টোকন ঠাকুর
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩ ২২:৩২ পিএম
হেমন্ত জাদুঘর থেকে ফেরে না, আমি কোনো পোস্টম্যান ঘুরতে দেখিনি, এমনকি
অরণ্যও দেখিনি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কেন লিখলেন হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে
দেখেছি অনেক? তাদের হলুদ ঝুলিতে নাকি গাভির মতো আবিল চিঠিতে ভরে গিয়েছিল। কই, সেভাবে
তো তেমন কিছু চোখে পড়েনি আমার। তাই বলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যে মিথ্যে লিখেছেন, সে দাবিও
করছি না। তবে অবশ্যই আমি স্বীকার করে নেব, হেমন্ত দাশ বাবুর। হেমন্তের স্টেকহোল্ডার
মাস্ট বি জীবনানন্দ দাশ। বাংলা কবিতার প্রবল চাষি বরিশালের জীবনানন্দ দাশ হেমন্ত চাষেই
সিদ্ধি নিয়েছেন; এটা বুঝি আজ বলাই যায়। ফলে চোখ রাখলেই আমরা দেখতে পাই হিমকুয়াশার মিহিলাবণ্য
গুটি গুটি করে এসে জমা হয়েছে তার কবিতায়, তার ভাবনায়। সেই ভাবনা লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে
সাতটি তারার তিমিরে, কালবেলা অবেলায়। রাশি রাশি কবিতায় হেমন্ত চিত্রিত হয়ে আছে। ফলে
তার কবিতার মধ্যেই দেখি ধান কাটা হয়ে গেছে। খড়-বিচালির পালা জমে আছে তার কবিতায়। শীতের
প্রবেশদ্বারে হেমন্ত কড়া নেড়ে যায়। এক কথায়, হেমন্ত মিউজিয়ামের একনিষ্ঠ কিউরেটর জীবনানন্দ
দাশ।
হেমন্তের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, বিশেষ করে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা
সান্যালের সঙ্গে। সত্যি সত্যি হেমন্ত যে একটা ঋতু, যা তার মহিমাÑ কবি জীবনানন্দ দাশই
তার প্রধান কিউরেটর। হয়তো ডেপুটি কিউরেটর হয়ে গেলেন বিনয় মজুমদার। লিখলেন অঘ্রাণের
অনুভূতিমালা।
শুধু কি বরিশালের দাশবাবু আর শিমুলপুরের বিনয় মজুমদারই হেমন্ত সংরক্ষণ
পর্ষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে আছেন? এতে তো পর্ষদ পূর্ণ হয় না। তাই
আরও আরও কবি হেমন্তচিত্রিত শব্দবাক্যে নিজেরাই যুক্ত হয়ে আছেন। আমি ঠিক জানি না, কে
বা কারাÑ তবে অনুভব করি, এ মুহূর্তেও খাতায় পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা হেমন্ত রচনা করে চলেছেন
কোনো না কোনো তরুণ কবি, যাকে প্ররোচনা দিয়েছেন দাশ। কিংবা তাকে প্ররোচনা দিয়ে থাকতে
পারে বাংলার কৃষকের ধানিমাঠ, ভোরের কুয়াশা, বৈরাগ্য দেওয়ার মতো নির্লিপ্ত আকাশ। হতেই
পারে, নাও হতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একবার হেমন্তের কবলে পড়েছিলাম। দেখলাম চাই বা না
চাই, ভোরের কুয়াশা আমায় ডাক দিল। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। কুয়াশা আমাকে হাঁটাতে হাঁটাতে
নিয়ে গেল মধুপুরের মাঠে, যে মাঠে আমার বাল্যবেলা চুপচাপ বসে আছে হারিয়ে যাওয়া বালকের
মতো, যে কুয়াশায় ঘাপটি মেরে আছে আমার বয়ঃসন্ধির প্রথম রহস্য।
যা-ই হোক, যে কথা বলছিলাম, আধুনিক নগরজীবনের মধ্যে বাস করেও, একবার
আমি দেখলামÑ হেমন্ত আমাকে শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন ‘শিশির শিকার করে নিয়ে যায় সমস্ত
সকাল’। আমাকেও হেমন্তের কুয়াশা হাইজ্যাক করে নিয়ে গেল বেড়িবাঁধের কাছে। আমি তো বুঝতেই
পারিনি যে, হেমন্ত হচ্ছে ছেলেধরা। আমাকেও ধরে নিয়ে গেল। হিম কনকনে শীতের আস্তানায় আমাকে
সে ছেড়ে দিল। আমি তো কাঁপতে কাঁপতে কানাবক, বসে থাকলাম বিলের ধারে, বিলটা বেড়িবাঁধের
ওপারেই। পুরো শীতকাল আমাকে সেবার কুয়াশার আস্তানায় আটকে থাকতে হলো। কুয়াশাকে মনে হলো
নারী। নারীই হচ্ছে গুয়ানতানামো বে। নারী আমাকে বন্দি করে রাখল বিনা বিচারে, পৃথিবীর
কেউ জানল নাÑ আমি ‘কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ বন্দিশালায়! তবে এসব কিছুর জন্য হেমন্তই দায়ী
নয়?
ঋতুভিত্তিক ছয়টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের শুটিং করেছিলাম। গ্রীষ্মের
চিত্র ছিল ‘তরমুজ’, বর্ষার ‘শালিক দিবস’, শরতের ‘দ্য গ্রেট অস্কার’, হেমন্তের ‘শুধু
শুধু’, শীতের ‘ওয়ানস আপন আ টাইম’ এবং বসন্তের ‘বসন্ত চিত্রনাট্যহীন’। তো সেবার হেমন্তের
কাজটা করার জন্য শুটিংয়ে গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। রূপগঞ্জের এক পাকা ধানের
মাঠই ছিল সে চিত্রের কেন্দ্রীয় লোকেশন। কয়েকটি চরিত্র এসে জড়ো হয় একটি মাঠের মধ্যে।
তার মধ্যে একজন মাস্টার ফাঁকা একটা মাঠের মধ্যে মাটিতে পুঁতে রাখা একটি বাঁশের সঙ্গে
ঝুলিয়ে দেয় একটি কালো ব্ল্যাকবোর্ড। সামনে কোনো ছাত্রছাত্রী নেই, তবু মাস্টার চরিত্রের
যুগল রায় ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন
‘ইতিহাস’। ‘আজ আমি পড়াব ইতিহাস। হেমন্তের ইতিহাস। মানে মাঠের ইতিহাস। ধানের ইতিহাস।
ধানের ভেতরে লুকিয়ে আছে কৃষকের ইতিহাস, কিষানির ইতিহাস। ওই যে দূরে, ধানিমাঠের ওপারে
দেখা যায় সারি সারি তালগাছ, আমি পড়াব তোমাদের আজ তালগাছের ইতিহাস। মাঠের মধ্যে কীভাবে
তালগাছ একা দাঁড়িয়ে থাকে, সেই ইতিহাস আর এ মাঠের ইতিহাসই আজ তোমাদের পড়াব। ছাত্রছাত্রীরা
(সামনে যদিও ফাঁকা, কেউ নেই শুধু পাকা ধানের মাঠ ছাড়া) তোমরা হোমটাস্ক করে এসেছে তো?
সেই ইতিহাসের শিক্ষক যুগল রায় শুটিংয়ের কিছুদিন পরই হঠাৎ মারা গেলেন।
যুগল রায় একা ছিলেন। বৈরাগ্য ছিল তার, যত দূর জানা যায়। হেমন্ত কি কিছুটা বৈরাগ্য দানকারীও
নয়, এই বাংলায়?
অনেক কথাই মনে আসে, অনেক কথাই মনে আসে না। হেমন্তের সব স্মৃতি আমরা
ধরেও রাখতে পারিনি। শুধু কি কুয়াশা, সকালবেলায় ঘাসের ওপর জমে থাকা কিছু শিশির বা পাকা
ধানের মাঠ ছাড়া যেন আর কিছু মনে নেই আমাদের। কিন্তু আছে। হেমন্ত থরে থরে সাজানো আছে
হেমন্ত মিউজিয়ামে। হেমন্ত মিউজিয়াম কোথায়? কিউরেটর কে মিউজিয়ামের?
এ লেখার শুরুতেই আমি উল্লেখ করেছি হেমন্ত মিউজিয়ামের কিউরেটরের নাম,
ডেপুটি কিউরেটরের নাম। দুজনই কবি। তাহলে কবি ছাড়া হেমন্তের দায়ভার আর কারও নেই? সে
কথাও বিশ্বাস করে নিতে হবে?
হায় রে...