কুমার দীপ
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৬:৩৭ পিএম
একেবারে শৈশবে
কবির নাম জানার আগেই প্রচলিত প্রবচনের মতো বাংলার শিশুদের মুখস্থ হয়ে যায়Ñ ‘আয় ছেলেরা
আয় মেয়েরা, / ফুল তুলিতে যাই / ফুলের মালা গলায় দিয়ে / মামার বাড়ি যাই। / ... ঝড়ের
দিনে মামার দেশে / আম কুড়াতে সুখ / পাকা জামের শাখায় উঠি / রঙিন করি মুখ।’ তারপর একটু
বড়ো হলে তারা মুগ্ধ হয়ে স্কুল বইয়ে পড়েÑ ‘আসমানীরে দেখতে
যদি তোমরা সবে চাও, / রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। / বাড়ি তো নয় পাখির বাসা
ভেন্না পাতার ছানি, / একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। / একটুখানি হাওয়া দিলেই
ঘর নড়বড় করে, / তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে। / পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান
হাড়, / সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।’ এরপর প্রত্যেকটি
শ্রেণিতে একটি করে মনোমুগ্ধকর, মর্মস্পর্শী কবিতা পড়তে পড়তে যখন সে বড়ো হয়, বড়ো হয়ে
বড়ো বড়ো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বড়ো বড়ো আর জটিল সব পড়ালেখা আত্মস্থ করে বড়ো বড়ো সার্টিফিকেট
অর্জন করে বড়ো-ছোটো চাকরি পেয়ে সংসারজীবনে প্রবেশ করে, তখনও শৈশব-কৈশোরের সেই ‘মামার বাড়ি’, ‘আসমানী’ কিংবা ‘রাখাল ছেলে’রা মাঝে মধ্যে
হৃদয়ের আকাশে ভালোবাসার ঘুড়ি হয়ে ওড়ে। নিজেদের শিশুসন্তানেরাও যখন সেই পঙক্তিগুলোতে
মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুরণন তোলে, শৈশবস্মৃতিগুলো বসন্তের কোকিল হয়ে ‘কুহু’ ‘কুহু’ সুর তোলে।
একজন কবির অমরত্বের জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে?
‘ইংরেজি সাহিত্যের
প্রভাবে বাঙালির ভাষার শ্রী উল্টিয়া গিয়েছে। যেমন আজকাল দুধে ভেজাল, ঘিয়ে ভেজাল, মধুতে
ভেজাল, মেঠাইয়ে ভেজালÑ তেমনই এখন সাহিত্যে ভেজালের ছড়াছড়ি। এমন যে তিলোত্তমা, তাতেও
নাকি বেবেকার ভেজাল আছে। উর্ব্বশী পড়িতে পড়িতে হঠাৎ এ পিপ, সাইকিডিয়ান মনে পড়িয়া যায়।
ইংরেজি সাহিত্যে ইংরেজি সমাজ আমাদের বাঙলা সাহিত্য ও বাঙলা সমাজের গায়ে যে দাগ দিয়া
যাইতেছে, তাহা বড়ো স্পষ্ট এবং সময়ে কলঙ্কস্বরূপ।’Ñ ‘নক্সী কাঁথার
মাঠ প্রসঙ্গে’ আলোচনার শুরুতেই বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি গবেষক
ড. দীনেশচন্দ্র সেন এ কথা বলেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই বাংলা কবিতায় ইংরেজি সাহিত্যের
প্রভাব ন্যূন নয়। পাশ্চাত্য প্রভাবের দৌরাত্ম্যে একদা মৈমনসিংহ গীতিকার মতো একান্ত
স্বদেশি সৃষ্টিও অনেকদিন শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টির অন্তরালে পড়ে ছিল। এই পাশ্চাত্য মিশ্রিত
ভেজাল থেকে বাংলার মাটি ও মানুষের সৃষ্টি অনুসন্ধানের অসামান্য দিকপাল অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র
সেন ‘নক্সী কাঁথার
মাঠ’ পড়ে মুগ্ধ
নহৃদয়ে লিখেছিলেনÑ ‘এ যেন সেই পুরাতন পল্লীকে ফিরিয়া পাইলামÑ
সেই পল্লীর পথ-ঘাটÑ এ যেন কত চেনা হৃদয়ের দরদ দিয়া আঁকা।’ অন্যদিকে
‘নক্সী কাঁথার
মাঠ’ ও ‘রাখালী’ কাব্য পড়ে
ছোট্ট এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেনÑ ‘প্রকৃত কবির
হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে
পারে না।’ দুজনের কথাতেই
স্পষ্ট, নির্ভেজাল বা খাঁটি সাহিত্যের স্বাদ জসীম উদদীনের কবিতার অন্যতম উপচার।
বাংলা কবিতার
এক আশ্চর্য মায়াবী অধ্যায়ের নাম জসীম উদদীন। ছাত্রাবস্থাতেই মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যসূচিতে
নিজের কবিতা ঠাঁই পাওয়ার বিরল দৃশ্য অবলোকনকারী এই কবি ইংরেজশাসিত বাংলাদেশের ফরিদপুরের
জাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে প্রথমে ড. দীনেশচন্দ্র সেনের গবেষণাসহযোগী
ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। আরও পরে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সরকারের
তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে থিতু হয়েছিলেন। প্রায় কুড়িটি কাব্যের স্রষ্টা জসীম উদদীন বেশ
কয়েকটি নাটক, একটি উপন্যাস, একাধিক ভ্রমণকাহিনি ও স্মৃতিকথা এবং বেশকিছু গান লিখে গেছেন।
বাংলার গ্রামীণ জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ বেদনা, সুখ-দুঃখ ইত্যাকার অনুভূতিরাশিকে
সরল, সুন্দর, ছন্দময় ও সুরেলা ভাষায় চিত্রায়িত করে পাঠকহৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নিতে
সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। আজকের দিনের ছন্দ-তালহীন, অন্ত্যমিলশূন্য, হেঁয়ালিপ্রবণ উপরচালাকিনির্ভর
কবিতাচর্চাÑ সেই মায়াবী কাব্যজগৎ থেকে ঢের দূরে সরে এসেছে। বাংলা কবিতার চিরকালীন ছন্দ-গীতিময়
কাব্যগুণের বিপরীতে দাঁড়ানো এই সময়ে বসে জসীমউ দদীনের কবিতার পাতায় চোখ রেখে, আবারও
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে সেই সরল মায়ার গভীরে।
‘এই গাঁয়েতে
একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো, / মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো। /
রানতে বসে জল আনতে সকল কাজেই হাসি যে তার, / এই নিয়ে সে অনেক বারই মায়ের কাছে খেয়েছে
মার। / সান করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে / মুখের হাসি দ্বিগুণ ছোটে কোনমতেই
থামতে নারে।’ কিংবা ‘তুমি যাবে
ভাই – যাবে মোর
সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়, / গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়; / মায়া মমতায় জড়াজড়ি
করি / মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি, / মায়ে বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়, /
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়, / ছোট গাঁওখানি-
ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া, / কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া; / ঘাটের
কিনারে আছে বাঁধা তরী / পারের খবর টানাটানি করি; / বিনাসুতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার
ওপার দিয়া; / বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।’... এমন মতো
সহজ-সরল বর্ণনা অথবা হৃদয় বিদীর্ণ করা বিখ্যাত সেই ‘কবর’ কবিতার বর্ণমালাÑ
‘এই খানে তোর
দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে, / তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। / এতটুকু তারে
ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, / পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক। / এখানে
ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা, / সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
/ সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি / লাঙল লইয়া খেতে ছুটিতাম গাঁয়ে ও-পথ ধরি।
/ যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত / এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত
শত। / এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে / ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা
হয়ে গেনু দিশে।’... এসব এখন পুরানো দিনের গানের মতোই মোহজাগানিয়া।
সাধারণ হৃদয়কে সহজ-সরল আবেগের মায়ায় ভরিয়ে দিতে এইসব মরমী পঙক্তিমালার জুড়ি মেলা ভার।
বিশ শতকের
প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে বিবিধরকমের কোলাহল শুরু হয়েছিল যে-সব পত্রিকার পাতা ধরে,
তারই অন্যতম একটিÑ ‘কল্লোল’। এই ‘কল্লোল’-সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত কেবল জসীম উদদীনের কবিতা প্রকাশই করেননি, কবি সম্পর্কে লিখেছিলেনÑ ‘কবিতায় জসীম
উদদীনই প্রথম গ্রামের দিকে সংকেত; তাঁর চাষা-ভুষো, তাঁর ক্ষেত-খামার, নদী-নালার দিকে।
তাঁর অসাধারণ সাধারণের দিকে।... কোনো কারুকলার কৃত্রিমতা নেই, নেই কোনো প্রসাধনের পারিপাট্য।
একেবারে সোজাসুজি মর্ম স্পর্শ করবার আকুলতা।’ জসীম উদদীনের
আগেও বাংলা কবিতায় গ্রামীণ জীবন ছিল। যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস
রায়... এঁরাও মায়াময় ও মর্মস্পর্শী সব কবিতা লিখেছিলেন বাংলার গ্রাম্যজীবন নিয়ে। কিন্তু
তাঁদের ভাব ও ভাষায় নাগরিক আভিজাত্যের ছাপ ছিল স্পষ্ট। বলা যায়, শিক্ষিত ও শহুরো মানুষের
ভাষাতে অশিক্ষিত ও গ্রাম্য মানুষের জীবনের বিবরণ সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে। এঁদের বাইরে
জসীম উদদীনের সমসাময়িক কবিদের অধিকাংশই আধুনিকতার উদগ্র মোহে বাংলার গ্রাম্যজীবনকে
কবিতার বাইরে রাখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। সেদিক থেকে জসীম উদদীন একেবারে গ্রামের মানুষের
নিজস্ব ভাষাতেই বর্ণনা করেছেন তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনি। জসীম উদদীনের কবিকৃতী
নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ রচয়িতা ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বলা যায়Ñ
‘নাগরিকতার
মোহে লক্ষ্যভ্রষ্ট বাঙালিকে সেদিন তিনি পল্লীর গোষ্ঠগৃহের দিকে আকর্ষণ করার জন্য রাখালিয়া
বাঁশির সুরে আহ্বান জানিয়েছিলেন।’ ‘পল্লীর গোষ্ঠগৃহ’, ‘রাখালিয়া বাঁশি’Ñ এসবই কৃষিভিত্তিক
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের আবহমানকালের অনুষঙ্গ। বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি ইত্যাদি লোকগানে
এসব অনুষঙ্গই মরমি সুর তৈরি করেছে। বাংলা কথাসাহিত্যেও গ্রাম্যজীবন যথেষ্ট যত্নের সাথে
উঠে এলেও গীতিমুগ্ধ বাঙালির প্রাণ কবিতা-গানেই আনচান করে ওঠে। কিন্তু সেই কবিতা যে
আজকের অতি-স্বাতন্ত্র্যপ্রয়াসী কবিযশপ্রার্থীর ছন্দানুপ্রাসহীন হেঁয়ালিপূর্ণ ও অসামঞ্জস্যস্বভাবী
সান্ধ্যভাষা কিংবা অতি সরল গদ্যের নৈর্ব্যক্তিকতাশূন্য স্বয়ম্প্রকাশ নয়, তা বলাই বাহুল্য।
এই কথা পড়ে কেউ হয়তো বলবেন, আজকের যে-কবিতাকে এসব নিন্দে-মন্দ বলছি, সেই কবিতাও হয়তো
একদিন মানুষের মুখে মুখে থাকতে পারে। কেউ কেউ আবার জীবনানন্দ দাশকেও হাজির করে ফেলতে
পারেন, মৃত্যুর পরেই তিনি উত্তরোত্তর পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে। সেক্ষেত্রে আমি বলিÑ
জীবনানন্দ দাশকে জীবদ্দশায় সকলেই না জানলেও অনেক শিক্ষিত বাঙালি, বিশেষত বাংলা কবিতার
অভিজাত পাঠকেরা তাকে একেবারে চেনেননি, তা কিন্তু নয়। আর তিনিও যে কবিতার ছন্দ-অলঙ্কারসহ
সকল নান্দনিক অনুষঙ্গকে সঙ্গে নিয়েই কবিতার গভীরতর সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলেন, সে কথাও
তো বলা বাহুল্য। মনে রাখতে হবে, বাংলা কবিতা গীতিপ্রধান, ছন্দ-তাল-লয়, উপমা-উৎপ্রেক্ষা
ইত্যাকার শৈল্পিক সুষমাব্যতীত এই কবিতার মহাসড়কে কেউ অমরত্বের মাইলস্টোন হিসেবে এখনও
দাঁড়াতে পারেননি।
এই সময়ে বসে জসীম উদদীনের কবিতা পাঠ মানে পল্লীবাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া মাটি ও মানুষের মায়াময় জীবন-নদীতে পুনরায় স্নাত হওয়ার সুযোগ পাওয়া। তাঁর যে নায়কেরা কলমিফুলের নোলক কিংবা হিজল ফুলের মালা দেওয়ার কথা বলে তরুণীকে প্রেম নিবেদন করত, সেই নায়কের যুগ এখন আর নেই বললেই চলে। আজকের তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর অন্তর্জালিক জগতে সেটা আর হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু হারিয়ে ফেলা আপনজনের মতো, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নময় দিনগুলোর মতো স্মৃতিকাতর করে তোলে তাঁর পঙক্তিমালা। তৈরি করে সরল-সুন্দর এক মায়াবী পৃথিবী।