আবদুস শাকুর শাহ
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫৪ পিএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫৪ পিএম
আমাদের শৈশবে
ছিল প্রধান আনন্দের বিষয় ঈদ। রোজা শুরু হওয়ার পর থেকেই সবাই ঈদের কথা ভাবতে শুরু করত।
ঈদের দিন সকালে খেতাম বগুড়ায় তৈরি বিখ্যাত লাচ্ছা সেমাই। নরমাল চিকন সেমাইও বগুড়ায়
তৈরি হতো। অনেক সময় বাড়িতেও সেমাই তৈরি করত। সে সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে বেরিয়ে পড়তাম।
সকালে জামা পরে তৈরি হয়ে গ্রামের আশপাশের সবাই মিলে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। অনেক সময়
দূরের ঈদগাহ ময়দানে নামাজ পড়তে যেতাম বাবার সঙ্গে। মাইলখানিক দূরে হেঁটে হেঁটে যেতাম
ঈদগাহে। সেখানে সবাই পরিচিত, সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। অনেক আনন্দ হতো। ঈদের দিনটা
কাটাতাম ডাংগুলি অথবা মার্বেল খেলে। আগে ছিল পাথরের মার্বেল। পরে এলো কাচের মার্বেল।
একটু বড় হওয়ার পর ঈদের দিনটা শুধুই গল্পগুজব করে কাটিয়েছি।
দুপুরে খেতাম
সাদা পোলাও আর মুরগি, খাসি বা গরুর মাংসের কোরমা। এখন আর সেই কোরমা প্রচলিত নাই। মুরগির
মাংস মিষ্টি টাইপের করে কোরমা বানাত। অনেক সময় খাসির মাংস দিয়ে বানাত। তার সঙ্গে আচার
বা সালাদ। মাদুর বিছিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতাম। মা সবাইকে খাবার বেড়ে
দিতেন। তখন গ্রামে চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়ার প্রচলন হয়নি। দু-একজন জমিদার বা ধনী লোকের
বাড়িতে খাবার টেবিল ছিল। ঈদে মহিলাদের আয়োজনটা কিন্তু এখনকার মতো ছিল না। তারা ব্যস্ত
হয়ে পড়ত ঈদের আগের দিন। পরের দিনের রান্নাবান্না ঠিকভাবে করতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে
ব্যস্ত থাকত।
তখন ঈদের পোশাক
ছিল শার্ট আর পাজামা। কলকাতায় এক ধরনের পকেটওয়ালা শার্ট পাওয়া যেত। পরে এলো পাজামা-পাঞ্জাবি।
মেয়েদের জন্য ছিল জামা। সেগুলো গ্রামের দর্জিদের দিয়ে তৈরি করা হতো। এখনকার মতো আমাদের
শৈশবের ঈদে অনেক খরচ হতো না। সহজের মধ্যে যা হতো সেটা দিয়েই সবাই আনন্দে ঈদ করত। শহরে
দেখছি ছোটরা ঈদের জামা কিনে ঈদের আগে দেখাতে চায় না। ঈদের দিন সবাইকে দেখায়। আমাদের
শৈশবে এমন কোনো ব্যাপার ছিল না। তখন কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা নতুন জামা পাওয়াই
কঠিন ছিল। ঈদের দিন আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে যেতাম। মামাবাড়িতে যেতাম। ফুপুদের বাড়ি যেতাম।
সেটা ছিল এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম। বেশিরভাগই হেঁটে হেঁটে যেতাম। হেঁটে হেঁটে যাওয়াটাই
ছিল আনন্দের।
আমাদের শৈশবে
ঈদে আতশবাজি হতে দেখেনি। পটকা ফোটানোর প্রচলনও দেখিনি। ঈদের মেলা হতো। দু-এক জায়গায়
মেলা বসতে দেখেছি। আতসবাজি হতো স্বাধীনতা দিবসে। তখন আনন্দ ছিল চাঁদ দেখার। ঈদের আগের
দিন সন্ধ্যায় সবাই একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়াত। সেটা হতো প্রতি এলাকাতেই। আমাদের বাড়ির
সামনে একটা উঁচু জায়গায় আমাদের এলাকার অনেকে এসেই ভিড় জমাত। কে আগে চাঁদ দেখতে পায়,
সেটা ছিল একটা প্রতিযোগিতা। বেশির ভাগ সময়ই ইয়াং যারা, তারাই আগে চাঁদ দেখত। কারণ তাদের
চোখ ভালো, তাই। শৈশবে ঈদে সিনেমায় যাওয়া হয়নি। তখনকার স্বাধীনতা দিবসে ফ্রি সিনেমা
দেখাত হলগুলো। সেই দিন রেলভ্রমণ ফ্রি থাকত। সবাই মিলে এক ড্রিস্টিক্ট থেকে আরেক ডিস্ট্রিক্টে
চলে যেতাম। এটা তখন একটা আনন্দ ছিল। আমি স্বাধীনতা দিবসে বিনে পয়সায় ট্রেনে ঘুরেছি।
একবার বগুড়া থেকে চলে গিয়েছিলাম পাকশী। সেখানে একটা সুগারমিল ছিল। সেখান থেকে ঘুরে
এসেছি জয়পুরহাট, নাটোর হয়ে আবার বাড়ি ফিরেছি। তখনকার আনন্দটা এখনকার চেয়ে ভিন্ন ছিল।
এখন যেমন মানুষের পয়সার প্রাচুর্য, তখন ছিল নির্মল আনন্দ। কিছু নাই, তার ভেতরও আনন্দ।
এখন প্রচুর আছে, তার ভেতর আনন্দ। দুইটা দুই ধরনের আনন্দ।
চারুকলায় ভর্তি
হওয়ার পর ঢাকায় চলে এলাম। এখানে ঈদের জামাতে যেতাম, নামাজ পড়ে চলে আসতাম। এখানে তো
কেউ পরিচিত ছিল না। এটা আরেক ঝামেলা। অপরিচিতদের সঙ্গে ঈদের জামাত। দাঁড়ালাম, নামাজ
শেষে চলে এলাম। আমি থাকতাম বড় ভাইয়ের কাছে আজিমপুর কলোনিতে। সেখান থেকে দুপুরের খাবার
খেয়ে রওনা দিতাম লক্ষ্মীবাজারে দিকে। সেখানে আমার এক বন্ধু ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ছোট
ভাই সৈয়দ রাইসুল হক। ওর ওখানে রাত আটটা পর্যন্ত গল্পগুজব করে বাসে করে বাসায় ফিরতাম।
পরিচিত আর কেউ ছিল না। আর্ট কলেজ বন্ধ হলে হোস্টেল বন্ধ হয়ে যেত। তখন সবাই বাড়ি চলে
যেত। বাড়ি গিয়ে ঈদে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে আড্ডা
হতো।
তখন আজিমপুরের
ঈদের মেলা একবার-দুইবার চোখে পড়েছে। অনেক জায়গাজুড়ে মেলা বসত। বেশির ভাগই ছিল খাবারের
জিনিস। আর ছিল খেলনা। বিদেশ সফর করেছি কয়েকবার ঈদের দিনে। বেশিরভাগ সময়েই ঈদের ব্যাপারটা
ফিল করতে পারিনি। কোথায় নামাজ হয়, কোথায় খাবার পাব- সেটা বুঝতেও পারিনি। যাদের আমন্ত্রণে
গিয়েছি তারা ছিল অন্য ধর্মের। ফ্রান্সের এক দ্বীপে গিয়েছিলাম ঈদের দিনে। সেখানে দেখি
একজন টুপি পরে ঈদের নামাজ পরতে যাচ্ছে, সঙ্গে এক মহিলা যাচ্ছে স্কার্ট পরা। সেখানে
আমি ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। যার সঙ্গে গিয়েছি সে নিষেধ করল। কারণ
তখন নাইন-ইলেভেনের পরের সময়টা। সেখানে নাকি কিছু আল কায়েদা সদস্য ছিল। তাদের ধরার জন্য
পুলিশ খুঁজছে। নামাজ পড়তে গিয়ে আবার কী ঝামেলায় পড়ি, এই ভেবে আর যাওয়া হয়নি। ভারতের
বরোদা এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দু-একবার ঈদের জামাতে গিয়েছি। হলে ঈদের দিনে কোনো
ব্যবস্থা ছিল না। হলে শুধু ওদের ধর্মের অনুষ্ঠানগুলো হয়। সেই সময় ভালো খাবার পরিবেশন
করা হতো। আমি নিজে থেকেই চিন্তা করলাম কাছাকাছি কোথায় ঈদের জামাত হয় কি না দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের
একপাশে কিছু ব্যবসায়ী থাকতেন। তারা ছিল মুসলিম। বাড়িগুলোর সামনে একটা খালি জায়গায় তারা
ঈদের নামাজ পড়ে। বিশ/পঁচিশজন নামাজি হবে। আমি তাদের সঙ্গে নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষ হওয়ার
পর দেখি চারদিকে পুলিশ। জিজ্ঞেস করলাম পুলিশ কেন? বলল নামাজের সময় যাতে কোনো হামলা-টামলা
না হয়, সে জন্য গভর্নমেন্ট থেকেই পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিল।
আশির দশক থেকে
আমার সংসার জীবনে ঈদের অনুষ্ঠানের শুরু। নিজের চাইতে পরিবারের ছোটদের জন্য বেশি কেনাকাটা
করা হতো। প্রথম জীবন কষ্টেরই ছিল। যে বেতনকাঠামো ছিল, তাতে কুলিয়ে ওঠা কঠিন ছিল। বেশির
ভাগ সময়ে একটা একটা করে ছেলেমেয়ের জন্য জামা কেনা হতো। ঈদের দিনে ঘরে ভালো খাবারের
আয়োজন করা হতো। পরে যখন গভর্নমেন্ট কলোনিতে এলাম, কলোনির সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ,
একজন আরেকজনের বাড়িতে যাওয়া- এগুলো হতো। হলের দায়িত্বে যখন এলাম, তখন ছাত্রদের জন্য
হলে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। ছাত্ররা আমার বাসায় আসত। কেউ সেমাই, কেউ পোলাও-মাংস খেয়ে
বিদায় নিত।
পরিবারের সবাই
মিলে একবার ঈদে বাড়ি গিয়েছিলাম। সেটা আশির দশকে। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন না। বোনদেরও
বিয়ে হয়ে গেছে। মা ছিলেন ভাইদের পরিবারে। অনেক দিন পর সবার একসঙ্গে দেখা হয়েছে। তখন
এক ধরনের আনন্দ ছিল। এভাবেই সুখ-দুঃখের মধ্যে আমার জীবনে ঈদ কেটে গেছে। ঈদ এলে আনন্দ
নিয়ে আসে ছোটদের জন্য। এখন ঈদের দিনে নাতি-নাতনিরা আসে, আনন্দ করে। ওরা তো তিনটা-চারটা
পর্যন্ত জামা কেনে। এখন ঈদ ওদেরই। ওরা যা করে সেটার সঙ্গে আমি এটেন্ড করি। খাবার মেনু
ওরাই ঠিক করে। এখন ওদের আনন্দ দেখেই আনন্দ পাই।