× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ম্যাক্সিম গোর্কি

সংশপ্তক সৃজনশীল এক সাহিত্যিক

মজিবুল হক মনির

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৩ ১২:১৬ পিএম

আপডেট : ০৪ মে ২০২৩ ১২:৩১ পিএম

সংশপ্তক সৃজনশীল এক সাহিত্যিক

সংকটের সঙ্গে সৃজনশীলতার সম্পর্কটা কি সব সময়ই শক্তিশালী? প্রায়ই বলা হয় যে, সংকট সৃজনশীলতার জন্ম দেয়। অন্তত সাহিত্যশৈলীর ইতিহাস তো দেখায় যেÑ সংকট প্রথিতযশা সাহিত্যিক তৈরি করে! মার্কিন মূলকের ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার এবং সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বা আমাদের নজরুলসহ অনেক লেখকই সংকটে সিক্ত হয়ে সৃজনশীলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং সংকটগুলোকে অনেক কবি-লেখক-সাহিত্যিক অনুপ্রেরণার শক্তিশালী উৎস হিসেবে নিয়ে সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ সব মর্মস্পর্শী ও কালোত্তীর্ণ রচনাসম্ভার।

এই যেমন ম্যাক্সিম গোর্কি। বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নাম, কী ঈর্ষণীয় তার সাহিত্যিক সাফল্য! ব্যক্তিগত জীবন তার সম্ভবত ততটাই সংকট আর সমস্যায় পরিপূর্ণ। একেবারে শিশুকাল থেকে শুরু করে, মৃত্যু পর্যন্তÑ সংকট ছেড়ে যেতে চায়নি কখনই এই রাশিয়ানকে! ১৮৬৮ সালে জন্ম নেওয়া আলেক্সি ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ পরবর্তীকালে ম্যাক্সিম গোর্কি নাম নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন রাশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, ব্যক্তিগত সংগ্রাম তার সাহিত্যিক জীবনকে প্রভাবিত করে ব্যাপকভাবে। বিশ্বব্যাপী পরিচিত খোদ ম্যাক্সিম গোর্কি নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভীষণ যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার কথা।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান। একপর্যায়ে মা বিয়ে করে অন্যত্র সংসার পাতেন (কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে মা মারা গিয়েছিলেন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে)। অনন্যোপায় ম্যাক্সিম নানা-নানির কাছে চলে আসেন বসবাসের জন্য। নানির কাছে কিছুটা স্নেহ-ভালোবাসা পেলেও নানার কাছ থেকে বরাদ্দ ছিল অনাদর-অযত্ন-অবহেলা। ফলে মাত্র আট বছর বয়সেই জীবিকার জন্য পথে নামতে হয় ম্যাক্সিমকে। জুতার দোকানে সহকারী, একজন রঙশিল্পীর ফুট-ফরমায়েশ খাটা থেকে শুরু করে জাহাজে বাসন-কুশন ধোয়া-মোছার কাজ করতে হয়েছে তাকে। এসব কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই শিকার হয়েছেন নিপীড়নের, প্রায় সময়ই থাকতে হয়েছে ক্ষুধার্ত এবং গায়ে দিতে হয়েছে নোংরা-পুরনো জামাকাপড়। নিগৃহীত এই জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন তিনি। শৈশব জীবনের সেই সব তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি পরবর্তীতে নিজের নামের সাথে যোগ করেন গোর্কিÑ অর্থাৎ তেতো! অনেকে মনে করেন, প্রথম দিকে স্বনামে লিখলেও সেই সময়ের রাশিয়ার কঠিন বাস্তবতার আলোকে, তার সোজা-সাফটা আর রীতিবিরুদ্ধ কথাগুলো অনেকের কাছে তিক্ত সত্য কথা হিসেবে বিবেচিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। সেই সময়ের রাশিয়ার তিক্ত বাস্তবতা আর নিজের চাঁচাছোলা রচনার কথা বিবেচনা করেই তিনি নিজের নামের সঙ্গে গোর্কি বা তেতো শব্দটি জুড়ে দেন।

প্রথমে নিজ দেশে, পরে ফিনল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক খ্যাতি পেয়ে গেলেও, লেখক হিসেবে শুরুটাও ম্যাক্সিম গোর্কির জন্য কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। লেখক হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে শুরুর দিকে বেশ কাঠখড়ই পোড়াতে হয়েছে তাকে। প্রথম দিকে তার রচিত কয়েকটি ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও, সেগুলো সংশ্লিষ্ট মহলের তেমন একটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। ১৮৯২ সালে প্রথম মাকার চুদ্রা নামের ছোটগল্প দিয়ে শুরু করে ম্যাক্সিম গোর্কিকে পরিচিতি পেতে অপেক্ষা করতে হয় ১৮৯৫ পর্যন্ত। ওই বছর প্রকাশিত ছোটগল্প চিউকাশ (চেলকাশ)-কে বিবেচনা করা হয় ম্যাক্সিম গোর্কির খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সূত্রপাত হিসেবে। অবশেষে প্রায় সাত বছর লেখালেখি করার পর ম্যাক্সিম গোর্কিকে প্রথম ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয় ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত তার ছোটগল্প দভাটসেট শেইসট ইয়াদনা (টুয়েনটি সিক্স মেন অ্যান্ড অ্যা গার্ল)। তার খ্যাতি তখন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, অনেকে তখন তাকে টলস্টয় বা চেখভের সমপর্যায়ের গণ্য করা শুরু করেন।

গোর্কির ব্যক্তিগত জীবনে বিয়োগান্তক ঘটনাগুলো কিন্তু থেমে থাকেনি। তার প্রথম স্ত্রী একাতেরিনা পাভলোভনাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। নানা কারণে তাদের মধ্যে টানাপড়েন লেগে ছিল, এর পরও তারা একসঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু ১৯২১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ম্যাক্সিম গোর্কির ব্যক্তিগত জীবনের সম্ভবত সবচাইতে বড় দুঃখজনক অধ্যায় হলো তার নিজের দুই সন্তানকেই অকালে হারিয়ে ফেলা। গোর্কির মেয়ে কাটিয়া (একাতেরিনা ম্যাক্সিমোভনা) যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯২১ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মারা যান। অন্যদিকে ১৯৩৪ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মারা যায় তার ছেলে ম্যাক্সিম পেশকভ। অনেকে মনে করেন ছেলে ম্যাক্সিমকে আসলে হত্যা করা হয় স্তালিনের নির্দেশে।

সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনীতিকও। তিনি বলশেভিকদের একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন এবং প্রায়ই তিনি জার সরকারের বিরোধিতা করেছেন। তিনি গোপন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে জার সরকারবিরোধী নানা বই-পুস্তক প্রকাশ করতে থাকেন। এ কারণে ১৯০৫ সালে তাকে তার রাজনৈতিক মতামতের জন্য গ্রেপ্তার এবং কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু ব্যাপক জনরোষের পর তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জার সরকার।

অবশ্য এই গ্রেপ্তার এবং কারাবরণ ম্যাক্সিম গোর্কির জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। তিনি আরও বেশি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। গোর্কির দুর্দান্ত সাহিত্যিক সৃষ্টিগুলোও প্রায় একই সময়ে আসতে থাকে। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় তার বহুল স্বীকৃত ও জনপ্রিয় উপন্যাস মা (মাত)। এই উপন্যাসটিকে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও এবং বলশেভিকদের সমর্থক হলেও ম্যাক্সিম গোর্কি ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা লেনিনের শাসনের বিরোধিতা করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের অন্য আরেকটি ঝড়-ঝঞ্ঝাময় সময় তাই শুরু হয় বলশেভিক বিপ্লবের প্রায় শুরু থেকেই। তিনি কঠোর ভাষায় বলশেভিকদের, বিশেষ করে লেনিনের সমালোচনা করতে থাকেন। তার পত্রিকা নোভায়া জিজন (নিউ লাইফে) ছিল লেনিন সরকারের কট্টর সমালোচক। একটি রচনায় ম্যাক্সিম গোর্কি লেনিনকে ঠান্ডা-রক্তের কৌশলী এমন একজন শাসক হিসেবে উল্লেখ করেন, যিনি প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণির সম্মান বা জীবন রক্ষা করেন না। এ ধরনের লেখা প্রকাশের পর ১৯২১ সালের দিকে ম্যাক্সিম গোর্কিকে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা নেওয়ার নামে রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য করা হয়। প্রায় ১০ বছর, ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ম্যাক্সিম গোর্কি রাশিয়ার বাইরে থাকতে বাধ্য হন। এর আগেও ১৯০৬ সালে তাকে দেশ ছাড়তে হয়।

নির্বাসনে থাকলেও গোর্কি তার সাহিত্যিক-রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিত্যাগ করেননি। নির্বাসনে থাকার সময়ই তিনি প্রকাশ করেন তার আত্মজীবনী ত্রয়ীর শেষ অংশ মাইয়ে ইউনিভার্সিটি (মাই ইউনিভর্সিটি, ১৯২৩)। এর আগে তিনি এর দুটি পর্ব প্রকাশ করে ফেলেছিলেন (দেসটাভু বা মাই চাইলহুড, ১৯১৩-১৪ এবং ভি উইদ্যাহ বা ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড, ১৯১৬)। নির্বাসনে থাকাকালেই তিনি লেখা শুরু করেন চার পর্বে সমাপ্ত তার বিখ্যাত উপন্যাস জিজন ক্লিমা সামগিনা ( দ্যা লাইফ অব ক্লিম স্যামগিন), এটি শেষ হয় ১৯৩৬ সালে।

স্তালিনের আমন্ত্রণে ১৯৩২ সালে ম্যাক্সিম গোর্কি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। সে সময় গোর্কিকে খুব ধুমধাম করে স্বাগত জানানো হয়, তাকে অভিহিত করা হয় সোভিয়েত বিপ্লবের একজন নায়ক হিসেবে। গোর্কিকে দেওয়া হয় সোভিয়েত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা অর্ডার অব লেনিন। রাশিয়ায় ফিরে তিনি ব্যাপকভাবে লিখতে এবং তা প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু গোর্কির জীবন খুব বেশিদিন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানো সম্ভব হয়নি। অচিরেই স্তালিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। সেটা হওয়াও ছিল স্বাভাবিক। রাশিয়াজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ভিন্নমতাবলম্বী লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সরকারের আচরণের সমালোচনা না করে পারেননি আজীবন স্পষ্টভাষী গোর্ক বা তেতো এই লেখক!

স্তালিনের সঙ্গে গোর্কির সম্পর্কের অবনতি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ১৯৩৪ সালে। সে বছর আয়োজিত সোভিয়েত লেখক ইউনিয়নের প্রথম কংগ্রেসে গোর্কিকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে অসম্মতি জানান। সে বছরের মে মাসে তার ছেলে ম্যাক্সিম পেশকভ মারা যান। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক সভা শেষে ফেরার কয়েকদিন পরই তার মৃত্যু হয়। ফলে অনেকে মনে করেন ম্যাক্সিম গোর্কিকে ভয় দেখানোর জন্য স্তালিনের নির্দেশেই তার সন্তানকে হত্যা করা হয়। পরে স্তালিনের সঙ্গে গোর্কির সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে যায় ১৯৩৫ সালে। গোর্কি তখন স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক লেখক কংগ্রেস অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। গোর্কি সে সময় সত্যিকার অর্থেই অসুস্থ থাকলেও, কংগ্রেসে তার অনুপস্থিতি স্তালিন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। কারণ রাশিয়া ছিল সেই কংগ্রেসের আয়োজক। ক্ষুব্ধ স্তালিন সরকার গোর্কিকে তার বাসস্থানে এক রকম নজরবন্দিই করে রাখে এবং বিদেশি লেখকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিষিদ্ধ। 

১৯৩৬ সালের ১৮ জুন পরলোকগমন করেন ম্যাক্সিম গোর্কি। আনুষ্ঠানিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়াকেই তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, অনেকে মনে করেন তাকে বিষ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।

শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক কণ্টকাকীর্ণ জীবনযাপন করেছেন ম্যাক্সিম গোর্কি। তার পুরো জীবনটাই ছিল একটা সংগ্রাম। কিন্তু তিনি কখনই তাতে পরাজিত হননি, হার মানেননি। তার রচনাগুলো তার সেই সব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বাসের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তার আবেগকে প্রতিফলিত করে। প্রথম প্রকাশনা থেকে শুরু করে কালোত্তীর্ণ রচনা পর্যন্ত গোর্কির লেখা আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত ও বিমোহিত করে চলেছে। গোর্কির জীবন আর রচনা সংকটেও সৃজনশীল হতে আর সংগ্রামী হয়ে উঠতে শেখায়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা