× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিশ্বাস্য রহস্য

আরিফ মজুমদার

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৩ ১২:১০ পিএম

বিশ্বাস্য রহস্য

পিচ-ইট-খোয়া ওঠা এবড়োখেবড়ো আর অপ্রশস্ত রাস্তার পাশে মকবুলের বাড়ি। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। ট্রাক থেকে ইট-বালু-সিমেন্ট নামাচ্ছে শ্রমিকরা। ঘরের কাম ধরছ নাকি মকবুল? সকালে হাটে যাওয়ার পথে একটু দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন ইউপি সদস্য হারিস মেম্বার। সামান্য উচ্ছ্বাস নিয়ে মকবুল জবাব দেয়, হগো চাচা হ, দোয়া কইরেন।

-আইচ্ছা ভাতিজা, দোয়া রইল, পাকা ঘর করো...। হারিস মেম্বার কথা শেষ করে হাটের দিকে চলে যান। মকবুলের টিনশেড ঘরের বয়স কম হয়নি। তার বাপ বেঁচে থাকতে বানানো ঘর। গ্রামে এখন অনেকে পাকা ঘর করছে; কেউ কেউ দ্বি-তলা ঘরও বানাচ্ছে। পাশের বাড়ির কাতারপ্রবাসী দুলালেরও একখানা দ্বি-তলা ঘর হয়েছে; একসময় যে দুলাল হাঁস-মুরগির ডিম কিনত পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে। দুলালের দেখাদেখিতে এবার মকবুলও তার পুরোনো টিনশেড ঘরের সামনের ফাঁকা জায়গায় একটি পাকা ঘর নির্মাণ শুরু করে। গ্রামের প্রবীণ রাজমিস্ত্রি লোকমান ঢালীর পরামর্শে আরসিসি পিলার দিয়েই নির্মাণ হচ্ছে তার ঘর। পনেরো দিনে ঘরের কাজ বেশ এগিয়েছেও। নির্মীয়মাণ ঘরসংলগ্ন স্থানে একটি টয়লেটের হাউস তৈরির জন্য খননকাজ শুরু হয় এদিন; সকাল থেকেই খননকাজে লেগেছে তিনজন শ্রমিক। লোকমান ঢালী সকালে শ্রমিকদের খননকাজ বুঝিয়ে দিয়ে অন্য কোনো বাড়ির কাজে গেছে। গ্রামের কয়েকটি বাড়ির কাজই চলছে লোকমান ঢালীর তদারকিতে। শ্রমিকদের দুপুরে খাইয়ে বাড়ির অদূরে হাটে রঙের দোকানে যায় মকবুল। বিকেলবেলা। হাউস খননের প্রায় শেষ পর্যায়ে, সেখানে মাঝারি আকৃতির একটি পুরোনো পিতলের কলসির সন্ধান পায় শ্রমিকরা। কয়েকটি ইট দিয়ে ঘিরে রাখা কলসির মুখটি বন্ধ। কলসটি নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়েছে শ্রমিকরা। নেড়েচেড়ে দেখছে তারা। ভেতরে ভারী কিছু আছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে! কলসির মুখ খুলবে কি না ভাবছে শ্রমিকরা। মকবুলের স্ত্রী শেপালী মোবাইল ফোনে স্বামীকে জানায় বিষয়টি। মকবুল উৎফুল্ল মনে তড়িঘড়ি করে রঙের দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে আসে। শ্রমিকদের সামনে থেকে কলসিটি সরিয়ে টিনশেড ঘরের ভেতর লুকিয়ে রাখে সে। শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে বিদায় করে দেয় মকবুল। কলসিটির ভেতরে কী আছে সেটা দেখার ইচ্ছে নিয়েই চলে যেতে বাধ্য হয় তারা!

দিনশেষে সন্ধ্যা নামে। রাতও হয় অনেক। স্ত্রীকে নিয়ে খাবার সেরে ঘুমাতে যায় মকবুল। কলসিটির ভেতর কী আছে, সেটি জানার খুব ইচ্ছে নিয়েও ভয় আর অদ্ভুত চিন্তায় কলসিটির মুখ খুলছে না মকবুল। তেমন কারণ ছাড়াই অন্তত আরও একটি দিন সময় নিতে চায় সে। রাতেও কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা কলসিটি উঁকি দিয়ে দেখে নেয় সে। কেমন একটা অজানা আতঙ্গে কলসিটির মুখ খোলার সাহসটুকু পায় না মকবুল। অব্যক্ত আনন্দ বা ভয় নিয়েই রাতের এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। তারপর..., গভীর রাতে স্ত্রীকে ঘুমে রেখে বিছানা থেকে নেমে আসে মকবুল। কলসিটি বের করে নেয় সে। একটা দা দিয়ে কলসিটির মুখে হালকা আঘাত করে মকবুল; খুলে যায় কলসিটির মুখ! সে দেখতে পায় কলসির ভেতর কেমন একটা সোনালি রঙের প্রদীপ! সোনার জাদুপ্রদীপ নাকি! ভাবছে মকবুল। প্রদীপটা বের করে হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে সে। বহুদিনের পুরোনো প্রদীপ মনে হচ্ছে; গায়ে কেমন ময়লাও পড়েছে! দেখলেই বোঝা যায় এটা অনেক বছরের পুরোনো, যা ব্যবহার হয়নি বহু বছর। হঠাৎ তার মাথায় আসে, আচ্ছা! কেমন হতো? যদি সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে থাকে এটা! তাহলে তো...! এটাতে হাত ঘষলেই কেউ একজন সামনে এসে যদি বলত, কী চাও! এসব অলীক ভাবনায় কেমন আনন্দ অনুভব করে মকবুল। প্রদীপটা আবারও একটু নাড়াচাড়া করে দেখে সে। তারপর কৌতূহল নিয়ে প্রদীপটা এক হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে অন্য হাতটা দিয়ে একটা ঘষা দেয় সে। না! তেমন কিছুই তো হলো না! আরেকটু ভাবে সে। তবু আশা ছাড়ে না মকবুল। তারপর আরেকবার ঘষা দেয়, ফের ঘষা দেয়...। কী আশ্চর্য! পাঁচবার ঘষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কে যেন আস্তে করে শব্দ করছে! মকবুল একটু চমকে উঠে বলল, কে-রে? কিন্তু কোনো জবাব পায় না সে। হয়তো তার মনের ভুল- ভাবছে মকবুল। কিন্তু ফের দরজায় শব্দ করছে কে! মকবুল হাতের প্রদীপটা রেখে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে তো অবাক! সাদা সালোয়ার-কামিজ পরা এক অচেনা নারী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে! তার মুখে কেমন চমৎকার হাসি! এমন সুন্দরী নারী তো জীবনেও দেখেনি সে! কেমন উন্নত আর সুষম তার বুকের জমিন! দীঘল কালো চুলগুলো একটু এলোমেলো আর যেন হরিণীর মতো উজ্জ্বল লাগছে তার দুই চোখ! চাহনিতেও কেমন মায়া ঝরছে! কেমন অদ্ভুত ভয়ে মকবুলের পুরো শরীর ভীষণ কাঁপছে; খুব অস্থির লাগছে তার। কিন্তু অচেনা নারীটার মায়াভরা চাহনিতে আস্তে-ধীরে একটু সাহসও হচ্ছে মকবুলের। অচেনা ওই নারী মকবুলকে হতবাক দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল, জনাব, আমাকে বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি আমি? আমার নিকট আপনার কী চাওয়ার আছে? আপনি এখন যা কিছু চাইবেন, হয়তো অনেক কিছুই আমার কাছ থেকে পাবেন। তবে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে আমারও, ধরুন...। মকবুল সংকোচবোধ নিয়ে একটু শুদ্ধভাবে বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু তুমি-বা কে? তোমার নাম-পরিচয়?

- আমি প্রদীপকুমারী।

- প্রদীপকুমারী!

প্রদীপকুমারী হালকা মাথা নেড়ে বলল- জি, আপনি ওই প্রদীপটা পাঁচ বার ঘষেছিলেন? মকবুল তখন চমকে গিয়ে মাথা নেড়ে বলল, হো-হো! ঘষছিলাম তো! প্রদীপকুমারী বলল, জনাব, তাই তো আমাকে আসতে হয়েছে এখানে! এবার বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি আমি? মকবুল কী বলবে ঠিক ভেবে পায় না! যদিও বিষয়টি তেমন বিশ্বাসও করতে পারছে না সে। তবু আমতা আমতা করে একটু ভদ্রতা প্রকাশ করল, আগে তুমি ঘরে আহো, চেয়ারে বও। তুমি তো বাইরে দাঁড়ায়ে...।

- না, জনাব। এটা আমার নিয়মে নেই। আপনার জন্য কী করতে পারি জলদি বলুন? মকবুল আগ্রহ নিয়ে বলল, অহন আমি যা চাইব, সবই দিতে পারবা তুমি? অল্প মাথা নেড়ে প্রদীপকুমারী বলল, তা তো নিশ্চয়ই! আমি যেকোনো বস্তুগত জিনিসই আপনার সামনে হাজির করতে পারি! তবে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে আমারও, বলেছি তো...! প্রদীপকুমারীর সীমাবদ্ধতা প্রকাশে কেমন একটু লজ্জা পায় মকবুল। লাজুক গলায় সে বলে, ঠিক আছে, বুঝতে পারতাছি। তবে তোমায় খুব সুন্দর লাগতাছে..., ঠিক যেন হুর-পরি! প্রদীপকুমারী বলল, ধন্যবাদ, জনাব! আর দেরি করবেন না, প্লিজ। এবার বলুন আমি কী করতে পারি? এমন এক সুন্দরী অচেনা নারীর কাছে হঠাৎ কিছু চাইতে কেমন যেন লজ্জা করছিল মকবুলের। তবু বারবার যেহেতু বলছে কিছু একটা তো চাইতেই হয়! একবার পরীক্ষা করেও দেখা যাক সত্যি সত্যি কিছু পাওয়া যায় কি না! তবু ইচ্ছেটা একটু চেপে রেখে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে সে বলল, আমার নাম হইল মকবুল! আমার বউ শেপালী..., থেমে যায় সে। আর কিছু বলতে পারে না মকবুল। প্রদীপকুমারী বলল, সংকোচ বোধ করবেন না, জনাব। বলুন, আমি আপনার কী প্রয়োজন মিটাতে পারি? আবারও মকবুল কথা পেঁচালো একটু, আমি তোমারে কী নামে ডাকব যেন? প্রদীপকুমারী হেসে বলল, আমার নাম ধরেই মানে প্রদীপকুমারী নামেই আমাকে ডাকবেন। মকবুল সামান্য ভেবে-চিন্তে বলল, আমার বাড়ির কাজ চলতাছে। অহন কিছু নগদ টেকা দরকার। প্রদীপকুমারী বলল, শুধু নগদ টাকা পেলেই চলবে!

মকবুল অধীর গলায় বলল, হ!

- কত টাকা লাগবে এখন, জনাব?

- এই দশ-বিশ লাখ টেকা!

- ঠিক আছে, জনাব। আপনি একটু চোখ বন্ধ করুন।

মকবুল ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে।

- এবার চোখ খুলুন।

কী আজব! মকবুল চোখ খুলে দেখে তার সামনে পড়ে আছে এক বস্তা টাকা! প্রদীপকুমারী বলল, জনাব, বলুন আর কিছু লাগবে? মকবুল বলল, একটা রঙিন টেলিভিশন! আমার বিউ শেপালী একটা টেলিভিশন কিনতে কতবার যে আমারে কইছে! আর...আর একটা মাঝারি সাইজের ফ্রিজ, একটু মর্ডান হইলে খুব ভালো হয়!

- ঠিক আছে জনাব, আপনি যেমনটি চাইবেন! আবার চোখ বন্ধ করুন। মকবুল ফের ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে।

- এবার চোখ খুলুন। মকবুল কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে দেখে টেলিভিশন আর ফ্রিজ তার সামনে! প্রদীপকুমারী ফের বলল, আর কিছু লাগবে জনাব? মকবুল এত কিছু পেয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে দেখছে- কেমন বিনীতভাবে পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে প্রদীপকুমারী! কিন্তু এখন আর কী চাইবে মকবুল। মোটরসাইকেল নাকি গাড়ি? কোনটা চাইবে সে। মোটরসাইকেলের কথাটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় মকবুলের। ঘুম থেকে উঠেই, প্রদীপকুমারী! ওহ, প্রদীপকুমারী, কই-গো..., চিৎকার করতে করতে দরজাটা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মকবুল। ভোররাতে মকবুলের এমন চিৎকারে ঘুম থেকে চমকে উঠে শেপালী। কিছুই বুঝতে না পেরে স্বামীর পিছু নেয় সে। মকবুলের কাছে গিয়ে জানতে চায়, কী হইছে গো? ঘরে কি কামাল চোরা ঢুকছে? মকবুল একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। ভয়ভয় গলায় শেপালীকে বলে, খোয়াব দেখছি-রে বউ! খুব খারাপ খোয়াব দেখছি! ঘরে ফিরে খাটের নিচে পিতলের কলসির দিকে নজর দেয় মকবুল। মসজিদে আজান হচ্ছে তখন। ভোরও হয়ে আসছে দ্রুত।

পরদিন সকালে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধারের খবরে মকবুলের বাড়িতে পুলিশ নিয়ে আসেন হারিস মেম্বার। (জনশ্রুতি আছে, কোনো এককালে অখ্যাত এক হিন্দু জমিদার বাড়ি ছিল এখানে) অগত্যা, নিজ বাড়িতে পাওয়া মুখবন্ধ পিতলের কলসিটি পুলিশের হাতে তুলে দেয় মকবুল। কলসিটির ভেতর সত্যি সত্যি সোনার জাদুপ্রদীপ আছে কী নেই, সেটা জানতে পারেনি মকবুল। অধিকন্তু শেষ রাতের স্বপ্নটার মধ্যে খুব বিশ্বাস্য কিছু একটা রহস্য আছে বলেই তার অনুভূত হচ্ছে। কেমন অব্যক্ত কষ্ট ভার করে তার মনে; দুই চোখ জলে ভরে যায় মকবুলের।  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা