মূল : নাগিব মাহফুজ
ফজল হাসান
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৭:১৫ পিএম
চুল্লি
বিপর্যয় ঘটেছিল।
জেইনহুমের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল আয়ুশা। জেইনহুম রুটি বানাত। যখন খবর রটে, তখন খবরের
টুকরো অংশ পুরো মহল্লার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি সরু পথে, কম হলেও এক হৃদয়বান ব্যক্তি
অবিশ্বাস করে মতামত ব্যক্ত করেছে :
‘আল্লাহপাক
আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন! আপনার ওপর কেমন এক বিপর্যয় নেমে এসেছে, জুমা চাচা, আপনি
একজন ভালো মানুষ!’
প্রশ্নের মুখোমুখি
হওয়া জুমা চাচা ছিলেন আয়ুশার বাবা। তিনি পরিবারের প্রধান ছিলেন। তার ছিল পাঁচ সুঠাম
দেহের ছেলে। তার একমাত্র কন্যা আয়ুশা তার মান-সম্মান ও শ্রদ্ধা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।
কেলেঙ্কারিটি
ছড়িয়ে পড়ার পরই লোকজন আয়ুশার সম্পর্কে বলাবলি শুরু করে। আয়ুশাকে বলা হতো সুন্দরী
ও মনোরমা। উম্ম রাদি, যিনি মসলাপাতি বিক্রি করতেন, ঘোষণা দিয়েছিলেন :
সে ছিল সুন্দরী,
তা অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু সে ছিল সাহসী। যাদের সঙ্গে সে কথা বলত, তার ঝলমলে
চোখের দৃষ্টি সরাসরি সেসব ব্যক্তির হৃদয়ে চলে যেত। তখন তারা ভুলে যেত যে, তারা কী
নিয়ে কথা বলছিল।
জুমা চাচা
ও তার ছেলেরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তারা মাথা নত করে মাটির দিকে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে
থাকত। প্রথমে তারা এত বেশি রাগান্বিত হয়েছিল যে, তারা কোনো ধরনের তথ্য ও সংবাদ পাওয়ার
আশায় মহল্লার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।
ভুল মানুষকে
অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত করে, অবশেষে মহল্লার প্রধান জুমাকে বললেন। যা কিছুই ঘটুক
না কেন, সে সব কিছু হারায়।
ছেলেদের কারণে
জুমা তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলেন।
‘তোমরা নিজেদের
বলো যে, তোমাদের বোন মরে গেছে,’ তিনি ছেলেদের বললেন। ‘আল্লাহ ওর
প্রতি সদয় হোন। তার ওপর সব কিছু ছেড়ে দাও।’
প্রত্যেকেই
কাহিনির টুকরো অংশ নিজেদের সুবিধা মতো একত্র করে নিয়েছে, তবে তা যথেষ্ট অনুমানযোগ্য।
ছেলেটি যখন রুটি সেঁকার চুল্লি থেকে রুটি বের করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ছেলেটির সঙ্গে
মেয়েটির দেখা হয়েছে এবং মেয়েটি ছেলেটির প্রেমে পড়েছে। রুটির দোকানির ছেলের পক্ষে কখনই
সম্ভব নয় যে, সে ধনাঢ্য কাপড় ব্যবসায়ীর মেয়ের পানিগ্রহণের প্রস্তাব করে; দুই প্রেমিক-
প্রেমিকা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আয়ুশা নিজের অলংকার এবং তার মায়ের সোনাদানা
যতটুকু নেওয়া সম্ভব ছিল, তা নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার একমাত্র গ্রহণযোগ্য উপসংহার যে,
তারা যেখানেই থাকুক না কেন, বিয়ে করবে।
তাই ছিল আয়ুশা
ও জেইনহুমের কাহিনির সমাপ্তি। বিপর্যয়ের ক্ষত শুকাতে জুমা চাচার পরিবারের দীর্ঘ সময়
লেগেছে। তারা তাদের সাধারণ জীবনে ফিরে গেছে, কিন্তু স্বাভাবিক নিম্নমুখী আঁকাবাঁকা
পথের কষ্ট সহ্য করেছে। বস্ত্র ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যায় এবং বাড়ি বিক্রি করার সব পরিকল্পনা
গ্রহণ করে।
দুর্দশার গভীর
অতলে তলিয়ে থাকার সময় তিনি দেখলেন যে, তার যে পরিমাণ অর্থকড়ির প্রয়োজন, তাই নিয়ে এক
পরিচিত বার্তাবাহক এসে উপস্থিত হয়েছে।
‘এই টাকা-পয়সা
আপনার মেয়ে আয়ুশা পাঠিয়েছে’, লোকটি বলল। ‘ঐশ্বরিক ইচ্ছা
নির্ধারিত যে, আপনার মেয়ের জামাই জেইনহুম আপনার জন্য এই টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছে।’
বস্ত্র ব্যবসায়ীর
জামাতা তাকে অবহিত করে যে, তার স্ত্রী যেসব অলংকার নিয়েছিল, সেগুলো বিক্রি করে তার
জন্য একটা রুটির দোকান করে দিয়েছিল। তারপর অনেক কষ্ট করে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে
এবং ভালোই করছে।
দেখেছেন? মসজিদের
ইমামকে মহল্লার প্রধান বললেন। ‘মেয়েটি সঠিক সময়ে ফিরে এসেছে। তার
পাপ মোচনের জন্য আপনার কোনো প্রয়োজন নেই।’
অভীষ্ট লক্ষ্যে
পৌঁছনোর চেষ্টা
জাকিয়া এক
বছর অন্য জায়গায় থেকে মহল্লায় ফিরে এসেছে। তার কোলে স্তন্যপান করা একটা শিশু। কেউ একজনও
বুঝতে পারেনি যে, সে চলে গিয়েছিল অথবা সে পুনরায় ফিরেছে। সে এখনও দেখতে ছিপছিপে এবং
মলিন; প্রকৃতপক্ষে সে সেখানে খুব কমই বসবাস করেছে। তার মুখের সৌন্দর্যের ঝলকানি অনেকটা
ফিকে হয়ে গেছে। তবে শুধু অনেক সময় আগে হারিয়ে যাওয়া যৌবনের খানিকটা চিহ্ন রয়ে গেছে।
সে তিনটি বাড়ির খোঁজ করছিল, তার ধোপানি মা সুখাইনার মৃত্যুর পরে যেসব বাড়িতে বুয়া হিসেবে
কাজ করত। অবশেষে সে শেষ বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বাড়িটা ভূগর্ভস্থ ঘরের দিকে ছিল।
জাকিয়া এতই
গরিব ছিল যে, কোনো সময় নষ্ট করার মতো তার পরিস্থিতি ছিল না। সুতরাং আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই
সে বাচ্চাদের জন্য চকোলেট, যেমন টার্কিশ ডিলাইট এবং চিনি মেশানো শা-জিরার বীচি, ফেরি
করে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে এক হাতে চৌকোনা করে কাটা হালুয়াভর্তি ঝুড়ি
ধরত এবং অন্য হাতে শিশুটি ধরে রাখত। সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে ঘুরে হালুয়া
বিক্রি করত। কিন্তু সে বস উসমানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য একটা বিশেষ জায়গা
বেছে নিয়েছিল। সে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যে উসমান তার কন্ঠস্বর শুনবে অথবা তাকে নিজের
চোখে দেখবে। উসমান চিরদিনের জন্য তাকে অবজ্ঞা করতে পারবে না। জায়গাটা ফাঁকা হলে উসমান
সুযোগ বুঝে জাকিয়াকে ইশারা করে। যখন সে দোকানের কাছে আসে, তখন তারা দৃষ্টি বিনিময় করে।
জাকিয়ার দৃষ্টি কড়া ও স্থির। অন্যদিকে উসমানের দৃষ্টি প্রতারণামূলক।
কেমন আছ, জাকিয়া?
সে জিজ্ঞেস করে।
প্রশংসা আল্লাহর,
যেকোনো ঘটনায়, সে রূঢ়, কিন্তু নিচু গলায় বলল।
‘তোমার কি কিছু
লাগবে?’
আল্লাহ মহান
দাতা, সে দৃঢ় গলায় বলল, কিন্তু এই বাচ্চাটি তার প্রাপ্য চায়, আল্লাহপাক যা নির্দেশ
দিয়েছেন।
‘এটা একটি দীর্ঘ
বিবৃতি, যার কোনো অর্থ নেই। শুধু বলো যে, তোমার প্রয়োজন আছে।’
‘আমি যা বোঝাতে
চেয়েছি, তাই বলেছি’, সে রাগান্বিত কন্ঠস্বরে জবাব দিল,
‘আর বিশেষ করে
আপনি তা ভালো করেই বুঝতে পারছেন।’
‘আমি কিছুই
বুঝতে পারছি না’, সে কম্পিত গলায় চিৎকার করে বলল। ‘আমার সামনে
থেকে চলে যাও। যে অযোগ্যের প্রতি করুণা করে, এটি তার জন্য পুরস্কার।’
দোকানি দোকানের
ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং রাগে-ক্ষোভে কাঁপতে থাকে। জাকিয়া দোকানের চারপাশে এবং
কাছাকাছি জায়গায় তার জিনিসপাতি বিক্রি করা অব্যাহত রাখে। সে কখনই তার পরিকল্পনা থেকে
বিচ্যুৎ হয়নি। সে ধৈর্য ও সিদ্ধান্তে অটল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানেই থাকে। অন্যদিকে
দোকানি ক্রোধে কাঁপছিল এবং সব ধরনের দুঃস্বপ্নে আচ্ছন্ন ছিল।
‘হায় আমার!’ দোকানি নিজেই
বলল, যেন সে অনুভব করছিল যে তার নিজের আত্মার মধ্যে উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছে, ‘আমার কাজে
মনোযোগ দিতে পারছি না।’
দোকানে ও বাড়িতে
সে নিজের জীবনকে ঘৃণা করতে শুরু করে। সে অনুভব করে যে, তাকে ও তার পরিবারকে শয়তান ভিন্ন
পথে প্ররোচিত করছে।
‘তুমি যদি এরকম
করো’, একদিন দোকানি
বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় জাকিয়ার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কেউ তোমার
মৃতদেহ খুঁজে পাবে না।’
জাকিয়া ভয়
পায়নি, এমনকি পিছু পা হয়নি। বরং তার পরিবর্তে সে শিশুকে নিয়ে খেলতে পেরে সন্তুষ্ট ছিল।
উসমান আর সহ্য করতে পারছিল না, মহিলা তার শিশুকে কোলে নিয়ে তার দোকানের আশপাশে ঘোরাফেরা
করতে দেখছিল। সে মহল্লার প্রধানকে গোপন জায়গায় ডেকে নিয়ে যায় এবং তাকে তার দুশ্চিন্তার
কথা বলে।
‘সত্যিই আমাকে
যা ভীত করেছে’ বলেই সে এক পলকের জন্য থামে। তারপর সে এই বলে তার
কথা শেষ করে, ‘যে সে শূন্য থেকে একটা কেলেঙ্কারি ঘটাবে।’
মহিলা যদি
কোনো মিথ্যা দাবি না করে, মহল্লার প্রধান উসমানকে বললেন, ‘আমি বলব তুমি
তোমার অহংকার হজম করো এবং কাজে ফিরে যাও, যা আল্লাহপাক তোমার জন্য বরাদ্দ করেছেন।’
কিন্তু সে
তো মিথ্যা দাবি করছে, জবাবে উসমান ভাঙা গলায় বলল।
‘সে এখনও তোমাকে
কেলেঙ্কারিতে জড়াতে পারে এবং লোকজন তাকে বিশ্বাস করবে।’
‘কিন্তু তাই
হোক, আপনি তা চান না।’
‘সে যেন মহল্লা
ছেড়ে চলে যায়, আমি বিষয়টা দেখব’, এক মুহূর্ত চিন্তা করে মহল্লার প্রধান
বললেন। ‘মহিলা মাসিক
ভাতা পাবে, যা আমরা দান হিসেবে গণ্য করব। আমাদের কাছে এটাই হলো সবচেয়ে উত্তম সমাধান।’
‘আমি আপনার
প্রস্তাব মেনে নেব’, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল বস উসমান।
মহল্লার প্রধান
পরদিন জাকিয়াকে ডেকে আনেন।
‘আমার কাছে
তোমার জন্য একটা ভালো সমাধান আছে’, তিনি বললেন।
মহল্লার প্রধান
সমঝোতায় পৌঁছানোর কথা বললেন।
‘তুমি সম্মানের
সঙ্গে বসবাস করবে’, তিনি তাকে বললেন, ‘আর তোমার মহল্লার
নতুন প্রধানকে তোমার সম্পর্কে বলব।’
তাদের মাঝখানে
নিস্তব্ধতা বিরাজ করে, চিন্তা-ভাবনা এবং অস্পষ্ট আবেগে ভরা একধরনের নীরবতা। মহল্লার
প্রধান অনুধাবন করেন, তিনি যে ধরনের সাড়া আশা করেছিলেন, তা তিনি পাচ্ছেন না।
‘তুমি শুনতে
পেরেছ, আমি কী বলেছি?’ তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন।
‘আমি শুনেছি
আপনি যা বলেছেন, মহল্লার প্রধান’, জবাবে সে বলল। তার ঘাড় শক্ত। ‘কিন্তু আমি
যাচ্ছি না।’
‘তুমি একটা
উন্মাদ!’ মহল্লার প্রধান
রেগে যান। এটা স্পষ্ট।
এই শিশুটি
তার সন্তান, মহিলা বলল, ‘আমি সেরকম ভাতা গ্রহণ করব না।’
‘তুমি কী করতে
চাও?’
‘শিশুটি এমন
জায়গায় রাখব যেন সে দেখতে পারে। তাহলে সব সময় সে তার অপরাধ স্মরণ করতে পারবে।’
জাকিয়া তার
দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে, যেমন হালুয়া বিক্রি করা, শিশুকে লালনপালন করা এবং
দোকানের আশপাশে ঘোরাঘুরি করা। উসমান চেপে রাখা দুর্দশার আরও গভীরে তলিয়ে যেতে থাকে।
তার ক্রোধ আরও বেশি ঘন হয় এবং আরও তীব্র হয়। জীবনে এই প্রথম সে খুন করার চিন্তা করে।
কিন্তু তারপর
তার মধ্যে একটা কিছু ঘটে এবং কাজের দিনের মধ্য দুপুরে, তার বুদ্ধি লোপ পাওয়ার পরে সে
মহল্লার প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে যায়।
‘আমি তাকে বিয়ে
করব এবং শিশুটিকে স্বীকৃতি দেব’, দোকানি চিৎকার করে বলল এবং এমনভাবে
মহল্লার প্রধানের হাত জড়িয়ে ধরে যেন সে ভিক্ষা কামনা করছে। ‘আমরা অন্য
কোনো মহল্লায় বসবাস করব।’
মহল্লার প্রধানের
জবাব স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ :
মহিলা কোনো
বিষয়ে কখনই তার জায়গা থেকে নড়বে না।
পোড়া কপাল
হাসান দাহশান
তিনবার মহল্লার মেয়েদের বিয়ে করেছে এবং তিন স্ত্রীই সন্তান প্রসব করার আগেই মারা যায়।
তারপর থেকে হাসান ‘হতভাগা হাসান’ নামে পরিচিতি
লাভ করে। যখন সে চতুর্থবারের মতো এক মেয়ের সঙ্গে বাগদান সম্পন্ন করেছে, যে কিনা বিবাহবন্ধনে
আবদ্ধ থাকার সময় মারা যায়, হাসানের দুর্ভাগ্য আবারও আঘাত করে এবং আরো ব্যাপকভাবে তার
পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন ছিল, একজন তাকে অন্যত্র চলে যেতে,
পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ও সন্ন্যাসী হতে বলেছিল। তার পরিবার তাকে নিরাশ না
হতে উপদেশ দিয়েছিল এবং তাকে তার দুর্ভাগ্যকে জয় করার জন্য উত্সাহিত করেছিল।
সব ভালো যার,
তারা তাকে বলেছিল, শেষ ভালো তার।
সে তাদের পরামর্শে
সাড়া দিয়েছিল এবং এক বা দুইবার পুনরায় চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার জন্য সব দরজা শক্ত
করে বন্ধ ছিল। তার পারিবারিক মর্যাদা এবং নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলেও লোকজন তাকে
‘মৃত্যুর দেবদূত’ হিসেবে গণ্য
করত। সে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল এবং একাকী থাকত, জীবনকে ঘৃণা করত, বন্ধুহীন ছিল এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা
ছাড়াই ব্যবসা-বাণিজ্য করত।
একই সময়ে হাসানের
মায়ের ব্যক্তিগত কাজের জন্য সানবুলা চাকরানী হিসেবে যোগ দিয়েছিল। বয়সের জন্য তার মায়ের
কর্মক্ষমতা ও চলাফেরা সীমিত হয়ে গিয়েছিল। তখন সানবুলা বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করেছে, কিন্তু
সে ছিল নোংরা এবং সম্পূর্ণ নিরাশ। মেয়েটি তার মাকে হারানোর পর হাসানের মা ওর প্রতি
সহানুভূতি দেখিয়েছেন। মেয়েটার মা শাক-সবজির আচার বিক্রি করতেন এবং তিনিও হাসানের মার
সহানুভূতি পেয়েছেন। যেহেতু তার নিয়ম ছিল কাজের মেয়ে, তাই তিনি ওকে গোছগাছ থাকা এবং
বেতের লাঠি ভর করে তাকে দাঁড় করানো শিখিয়ে ছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তিনি যেন সবার কাছে
গ্রহণযোগ্য হন। সরু লিকলিকে কোনো মেয়েকে সুন্দরী বিয়ের পাত্রীতে পরিণত করা কোনোভাবেই
সম্ভব নয়। তবুও জীবন মেয়েটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল এবং তার আসল রঙ দেখিয়েছিল।
সে শিখেছে কিভাবে নিজের চুল আঁচড়াতে হয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনে কাজকর্ম শিখতে শুরু করেছে।
তার পরও সে
সুন্দরী ও মনোরমা ছিল না, হতভাগা হাসান তাকে কাছাকাছি থেকে লক্ষ রাখত; মেয়েটির কাছ
থেকে আসা এক ধরনের উষ্ণতা সে অনুভব করত। হাসান যখন মেয়েটিকে ইশারা করত, তখন সে কোনো
দ্বিধা না করেই সাড়া দিত। হাসান সম্ভবত তার প্রথম পদক্ষেপে আগ্রহী ছিল, কিন্তু সে চলে
যাওয়ার পরপরই বিচলিত বোধ করেছিল। সে অতীতে যেসব দুর্দশা ভোগ করেছিল, তার দিকে ফিরে
তাকালে তাকে হতবাক হতে হয়েছিল। সেসব দুর্দশা শুধু অব্যাহত ছিল এবং তীব্রতর হয়েছিল।
কোনো সুন্দরতা
নেই, সে নিজেকে বলেছিল, অর্থকড়ি নেই এবং কোনো আদর্শ নেই।
দীর্ঘ বিরতির
পর তাদের সম্পর্ক যেমন ছিল, তেমনই চলতে থাকে। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
হাসান লক্ষ করেছে যে, মেয়েটি বদলে যাচ্ছিল। তার মুখমণ্ডলে সেই ফাঁকা অভিব্যক্তি ছিল
না এবং চোখে দুঃখ জমেছিল। সে এখন বুঝতে পেরেছে যে, হাসান এগিয়ে এসেছিল এবং ঘৃণায় পেছনে
সরে গেছে। হাসানের মনে হয়েছিল যেন সে মেয়েটির সম্মুখে নিজেকে প্রকাশ করছে এবং এ বিষয়টি
তাকে দুঃখিত করে তুলেছে। যখন হাসান তাকে ইশারা করে, তখন সে কোনো জবাব দেয় না, বরং তার
পরিবর্তে সে বৃদ্ধা মহিলার ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করে।
সুতরাং, সে
নিজেকে বলল, এমনকি কীটপতঙ্গেরও অহংকার আছে।
মেয়েটির প্রত্যাখ্যান
তাকে ক্ষুব্ধ করছে।
সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে সে বুঝতে পেরেছে যে, তার মা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। সে জেনে বিস্মিত হয়েছিল
যে মেয়েটি এখন নামাজ পড়তে ও রোজা রাখতে শুরু করেছে।
একবার সে মেয়েটির
হাত ধরেছিল এবং জোর করে তাকে তার কাছে টেনে এনেছিল।
‘মোকাবিলা করার
জন্য আমার পর্যাপ্ত পরিমাণে দুর্দশা আছে’, মেয়েটি তার
হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় বলেছিল।
সে অনুভব করেছিল
যে, এই মাত্র মেয়েটি যা বলেছে, তা উভয়ের জন্যই সত্য।
‘আমারও তাই’, সে মেয়েটিকে
বলল। ‘আমাদের প্রত্যেকেরই
একে অপরের প্রয়োজন।’
সূত্র : চুল্লি,
অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা এবং পোড়া কপাল গল্প তিনটি ইংরেজিতে দ্য ওভেন, প্যারসিউট
এবং ব্যাড লাক গল্পের অনুবাদ। গল্পগুলো নোবেলবিজয়ী মিসরীয় কথাসাহিত্যিক নাগিব মাহফুজের
মৃত্যুর পরে প্রকাশিত (২০১৯ সালে) ‘দ্য কোয়ার্টার
: স্টোরিজ বাই নাগিব মাহফুজ’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। আরবি থেকে গ্রন্থটি
ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রজার অ্যালেন।