স্মৃতি ভদ্র
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৪:৩৭ পিএম
আজকাল এক অদ্ভুত
সমস্যা দেখা দিয়েছে আমার। কতগুলো নিখোঁজ সংবাদ মাথায় বারবার এসে টোকা দিচ্ছে।
প্রতিদিন কত
নিখোঁজ সংবাদই তো পড়ি খবরের কাগজে। সেসব নিয়ে আমার কখনই কোনো সমস্যা হয়নি। হবে কেন?
খবরের কাগজে পড়া নিখোঁজ সংবাদগুলো তো আমার সঙ্গে সংযোগহীন।
তবে আমি আজকাল
যে নিখোঁজ সংবাদের সমস্যায় ভুগছি তা কিন্তু মোটেও খবরের কাগজে খুঁজে পাওয়া নয়।
সময়-অসময়ের
বালাই নেই, সুযোগ পেলেই নিখোঁজ সংবাদগুলো হুটহাট আমার সামনে এসে হাজির হচ্ছে। তাতেও
আমার খেদ থাকত না, যদি ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যেত।
প্রথম দিন
নিখোঁজ সংবাদ এলো ঘুমের ভেতর, এক অদ্ভুত স্বপ্নে। সাধারণত আমি খুব একটা স্বপ্নবাজ মানুষ
নই। তা সে ঘুমেই হোক বা জেগে থাকা অবস্থায়। তাই বলে ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখতে আমার নিয়ন্ত্রণ
থাকবে- এমন তো হতে পারে না। তবুও কেন যেন স্বপ্ন এসে আমার ঘুমে তেমনভাবে আঘাত হানত
না।
কিন্তু সেদিন
এমন হলো না। বহুকাল পর একটি স্বপ্ন এলো। আমার ঘুমের ভেতরেই এলো। স্বপ্ন দেখা কোনো বড়
ব্যাপার নয়। তবে আমি যে স্বপ্ন দেখলাম, সেটিই আসলে বড় কিছু হয়ে দাঁড়াল আমার জন্য।
স্বপ্নটি এমন-
আমি একটি রাস্তায়
হেঁটে চলেছি। যার দুই পাশে অসংখ্য হোল্ডিং বোর্ড। তাতে নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো।
প্রথম হোল্ডিংয়ে ঝোলানো একটি বইয়ের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবর। তাতে লেখা, আজ থেকে একান্ন
বছর আগের একটি বই হারিয়ে গেছে। বইটির কভার ছিল চামড়ার। বিশেষ এই বইটি হাতে লেখা, যার
সব হরফ একই মাপের…।
ঠিক এই জায়গায়
এসে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শেষরাতের স্বপ্নটি আমার ভাঙে আসলে শেয়ালের ডাকে। অথচ আমার ঘরটির
গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া আমগাছটায় অসংখ্য চড়ুইয়ের বাস। ভোর হতেই যাদের কিচিরমিচিরে অন্য
সবদিন আমার ঘুম ভাঙে। এজন্যই হয়তো স্বপ্ন নয়, শেয়ালের ডাকটাই মাথার ভেতর খোঁচা দিতে
লাগল অনেকটা সময়। আর সে খোঁচাতেই আমি খানিক সময় ভুলে গেলাম সেই স্বপ্নের কথা।
তবে সেদিন
দুপুরের পর স্বপ্নটি আবার ফিরে এলো আমার কাছে। আর তা ফিরল বেশ মহাসমারোহে। সাধারণত
তেমন কিছু করার থাকে না আমার দুপুরের পর। কখনো পুরোনো খবরের কাগজের পাতা উল্টাই কিংবা
কোনো বইয়ের। কিন্তু সেদিন কোনোটাই করতে ভালো লাগছিল না বলে চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবার
চেষ্টা করছিলাম। ঠিক তখনই অন্ধকারের ভেতর জ্বলজ্বল করে উঠল স্বপ্নের সেই হোল্ডিং। নিখোঁজ
সংবাদের খবরটি হুবহু আমার সামনে আবার চলে এলো। যেহেতু ঘুমের ভেতর ছিলাম না আমি, তাই
ভাবতে অসুবিধা হলো না। ভাবনায় প্রথমেই এলো স্বপ্নটির অভিনবত্ব।এতকিছু থাকতে বই হারানোর
বিজ্ঞপ্তি কেন কেউ দেবে? এরকম কোনো নিখোঁজ সংবাদ জ্ঞানত আমার দেখা নেই। এবার মস্তিষ্কে
জোর দিলাম আমি। পুনরায় স্বপ্নটিকে মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, সেটা বই হারানোর
বিজ্ঞাপনই ছিল। বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। নিজেকে বোঝালাম, আমি বই পড়তে ভালোবাসি, তাই স্বপ্নে
এমন এলো।
আমি স্বপ্ন
নিয়ে ভাবা তখন বন্ধ করে দিলাম।
কিন্তু এখানেই
শেষ হলো না বিপত্তি। এবার বিপত্তি স্বপ্ন থেকে এলো না। বরং এলো আমার ঘরের সামনে বেখাপ্পা
দাঁড়িয়ে থাকা একটি ইলেকট্রিক তারের খাম্বা থেকে। টু-লেট থেকে শুরু করে সন্ধান চাইসহ
নানা ধরনের বিজ্ঞপ্তিতে ঢেকে থাকা খাম্বাটি। স্বভাবতই সেসব আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি
আগে। কিন্তু সেদিন নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির নিচে হাতে আঁকা একটি বইয়ের ছবি আমার সব মনোযোগ
কেড়ে নিল। ঠিক যেন স্বপ্নে হোল্ডিংয়ে ঝুলে থাকা সেই নিখোঁজ সংবাদ। এবার আমি নড়েচড়ে
বসলাম। কিছু একটা ঘটছে আমার সঙ্গে।
স্বপ্নে অবাস্তব
অনেক কিছুই আসে, তাই বলে বাস্তবেও বইয়ের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি এলো। আর ঠিক কী কারণেই-বা
আমার ঘরের সামনেই বিজ্ঞপ্তিটা সাঁটা হলো? বেশ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে
ভাবতে বসলাম, স্বপ্নের বিক্ষিপ্ত অংশগুলো মিলিয়ে এই ধাঁধার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাইলাম।
মনে করার চেষ্টা করলাম বইটির কোনো ছবি স্বপ্নের হোল্ডিংয়ে ছিল কি না।
মনে করতে পারলাম।
না কোনো ছবি
ছিল না।
আবার স্বপ্নের
টুকরোগুলো জড়ো করে চেষ্টা করলাম নতুন কোনো তথ্য খোঁজার বা স্বপ্ন মেলাবার।
মনে পড়ল,
বইটির বিশেষত্ব হাতে লেখা হরফ।
সেই প্রথম
আবিষ্কার করলাম আমি স্বপ্নবাজ হয়ে পড়ছি। অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নের জন্য নিজের ওপর বিরক্তি
এলো। আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম, স্বপ্নটির ফিরে আসুক। আমি পুরো স্বপ্নটিই এবার দেখতে
চাইলাম।
এক রাত, দুই
রাত, তিন রাত…এভাবে বেশ কিছু রাত কেটে গেল স্বপ্নটি আর ফিরে এলো
না। এতদিন অপেক্ষা করার পর স্বপ্নটি আমার মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা। তা না হলেও
অন্তত ঝাপসা হয়ে যাওয়ার কথা। আর এদিকে ইলেকট্রিক খাম্বা থেকে নিখোঁজ বইয়ের বিজ্ঞপ্তিও
নিখোঁজ হয়ে গেছে। মাথায় টোকা দেওয়ার মতো আর কিছু থাকার কথা না এরপর।
কিন্তু এমন
হলো না।
সব হিসাবের
গরমিল করে স্বপ্ন আবার হাজির হলো আমার কাছে। তবে রাতের ঘুমে নয়। স্বপ্ন ফিরল ঝকঝকে
এক রোদের দিনে। সেদিন গরম একটু বেশিই পড়েছিল। সারা দিন দোকানে বসে সামনের খোলা মাঠের
দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এমনিতেই আমার দোকানে তেমন জিনিসপত্র নেই। তার ওপর হল্কা গরমের দুপুরে
কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া আসেও না। তাই হেলানো চেয়ারে বসে দেখছিলাম স্কুলমাঠের ছেলেগুলোকে।
সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেগুলো কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিনই আসে। ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের
করে হাতের আড়ালে। এরপর সবাই ভাগাভাগি করে ধোঁয়া টানে অনেকক্ষণ। আগে এই স্কুলমাঠে বাচ্চাদের
খেলতে দেখা যেত। এসব ধোঁয়াবাজদের কারণে মাঠ এখন ফাঁকাই থাকে বেশিরভাগ সময়।
আর কত দেখব
এদের? প্রতিদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যাবধি তো এদেরই দেখি। এক দল যায় আরেক দল আসে। সারা
দিন এসব দেখতে দেখতে চোখ বড় অভ্যস্ত আমার। তাই চোখে তন্দ্রামতো এলো। আর ঠিক তখনই দপ
করে ফিরে এলো স্বপ্ন। স্বপ্নে সেই একই রকম হোল্ডিং, একই রকম নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞপ্তি।
তবে বই নয়, বিজ্ঞপ্তি হলো শব্দের :
আজ থেকে ৪৪
বছর আগে ৫ জুন রোজ রবিবার কয়েকটি শব্দ হারিয়ে গেছে। শব্দগুলোর বয়স ছিল ১৬ বছর। যে বা
যারা শব্দগুলো লিখেছিল তারা যত্নের সহিত একই হরফে লিখেছিল শব্দগুলোকে। নিরীহ শব্দগুলোর
সঙ্গে জানামতে কারো কোনো বিবাদ ছিল না...
ঠিক এই জায়গায়
এসে আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেল। তবে স্বপ্নের ঘোর কাটল না। মনে হলো স্বপ্নটি তখনও আমার
চারপাশে ঘটে চলেছে। ঠিক তখনই দূর থেকে কিছু শব্দ ভেসে এলো আমার কাছে,
দখলদার এলো...
ভয়ে পালিয়ে গেল... হারিয়ে গেছে...
এরকম কিছু
ভাঙা ভাঙা শব্দ। মনে হলো, এই শব্দগুলোর জন্যই হোল্ডিংয়ে নিখোঁজ বিজ্ঞাপন ঝুলছে। আমি
এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে হোল্ডিং খুঁজি। হঠাৎ মধ্যবয়স্ক একজন লোক আমার সামনে চেঁচিয়ে
ওঠে-
ও ভাই, কখন
থেকে কথা বলছি আপনি শুনতে পারছেন না?
চারপাশের থম
ধরা বিকেলের হল্কা বাতাস গায়ে এসে ধাক্কা দিয়ে জানালো আমি আর স্বপ্নের ভেতর নেই। ওদিকে
লোকটি বলে চলেছে, আমার একটা ছাগল হারিয়ে গেছে। কালোর মধ্যে সাদা ছোপ ছোপ। মাঠে ঘাস
খেতে খেতে ওদের দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল মাঠ ছেড়ে। কোথায় যে গেল? আপনি দেখেছেন?
বুঝলাম, শব্দগুলোর
সঙ্গে স্বপ্নের কোনো যোগসাজশ নেই। তবে স্বপ্নের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে আমার যে একটা
যোগসাজশ তৈরি হয়েছে, তা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল। নয়তো স্বপ্ন দেখার পর প্রতিবার
আমার সামনে এরকম সত্যি সত্যি নিখোঁজ সংবাদ হাজির হওয়ার কথা নয়।
আমি তো তন্দ্রায়
ছিলাম, ছাগল হোক আর মানুষ কোনো কিছুই দেখিনি। তবুও কেন যেন মধ্যবয়স্ক লোকটির সঙ্গে
কথা আগাতে ইচ্ছা হলো, আপনার ছাগল ঘাস খাওয়া ছেড়ে হঠাৎ পালাতে গেল কেন?
লোকটির কণ্ঠ
বেশ চিন্তাযুক্ত ছিল, আগে এমন ভয় পেত না। যখন বাচ্চারা এই মাঠে খেলত প্রতিদিন বিকেলে,
তখন ছাগলটি একটুও ভয় পেত না। তবে যেদিন থেকে এদের আনাগোনা বেড়েছে, সেদিন থেকেই ছাগলটা
ভয়ে থাকে, ঘাসও খায় না ঠিকমতো। আজ আমি একটু অমনোযোগী হতেই ছাগলটা পালিয়ে গেল...
লোকটার তর্জনি
মাঠের ওসব ছেলেপেলের দিকে তাক করা। লোকটি বলে চলেছেন,
আচ্ছা, এরা
কারা? কেন এভাবে মাঠ দখল করে রাখে?
আমি একটু কেশে
গলা পরিষ্কার করলাম। আদার ব্যাপারী আমি জাহাজের খবর কেন রাখব?
না, কোনো সাদা
ছোপের কালো ছাগল দেখিনি বলে মধ্যবয়স্ক লোকটির সঙ্গে আলোচনার সমাপ্তি ঘটালাম।
খেয়াল করলাম
বাস্তবের নিখোঁজ সংবাদে আমি ততটাই নিরাসক্ত, যতটা আসক্ত স্বপ্নের নিখোঁজ সংবাদে। আমার
এই আসক্তি আরও বাড়িয়ে দিল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
রাতে দোকান
বন্ধ করার পর আমার তেমন কিছু করার থাকে না। ঘরে ফেরার আগে খানিক সময় ল্যাম্পপোস্টের
আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মাঠের এককোণে বসে থাকি। খোলা বাতাসে শ্বাস নেই খানিকক্ষণ।
তেমনই একসময় স্কুলের মাঠে খুন হয়ে গেল একজন পরিচয়হীন মানুষ। অন্ধকারে থেকেও আমি ল্যাম্পপোস্টের
আলোয় খুনি আর নিহত মানুষ দুজনকেই পরিষ্কার চিনে ফেললাম।
তবে আমি কাউকে
কিছু না বলে চুপচাপ অন্ধকারের ভেতর দিয়েই পালিয়ে গেলাম। তবে তাতে কোনো সমস্যা হলো না।
অপঘাতে মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে গেল আনজুমান মফিদুলের গাড়ি। আর কয়েক দিন পর এই ঘটনা
নিয়ে কানাঘুষোও বন্ধ হয়ে গেল সবার।
এমনকি সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে আমিও ভুলে গেলাম খুনি ওই মাঠে বসে ধোঁয়া টানা কোনো এক দলেরই সদস্য।
এ আর এমন কী?
আমিও সব ভুলে বেশ ভালোই থাকলাম কিছুদিন। তবে এই ‘কিছুদিন’ ফুরালো আবার
একদিন। না, না, এক দিন নয় প্রতিদিন। আমার ঘুমে স্বপ্ন আসতে লাগল এরপর প্রতিদিন। নিয়ম
মেনে খুনের ঘটনাটিই নানাভাবে স্বপ্নে আসার কথা। কিন্তু তা হলো না। বরং নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি
স্বপ্নে আসতে লাগল ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের।
তবে তা শুধু
ঘুম বা তন্দ্রাবস্থায় হলে না হয় কথা ছিল। তা না হয়ে এরপর একটু আনমনা হলেও আমি স্বপ্ন
দেখতে লাগলাম। কী অদ্ভুত শোনাচ্ছে তাই না? কিন্তু আমার সঙ্গে এমন অদ্ভুত ব্যাপারই ঘটতে
থাকল।
এই তো সেদিনের
কথা, দোকান খুলেছিলাম একটু দেরি করেই। আসলে আমার দোকানে এমন কিছুই নেই, যা মানুষকে
খুব আকৃষ্ট করে। বাবার আমলে শেষ মেরামত করা দোকানের কোনাকানচিতে খুঁজলে সেই আমলের জিনিসই
খুঁজে পাওয়া যাবে। ভাই-বোন দয়া করে দোকানের ভাগ নেয়নি, তাই অন্তত সারা দিন এখানে বসে
থাকতে পারি।
বসে বসে মানুষ
দেখি। দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেছে সামনে দিয়ে যাওয়া সবার চেহারা আর সবার যাওয়ার সময়।
খুব একঘেয়ে ব্যাপার। তাই মাঝেমধ্যেই আনমনা হয়ে যাই। এমন একসময়েই সেদিন কিছু দৃশ্য চোখের
সামনে ভেসে উঠল। তাকে স্বপ্ন বলে ভাবতাম না যদি না তাতে সেই একই রকম নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির
হোল্ডিং না থাকত। আমি দেখলাম :
আমি দুই পাশে
হোল্ডিংয়ে ঝোলানো একই রকম দুটো নিখোঁজ সংবাদ দেখলাম। তাতে লেখা, আজ থেকে ২৬ বছর আগে
শুক্রবার ভোররাতে বয়সি একজন লোক হারিয়ে গেছে। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির সাহসী লোকটিকে শেষবার
দেখা গিয়েছিল শুক্রবার দিনের বেলায়, যখন তিনি এলাকার কলেজমাঠে শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন
দেখাচ্ছিলেন সবাইকে...
হঠাৎ আমার
মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় আর আনমনে আসা হোল্ডিংগুলো হারিয়ে ফেলি। বয়স হয়েছে, নিউরোলজিক্যাল
কোনো সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রাতেও স্বপ্নের কারণে ঘুম ঠিকঠাক হয় না। ভাবনাগুলো
দিয়ে সাময়িকভাবে ঘটনার পক্ষে যুক্তি সাজালাম।
কিন্তু এখানেই
শেষ হলো না। আবার এলো, বারবার আসতে লাগল একই স্বপ্ন। স্বপ্নটির প্রভাব এমন হলো আশপাশের
সবাইকে সেই হোল্ডিংয়ে ঝোলানো নিখোঁজ সংবাদের সেই যুবক বলে মনে হতে লাগল।
এতে বিড়ম্বনা
আরও বাড়ল। একদিন গলির শেষ বাড়ির পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির নেতা টাইপের ছেলেটিকে বাড়ি
ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে বসলাম। আমার কাণ্ডে ছেলেটি অবাক বা বিরক্ত হলো। তবে আমাকে খুব
বেশি কিছু বলে সময় নষ্ট করল না, শরীর খারাপ আপনার, বিশ্রাম করুন।
শব্দগুলো বিদ্রুপ
মনে হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর ভাববো না স্বপ্ন বা আনমনে ভেসে আসা দৃশ্যপট
নিয়ে। বয়স্ক মস্তিষ্ক ভোগাচ্ছে খুব। সেসব ভেবে নিজের প্রতি বিরক্তি এলো। তবে আমার জন্য
আরও ভোগান্তি তখনও অপেক্ষা করে আছে। আমি যতই না ভাবি, যতই স্বপ্নকে অর্থহীন বলে দূরে
ঠেলি, ততই স্বপ্ন আমাকে গিলে খেতে লাগল। অবস্থা এমন দাঁড়ালো চেহারায় উষ্কখুষ্ক ভাব
ফুটে উঠল। দোকান খুলতেও ভুলে যেতে লাগলাম। সারাক্ষণ স্বপ্নে দেখা নিখোঁজ সংবাদের মানুষ
কিংবা বই অথবা শব্দগুলো খুঁজি।
এর মধ্যেই
সেই স্কুলের মাঠে ওদের আনাগোনা আরও বেড়েছে। খেলার মাঠে ওদের বাইরে সবার আসা বন্ধ হয়ে
গেছে। দোকান থেকে মাঠটিকে কেমন অচেনা লাগে এখন। আর এসবের মাঝেই আমি স্বপ্নগুলোর টোকা
থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছিলাম মনে মনে আজ সন্ধ্যায়। কিন্তু সে উপায় না এসে উল্টো এলো
স্বপ্ন। বীভৎস স্বপ্ন। দোকানে বসে ঝিমুচ্ছিলাম আমি। তখন এলো সেই স্বপ্ন : আমার সামনে
বড় একটি হোল্ডিংয়ে ঝোলানো মেয়ের ছবি। বীভৎস একটি ছবি। রক্তাক্ত অর্ধ উলঙ্গ একটি মেয়ের
ক্ষতবিক্ষত ছবি। তাতে লেখা, বায়ান্ন বছর বয়সি একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে, যার পরনে সবুজ
রঙের একটি কাপড়।
স্বপ্নের ভেতরেই
আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে আমার খুব চেনা লাগছে, তবে কিছুতেই স্মরণে আনতে পারছি না
মেয়েটিকে। দপ করে আমার ঝিমুনি ভেঙে গেল। খুব চেষ্টা করেও মেয়েটিকে চিনতে পারছি
না বলে বুকের ভেতর ব্যথা শুরু হলো। আর এ না চেনাই আমার মাথায় টোকা দিচ্ছে বারবার। এমনিতে
কোনো মেয়ের দিকে আমি সেভাবে আগ্রহ নিয়ে তাকাই না। কিন্তু এ সময় তাকাতে হচ্ছে। না, কারও
সঙ্গেই মিলছে না সেই হোল্ডিংয়ের মেয়েটা। অথচ মেয়েটিকে আমি চিনি।
এসব ভাবতে
ভাবতেই দোকানের এক কোণে জমিয়ে রাখা অনেক পুরোনো সংবাদপত্রে হঠাৎ করেই চোখ পড়ল। এসব
একসময় জমাতাম। আজকাল অবশ্য সংবাদপত্র পড়ে জমাই না, ফেলে দিই। কী ভেবে ধুলো ঝেড়ে সংবাদপত্রগুলো
হাতে নিতেই আমার মনে পড়ল মেয়েটিকে। মেয়েটি সন্তানসম্ভবা ছিল। দেখেছিলাম বর্ডারের
খুব কাছে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল মেয়েটি। পোড়া ক্যাম্পের পাশে অর্ধ উলঙ্গ মেয়েটির
নিম্নাংশে বেরিয়ে আছে একটি শিশুর রক্তাক্ত হাত। হ্যাঁ, হোল্ডিংয়ের মেয়েটিকে আমি চিনতে
পেরেছি। তাহলে স্বপ্নটি আসলে আমার অবচেতন মনের লুকিয়ে থাকা সেই ঘটনা থেকেই এসেছে। কোনো
উটকো কিছুও ঘটছে না আমার সঙ্গে। হিসাব মেলানোর আনন্দে আমি লাফ দিয়ে উঠি। আর ওঠার সঙ্গে
সঙ্গেই হুড়মুড় করে পড়েও যাই।
মনে পড়ল,
একাত্তরের নভেম্বরে বিরলের মুল্লুক দেওয়ানের খুব কাছে পাকিস্তানি আর্মির হেড
কোয়ার্টার আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম আমি, সেখানেই গ্রেনেডের আঘাতে বাঁ পা হারিয়ে গেছে
আমার।