সাজিদ উল হক আবির
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৫:২০ পিএম
মুক্তিযুদ্ধ
ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এক বীরাঙ্গনার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা শাহীন আখতারের উপন্যাস তালাশের
মাঝের একটি দৃশ্য থেকে আলোচনা শুরু করা যাক। ওই দৃশ্যে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে
আটক তিন নির্যাতিতা নারীকে আমরা আবিষ্কার করি ক্যাম্পের দেয়ালে কান ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকা অবস্থায়। দেয়ালের ওপাশ থেকে তাদের কানে ভেসে আসে ঝুমবৃষ্টির শব্দ। দেয়ালের ভেজা
ইট-সিমেন্ট বালিতে তারা খুঁজে পায় ধোঁয়া ওঠা শিশিরের গায়ে জড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের মিষ্টি
ঘ্রাণ, মিষ্টিকুমড়ার মনমাতানো গন্ধ। এভাবে বর্ষা পেরিয়ে শরৎ আসে। ঋতু বদলায়। পাকসেনাদের
উপর্যুপরি ধর্ষণের ফলে পেটের মধ্যে টাইম বোমার মতো বড় হতে থাকে পিতৃপরিচয়হীন অনাগত
সন্তান। নির্যাতিতাদের কেউ কেউ মারা পড়ে বেঘোরে। কেউ আবার ন্যূনতম সুযোগে বেছে নেয়
আত্মহননের পথ। অল্প কিছু নারী খানসেনাদের পাশবিকতার চিহ্ন শরীরে ধারণ করে বেঁচে থাকে,
বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছাকে পুঁজি করে। সেই বেঁচে থাকা নারীরা, সমাজ যাদের গালভরে নাম
দিয়েছে বীরাঙ্গনা, তাদেরই আখ্যান, শাহীন আখতারের অসম্ভব সংবেদনশীল এ উপন্যাস, তালাশ।
দেয়ালে কান
পেতে রাখা অনুরাধা, মরিয়ম বা শোভা রানীর আদলে আমরাও কানের সঙ্গে এই বই চেপে ধরলে শুনতে
পাব প্রেমাসক্ত রমণীর খিলখিলে হাসি, প্রতারিত বিক্ষুব্ধ প্রেমিকার চিৎকার, ২৫ মার্চ
কালরাতের মর্টার-মেশিনগানের ঠা ঠা গুলি, ক্যাম্পে আটক বীরাঙ্গনাদের আর্তনাদ, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর
বাংলায় বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্রে সেলাই মেশিনের শব্দ, ’৭৫-এ সপরিবারে
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বীরাঙ্গনা পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা মেয়েদের হাঁড়িকুঁড়ি সব
রাস্তায় ছুড়ে ফেলার ঝনঝন আওয়াজ, ’৯২-এর ২৬ মার্চ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
মাইকে ভেসে আসা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঘোষণা, সব শেষে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর পাড় ঘেঁষে
যে পদ্মায় ভেসে চলা বীরাঙ্গনা অনুরাধার মরদেহস্পৃষ্ট জলের মৃদুমন্দ ধ্বনি।
বইটির ফ্ল্যাপে
উপন্যাসের সারাংশ হিসেবে লেখা আছেÑ ‘তালাশ উপন্যাসের
বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। সেসব মানুষ, যারা বিক্ষত, বিপর্যস্ত,
উন্মুল, অভিঘাতস্নাত, বিক্ষুব্ধ ও জেদি। তাদের খোঁজ পড়েছে যুদ্ধের ২৮ থেকে ৩০ বছর পরÑ
এ সময়ের পরিধিতে। তৎকালীন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের একজন সমাজকর্মী কিছু স্মৃতি টেবিলের
কাচের নিচে সংরক্ষণ করত। সেই সুবাদে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ’৭১-এর বীরাঙ্গনা
মরিয়মের ঠিকানাটা তার মনে থাকে, যা যুদ্ধের ২৮ বছর পর চলে আসে গবেষক মুক্তির হাতে।
সেখানে মরিয়ম আছে আবার নেইও। কারণ তার পেছন পেছন নয় মাসের গল্পগাথা ঢাকা ছেড়ে পদ্মা
পেরিয়ে চলে গেছে বহুদূর। মুক্তি সেদিকে পা বাড়ায়; মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকার, অনাবিষ্কৃত
পথে কাহিনি এগিয়ে চলে...’
বলাবাহুল্য,
বীরাঙ্গনা এবং ’৭১-এ যুদ্ধপীড়িত নারীদের আখ্যান হিসেবেই খ্যাতি
লাভ করা এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু কেবল নারীরা নন। ফ্ল্যাপের লেখা থেকে স্পষ্ট হয় যে
তালাশের রচয়িতা নিজেও চাননি কেবল যুদ্ধপীড়িত নির্যাতিত নারীদের গল্প হিসেবে তার এই
উপন্যাসকে পাঠ করা হোক। যে কারণে উপন্যাসের বিষয় কেবল যুদ্ধাক্রান্ত নারী নয়, বরং যুদ্ধাক্রান্ত
মানুষ। তবে উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রটি একজন নারী হওয়ায় উপন্যাস বর্ণনার দৃষ্টিভঙ্গিটা
নারীর। এক জীবনে কত বিচিত্র কায়দায় প্রতারিত হতে হয় নারীকে, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়
এই বইয়ে। শুধু নারী হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও যে নিপীড়নের
মধ্য দিয়ে যেতে হয় যুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের, সে সম্পর্কেও তালাশ তার পাঠককে সচেতন
করে তোলে।
শুধু নামে
নয়, যীশু মাতা মেরির আদলেই যেন তৈরি এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মরিয়ম, বা মেরি। ম্যাট্রিক
পরীক্ষা শেষ করে দূর সম্পর্কের এক পুরুষ আত্মীয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে আর ফুলতলী
গ্রামে ফেরা হয় না তার। বাবা-মা পাঠিয়ে দেন ঢাকার রায়েরবাজারে দুই কামরার বাড়িতে। সেটা
ষাটের দশকের শেষভাগ। তারপর ’৭১। তারপর যুদ্ধের ডামাডোলে একাকী মেরির
একের পর এক পুরুষের সঙ্গে নিয়তিকে জড়িয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা। নিয়তি, আফসোস, মেরির জীবনে
আবির্ভূত হয় কাঁচাখেকো অজগর রূপে। প্রথম প্রেমিক আবেদ জাহাঙ্গীরের প্রেমের বীজে গর্ভপাত
হয় ২৫ মার্চ কালরাতে। তারপর থেকে স্রেফ ভেসে চলা এখান থেকে সেখানে, আর্মিদের হাতে ধৃত
হওয়ার আগপর্যন্ত।
যেহেতু সে
দেবী বা দানবীÑ দুটির একটিও নয়, তাই যুদ্ধাবস্থায়, বা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পুরুষের
মাঝেই নিস্তার খুঁজতে বাধ্য হয়। আবেদ জাহাঙ্গীর থেকে শুরু করে, পাড়ার মাতব্বর হাজি
সাহেবের চামচা রমিজ শেখ, পাকিস্তান আর্মির মেজর ইশতিয়াক থেকে নিয়ে পার্কে বেশ্যাগমনকারী
মমতাজ, কবি পরিচয়ধারী আবেদ সামির থেকে নিয়ে নিয়তির চূড়ান্ত রসিকতাÑ সমকামী দেবাশীস।
এরই ফাঁকফোকরে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সংঘটিত সব সামাজিক সার্কাসের নগ্নরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
’৭১-এ রাজাকারবৃত্তির
ফলে ঢাকা শহরে হাতছাড়া হওয়া বাড়িগুলো পুনর্দখলের জন্য মেরির মামা নিজের প্রতিবন্ধী
ছেলের সঙ্গে মেরির বিয়ের পাঁয়তারা কষে ঢাকঢোল পিটিয়ে, পত্রপত্রিকার লোকজন ডেকে। বীরাঙ্গনার
শ্বশুরের সামাজিক পরিচয় যাতে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, তার পূর্বের পাপকর্মের। জীবন-জীবিকার
সন্ধানে মেরি যেখানেই যায়, সেখানেই ভূতের মতো তাকে তাড়া করে ফেরে তার বীরাঙ্গনা পরিচয়।
উপন্যাস শেষ হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আটক মেরির সঙ্গী অনুরাধার মৃতদেহের
তালাশে মেরির পদ্মা নদীতে নৌকা নিয়ে ভেসে পড়ার মাধ্যমে। এককালের পড়ুয়া, সংবেদনশীল,
কল্পনাপ্রবণ, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর অনুরাধার স্থান হয়েছিল দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীতে।
মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়মমাফিক ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল পদ্মায়।
মেরির জীবনের
মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় মেশার জন্য যুঝতে থাকা বীরাঙ্গনাদের সংগ্রাম উপন্যাসের প্রধানতম
ঘটনাপ্রবাহ। তবে একে ঘিরে লেখিকা বুনে চলেন স্বাধীনতা সংগ্রাম সংশ্লিষ্ট টুকরো টুকরো
আরও অনেক হৃদয়গ্রাহী আখ্যান, যার সবটা মিলে তালাশ উঠে দাঁড়ায় এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস
হিসেবে। উপন্যাসে আমরা জানতে পারি দেশ স্বাধীন হলে নির্যাতিতা বাঙালি রমণীদের ৩০ থেকে
৪০ জনের ছোট একটা দল পাকসেনাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তান
চলে যাওয়া এসব নির্যাতিতা নারীর মাতৃভূমির প্রতি এক প্রতিশোধ হয়ে থাকে, যে দেশ তার
কন্যাদের ওপর নির্যাতনকে স্রেফ নিজের জাতীয়তাবাদী অহমের ওপর আঘাত হিসেবেই বিবেচনা করেছে।
নির্যাতিতা নারীর জায়গায় নিজেকে স্থাপন করে তার কষ্ট কখনও বুঝতে চায়নি।
উপন্যাসে আমরা
আরও দেখি, পতিতাপল্লীতে ঠাঁই পাওয়া বীরাঙ্গনাদের খোঁজে বের হওয়া গবেষক মুক্তি, ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে
নির্যাতিত প্রথম যে নারীর খোঁজ পান, নাসিম বানু নামের সে মহিলা একজন বিহারি। যুদ্ধ
বা যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বাঙালিদের গণধর্ষণের শিকার হয়ে তার ঠাঁই হয় পতিতাপল্লীতে। আরও
জানা যায় যে, নির্যাতিতা বীরাঙ্গনাদের অনেকেই গর্ভপাত করাতে চায়নি। কিন্তু সরকারের
ইচ্ছা ছিল না পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের বীজে জন্ম নেওয়া শিশুদের দেশে রাখার। ওই নারীদের
ঘুম পাড়িয়ে তাদের পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে
শাহীন আখতার সন্তানসম্ভবা বীরাঙ্গনাদের এই দ্বিমুখী কষ্টের চিত্র অঙ্কন করেন।
শাহীন আখতারের
উপন্যাসে ভাষা নিজেই একটি স্বতন্ত্র চরিত্র হিসেবে উঠে আসে বরাবর। রূপক, প্রতীক ও অলংকারে
বেষ্টিত তার লেখার নিবিড় পঠন ছাড়া পাঠোদ্ধার দুরূহও হয়ে ওঠে ক্ষেত্রবিশেষে। বিশেষ করে
উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মৃত্যুর দৃশ্য লেখিকা অঙ্কন করেন মেটাফোর টেনে টেনে।
মেরির সদা ভীত ভাই মন্টু যখন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে পাকিস্তানি আর্মির সম্মুখীন
হয়, তাকে আমরা আবিষ্কার করি পতঙ্গের মতো আর্মি জিপের হেডলাইটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। ২৬
মার্চে গর্ভপাত ঘটা মরিয়মের জীবন রক্ষাকারী রমিজ শেখের নির্যাতন ও মৃত্যুর দৃশ্য বর্ণিত
হয় সিরাজ-উদ-দৌলা পালার রূপকে। মরিয়মকে আর্মি ক্যাম্পে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে সে আলেয়া
আলেয়া বলে চিৎকার করে ছুটে আসে, এবং পীঠে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। মরিয়মের মনে গভীর
দাগ কেটে যাওয়া সুরা-কবিতা ও নারী আসক্ত মেজর ইশতিয়াকের শেষ দৃশ্য রচিত হয় কারবালার
আখ্যানের অনুকরণে। নারী-পুরুষের সম্পর্কের টানাপড়েন বোঝাতে বারবার হাজির হয় সাপলুডু
খেলার উপমা।
তালাশে বর্ণিত
জলাধারগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী তাৎপর্যবাহী। উপন্যাসের শুরুতে গ্রামের বাড়ি ফুলতলীতে
যাওয়ার পথে মেরি-মন্টুকে আমরা আবিষ্কার করি সুন্দরীর জলা নামে এক কুখ্যাত জলাশয়ে দিকভ্রান্ত
হয়ে আতকা পড়তে। সেই জলার বদ্ধ পানিতে ঘুরপাক খাওয়া জীবনই বেছে নিতে হয় মেরিসহ সব বীরাঙ্গনার।
প্রবহমান নদীর মতো বহতা জীবনের স্বাদ নেওয়া হয় না তাদের। স্রোতস্বিনী পদ্মায় অবগাহনের
সুযোগ মেরিদের জীবনে একবারই ঘটে। অনুরাধার মতো পতিতাপল্লীতে আশ্রয় পাওয়া বীরাঙ্গনার
মৃত্যু হলে, তাদের শবের শেষ আশ্রয় হয় নদীর প্রবহমান স্রোতের ধারা।
নিঃসন্দেহে, তালাশ গত দুই দশকে রচিত বাংলা উপন্যাসগুলোর শ্রেষ্ঠতম একটি নিদর্শন। নিজগুণে এই উপন্যাস লেখিকাকে এনে দিয়েছে ২০২০ সালে এশিয়ান লিটেরারি অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৪ সালের ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’-এর মতো মর্যাদাদায়ক সম্মাননা।