ইমরান-উজ-জামান
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৪:২৮ পিএম
গেন্ডারিয়া
এক সময়ের ঢাকার গ্র্যান্ড বা বনেদি এলাকা। বাড়িগুলোর পরতে পরতে আছে ইতিহাস। এই গেন্ডারিয়াতে
আছে দীননাথ সেন রোড। দীননাথ সেন ছিলেন কালজয়ী নায়িকা সুচিত্রা সেনের শ্বশুর। এখানেই
ছিল তার বসতি। তার নামেই এই রাস্তার নামকরণ করা হয়। রাস্তার শেষ মাথা থেকে ডানে তাকালেই
চোখে পড়বে পুরোনো সময়ের আদলে গড়া লোহার গেটের একটি বাড়ি। বাড়ির সদর দরজার একপাশের দেয়ালে
পাথর খোদাই করে লেখা-
রওশন মঞ্জিল
১০২/এ, দীননাথ
সেন লেন
গেন্ডারিয়া,
ঢাকা
গেটের আংটা
ঘুরিয়ে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করতে করতেই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়! এ যেন বড়ো কোনো বারান্দা,
নয়তো কোনো জমিদারের বাংলো! অভূতপূর্ব বারান্দাওয়ালা বাড়ির সম্মুখে লাগানো নয়নতারা,
রঙ্গন, গন্ধরাজ ও নারিকেল গাছ মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। অন্য অনেক গাছের সঙ্গে বাড়ির দেয়াল
বেয়ে তিনতলা ছাড়িয়ে ছাদে উঠে গেছে জেসমিন ফুলগাছের লতা। উঠানের সিঁড়ি মাড়িয়ে বারান্দায়
উঠে গেলে মনে হবে কোনো জমিদারবাড়িতে এসে পড়েছি। তবে এটা কোনো জমিদারের বাড়ি নয়।
কাঠের চৌকাঠ
পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে স্টিল আর কাঠের বুকসেলফে, সারি সারি দস্তয়েভস্কি,
তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কিসহ নানা দেশের নানা লেখকের বই। দেয়ালে ঝুলছে বুকপকেটে কলম
আর দুই পাশে দুজন নারী এমন একটি ছবি। আছে একজন পুরুষের আবক্ষ ছবি, যা সাদা-কালো ফ্রেমে
বাঁধাই। বুকপকেটে কলম নিয়ে ছবির মানুষটি হায়াৎ মামুদের বাবা শামসের আলী। তার এক পাশে
হায়াৎ মামুদের মা আমিনা খাতুন; অন্যপাশে ফুফু সাবেরা খানম, যাকে হায়াৎ মামুদরা বেটি
বলে ডাকতেন। আর অন্য আবক্ষ ছবিটি তার ছোট ভাই মোস্তফা কামাল ইসমাইল। বাড়ির সবাই তাকে
মনু বলে ডাকত। আর বন্ধু-সহপাঠীরা ডাকত কামাল নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে
পড়তেন। একদিন ছবি আঁকতে বুড়িগঙ্গার পাড়ে গিয়ে পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। সেই সঙ্গে
পুরস্কার গ্রহণের ছবি ও ক্রেস্টও শোভা পাচ্ছে ঘরে।
হায়াৎ মামুদের এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা তার বাবা শামসের আলী। শামসের আলী ও তার বন্ধু শেখ হাবিবুর রহমান মিলে গেন্ডারিয়ায় জায়গা কিনে এই বাড়ি করেন। মূলত ১৯৬২ সালে শামসের আলী পরিবারসহ গেন্ডারিয়ায় চলে আসেন।
বাংলায় ১৩৪৬
সাল ১৭ আষাঢ়, ভারতের হুগলীর মৌরা গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন মনিরুজ্জামান, অর্থাৎ হায়াৎ
মামুদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তার নাম হয়ে যায় হায়াৎ মামুদ। হায়াৎ মামুদের বাবা
কবি না হলেও তার ছিল কবি-মন। তারই ছাপ পাওয়া যায় রওশন মঞ্জিলের প্রতি কোণায় কোণায়।
পিতার কাব্যপ্রীতি থেকে মনের রঙে রাঙানো এই বাড়িতে হায়াৎ মামুদ গড়ে তুলেছেন বইয়ের রাজ্য।
বাড়ির নিচতলায় দুইপাশে বারান্দা ও বাগান বেষ্টিত বসার ঘরে রয়েছে বই। হায়াৎ মামুদের
শোয়ার ঘরে বিছানার পাশঘেঁষে আছে বোঝাই করা বইয়ের সেলফ। চা টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, খাটের
কানিতে স্তূপ করে রাখা বই আর বই। সিঁড়ি মাড়িয়ে যেতে যেতে সিঁড়ির পাশে দেখা যাবে শিল্পাচার্য
জয়নুল আবেদীনসহ বিখ্যাত শিল্পীদের বাঁধাই করা ছবি। তিনতলায় আছে একটি লাইব্রেরি কক্ষ।
সারি সারি রাখা বইয়ের সেলফ, সাজানো আছে বইয়ের আকর। বারান্দাতেও তাই। ডাইনিংয়েও একই
চিত্র চোখে পড়ে। সিঁড়ি মাড়িয়ে তিনতলা ছাড়িয়ে গেলে আছে আরও একটি লাইব্রেরি। বাড়ির পুরো
ছাদকে সামনে রেখে চিলেকোঠার ঘরে এই লাইব্রেরি। এটাকে লাইব্রেরি না বলে বরং বইয়ের স্তূপ
বললেই যুক্তিযুক্ত হয়। নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে বই নেই।
বই, বই এবং বই- অজস্র বইয়ের সম্ভার রওশন মঞ্জিলজুড়ে। এমনকি রান্নাঘর ও ওয়াশরুমের দরজায়ও
বই সংরক্ষণের ব্যবস্থা। আলাদা দুটি লাইব্রেরি তো আছেই। বইপড়ুয়া মানুষের জন্য হায়াৎ
মামুদের বাড়ি বইয়ের এক স্বর্গরাজ্য। বলা যায় এমন কোনো বই নেই যা এই বাড়িতে নেই, তেমনি
এমন কোনো লেখক নেই যে এই বাড়িতে আসেননি। দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিকের স্মৃতিতে ভরপুর
এই বাড়ি। আর সেই স্মৃতির সিংহভাগজুড়ে আছে আড্ডা, খুকু আপার নিবিড় আতিথ্য আর পরিবারের
অন্য সদস্যদের আন্তরিকতা, হায়াৎ মামুদের প্রাণখোলা হাসি।
বাড়ির চিলেকোঠার
ঘরের সামনে বিস্তীর্ণ ছাদ। ছাদের চারপাশে সিমেন্টের থাম দিয়ে প্রাচীর দেওয়া। একপাশে
আছে নিচে থেকে বেয়ে ওঠা জেসমিন। সাদা চিরল পাপড়ির জেসমিনে সুবাস ছড়িয়ে চলেছে। চিলেকোঠার
ঘরের পাশঘেঁষে আছে লোহার সিঁড়ি; চাইলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যাওয়া যায়।
হায়াৎ মামুদ
যে ঘরে বসে আডডা দেন, তার বাবাও সেখানেই তার আড্ডার আসর বসাতেন। এলাকায় সমবয়সিরা আসতেন
বাবার কাছে। বাড়িতে এখনকার মতো তখনও কাজের মেয়ে ছিল। কাপের পর কাপ চা সরবরাহ করত। আড্ডা
দেওয়ার স্বভাবটা তিনি পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। এখনও আসে প্রকাশক, লেখক, ছাত্র, পড়শি,
বন্ধুবান্ধব। দেশি-বিদেশি স্বজন আর সাহিত্যপ্রেমীরা। এখন কাজের মেয়ের সঙ্গে স্নেহমাখা
হাতে চা-টা সরবরাহ করেন হায়াৎ মামুদের সহধর্মিণী খুকু। বড় আয়োজনে ছেলে সৌম্য হায়াৎও
সহযোগিতা করেন। স্ত্রী খুকু, ছেলে সৌম্য মামুদ, আর সৌম্যর স্ত্রী পলি, চার নাতি-নাতনি
দীপ্ত জামান, কুশল জামান, আদিত্য জামান ও মিলিত জামানকে নিয়ে এই বাড়িতে তাদের বাস।
মেয়ে লোপা মুদ্রা স্বামীর সঙ্গে থাকেন দেশের বাইরে। আর দোতলায় ভাই সিরাজুল ইসলামের
বাস। হায়াৎ মামুদের এই বাড়ি নিয়ে কিংবদন্তির মতো নানা গল্প ছড়িয়ে আছে সাহিত্যজগতে।
সেসব কিংবদন্তির সঙ্গে পরিচিত হতে হলে আর ঐতিহাসিক সব স্মৃতির সঙ্গে মেল ঘটানোর ইচ্ছে
হলে যেতে হবে গেন্ডারিয়ার রওশন মঞ্জিলে। এ যেন কোনো বাড়ি নয়, এ এক অনন্য বইয়ের মঞ্জিল।