রফিকুর রশীদ
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪১ পিএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০৩ পিএম
আমাদের গ্রামে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।
অতি সাধারণ গ্রাম। পাশেই একফালি নদী। নাম তার
কাজলা। ওই নামটুকুই আছে। প্রকৃতপক্ষে নদীচরিত্র খুইয়ে বসেছে সেই কবে! গ্রাম্য বৃদ্ধার
বুকের ওপর আলগোছে পড়ে থাকা শতছিন্ন শাড়ির আঁচলের মতো যেন-বা। ওইটুকু আঁচল থাকলেই বা
কী, আর না থাকলেই বা কী! আমাদের কাজলার হয়েছে সেই দশা। বুকে নেই পানির হদিস, তরঙ্গ
উচ্ছ্বাস সে পাবে কোথায়? তা সেই কাজলাপারের গ্রামের মানুষের যে সামাজিক জীবন, অম্লমধুর
সেই জীবনও কাজলার মতোই নিস্তরঙ্গ। এখানে নিত্যনতুন এমন কোনো ঘটনার ঘনঘটা ঘটে না বললেই
চলে, যে ঘটনার তরঙ্গাভিঘাত আরো বহুদিন বহু বছর এই সমাজের বুকে প্রবহমান থাকে, বেগবান
থাকে। ফলে সহসা একদিন শ্রাবণের বৃষ্টিধোয়া এক প্রভাতবেলায় কাজলাপারে পাটক্ষেতের আলে
মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া বিবস্ত্র যুবতীর ক্ষতবিক্ষত শরীর আবিষ্কৃত হলে আমাদের নিস্তরঙ্গ
গ্রামটি হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে, ছেলে-বুড়ো সবাই যেন হাতের তেলোয় চোখ রগড়ে ঘুম তাড়িয়ে
বুঝতে চেষ্টা করে, এটা কী হলো? কে এই মেয়েটি? এখানে তার এই পরিণতি হলো কীভাবে?
সূর্যের বৃত্ত থেকে কুসুম ফেটে বেরোতে না বেরোতে
এ খবর অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। কিন্তু আমাদের এই সামান্য গ্রাম আর কতটুকু বড়,
কতই বা লোকসংখ্যা! কাজলাপারের অস্বাভাবিক ও অসামান্য সংবাদটিকে যথাযথভাবে ধারণ করার
জন্য যে মোটেই যথেষ্ট নয়, সে কথা বোঝা গেল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের গ্রামের
চারদিকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৌতূহলী জনতা আসতেই থাকে কাতারে কাতারে। তাদের চোখে-মুখে
সে কী উত্তেজনা! মানুষের ভিড়ের মধ্যে কনুইবাজি করে এবং গায়ের জোরে ঠেলাঠেলি করে সামনে
এগিয়ে যাওয়ার সে কী তীব্র প্রতিযোগিতা! কেউ পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়। নগ্ন নারীদেহ বলে
কথা। তার আকর্ষণই আলাদা। যারা দেখেছে, তারা তো খোলামেলাই জানাচ্ছে-কাপড়চোপড় দূরে থাক,
সারা দেহে তার এক টুকরা সুতা পর্যন্ত নেই।
নানা বয়সের কৌতূহলী মানুষের বিবরণ এই বিপন্ন নারীদেহের
বস্ত্রহীনতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও এক রকম কথা ছিল; কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। অকুস্থলে
পৌঁছে দুই চোখের তৃষ্ণা নিবারিত হলে, নাকে-মুখে হাত চেপে কাজলার উঁচুপাড় ধরে সবাই
ফিরে আসে; কেউ সোজা গিয়ে সদর রাস্তায় ওঠে, পায়ে হেঁটে বা সাইকেল হাঁকিয়ে চলে যায়, কেউ
বা রাস্তার পাশে ঝাঁকড়া বটতলায় বসে দুদণ্ড জিরিয়ে নিতে চায়। তবে সবার মুখে আলোচনার
বিষয় ওই নারীদেহ। গায়ের রঙ ফরসা ধবধবে, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কেউ কেউ বলে, নিয়ন্ত্রণাধিক
রক্তক্ষরণের ফলে ফ্যাকাশে-পাংশুটে হয়ে গেছে। আর কতক্ষণ এ রকম বেহাওলায় পড়ে আছে, তার
কি ঠিক আছে।
রক্তক্ষরণ?
বেশ কজন প্রত্যক্ষদর্শী একসঙ্গে চমকে ওঠে। একজন
তো বলেই বসে, কই, রক্তপাত তো নজরে পড়েনি!
খুব নিকটেই একজন সমর্থন জানায়-না না, গলায়-মাথায়
কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন তো দেখলাম না! রক্তটক্ত আবার কোথায়?
রক্তক্ষরণের প্রসঙ্গ যে তুলেছিল, সে কোনো জবাব
না দিয়ে খিকখিক করে হেসে ওঠে। হাসির শব্দে অনেকে তার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে দেখে অতিদ্রুত
সে দুই হাতে মুখ ঢেকে হাসির লাগাম টানতে চায়; কিন্তু তখনই আবার ফিনকি দিয়ে কলকলিয়ে
ওঠে হাসি। বিরক্ত না হয়ে কে থাকতে পারে! কে যেন কড়া গলায় ধমকে ওঠে, এত হাসির কী হলো!
হাসছি কি আর সাধে!
ভয়ানক নির্লজ্জের মতো লোকটা আবারও হাসে। হাসির
ভাঁজ খুলতে খুলতে অসভ্য ভঙ্গিতে সে বলতেই থাকে, আমি রক্ত দ্যাখলাম দুই ঠ্যাঙের মাঝখানে,
আর তুমরা গলা-মাথা সব...
কথা শেষ হয় না তার। চমকে ওঠে লোকজন, তাই নাকি!
এরপর আর কালবিলম্ব ঘটে না। আলোচনার গতিমুখ এক
লাফে কুৎসিত বাঁকবদল করে। কথিত রক্তধারা যাদের নজরে পড়েনি, তারাও অতি সহজেই যেন নিশ্চিত
হয়ে যায়, উপর্যুপরি গণধর্ষণের ফলেই এ রক্তক্ষরণ ঘটেছে। এমন পৈশাচিক ঘটনার খবর অনেকেরই
জানা আছে। কেউ কাগজে পড়েছে, কেউ বা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে। কতজনের কত যে বিচিত্র
অভিজ্ঞতা! সেই সব বিবরণ অতিদ্রুত ডালপালা মেলতে থাকে। সুযোগ বুঝে মূলহীন আলোকলতাও আগ্রাসি
ডগা বাড়ায় ফনফনিয়ে। কাজলাপারে পড়ে থাকা স্পন্দনহীন এই নারীদেহটিও কতভাবে লাঞ্ছিত-নির্যাতিত
হতে পারে, কল্পনার রঙ মাখিয়ে তারও বিশদ বিবরণ চলতে থাকে। তখনই আবার চলে আসে তার দেহের
বর্ণনা। ঘন লম্বা কেশদাম থেকে শুরু করে হাত-পা, নাক-মুখ, চোখ, এমনকি উদোমবক্ষ, কিছুই
বাদ যায় না। বাপরে বাপ! অস্বাভাবিক মৃত্যুর ছোবল খাওয়া নারীদেহ হলে বুঝি দর্শকের সব
ইন্দ্রিয় এতটাই শজারু-সজাগ হয়ে যায়! এতটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সব কিছু! ঠোঁটের নিচে
কবেকার সূক্ষ্ম কাটা দাগ, স্তন জোড়ার মাঝখানে উপল ভূমিতে ক্ষুদ্র এক খয়েরি তিল, স্তনবৃন্তের
গড়ন কেমন, বামদিকে কাঁধের নিচে কী একটা জরুল অথবা আঁচিল, নাভির নিচে দাদ-খুজলির চাকা,
ধীরে ধীরে উঠে আসে সব বিবরণ। এরই মাঝে একজন তো আচানক এক তথ্য জানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে
দেয়। বিবস্ত্র ওই নারীদেহের পায়ের পাতা পর্যন্ত সে নিখুঁতভাবে দেখেছে। খুব গভীর পর্যবেক্ষণ
তার। তাই সে জোর দিয়ে জানায়, ওই মহিলার ডান পায়ে আছে ছয়টি আঙুল। পাঁচটির জায়গায় ছয়টি।
ফলে তার আঙুলগুলো আদার প্যাঁচের মতো জড়িয়ে আছে। একটির গায়ে আরেকটি লেগে আছে নিবিড়ভাবে।
তা হবে হয়তো বা। এতসব সুগভীর পর্যবেক্ষণের যোগফল যা দাঁড়ায় তা থেকে এটুকু অত্যন্ত স্পষ্টভাবে
প্রতিভাত হয় যে কাজলাপারে পাটক্ষেতের আইলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটি দেখতে যথেষ্ট
সুন্দরী।
মেয়েটির বয়স কত হতে পারে সেটা কিন্তু অনির্ণীতই
থেকে যায়। তাকে কি মহিলা বলা চলে? নারী? নাহ, মেয়েদের বয়স নির্ণয়ের কাজটা মোটেই সহজ
নয়। ‘সুন্দরী’ বলে
ঘোষণা দেওয়া যত সহজ, ততটা মোটেই নয়। শৈশব থেকে কৈশোর এমনকি তারুণ্যের বারান্দা পর্যন্ত
এক রকম; যৌবনের পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা দিলেই সামনে অথই সমুদ্দুর, অবাধ সাঁতার; কে তার
তড়া পায়, ধরা পায়! কে বলবে বালিকা কবে যুবতী হলো, কখন হলো মেয়েমানুষ! কাজলাপারের ঘুমন্ত
মেয়েটির বস্ত্রহীন উদোম শরীর এতটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পরও সবাই একমত হতে পারে না
তার বয়সের প্রসঙ্গে এসে। কত হতে পারে তার বয়স-বাইশ? বত্রিশ? বিয়াল্লিশ? কেউ কেউ চোখ
কপালে তুলে ভাবতে বসে- অ্যাঁ, বিয়াল্লিশও হতে পারে? কারও কারও শরীরে বাঁধন থাকে বটে,
একেবারে গিঁটে গিঁটে অটুট থাকে, বাইরের লাবণ্য দেখে ধরাই যায় না আদৌ ছেলেপুলে হয়েছে
কি না। স্তনের বিষয়ে অধিক কৌতূহলী লোকটি অনেকক্ষণ বিরতির পর খ্যাক খ্যাক করে হেসে তার
বিজ্ঞ অভিমত পেশ করে-আরে ওটা আবার কোনো সমস্যা হলো? মেয়েমানুষের বুকের গঠন দেখলেই সব
পরিষ্কার। বয়স লুকাবে কোথায়?
বেশ, তাহলে যাও, আর একবার ভালো করে দেখে এসো উলঙ্গ
মেয়েটার বুক। তারপর বলো তার বয়স কত?
উপস্থিত অনেকেই চেপে ধরে বিশেষ অভিজ্ঞ সেই লোকটিকে।
তখন সে ভীষণ গাঁইগুঁই শুরু করে। প্রস্তাব অনুযায়ী উলঙ্গ নারীদেহটি পুনর্বার প্রত্যক্ষ
করতেও যাওয়া হয় না তার, আবার ভয়ে ভয়ে বয়সের আন্দাজও কিছুতে প্রকাশ করতে পারে না। এ
অবস্থায় মেয়েটির সম্ভাব্য বয়স নিয়ে যে যেমন পারে মন্তব্য করে, এমনকি নিজের অবস্থানে
দাঁড়িয়ে তর্কও জুড়ে দেয়-না না তিরিশের ওপরে যেতেই পারে না। এদিকে ত্রিশের এপারে যাদের
অবস্থান, তারাও পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়। অকাট্য প্রমাণ হিসেবে তারা আবারও সেই ক্ষতবিক্ষত
নারীদেহের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আবার সেই বুকের বর্ণনা, স্তনবৃন্ত কোনো দিকে
হেলে পড়েছে কি না, ওই বৃন্তের গোড়ায় খয়েরি বৃত্তের আয়তন কতটা, তলপেটের চামড়ায় ভাঁজ
পড়েছে কি না, ইত্যাকার পর্যবেক্ষণের ফল ঘুরেফিরে উঠে আসে। কথার পিঠে কথা আসে, কদর্যপূর্ণ
তর্কাতর্কি জমে ওঠে; কিন্তু প্রকৃত বয়সের কিনারা হয় না কিছুতেই।
অথচ এ কথা তো সত্যি, এ বয়সের নারী প্রায় সব বাড়িতেই
আছে। আমাদের গ্রামে তো বটেই, সব গ্রামে প্রায় সব ঘরে ঘরে এই বয়সের নারীরাই ঘরের খুঁটি
হয়ে সংসারের বোঝা কাঁধে নেয়, ঝড়ঝাপটা সামলায়, সন্তান লালন-পালন করে, পুরুষের চোখে নতুন
স্বপ্নের আলোকলতা ছড়িয়ে দেয়; কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে কাজলাপারে শুয়ে থাকা এই বিবস্ত্র
নারীকে কেউ চিনতেই পারে না। আশপাশের গ্রাম থেকে আসা লোকজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে;
কিন্তু মোটেই শনাক্ত করতে পারে না, মেয়েটি কে? কারও যেন মনেই পড়ে না, আগে কোথাও তাকে
দেখেছে কি না। ঘটনার অকুস্থল যেহেতু আমাদের গ্রামের কাজলাপার, তাহলে এ গ্রামের কেউ
না কেউ তাকে চিনবে তো! যদি এ গ্রামের মেয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই; এই ধুলামাটির রাঙাপথ,
এই সবুজ মাঠ বনবনানী, এই যে উঠোনের কোণে কলাগাছের ঝাড়, গোধূলিবেলায় ঘরে ফেরা পাখির
ঝাঁক- এসবই তার আশৈশবের চেনা। এমন দুঃসময়ে তাকে কেউ চিনবে না? গ্রামের মানুষ কি এত
সহজে চোখের পর্দা উল্টে ফেলতে পারে? তাই সম্ভব? এ গ্রামের মেয়ে না হয়ে যদি কারও বাড়ির
বউ হয়, তাতেই বা কী আসে যায়! বউয়ের আব্রু-ইজ্জত রক্ষার কথা কেউ ভাববে না! উদোম আকাশের
নিচে পড়ে আছে মেয়েটির বস্ত্রহীন দেহ, এ দৃশ্য কাউকে একটুখানি লজ্জিতও করে না? ইউপি
চেয়ারম্যান মোটরসাইকেল ভটভটিতে এসে কাজলাপারে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নগ্ন নারীর সৌন্দর্য
সুধায় মগ্ন হয়ে থাকে, একসময় কেরামত মেম্বার এসে ধ্যানভঙ্গ ঘটায়-ইর আবার পোস্টমর্টেম
লাগবে নাকি চিয়ারম্যান সাব?
চেয়ারম্যান সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে প্রথমে
ন্যাটা চৌকিদারের খোঁজ করে। গ্রামে এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও গ্রাম্য চৌকিদারের কোনো
ভূমিকা থাকবে না, এটা তো হয় না। নাকে-মুখে ন্যাকড়া চেপে ন্যাটা চৌকিদার হাজির হলে তাকে
পাঠায় থানা পুলিশের কাছে। তারপর কেরামত মেম্বারের কাঁধে হাত রেখে চেয়ারম্যান গুরুগম্ভীর
মুখে বলে, আনন্যাচারাল ডেথ। দেখা যাক কী করা যায়!
মোটরসাইকেলের সিটে পাছা ঠেকিয়ে পায়ে কিক কষতে
গিয়েও কী মনে করে চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে পড়ে, মেম্বারকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটি
কে, বলো দেখি!
কেরামত মেম্বার চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে। যেন
এমন প্রশ্ন সে কস্মিনকালেও শোনেনি। কী ভেবে প্রায় অকারণে ফিক করে সে হেসে ওঠে। চেয়ারম্যান
সে হাসিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার প্রশ্ন করে-কার বউ ওটা?
এ প্রশ্ন তো নতুন কিছু নয়! সেই ভোরবেলা থেকেই
দর্শকরা খাবি খাচ্ছে এই প্রশ্নে-কার বউ ওটা? কিংবা কার মেয়ে? বেশ কজন অতি-উৎসাহী মানুষ
একবারের জায়গায় দু-তিনবারও ছুটে গেছে সেই বিবস্ত্র নারীর কাছে, ভিড় ঠেলে তার মাছি ভনভনানো
মুখের কাছে মুখ নামিয়ে চিনতে চেষ্টা করেছে, দু-একজন আবার ভুল শনাক্তের জন্য দাঁতে জিভ
কেটে পিছিয়ে এসেছে। নাহ, সঠিক পরিচয় কেউ নির্ণয় করতে পারেনি। এ গ্রামে এমন চেহারা আগে
কখনও কেউ দেখেনি। তাহলে অচেনা এই মেয়েটি এখানে এলো কোত্থেকে? কারা নিয়ে এলো? কোন পিশাচের
দল? এসব প্রশ্নের কোনো কিনারাই হয়নি এ নাগাদ। প্রশ্নের পিঠে শুধু প্রশ্নই উঠেছে, ভুল
শনাক্তের সূত্র ধরে কখনও বা কুৎসিত বিতর্কও জমে উঠেছে, সমাধান কিছুই হয়নি। অবশেষে সবাই
ধরে নিয়েছে, এমন ঘটনা তো এখন হরহামেশা ঘটেই চলেছে, কতটুকুই বা অস্বাভাবিক এমন!
অনেক বিলম্বে হলেও চেয়ারম্যানের মুখে সেই পুরোনো
প্রশ্ন শুনে অনেকেই আবার নতুন করে ভাবতে বসে-তাই তো, এ গ্রামের হোক বা না হোক, মেয়েটির
কোনো পরিচয়ই জানা যাবে না! শতেক কাজে ব্যস্ত চেয়ারম্যান মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে চলে যাওয়ার
পরও উপস্থিত অনেকের চোখে-মুখে ওই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা চিহ্নের আকৃতি নিয়ে তা ধরে দাঁড়িয়ে
থাকে- একটা মানুষকে তাহলে চেনাই যাবে না? প্রশ্নটি ঘুরতে ঘুরতে ভীষণ এক ঘূর্ণাবর্তে
এসে পাক খায়। চেনা-অচেনা যা-ই হোক, মৃতদেহের শেষকৃত্য বলেও কি কিছুই হবে না?
বেলা গড়িয়ে পড়ে পশ্চিমে। মানুষের ভিড় খানিকটা
হালকা হয়ে এলেও অনেকের মাথায় শেষ প্রশ্নটি উৎকট হয়ে ঠোকা মারে- একটা মানুষের মরদেহ
স্রেফ শিয়াল-কুকুরের পেটে যাবে? শেষকৃত্যের প্রশ্নে সাংঘাতিক এক গিঁট পথ আগলে দাঁড়ায়-
মেয়েটি হিন্দু না মুসলমান সেটুক তো অন্তত জানতে হবে! শহরে অশনাক্তযোগ্য লাশের ক্ষেত্রে
আঞ্জুমান মুফিদুল যা-ই করুক কাজলাপারের এই গ্রামে সেসব হ্যাপা কে সামলায়! এদিকে শ্রাবণ
আকাশ নত হয়ে আসছে কালো মেঘে। কখন যে বরিষণ ধারা ঢালতে শুরু করে তার কি ঠিক-ঠিকানা আছে!
দুই.
পরদিন প্রভাতবেলায় আমাদের গ্রামের বাঁশবাগানে
আবার শোনা যায় পাখির কাকলি, গাছে আবার ফুল ফোটে, অন্ধকারের পর্দা চিরে আবারও হেসে ওঠে
আলোকের ঝরনাধারা। কী যে খেয়ালি প্রকৃতি, সারা রাত অঝোরধারায় বৃষ্টি ঢালার পর কে জানত
সকাল হতে না হতে এমন আলো ঝলমলে আকাশের শামিয়ানা মেলে ধরবে। আর এদিকে কেমন অবাক কাণ্ড
দ্যাখো- কাজলাপারে এসে সেই আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একাব্বরের মা মতিজান বেওয়া।
আলিঝালি বিধবা। মাসখানেকেরও অধিক হয়ে গেল সে গ্রামে নেই, ছেলেমেয়ের সন্ধানে গেছে ঢাকায়।
একাব্বরের সন্ধান মিলেছে। দুর্ঘটনা তাদের গার্মেন্টে নয়। ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে একাব্বরের
ছোট বোন কুলসুম ও তার স্বামী যেখানে কাজ করে সেখানে। সেই গার্মেন্টে। কত মানুষ যে সেই
ধ্বংসস্তূপে মারা পড়েছে, তার কোনো সঠিক লেখাজোখা নেই। এসব গা-শিউরানো খবর শুনে কোন
পাষানি মা স্থির হয়ে বাড়িতে বসে থাকতে পারে? ঢাকা নগরী সে চেনে না, তবু ছেলেমেয়ের দুটি
মোবাইল নম্বরের ওপর ভরসা করে একদিন গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার উদ্দেশে।
একাব্বরের মায়ের গ্রামে ফেরার কথা তো কেউ শোনেনি।
বাদলা মাথায় সে এই কাজলাপারেই বা কখন এলো, কিভাবে এলো? সেও কি সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে
ভিজে বিবস্ত্র এই মেয়েটিকে আগলে রেখেছে? না, এই মুহূর্তে একেবারে আক্ষরিক অর্থে বিবস্ত্র
আর বলা চলে না। মতিজান বেওয়া নিজের বুকের আঁচল টেনে বিছিয়ে দিয়েছে অচেনা মেয়েটির বুকের
জমিনে। তার দেহের নিম্নাংশ তখনও আগের মতোই অনাবৃত। তা নিয়ে মতিজান বড়ই বিব্রত, সংকুচিত,
কুণ্ঠিত। সাতসকালে সমবেত কৌতূহলী যুবকদের মধ্যে কাকে যেন হাত ইশারায় ডেকে সে বলে, কাপড়চোপড়
একটা কিছু আনি দেনা বাপ, আমার মেয়িডার গার ওপরে দেব।
মতিজানের মেয়ে? চমকে ওঠে সবাই। চোখ রগড়ে ভালো
করে তাকায়। মতিজানের মেয়ে মানে তো সেই কুলছুম! মাথা খারাপ! এই গ্রামে জন্ম, এই ধুলামাটিতে
বেড়ে ওঠা কুলছুমকে এ গ্রামের লোকজন চিনবে না? তার কোনো খবরই জানবে না? বললেই হলো! আত্মীয়তার
সম্পর্ক থাক বা না থাক, গ্রামের মানুষের ওপর টান থাকবে না? কেউ কারো খোঁজখবর রাখবে
না, তাই হয়! ঢাকায় রানা প্লাজার ধ্বংসলীলার খবর নিয়ে যখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু
হয়, তখন তো এ গ্রামের লোকজন হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। একাব্বারসহ আরো যে দু-চারজনের মোবাইল
নম্বর জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা, খবরাখবর সংগ্রহ করা-
সাধ্যমতো সবই করেছে গ্রামের মানুষ। কী, করেনি? ছেলেমেয়ের চিন্তায় উন্মাদিনীপ্রায় মতিজান
বেওয়াকেও একদিন তারা ঢাকার কোচে উঠিয়ে দিয়েছে।
সেই মানুষ সবার অলক্ষ্যে ঢাকা থেকে ফিরে এসে সহসা
এ রকম নাটক করলে সবাই মানবে কেন? গ্রামের লোকজন কী ঢাকার খোঁজখবর কিছুই রাখে না? পাশের
গ্রামের শেফালী হাত-পা থেঁতলে আধমরা হয়ে বাড়ি ফিরেছে, তাকে দেখতে যায়নি তারা? একাব্বরের
খবরও পেয়েছে। সে ভালোই আছে। মারা গেছে কুলছুমের স্বামী। হাই স্কুল মাঠের পচাগলা লাশের
সারি থেকে তার মৃতদেহ নাকি শনাক্ত করাও সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু নানাবিধ বাস্তব অসুবিধার
কারণে সেই লাশ বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনতে পারেনি। সেই লাশ দাফন-কাফন হয়েছে সরকারি তত্ত্বাবধানে।
আর এই কুলছুমের কোনো খবর নেই, জীবিত বা মৃত কোনো সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে না। কুলছুমের
মা মতিজান কিছুতেই প্রবোধ মানছে না, দিন-রাত রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে মাথা
কুটছে। গ্রামে এসব খবরই এসে পৌঁছেছে। কৌতূহলী সবাই সে সব জানেও। ময়মুরব্বিদের মধ্যে
কেউ কেউ মতিজান বেওয়ার জন্য জিভ চুকচুক করে আফসোসও করেছে-বেচারা এইবার বোধহয় পাগলই
হয়ে যাবে। কুলছুম যে তার জানের টুকরা! তাকে ছাড়া বাঁচবে কী করে!
প্রশ্নটা যেহেতু বাঁচা-মরার, তাহলে ব্যাপার মোটেই
সামান্য নয় সেটা ঠিক; হয়তো সংকট আছে আরো গভীরে। কিন্তু তাই বলে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই
গ্রামবাসীকে এ রকম এক নাটকের মুখোমুখি হতে হবে, সে কথা কে ভাবতে পেরেছে! দৃশ্যটি বেশ
নাটকীয় বটে। সন্তানহারা এক শোকবিহ্বল মা বসে আছে আলুথালু, দৃষ্টি তার ভাবলেশহীন, মৃত
কন্যার মাথা তার কোলে, নিজের বুকের আঁচল দিয়ে সন্তানের আব্রু রক্ষার সবিশেষ প্রচেষ্টা-
একে মানুষ নাটকীয় বলবে না?
বেলা বাড়তে বাড়তে কাজলাপারের জমায়েতে লোকসংখ্যাও
বাড়তে থাকে। নানাজন এসে নানা প্রশ্নে জেরবার করে মতিজানকে। সবাই মিলে নানা যুক্তিতে
বুঝতে চেষ্টা করে- কাল থেকে বেআব্রু পড়ে থাকা এই মৃতদেহটি কিছুতেই তার কন্যা কুলছুমের
নয়। কুলছুমকে তারা আশৈশব বেশ ভালো করেই চেনে, এ কুলছুম নয়।
কে শোনে কার কথা!
একেবারে সহজ-সরল যুক্তি মতিজান বেওয়ার- দশ মাস
পেটে ধরেছি আমি, বুকের দুধ খাওয়ায়েছি আমি, বাপের অভাব কখনও বুঝতে দিইনি, আমিই বাপ,
আমিই মা; আর আমি কিনা আমার মেয়িকে চিনবু না! পর্বত-প্রমাণ অটল সিদ্ধান্ত তার। সমাজের
মণ্ডল-মাতুব্বর, মেম্বার, চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম গুছিয়ে একত্র হলে সে সবার মুখের
ওপর অনতিক্রম্য এক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- আমার মেয়ির জানাজা হবে না?
পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতে সবার দৃষ্টি
এসে পড়ে ইমাম সাহেবের দিকে। গতকাল তিনি ওই বেপর্দা নারীর ধর্মপরিচয় জানতে চেয়েছিলেন-
হিন্দু না মুসলমান! সন্তানের প্রতি মায়ের স্বীকৃতি ঘোষণার পর সেই প্রশ্নটি হয়ে ওঠে
অবান্তর; বরং মতিজানের প্রশ্নটি কানে কানে আছড়ে পড়ে- জানাজা হবে না? ইমাম সাহেবের ভয়
হয়, উত্তর দিতে দেরি হলে মতিজান যদি হঠাৎ হা হা করে হেসে ওঠে!