× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পটচিত্র শিল্পীর পরম্পরায় সেতু আচার্য্য

মোহাম্মদ আসাদ

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:২৬ পিএম

আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৫৪ পিএম

পটচিত্র শিল্পীর পরম্পরায় সেতু আচার্য্য

বাংলার প্রাচীনতম লোকশিল্পের মধ্যে অন্যতম পটচিত্র। এ দেশে অথবা ভারতবর্ষে যেসব পটচিত্রীর নাম পাওয়া যায় তারা সবাই পুরুষ। পটচিত্র পুনরুদ্ধারে এবার পেলাম প্রথম নারী পটচিত্র শিল্পী সেতু আচার্য্যের নাম। তিনি এ দেশের ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র শিল্পী শম্ভু আচার্য্যের বড় মেয়ে। গাজীর পট বংশপরম্পরায় ধরে রেখেছেন শম্ভু আচার্য্য। তিনি হলেন আচার্য্য পরিবারের নবম পুরুষ। তার ছেলে অভিষেক আচার্য্য ও বড় মেয়ে সেতু আচার্য্য দুজনই ভালো পটচিত্র আঁকেন। সেতু আচার্য্য এরই মধ্যে অনেক কাজ করেছেন। সেতু স্বশিক্ষিত শিল্পী। শৈশব থেকেই দেখেছেন বাবার পট আঁকাআঁকি। শৈশব থেকেই বাবা শম্ভু আচার্য্যকে পট আঁকায় সহায়তা করেছেন। সেভাবেই শিল্পীসত্তা গেঁথে যায় মনে। তারপর বিয়ে-সন্তান, কেটে যায় কয়েক বছর। মনের ভেতর শিল্পীসত্তা বেঁচে থাকে। সেই শিল্পীমন বারবার তাকে নিয়ে যায় পটচিত্র আঁকার দিকে। সম্প্রতি অনেক ছবি এঁকেছেন ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র ধারায়। মুন্সীগঞ্জের আচার্য্য পরিবার পট আঁকার ধারায় আঁকলেও সেতুর কাজে নিজস্বতা লক্ষণীয়। তিনি পৈতৃক ঐতিহ্য গাজীর পট ছাড়াও এঁকেছেন নানা রকম লোকাচারের ছবি। বাজারের ক্যানভাস হলেও রঙ ব্যবহার করেছেন পারিবারিক ঐতিহ্যমতো বানিয়ে।

এবার বলি গাজীর পট ও আচার্য্য পরিবার কেন গুরুত্বপূর্ণ। গাজীর পট হচ্ছে কাপড়ে আঁকা চিত্রকর্ম, যা পেঁচিয়ে রাখা যায়। এ পট অনেক প্যানেলে বিভক্ত। একেকটি প্যানেলে আঁকা থাকে পীর গাজীর মহত্ত্ব নিয়ে উপাখ্যান। মধ্যেখানে থাকে বড় করে গাজীর একটি ছবি। সে ছবিতে গাজী বসে আছেন বাঘের ওপর। তার সামনে পীর পতাকা আর পেছনে ছোট ভাই কালু ছাতা হাতে দাঁড়ানো। বাকি প্যানেলগুলো ছোট ছোট। এ পট দেখিয়ে বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা একসময় গাজী পীরের মহত্ত্ব ও লোকাচার সম্পর্কে বর্ণনা করত। এ গাজীর পট ছিল ভাটি অঞ্চলের মানুষের অন্যতম বিনোদন। গ্রামীণ এ লোকশিল্পের কথা শহুরে মানুষের জানাই ছিল না। ১৯৭৭ সালে লোকগবেষক তোফায়েল আহমেদ আশুতোষ মিউজিয়ামে দেখতে পান একটি গাজীর পট। তার সঙ্গে লেখা ছিল দুই বাংলার একমাত্র গাজীর পট। সেটি এঁকেছেন বাংলাদেশের পটশিল্পী সুধীর আচার্য্য। তোফায়েল আহমেদ দেশে এসে খুঁজতে থাকেন সুধীর আচার্য্যকে। নরসিংদীতে খুঁজে পান পটগায়ক দুর্জন আলীকে। দুর্জন আলী সুধীর আচার্য্যের আঁকা পট দিয়ে গ্রামে গ্রামে গাজীর গান শোনাতেন। তাঁর কাছ থেকে সন্ধান পান মুন্সীগঞ্জের সুধীর আচার্য্যের। তখন পট তৈরির কাজ প্রায়ই বন্ধ। তার ছেলে শম্ভু আচার্য্য চলে গিয়েছিলেন কমার্শিয়াল আর্টের কাজে। সুধীরের অনুরোধে শম্ভু আচার্য্য ফিরে আসেন পটচিত্র আঁকার কাজে। বাবা সুধীর আচার্য্যের সঙ্গে মিলে পটের কাজে মন দেন। নতুন উদ্যমে শুরু হয় গাজীর পটের যাত্রা। ১৯৮৯ সালে কারুশিল্প পরিষদ সুধীর আচার্য্যকে কারুশিল্প পদক দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করে। ১০ ফেব্রুয়ারি তার হাতে তুলে দেওয়া হবে পুরস্কার, সে চিঠি পৌঁছায় ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে। সেদিনই বিকালে পটশিল্পী সুধীর আচার্য্য পরলোকগমন করেন। তার পর থেকে ঐতিহ্যবাহী গাজীর পট এঁকে চলেছেন তার সুযোগ্য সন্তান শম্ভু আচার্য্য। এ কাজ তার পরিবারে চলে এসেছে বংশপরম্পরায়। শম্ভু আচার্য্য এ পরিবারের নবম পুরুষ। ৪৫ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি পটচিত্র এঁকে চলেছেন। দেশে-বিদেশে তার আঁকা পটচিত্র সমাদৃত হয়েছে। তার আঁকা পটচিত্র আমাদের ঐতিহ্যবাহী এক শিল্পকলা। এ ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প নতুন প্রাণ দিলেন সেতু আচার্য্য।



সেতু আচার্য্য বলেন, গাজীর পটশিল্পী আচার্য্য বংশের আমি দশম প্রজন্ম। বাবা শম্ভু আচার্য্য, ঠাকুরদা সুধীর আচার্য্য। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখেছি বাড়িতে পট আঁকার কাজ চলছে। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার মতো বাবার এ কাজও ছিল পরিবারের নিয়মিত কাজ। এভাবেই দেখে দেখে বড় হয়েছি। একটু বড় হয়ে বাবাকে সহায়তা করা শুরু করলাম। গাজীর পটের কাজেই বেশি সহায়তা করেছি। বাবা ড্রয়িংটা করেছেন, সেটার রঙ ভরাটের কাজটা করতাম। রঙ এগিয়ে দেওয়া, রঙের নানা উপকরণ এগিয়ে দেওয়াসহ টুকিটাকি কাজ নিয়মিতই করেছি। মনোযোগ দিয়ে দেখেছি বাবার কাজ করার কৌশল। এসএসসি পাস করার পরই বিয়ে হয়ে গেল। বাচ্চা হলো। অনেক দিন কাজ থেকে দূরে ছিলাম। ছেলের বয়স যখন দু-তিন বছর, তখন বাবা ক্যানভাস কিনে দিলেন। নিজের বানানো রঙ দিয়ে গেলেন। বললেন আবার শুরু কর, দেখ কী হয়। পাঁচ বছর ধরে নিয়মিতই ছবি আঁকছি। জানি না কী হচ্ছে, ভালো লাগছে করছি।

আচার্য্য বংশের দশম প্রজন্ম চলে এলেও শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন শম্ভু আচার্য্যের বাবা সুধীর আচার্য্য থেকে। এর আগে তারা পটচিত্র আঁকতেন বেদে সম্প্রদায়ের পটগানের গায়কদের জন্য। বেদে মহাজনরা দূরদূরান্ত থেকে এসে চার-পাঁচটি করে পট কিনে নিয়ে যেতেন। তারা আবার গায়ক বেদেদের দিয়ে পটের গান গাইয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। এভাবেই চলছিল পটচিত্রের যাত্রা। শম্ভু আচার্য্য পটচিত্র নিয়ে গেছেন উচ্চ আসনে। বেদে নৌকা থেকে এখন পটচিত্র জায়গা করে নিয়েছে ধনীদের দেয়ালে। জায়গা করে নিয়েছে দেশ-বিদেশের জাদুঘর ও সংগ্রহশালায়। সেটার একমাত্র শিল্পী ছিলেন শম্ভু আচার্য্য। সেতু আচার্য্যের কাজে সেই জায়গাটা আরও বিস্তৃত হবে। সেতু আচার্য্য বাস করেন ঢাকায়। স্বামী একজন ব্যাংকার, স্ত্রীর কাজে তরুণপ্রাণ।

সেতু আচার্য্য আরও বলেন, শুনেছি আমার দুই বছর বয়সেই ঠাকুরদা মারা যান। আমাদের ঘরে একটা পট ছিল ঠাকুরদার করা। তখন চিন্তা করতাম ঠাকুরদা করেছেন, বাবা করেছেন আমিও করব। এ কাজ আমি কখনও ধরে ধরে শিখিনি। দেখতে দেখতেই শেখা। ছোটবেলা থেকেই রঙতুলি আমার খুব ভালো লাগত। গাজীর পটের প্রতি দুর্বলতা আমাদের একটু বেশি। শুনেছি দাদা পট আঁকতেন গামছার ওপর। বাবাকে দেখেছি ক্যানভাসে আঁকতে। আমিও ক্যানভাসেই আঁকি। তবে বাবার রঙ তৈরির কৌশল দেখেছি ছোটবেলা থেকে। সে পদ্ধতিতেই রঙ তৈরি করে নিচ্ছি। বাবার দেখানো পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক রঙ নিজেই তৈরি করি। হাতে তৈরি রঙে ভিন্নতা আছে। তাই আমি এ কৌশল ধরে রাখার চেষ্টা করছি। সাদা ক্যানভাস দেখলেই কাজ করতে ইচ্ছা করে।

গত পাঁচ বছরে সেতু অনেক কাজ করেছেন। ঘরের দেয়াল ও নিচে ছবি আর ছবি। কিছু ক্যানভাস তৈরি করে রেখেছেন আঁকার জন্য। বাবা শম্ভু আচার্য্যের মতো সেতু আচার্য্যের কাজও সমাদৃত হবে। সেতু আচার্য্যের জন্য শুভকামনা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা