× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

তলস্তয়ের ডায়েরি

আন্দালিব রাশদী

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৪:৩৩ পিএম

তলস্তয়ের ডায়েরি

ওলেগ ইউরিয়েভ লিখেছেন, বিশ্বসাহিত্যের প্রথম পপস্টার লেভ তলস্তয়। ভার্জিনিয়া ওলফ মনে করতেন, তলস্তয় ১৯১০ সালে মানবচরিত্র বদলে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, যখন মানুষের সম্পর্ক প্রভু ও ভৃত্যের, স্বামী ও স্ত্রীর, পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে পাল্টে যেতে থাকে, তখন একই সঙ্গে ধর্ম, আচরণ, রাজনীতি ও সাহিত্যেও মানুষের সম্পর্ক বদলে যায় (পিটার স্ট্যানস্কির আর্লি ব্লুমসবারি অ্যান্ড ইটস ইন্টিমেট ওয়ার্ক)।

পরিবার ও রাষ্ট্রের ঔদাস্য ও অসহযোগিতার পরও শতবর্ষ আগে তাঁর খবর নেওয়ার জন্য ইউরোপের গণমাধ্যম যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ইয়াসনায়া পলিয়ানাতে এসেছে, অখ্যাত আস্তাপোভো স্টেশনে ভিড় জমিয়েছে, এমনকি সদ্য আবিষ্কৃত মুভি ক্যামেরাও সঙ্গে এনেছে- সে সময় এমনটি কোনো লেখক কেন, অন্য কোনো সেলিব্রেটির বেলায়ও দেখা যায়নি।

তলস্তয় বিশ্বসেরা লেখক। তার কর্মকাণ্ড ঠাঁই দিতে ৯০ খণ্ড ছাপাতে হয়েছে। তিনি কাউন্ট, ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সৈনিক, নতুন ধর্মের প্রচারক, চার্চদ্রোহী ও রাষ্ট্রদ্রোহী, তিনি লাঙলের পেছনে হাঁটা নগ্নপদ কৃষক, তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠাতা : তিনি পেরেছেন জারকে কড়া চিঠি লিখতে; স্ত্রীর সঙ্গে কলহের খবর সবার জানা, চিয়ের্তকভ নামের সেক্রেটারির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে স্ত্রীর অনেক কথা শুনেছেন, এক জীবনে কৌমার্য বিসর্জন দিয়েছেন বারবনিতার কাছে, ভূমিদাসকন্যার সঙ্গে সহবাসে জন্ম দিয়েছেন একটি পুত্রসন্তান; যিনি জীবন কাটিয়েছেন ইয়াসনায়া পলিয়ানার কোচোয়ান হিসেবে, সমকালীন বড় লেখকদের সঙ্গে বিদ্বেষের সম্পর্ক, এমনকি তুর্গেনিভকে বন্দুকযুদ্ধে আহ্বান, নিপীড়িত দুখবোর সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য রেজারেকশনের সমুদয় সম্মানি অকাতরে প্রদান- এতসব ঘটনা এক জীবনে যিনি ঘটাতে পারেন, গণমাধ্যম তো তাঁকে তাড়া করবেই।

১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনটা ছিল আনন্দময়, কাব্যিক এবং নিষ্পাপ। বয়স যখন তাঁর সাত কিংবা আট তাঁর ইচ্ছা হতো আকাশে উড়বেন এবং তিনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, উড্ডয়ন অবশ্যই সম্ভব- মাটিতে বসে হাঁটু গেড়ে পায়ের গোড়ালি চেপে ধরতে হবে। এ চাপ যত বেশি হবে তত ওপরে ওঠা যাবে।

নিজের চেহারা নিয়ে বেশ হীনমন্যতায় ভুগছিলেন- আমি জানি আমি দেখতে ভালো নই, কাজেই আমার চেহারা নিয়ে কোনো কথা উঠলে আমি কষ্ট পেতাম। এমনও সময় আসত অথবা আমাকে দখল করে নিত, আমি ভাবতাম এ রকম বড় যার পুরু ঠোঁট, ছোট ধূসর চোখ এ নিয়ে পৃথিবীতে কখনও সুখী হওয়া সম্ভব নয়। আমি ঈশ্বরকে বলতাম, তুমি অলৌকিক কিছু একটা করে আমাকে হ্যান্ডসাম বানিয়ে দাও। আমার যা কিছু আছে এবং ভবিষ্যতে আমার যা কিছু থাকবে একটি হ্যান্ডসাম চেহারার বিনিময়ে আমি সব দিয়ে দেব। এসব কথা সরাসরি তাঁর ডায়েরি থেকে নেওয়া।

২৮ আগস্ট জন্মদিনে তলস্তয় লিখলেন :

আমি এখন ২৪, এখনও কিছুই করে উঠতে পারিনি। আমি মনে করি আট বছর ধরে আমার সন্দেহ ও আবেগের সঙ্গে অকারণে সংগ্রাম করিনি- তাহলে কী আমার নিয়তি? ভবিষ্যৎই তা বলে দেবে।

১৮৪৭ সালের মার্চে ডায়েরিতে লিখলেন : আমি অনেকটা বদলে গেছি, কিন্তু আমি শুদ্ধতার যে পর্যায়ে পৌঁছাতে চাই (আমার পেশায়) সেখানে এখনও পৌঁছাতে পারিনি। আমি যা সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করি, তা করতে পারি না। আমি যা সম্পন্ন করি তা-ও সম্পূর্ণভাবে করতে পারি না। আমি আমার স্মৃতির চর্চা করি না। এ কারণে আমি এখানে কতগুলো বিধি উপস্থাপন করছি যা অনুসরণ করলে আমার মনে হয় বিশেষভাবে উপকৃত হব।

১. আমি যত কিছুই করি না কেন যা নিজে থেকে নির্ধারণ করি তা আমাকে সম্পূর্ণ করতেই হবে।

২. আমি যা সম্পন্ন করি তা পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

৩. যে গ্রন্থের কথা আমি ভুলে গেছি কখনও তার সূত্র উল্লেখ করব না, বরং পুনঃপুন চেষ্টার মাধ্যমে তা স্মরণ করার উদ্যোগ নেব।

৪. সার্বক্ষণিকভাবে আমার মনের সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করার জন্য মনকে বাধ্য করব।

৫. সব সময় সজোরে সরব পাঠ ও চিন্তা করব।

৬. যারা আমার কাজের মধ্যে বাধা দিচ্ছে তারা যে বাধা দিচ্ছে এটা বলতে লজ্জাবোধ করব না। প্রথমে তাদের এটা অনুধাবন করাবার চেষ্টা করব, তাতে যদি কাজ না হয় (বাধা দেওয়ার ব্যাপারটা যদি না বোঝে) তাহলে ক্ষমা চেয়ে কথাটা খোলাখুলি বলে দেব।

তলস্তয় জুয়া ছেড়ে দিয়েছেন, বদলে গেছেন অনেকখানি, তাঁকে বড় কিছু অর্জন করতেই হবে। বদলে না গেলে বড় হওয়া যায় না, তলস্তয় সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়েছেন। সেনাজীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা বড্ড খারাপ।

৬ জানুয়ারি ১৮৫৩ সালে তিনি লিখছেন :

আহম্মক সব লোকজন। সবাই, বিশেষ করে আমার ভাই কেবল মদে চুর হয়ে আছে, এটা আমার জন্য সুখবর নয়। যুদ্ধ বড় অন্যায় এবং অমঙ্গলজনক। যারা যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা বিবেককে রুদ্ধ করে। আমি কি ঠিকপথে আছি? ঈশ্বর আমাকে জ্ঞান দিন, আমি ভ্রান্ত হলে ক্ষমা করুন।

ডায়েরিতে লিখলেন :

১৮-২০ জানুয়ারি (১৮৫৩) : আমার জীবন এতটাই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছে যে, আমি নিজেকে চিনতে পারছি না। এভাবে বেঁচে থাকতে আমি বড্ড লজ্জা বোধ করছি।

২৪ জানুয়ারি-১০ ফেব্রুয়ারি : আমার অনেক ঋণ। আমার হাতে যা আছে তার চেয়ে বেশি (জুয়ায়) হেরেছি। বাল্টাতে আমার বন্দুক হারিয়েছি। আগামীকালের পর থেকে আমি খেলা ছেড়ে দেব, আর অভিযান শেষ হওয়ামাত্রই ছেড়ে দেব ( সেনাবাহিনীর) চাকরি।

১৬ এপ্রিল : ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করুন। এই প্রথমবারের মতো ভয়াবহ বেদনা ও বিষণ্নতার অনুভূতি আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার অনুতাপ হচ্ছে কোনো আনন্দ ও সুবিধা আদায় না করেই আমার যৌবন অপচয় করে ফেলেছি।

তলস্তয়ের বয়স তখন ২৫ হয়নি; তিনি সরে আসতে চাইছেন তার অপচিত যৌবন থেকে।

৪-৭ মে (১৮৫৩) : ...আমাকে অবশ্যই একজন মেয়েমানুষ পেতে হবে। কামনার তাড়না আমাকে একদণ্ডের জন্যও স্বস্তি দিচ্ছে না।

৪-১৫ মে : ... সাত দিন আমি কিছুই করিনি; হার্ডিতে ছিলাম। কেবল মদ্যপান করেছি; বহুবার ভেবেছি আর পান করব না, ছেড়ে দেব।

১৫-২২ মে : একটি কসাক মেয়েকে দুবার উপভোগ করলাম। এটা ঠিক নয়। আমি নিজেকে অনেক নিচে নামিয়ে ফেলেছি। গল্পটা পরিত্যাগ করেছি, কৈশোর লিখতে শুরু করেছি। শৈশব রচনার সেই একই আগ্রহ নিয়ে। আমি আশা করি এটাও একই রকম ভালো হবে। আমার সব ঋণ শোধ হয়েছে। আমার সামনে খুলে গেছে উজ্জ্বল লেখক-জীবনের দরজা। ...আমি তরুণ ও বুদ্ধিমান। আমি আর কী চাইতে পারি। আমাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। আত্মসংযম চর্চা করতে হবে- তার পরও আমি চাইলে সুখী হতে পারি।

২৫ জুন : ...তাস খেললাম ও সুলতানকে হারালাম ( জুয়ায় হেরে তাঁর সুলতান নামের ঘোড়াটি দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন)। ... মেয়েরা আমাকে গোল্লায় নিয়ে গেছে। যতটা পারি নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে চেষ্টা করব, পরিশ্রমী হব, খেয়ালের বশে কিছু করব না। অশুভ কোনো কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ব না। ...শেষ দিকে আমি অনেক অশুভ কাজ করেছি। তুচ্ছ বিষয়ে প্রচুর ব্যয় করেছি, এতটা সময় নষ্ট করেছি যা অনেক ভালো কাজে ব্যয় করতে পারতাম। আমি অহংকার করেছি, ঝগড়া করেছি, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছি।

আমার জীবনের লক্ষ্য তো স্পষ্ট। তা হচ্ছে কল্যাণসাধন, আমার ভূমিদাস ও আমার স্বদেশিদের প্রতি দায়িত্ব পালন। এটি আমারই দায়িত্ব, কারণ প্রথমত আমি তাদের আমার বলে স্বীকার করে নিয়েছি, দ্বিতীয়ত আমার সেই মন ও মেধা রয়েছে।

(বহু আগে থেকেই) আমার চিন্তা ছিল নিজের জন্য একটি জীবন বিধিমালা প্রণয়ন করা। আমি সেখানেই ফিরে যাচ্ছি... আজকের সন্ধ্যা থেকেই, আমি যে অবস্থায়ই থাকি না কেন প্রতিদিন সন্ধ্যায় দিনের খতিয়ান নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি। ভুয়া লজ্জা সব সময়ই আমাকে বাধা দিয়েছে, আমি এখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাধা যতটা সম্ভব অতিক্রম করব।

রূঢ় মনে হলেও যা বলার সরাসরি বলব। শিশুসুলভ অপ্রয়োজনীয় খোলামেলা নয়, সবার সঙ্গে প্রাণখোলা হয়ে যাব। মদ ও নারী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করব।

(মদ ও নারীর) আনন্দ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও মেঘাচ্ছন্ন কিন্তু এর অনুশোচনা অনেক বেশি।

( সেদিনই তলস্তয় প্রচুর খেলেন, আলস্য থেকে ঘুমিয়ে পড়লেন, লেখা বন্ধ করলেন, অহংকার করলেন, কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই একজনকে অপমান করলেন এবং নারীসান্নিধ্যের জন্য লালায়িত হয়ে উঠলেন।)

২৬ জুন লিখলেন যে তিনি তার বিবেকের শাসন অমান্য করে চলেছেন। ...এই বাধ্যতামূলক রিপু নিয়ন্ত্রণ, আমার মনে হয়, আমাকে অস্থির করে রাখছে, কাজে বাধার সৃষ্টি করছে।

১২ অক্টোবর (১৮৫৩) : ডায়েরিতে আত্ম-আবিষ্কার। সাহিত্য চরিত্রায়ণ পড়ে তলস্তয়ের বিশ্বাস জন্মেছে :

...ক্ষমতা ও কাজের আগ্রহ বিবেচনায় আমি অবশ্যই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, আজ থেকে আমি তা-ই মনে করব। সকালে লিখলাম, কৈশোর এবং সন্ধ্যায় ও রাতের খাবারের পর দ্য ফিউজিটিভ

৪-৬ অক্টোবর : ...গত রাতটা কাটালাম একটি মেয়ের সঙ্গে। আমি ভয়ানক বিষণ্নতায় ভুগছি। আগামীকাল কাজে ডুবে থেকে এ বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করব।

৩১ অক্টোবর : পুশকিনের ক্যাপ্টেন দুহিতা পড়লাম। আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, হায়! পুশকিনের গদ্য এত পুরোনো ধাঁচের! কেবল ভাষাই নয়, যেভাবে গল্পটা বলা হয়েছে তা-ও... নতুন প্রবণতা হচ্ছে ঘটনার চেয়ে বেশি ঘটনার অনুভবের প্রাধান্য। সেদিক দিয়ে পুশকিনের লেখা খালি খালি মনে হয়।

এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, টাকা যে আমাদের জীবনপ্রবাহের অন্যতম প্রধান উপাদান আমরা সবাই সেই সত্যটি লুকিয়ে ফেলি। ব্যাপারটা যেন খুব লজ্জার। উপন্যাস হোক, কিংবা জীবনী কিংবা গল্প- এখানেই তারা টাকার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চায়। অথচ এর মধ্যে চিহ্নিত জীবনের সর্বপ্রথম আগ্রহ (যদি সর্বপ্রধান না-ও হয়ে থাকে, এটাই সবচেয়ে নিরবচ্ছিন্ন কারণ) আর এর মধ্য দিয়েই মানুষের চরিত্র সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়।

তলস্তয় তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উচ্চতা সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলেন যদিও বড় কোনো কীর্তি রেখে যেতে না পারা নিয়ে তাঁর আফসোসও ছিল।

যখনই একজন নতুন মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়, হতাশার একটি যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি লাভের অভিজ্ঞতা আমার ঘটে। আমি সেই মানুষটিকে আমার মতোই ভাবি এবং আমার প্রমিত মান প্রয়োগ করে তাকে পরিমাপ করি। এখন থেকে চিরদিনের জন্য এ প্রমিত মাপ বাদ দিয়ে আমাকে এই ভাবনার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে যে আমি অবশ্যই ব্যতিক্রমধর্মী, আমি আমার বয়সের চেয়ে বেশি এগিয়ে এবং আমি সেই মানুষদের একজন যাদের কারও সঙ্গে মেলে না, যাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না এবং যারা কখনও তৃপ্ত হয় না। আমাকে মানুষ পরিমাপের জন্য ভিন্ন একটি প্রমাণ মাপ (যা আমার প্রমিত মাপের নিচে)। ঠিক করে নিতে হবে। তাহলে আমার ভুলভ্রান্তি কম হবে। আমার বন্ধুরা আছেন যারা আমাকে বুঝতে পাবেন- এ ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজের সঙ্গে অনেক প্রতারণা করেছি। বাজে কথা। আমি এখনও এমন একজন লোকের দেখাও পাইনি যার নৈতিক মাপ আমার সমান...।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ও শিক্ষকদের সম্পর্ক তিনি কখনও উচ্ছ্বসিত ছিলেন না।

রুশ ইতিহাসের অধ্যাপক আইভানভ আমাকে সেকেন্ড কোর্সে পাস নম্বর দিলেন না (যদিও আমি একটি লেকচারও ফাঁকি দিইনি, এবং রুশ ইতিহাস আমার ভালোই জানা) কারণ আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া। যদিও জার্মান ভাষা আমার ক্লাসের অন্যদের তুলনায় ভালোই জানি। এই অধ্যাপকই আমাকে সবচেয়ে কম নম্বর দিয়েছেন।

১৮৪৮-এর এপ্রিলে লিখলেন :

কার্যত তেমন কিছু না জেনে কেবল দু-এক ঘণ্টা পড়ে পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য পরীক্ষায় বসলাম এবং প্রতিটি বিষয়ের জন্য মাত্র এক সপ্তাহ সময় ব্যয় করে অনার্সসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে পাস করে গেলাম।

যার পক্ষে পরীক্ষায় উতরে যাওয়া তেমন কোনো ব্যাপারই নয়, তিনি ডিগ্রি লাভের জন্য বাকি পরীক্ষাগুলোয় বসলেন না। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রকল্প বাদই দিয়ে দেন।

১৮৫১ সালের এপ্রিলের শেষে কদিন মস্কোয় কাটিয়ে তাই নিকোলাসের সঙ্গে ককেশাস চলে এলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। কিন্তু সম্ভোগ ও জুয়ায় তার দিন কাটছে।

২ জুলাই লিখলেন জুয়া খেলে নিজের ২০০ রুবল গুনেছেন, নিকোলেঙ্কার কাছ থেকে নেওয়া ১৫০ রুবল এবং ধার নেওয়া ৫০০ মোট ৮৫০ রুবল হেরেছেন।

২৫ বছর বয়সে তলস্তয় ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সৈনিক। তাঁর প্রিন্স গরচাকভের অধীনে কাজ করার কথা। কিন্তু পেলেন ভিন্ন আদেশ।

২২ মার্চ ১৮৫৩ : গতকাল শুনলাম আমাকে প্রিন্সের কাছে রাখা হবে না, অলটেনিওজায় আমাকে আমার দলের সঙ্গে যোগ দিতে হবে। (তিনি মাত্র কয়েক সপ্তাহ নিজের কোম্পানিতে কাজ করেছেন)। ...আমার বদলির কারণ আমি ব্যাটারি কমান্ডারের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম আর সেজন্যই আমার অহংকার লুটিয়ে দিল।

১৫ জুন তাঁর অনাচারের একটি সারমর্ম লিখেছেন : আমি বহু নারী ভোগ করেছি, মিথ্যাচার করেছি, অহংকার করেছি এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, আমার যেমন আচরণ আমি নিজে প্রত্যাশা করি সে রকম আচরণ করিনি।

৭ জুলাই লিখলেন :

আমার সবচেয়ে বড় দোষ আমার বিনয়ের অভাব। আমি কে? একজন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেলের চার সন্তানের একজন, সাত বছর বয়সে এতিম, অন্য নারী ও আগন্তুকের হাতে বড় হওয়া, সামাজিক কিংবা অর্জিত শিক্ষা ছাড়া ১৭ বছর বয়সে আমি নিজেই নিজের প্রভু; বড় কোনো সম্পদের অধিকারী নই। সামাজিক মর্যাদাও নেই, কোনো নীতিবোধও নেই; এমন একজন যে তার সবকিছুর চূড়ান্ত রকম কাজে ব্যবস্থাপনা করেছে। লক্ষ্যহীনভাবে নিরানন্দে সে জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো নষ্ট করেছে। ঋণ ও অন্যান্য বাজে অভ্যাস থেকে রেহাই পেতে সে ককেশাসে চলে এসেছে : বাবার সঙ্গে সেনা কমান্ডারের সংযোগ কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনী বদলি হয়েছে দানিউবের সেনা কোম্পানিতে; যার নিজের বেতন ছাড়া অন্য কোনো সহায় নেই (এ বেতনটাও আবার বাকি আর শোধ করতে শেষ হয়ে যায়), গুরুত্বপূর্ণ কোনো বন্ধু নেই, সমাজে তার কোনো ক্ষমতা নেই, কাজের ভাগ নেই, বাস্তব কর্মক্ষমতা নেই কিন্তু আছে আতিকায় উচ্চাশা। হ্যাঁ এটাই আমার সামাজিক অবস্থান। তাহলে দেখুন আমি কেমন!

৯ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৫৩ সালে প্রচণ্ড দাঁতব্যথায় ভুগছেন, এর মধ্যেই পড়েছেন আঙ্কল টমস কেবিন। এমন একটি সময়ে তিনি এ বইটি পড়েছেন যখন ভূমিদাসত্বের অবলুপ্তির আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে এবং তলস্তয় এর সঙ্গে গভীরভাবে সহানুভূতিশীল।

১৭ সেপ্টেম্বর লিখেছেন : খুব বাজে ব্যবহার করেছি, সন্ধ্যায় কিছুই করিনি, মেয়েদের পেছনে ছুটেছি। আমার নিজের সঙ্গে বিরোধিতা করে বাইরে বেরোচ্ছি।

২১ অক্টোবর তিনি লিখেছেন : জুয়া খেলে আমার সব টাকা হারিয়েছি।

১৮৫৫-এর ১৬ আগস্ট তলস্তয় কারনায়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, এতে সার্ডিনিয়ান কন্টিনজেন্ট মিত্রশক্তির সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। সেভাস্তপোল রক্ষার শেষ চেষ্টা বিফলে যায়।

তিন দিন পর তলস্তয় তাঁর ভাইকে লেখেন : আমি কিছুই করিনি, কারণ আমার মাউন্টেন আর্টিলারিকে গোলাগুলির জন্য আদেশই দেওয়া হয়নি।

১৮৫৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তলস্তয় আন্টি তাতিয়ানাকে লিখেছেন :

২৭ (আগস্ট) সেভাস্তপোলে বিশাল ও বিখ্যাত ঘটনাটি ঘটেছে। আক্রমণের দিনই আমার শহরে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল। ভলান্টিয়ার হিসেবে আমি কিছু অংশগ্রহণও করি। আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই, আমি আদৌ তেমন বিপদাপন্ন অবস্থায় পড়িনি।

২৪ (আগস্ট) আমার জন্মদিন। দ্বিতীয়বারের মতো এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ও শোকাবহ দিন। ১৪ বছর আগে এমন দিনে আলেজান্দ্রা ইলিনিশনা আন্টি মারা যান, আর এবার সেভাস্তপোলের পতন। যখন শহরটা আগুনে পুড়ছিল আমি কেঁদেছি, দুর্গে ছিল ফ্রেঞ্চ পতাকা, এটা সাধারণভাবে একটি দুঃখেরই দিন।

ক্রিমিয়া ও তুরস্কে অবস্থানকালে তিনি কখনও বই হাতছাড়া করেননি। এ সময় তিনি পড়েছেন : গ্যেটে, আলফোঁসকার, লার্মনটভ, পুশকিন, চার্লস ডিকেন্স, শিলার, অস্ত্রভস্কি, জর্জ স্যান্ড, হাইনরিখ হাইনে, থ্যাকারে ও বালজাক।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ফোর্থ ব্যাস্টিয়নের হয়ে বিপজ্জনক স্থানে অবস্থান করার সময়ও তলস্তয় লিখে গেছেন। সেভাস্তপোল অবরোধের সময় তিনি লিখেছেন সেভাস্তপোল ইন ডিসেম্বর ১৮৫৪ এবং সেভাস্তপোল ইন মে ১৮৫৫ এবং পতনের পর লিখেছেন সেভাস্তপোল ইন অগাস্ট। তিনি যদিও শক্তিশালী দেশপ্রেমের তাড়ণাতেই স্বেচ্ছায় সেভাস্তপোলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যুদ্ধকে কখনও গ্রহণ করতে পারেননি।  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা