উদয় শংকর দুর্জয়
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৫:১৩ পিএম
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:১৩ পিএম
একাকিত্ব,
বিষন্নতা আর নিপীড়িত জীবনের আলো-ছায়ায় ঘেরা প্রতিদিনের যে কলহ ঘিরে থাকে তা থেকে মুক্তির
জন্য মানুষ অন্য পথ খুঁজে চলে, হোক সে পথ কণ্টকাকীর্ণ অথবা বেদনাহীন। পালাতে চাওয়াটা
আসলেই তার মূল উদ্দেশ্য। আর পালাতে পারলেই কি বেঁচে যাওয়া যায়? জীবন থেকে কি আসলে পালানো
সম্ভব! প্রতিটি ছাপোষা জীবনের অলিগলিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে নিঃসঙ্গতার আবছায়া অন্ধকার।
হেনরি চার্লস বুকাওস্কি যখন নিঃসঙ্গতার একটি নাম দেন নীলপাখি, তখন পারিপার্শ্বিক মানুষের
আহত মনের জানালা খুলে বেরিয়ে আসতে চায় সে পাখি। কিন্তু কজন সবার করুণা দৃষ্টির বাইরে
সেই দুঃখকে লুকিয়ে রাখে, চেপে রাখে আজীবনের জন্য! বুকাওস্কি জীবনকে উপলব্ধি করেছেন
ঠিক উল্টোভাবে আর পাঁচজন যেভাবে করে না। তার পারিপার্শ্বিকতার দেয়ালে আঁকা সব চিত্রকে
ফাঁকি দিয়ে বেছে নিয়েছেন সাধারণ জীবন। তিনি অন্তর্দ্বন্দ্বে পরাভূত ছিলেন না কখনোই;
নিজস্ব বোধ-সত্তাকে বেঁধেছিলেন নিম্ন জীবনযাত্রার এক নিখাদ সাক্ষী হিসেবে। যেখানে ছিল
পরাজয়, বেকারত্ব, একঘেয়েমি, জীবনের অসাড়তা। আর এগুলোই ছিল তার লেখালেখির আলোচ্য বিষয়বস্তু।
তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো অধিকাংশই আত্মজীবন থেকে উঠে আসা সরলপথের অভিযাত্রী। তার তৈরি
চরিত্র এমন : কখনও বারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মদ গিলে পাঁড়মাতাল হয়ে নোংরা ফ্ল্যাটে
ফিরছেন, কখনও পোস্ট অফিসে চাকরি করতে গিয়ে জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না, কখনও
রেসের মাঠে জুয়া ধরে সব খুইয়ে ফিরে আসছেন, কখনও প্রকাশকের দেওয়া আরাম-আয়েশের প্রস্তাব
ফিরিয়ে দিয়ে আবার বারে ফিরে গিয়ে মদ গিলছেন, মারামারি করছেন, প্রেমিকের ঠোঁটে চুমু
খাচ্ছেন, মৃত্যুর রহস্য সন্ধান করছেন। তার রচিত সব উপন্যাসই তার জীবনের সফলতা আর বিফলতার
ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব।
২৪ বছর বয়সে
তার প্রথম ছোটগল্প ‘আফটারম্যাথ অবি এ লেন্দি রিজেকশন স্লিপ’ প্রকাশিত
হয়। দুই বছর পর দ্বিতীয় গল্প ‘টোয়েন্টি ট্যাঙ্কস ফ্রম ক্যাসেলডাউন’ ব্ল্যাক সান
প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় Portfolio: An Intercontinental Quarterlz ম্যাগাজিনের তৃতীয়
সংখ্যায়। সাহিত্যজগতের প্রথা ভাঙতে গিয়ে প্রকাশনা প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে
পড়েন এবং লেখালেখি থেকে প্রায় ১০ বছর হারিয়ে যান। তিনি এই দীর্ঘসময়কে মাতাল সময় বলে
আখ্যায়িত করেন। আর একটা সময় এই হারানো বছরগুলো তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি টের
পান জীবনের এক ভিন্ন মানে; অতীত সময়গুলোর সঙ্গে নিজেকে বোঝাপড়ার এক নতুন অধ্যায় খুঁজে
পান। লসএঞ্জেলেসের একটি পিকল ফ্যাক্টরিতে স্বল্পমেয়াদে কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সালের দিকে
শুরু করেন আমেরিকার ডাকবিভাগের কাজ। সেখানেও তিনি স্থির হতে পারেননি, অজানা কোনো কিছু
তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সারাক্ষণ। চাকরি থেকে বিদায় নেন; বাড়িতে অবসর সময় কাটাতে থাকেন।
এই অবসরের অজান্তে পাকস্থলিতে বাসা বাঁধে আলসার। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ফিরে নিজের
মধ্যে এক নতুন উন্মাদনা উপলব্ধি করেন। শুরু করেন কবিতা লেখা। ১৯৫৫-তে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ
হন; বিধি বাম সেখানেও বিঘ্নতা, তিন বছরের মাথায় সম্পর্কের ইতি টেনে দেন। বিধি যেন কিছুতেই
পিছু হাঁটতে চায় না, আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে ধরে যে, যেন এগিয়ে যেতে চায় পথিকের হাত ধরে।
বুকাওসস্কি আবার ফিরে যান তার পুরনো ডেরায়, মদ গেলা আর কবিতা লেখাই তার প্রধান কাজ
হয়ে উঠল। তাই তো তিনি লিখলেন-
‘আমার বুকের
মধ্যে একটি নীলপাখি আছে
সে বাইরে আসতে
চায়
কিন্তু আমি
তার জন্য খুব কঠিন,
আমি বলি, ওখানেই
থাকো, আমি কাউকে দেখতে দেব না।’
সাহিত্য যখন
হয়ে ওঠে উপভোগীয় জীবনের নির্যাস, যখন হয়ে ওঠে অনুলব্ধগত সময়ের স্বাক্ষর, তখন তা কখনও
কখনও দর্শন হয়ে ওঠে। জীবনের প্রাপ্তি অথবা ক্ষোভের সীমানার ওপার থেকে যে সূর্য উঁকি
দেয়, তার কিরণরশ্মির অববাহিকায় যে আখ্যান রচিত হয় তা মৌলিক না হয়ে পারে না। বুকওসস্কি
এবার গেলেন বাজি ধরতে হর্স রেসিংয়ের মাঠে, জীবনের বাজি নাকি জীবনে টিকে থাকার বাজি?
জুয়া খেলে কেউ কখনও সম্পূর্ণরূপে জিততে পারে না, অধিকাংশ সময় হেরে যেতে হয়। এখানেও
জীবনের চরম পরিস্থিতিকে সামলে নিয়ে ফিরে গেলেন তার সেই পুরোনো চাকরিতে, ডাকঘরে। এবারই
হয়তো তার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত হবে এই আশায়। সে আশার মূলে ঘি ঢেলে দিলেন ব্ল্যাক স্প্যারো
প্রেসের প্রকাশক জন মার্টিন, বুকাওস্কিকে
ফুলটাইম লেখালেখি করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। বুকাওস্কির বয়স তখন ঊনপঞ্চাশ, তিনি ভাবলেন
যদি ডাকঘরে এই চিঠি সাজানো- গোছানোর কাজ করি, তাহলে নিশ্চিত পাগল হতে আর কিছু বাকি
থাকবে না। আর যদি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে সম্পূর্ণভাবে নিয়ে নিই- তাহলে ভাত জুটবে না।
এটা মনে হয় শুরুতে সব লেখকের জন্য একটা ঝুঁকি থেকে যায়। আবার এটাও সত্য যে, সারা জীবনে
অনেক লেখকই তার লেখার মূল্য পান না। ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে না জেনেও বুকাওস্কি মার্টিনের
কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তবে মার্টিন তাকে কোনোদিন অভুক্ত রাখেননি। বুকাওস্কির সাহিত্যজীবনের
সবচেয়ে বড়ো কাজগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই ব্ল্যাক স্প্যারো প্রকাশনা থেকেই।
হেনরি চার্লস
বুকাওস্কি ছিলেন জার্মান আমেরিকান কবি এবং লেখক। ১৯২০ সালের ১৬ আগস্ট প্রুশিয়ার জার্মানিতে
জন্মগ্রহণ করেন, বেড়ে ওঠেন আমেরিকার লসএঞ্জেলেসে, এক সাধারণ পরিবেশে। সহজতর জীবনযাপনের
মাধ্যমে নিজেকে চেনার সুযোগ পেয়ে যান। তিনি দারিদ্র্য-পীড়িত-অবহেলিত আমেরিকানদের নিয়ে
লেখা শুরু করেন। তার লেখা পড়লে মনে হবে- তিনি আমাদের কথা বলছেন, আমাদের নিত্যদিনের
হালচালের কথা বলছেন, আমাদের চলাফেরার সঙ্গে যে খুঁটিনাটি প্রেম ও প্রণয় জড়িয়ে আছে,
সেসবের কথা বলছেন। তার অধিকাংশ লেখার মধ্যে উঠে এসেছে ক্ষুদ্র মানুষদের কথা, দারিদ্র্যের
কথা। তিনি সমাজের উচ্চস্তরের ভাব-বিলসাতাকে তোয়াক্কা করেননি। সমাজ এবং পরিবারের অভাব-অভিযোগ
থেকে যে অভিজ্ঞান লাভ করেছেন, তা থেকে তিনি সাহিত্যের ভাণ্ডারে অভাবনীয়ভাবে ঢেলে দিয়েছেন।
তার প্রথম উপন্যাস ‘পোস্ট অফিস’ প্রকাশিত
হয় ১৯৭১ সালে, যেখানে পুরোটাজুড়ে তার আত্মজীবনীমূলক ঘটনাপ্রবাহ উঠে এসেছে। ডাকবাহক
হিসেবে কর্মরত অবস্থায় আর্থসামাজিকতার যে টানাপড়েন রয়েছে, তা তিনি স্পষ্টভাবে বোঝাতে
সমর্থ হয়েছেন। হেনরি চিনাস্কি হচ্ছেন এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, যার উপস্থিতি
দিয়েই বুকাওস্কি নিজেকে তুলে ধরেছেন। বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করছেন, কাজের শেষে বারে গিয়ে
চুটিয়ে মদ্যপান করে বসায় ফিরছেন, মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তি করছেন। একজন স্বল্প আয়ের যুবকের
যে স্বল্প স্বপ্ন থাকে ঠিক তেমনি, যেন তার বেশি কিছু নয়। প্রায় সিংহভাগ লেখক- তারা
তাদের নিজস্ব সত্যিটাকে তুলে ধরতে চান না, পাশ কাটিয়ে লিখতে চান, পাঠকের মনের মতো করে
তৈরি করতে চান ঘটনার প্লট। বুকাওস্কি সেদিক থেকে একদম নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন। তিনি যে
সময়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে চালিত করছেন, তা তিনি কেন লুকিয়ে রাখবেন? মধ্যপ অবস্থায় স্ত্রীর
সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন, সাংবাদিকের কাছে ইন্টারভিউ দিতে দিতে কখনও সোফা থেকে স্ত্রীকে
লাথি দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। এটা যে একটা মানুষের সাংসারিক জীবনের প্রতিরূপ, সেটা কেউ
যদি না বলে তাহলে বাইরের কেউ তো জানতে পারে না। অকপটে তিনি সত্যকে সত্য বলেই ব্যক্ত
করেছেন তার লেখার মধ্যে। বুকাওস্কি তার পোস্ট অফিস উপন্যাসে এভাবেই বর্ণনা করেছেন-
‘We slept
without touching. We had both been robbed’ and ‘How the
hell do I know who zou are or. am or anzbodz is?’ ফিকশনের মধ্যে
যখন জীবনদর্শনের অনুসন্ধিৎসু উত্তর উঠে আসে তখন তা অপরিহার্য এবং মূল্যবান হয়ে ওঠে।
মানুষ কি সব সময় জানতে পারে সে কে? সে যখন নিজেকে চিনতে পারে না, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন
জেগে ওঠে পাশের মানুষটা কে, বা কী তার পরিচয়?
‘In the
morning it was morning and I was still alive.
Mazbe I’ll write
a novel, I thought.
And then
I did.’
কবি ডব্লিউ
এহিচ অডেনের কথা উঠে আসতে পারে এখানে। কবি ডব্লিউ এইচ অডেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত থাকাকালে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘কেন সে কবিতা
লিখতে চায়? যদি সে বলে তার কিছু বলার আছে, এই কারণে সে লিখতে চায়- তাহলে আমি বলব সে
কিছুতেই কবি হওয়ার আশা করতে পারে না। কিন্তু সে যদি বলে, আমি শব্দের চারিপাশে থেকে
শুনতে চাই তাদের কথন এবং অনুধাবন করতে করতে চাই তাদের রহস্য, তাহলে বলা যেতে পারে কাব্যকলার
মৌলিকত্বে তার একান্ত উৎসাহ রয়েছে এবং কবি হওয়ার স্বপ্ন সে দেখতে পারে।’ নিঃসন্দেহে
বলা যায় যে, পারিপার্শ্বিক সময় আর যাতনা বুকাওস্কিকে তাড়িত করেছিল তার লেখার জন্য।