস্পষ্ট দেখতে পেলাম। পুরো চেহারা বুঝতে না পারলেও রুকিয়ার ইশারার জবাবে সম্মতি জানিয়ে সে যে আমাদের দিকে আসতে লাগল বুঝতে পারলাম।

রুকিয়ার স্বামী আসার আগের সময়টুকুতে সিনেমার ফ্লাশব্যাক দৃশ্যের মতো কল্পনায় আমাদের ফেলে আসা দিনগুলো থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।

তখন আমি কলেজে পড়তাম। একই কলেজে রুকিয়াও পড়ত। দুজনেরই গ্রুপ ছিল সায়েন্স। প্রতিদিন রুকিয়ার সঙ্গে দেখা হতো। দেখতে দেখতে তার প্রতি ভালোলাগা অনুভব করতে থাকি। কিন্তু রুকিয়াকে ঘুণাক্ষরেও তা বলিনি।

রুকিয়াকে ভালো লাগলেও তার নামটা ভালো লাগত না। কেন জানি মনে হতো রুকিয়া, সালেহা, আবিদা কিংবা আছিয়াÑ মেয়েদের এসব নাম নানি-দাদিদের আমলের। তাই একটু সম্পাদনা করে রুকিয়াকে আমি ডাকতাম রুবা। তার আর আমার নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলাম নামটা।

রুবার গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, দুধের মতন সাদা নারী। অবশ্য রুবা তখনও নারী হয়ে ওঠেনি। তখনও মাথার চুল দুই ভাগ করে কলাবেণি বেঁধে কৈশোরের চাঞ্চল্য নিয়ে ক্লাসে আসত। তো নারী না হয়ে ওঠা সেই কিশোরী রুবার একদিন ভীষণ মন খারাপ। প্রথম ক্লাসের পর ক্যান্টিনের দিকে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম মাঠের দক্ষিণ দিকের মেহগনি গাছগুলোর নিচে চারজন বান্ধবী তার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রুবা বেশ উদ্বিগ্ন, তার চোখের কোণে বেদনার অশ্রু টলমল করছে।

এরকম একজন মেয়েকে অবস্থায় দেখে কিছুটা কষ্ট লাগল আমার। ফরসা শরীরের মেয়েদের চোখের মণি বেশ কালো হয়। একটু কান্নাতেই জল গড়িয়ে পড়ে। কালো চোখ লাল হয়ে যায়। কালো চোখের মেয়েদের অশ্রুতে বেশ দুখী লাগে। কারও দুখীমুখ দেখতে আমার ভালো লাগে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?’

রুবা আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একজন জবাব দিল, ‘রুকিয়ার ভীষণ বিপদ!’

রুকিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা আরিফুল হকের ছেলে শাওন তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। শাওনের বয়স পঁচিশ। শারীরিক গঠন লম্বাটে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ভেড়ার লোমের মতো। একজন বখাটে ছেলের যেসব গুণ থাকতে হয়, শাওনের সবই আছে।

রুকিয়া সেদিন কলেজে আসার পথে রাস্তার মোড়ে শাওন তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তাকে প্রেম করার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হলে অপমান করার হুমকি দেয়। রুকিয়ার একটাই অপরাধ, সে বেশ সুন্দরী। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে শাওনের হাত থেকে বাঁচতে রুকিয়া একটু দূরে চায়ের দোকানে কয়েকজন লোক দেখে সেখানে ছুটে যায়। চায়ের দোকানের লোকজন দেখে দলবল নিয়ে কেটে পড়ে শাওন। এমনটা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। নিরুপায় হয়ে রুকিয়া বিকল্প পথ ব্যবহার করে কলেজে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সব পথই তারা দখল করে রাখে। এমনকি পথ মাড়িয়ে কলেজের গেটে পর্যন্ত চলে আসে। তাকে দেখলেই আজেবাজে মন্তব্য করতে থাকে। তুলে নেওয়ারও হুমকি দেয়। পরিস্থিতি একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে রুকিয়া কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। রুকিয়া কলেজে আসে না বলে বান্ধবীরা তার খোঁজ নেয়। তারা বিষয়টা অবগত হয়ে রুকিয়াকে মায়ের কাছে শেয়ার করার পরার্শ দেয়। রুকিয়া তা- করে। সব জেনে মা একটা পথ বের করেন। সংসারের কাজ ফেলে মেয়ের সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করতে থাকেন। রুকিয়ার সঙ্গে মাকে দেখে শাওন আর পথ রোধ করে দাঁড়ায় না। কিছুদিন নিজেকে আড়াল করে রাখে। রুকিয়া ভাবে, ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে সে। একটানা দুই মাস মা রুকিয়ার সঙ্গে কলেজে আসা-যাওয়া করে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে মা তার সঙ্গে কলেজে আসা বন্ধ করে দেন। মা সঙ্গে আসেন না বলে শাওন আবার কোথা থেকে যেন এসে হাজির! এবার বেশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরাসরি তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়।

রুকিয়ার বাবা-মা আর বসে থাকেননি। নিজেদের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে এতদিন নীরবে সব সয়ে গিয়েছিলেন। এবার আর সম্মান ক্ষুণ্নের চিন্তা করলে চলবে না। অপহরণ-চেষ্টার অভিযোগ জানিয়ে রুকিয়ার বাবা থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই বলে জানায়। কারণ প্রতি বছর শাওনের জন্মদিনে এলাকার চেয়ারম্যান কেক কাটেন। শাওনের বাবা আরিফুল হক একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। প্রভাবশালী এক নেতার সঙ্গে তারভাই-ব্রাদারসম্পর্ক। তাই পুলিশ আরিফুল হককে বিষয়টা ফয়সালা করার অনুরোধ করে। অন্যদিকে রুকিয়ার বাবা থানায় কোনো সাহায্য না পেয়ে সরাসরি আদালতে অভিযোগ করেন। আদালত থেকে থানাকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলে পুলিশ শাওনকে ধরে আনে। শাওনের বাবা আরিফুল হককেও ডেকে আনে। আরিফুল হকের এবার টনক নড়ে। উপায়ান্তর না দেখে সিনিয়র নেতাদের কাছে ছুটে যান। নেতাদের পরামর্শে ছেলেকে বাঁচাতে তাকে মানসিক রোগী বলে পরিচয় দেন। পুলিশ আরিফুল হকের কাছ থেকে মুচলেকা নেয় এবং তার ছেলে আর মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করবে না বলে লিখিত অঙ্গীকার নেয়। রুকিয়ার মা-বাবাও বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে মেয়েকে একা একা কলেজে যেতে দেন। কয়েকটি দিন সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু কিছুদিন পর শাওন আবার বেরিয়ে আসে। সেদিন রুকিয়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের গেট পর্যন্ত চলে আসে। আসার সময়টাতে তাকে শ্লীল অশ্লীল অনেক কথাই বলে। রুকিয়া কোনো কথায় কর্ণপাত না করে সোজা কলেজের গেট পেরিয়ে ক্লাসে চলে আসে। এখানে তার সহপাঠীরা অবস্থান করছিল। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বান্ধবীকে ডেকে বাইরে নিয়ে এসে মেহগনি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের চরম দুর্দশার কথা জানায় এবং জানতে চায়, এখন এর থেকে বাঁচার উপায় কী?

শাওন আগে শুধু পথে উত্ত্যক্ত করত। আদালতে অভিযোগ করার পর বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গেছে। তাই নিজের বাসায় থাকা নিরাপদ নয় বলে রুকিয়া একেক দিন একেক আত্মীয়ের বাসায় রাতযাপন করতে থাকে। ঘটনাটা জানার পর রুকিয়ার ক্লাসমেট হিসেবে আমরা কজন বন্ধু তাকে এহেন দুর্দশা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলাম। প্রথমে ভাবলাম, শাওনের সঙ্গে কথা বলব। তাকে বোঝাব। সে যদি বোঝে, ভালো। না হলে প্রয়োজনে মারামারি করতেও প্রস্তুত আছি। আমার এমন তেজোদীপ্ততার নেপথ্যে একটা কারণ আছে। রুকিয়াকে যে আমার ভালো লাগে তা শুধু ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভালোবাসা পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে।

ভালোবাসা সব পারে, পাথরে ফোটাতে পারে ফুল।

জোয়ারের জলে ভাসাতে পারে মরা নদীর দুই কূল।

ভালোবাসা সব পারে, চৈত্রে আনতে পারে বসন্ত

                   ফুলে ফুলে সাজাতে পারে জীবনের আদ্যোপান্ত।

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে রুকিয়ার কিন্নর কণ্ঠে যেদিন কবিতাটা আবৃত্তি শুনেছিলাম সেদিনই তার প্রতি আমার ভালোলাগা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এখন ভালোবাসার পরিণতি হিসেবে তাকে জীবনসঙ্গী করে পেতে অপেক্ষায় আছি। রুকিয়ার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার ভাগ্য কেমন আমি জানি না। রুকিয়াকে জীবনসঙ্গী করে পেতে দরকার হলে ভাগ্য বদল করে নেব। পৃথিবীতে অনেকেই নিজের ভাগ্য নিজে তৈরি করেছে। আমিও না হয় তা- করব।

রুকিয়াকে পেতে ভাগ্য বদল করার প্রথম ধাপ হিসেবে আমি শাওনকে তার পেছন থেকে সরানোর মিশনে নেমে পড়ি। ক্ষেত্রে আমাকে একাই শাওনের মুখোমুখি হতে হয়। আমার বন্ধুরা কেউ তার সামনে যাওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু আমি দৈববলে কোথা থেকে যেন সাহস পেয়েছি। শাওনকে খুঁজে বের করে তাকে অনুরোধ করি রুকিয়ার পেছন থেকে সরে যেতে। উল্টো শাওন আমাকে বলে, ‘আমি তো রুকিয়ার পেছনে নই, সামনে আছি। তুমি বরং রুকিয়ার পেছন থেকে সরে যাও।

তার কথায় আমার পৌরুষে আঘাত লাগে। ইচ্ছে হয়, তাকে তখনই খুন করি। কিন্তু খুন করা আমার কাজ না। আমার কাজ ভালোবাসা।

রুকিয়াকে আমি ভালোবাসি।

কথাটা আচমকা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আর তাতেই শাওন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে একটা কল করতেই মিনিট দশেকের মধ্যে তার সব সাঙ্গোপাঙ্গ এসে হাজির হয়। প্রত্যেকের হাতে ক্রিকেট স্টাম্প ব্যাট। তারপর? তারপর তারা স্টাম্প ব্যাট দিয়ে আমার ওপর আঘাত করতে থাকে। আমার মাথা ফেটে রক্ত ঝরে পড়ার আগে তাদের আঘাত থামেনি।

তিন ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর হাসপাতালে নিজেকে আবিষ্কার করি মাথায় হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায়। এরপর প্রায় পনের দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় বেডরেস্টে কেটে যায় আরও সপ্তাহখানেক। এক মাস পর কলেজে এসে রুকিয়াকে আর খুঁজে পাইনি। তার বান্ধবীদের কাছে জানতে পারি, গত সপ্তায় রুকিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।

আসলে রুকিয়ার বিয়ে হয়নি। রুকিয়াকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাওনের হাত থেকে বাঁচাতে বাবা-মা রুকিয়াকে বিয়ে দিয়েছেন।

 রুকিয়ার স্বামী আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, এতটাই চমকে উঠলাম যে, সমুদ্রের শান্ত জলে আচমকা ঘূর্ণিঝড়ের গর্জন শুনতে পেলাম। কাকে দেখছি! রুকিয়া বিয়ে করেছে শাওনকে! শাওন এখন রুকিয়ার স্বামী! আমার সঙ্গে এত বড় পল্টি নিল সে!

পরাজিত সৈনিকের মতো আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাওন আমার কাছে এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। এবার আর ইতস্তত করার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দন করতে করতে শাওনের দিকে তাকিয়ে আরও অবাক হলাম। তার মাথায় সেই ভেড়ার লোমের মতো চুল নেই। এখন কদমছাঁট চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নেই, এখন একেবারে ক্লিন শেভ। হাঁটুর সামনে খামচি দিয়ে ছিঁড়ে রাখার মতো ছেঁড়া জিন্স প্যান্টের বদলে এখন পরে আছে কালো রঙের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট আর ফুলহাতা সাদা শার্ট। আশ্চর্য! শাওন এতটা ফরমাল হলো কীভাবে?

ভালোবাসা সব পারে, পাথরে ফোটাতে পারে ফুল

জোয়ারের জলে ভাসাতে পারে মরা নদীর দুই কূল।

ভালোবাসা সব পারে...

আমাদের কাছ থেকে কখন যে সরে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল রুকিয়া। শাওন আমার সঙ্গে আর কথা না বলে তার স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে এলাম আমার স্ত্রীর কাছে। দোলা মুঠোফোনের ক্যামেরায় এখনও ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে সেলফি তুলতে লাগল। আমি, দোলা আর সমুদ্রের ওপারের অস্তগামী লাল সূর্যটা সেলফির একটি ফ্রেমে বন্দি হলাম।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা