আশরাফ উদ্দীন আহমদ
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৫৪ পিএম
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫৮ পিএম
চন্ডিপাড়ার
ভেতর দিয়ে বুজকাঁটার ঝোঁপের মধ্যেকার রেলগাড়ির লাইনের মতো সরু মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যায়
গঙ্গা। বুজকাঁটা ছাড়াও পথের দুপাশে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে অড়হর-শেয়াকুল-আকন্দ-বাবলা-সজনে-পিটালী-কলা-কড়ই-ঘোড়ানিম-জগডুমুর-খেঁজুর-তাল-নারিকেলসহ
বহু বৃক্ষজাতীয় ঝোপঝাড়। গঙ্গারাম এক সময় পায়ে পায়ে বিষ্ণুপুরের সড়ক ছেড়ে ওপাশে পরানতলীকে
পেছনে রেখে খালপাড়ের বাঁশতলায় এসে দাঁড়ায়। আর কয়েক কদম সামনেই মাধবদিয়ার মহাশ্মশান।
আজ ঘোর কালরাত্রি,
অমাবস্যা। এ অমাবস্যা আকাশের সোনার থালার মতো ঝলমলে রুপালি চাঁদটাকে গিলে খেয়ে অন্ধকারে
ভরিয়ে দিয়েছে। অন্ধকার ঝোপঝাড়ে কানাকানি করছে হাজার হাজার আলোকবর্তিকা জোনাকি মেয়েরা।
প্রকৃতি শান্ত নিস্তব্ধ এখন। কোথাও কারও সাড়া নেই। বৃক্ষরাজি প্রাণিকুল নিশ্চুপ। বাতাসে
কিসের এক শব্দ। শিশিরের শব্দ নাকি পাতার ওপর দিয়ে পোকামাকড় হাঁটার শব্দ। কান খাড়া করলে
আরও অনেক শব্দ দলবদ্ধ হয়ে পাখনা মেলে উড়ে আসে।
গঙ্গারাম জ্যোৎস্নাহীন
অনাবিল কালো অন্ধকারে প্রত্যক্ষ করে নিজেকে। আর প্রত্যক্ষ করে শ্মশানের সদ্য পুড়ে যাওয়া
মরার সংকুচিত একখণ্ড মাংসপিণ্ডে নেভানো ধোঁয়া। স্পষ্ট লক্ষ্য মরার চারদিক। এ মড়া সন্ধ্যের
ঠিকঠিক আগে পোড়ানো। চিমনির ভাটার মতো কালো আর ছাঁই রঙের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের
মেঘের দেশে মিলিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গার চোলাই খাওয়ার নেশা ক্রমশ কেটে যেতে থাকে। শ্মশানের
অশ্বথগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায় ক্ষণিক। বিশাল জটাধারী অশ্বথগাছের মাথায় কিসের একবিন্দু
আলো যেন খেলা করছে। অথবা ওই আলোটুকু থেমে আছে, আর সে কারণে গুঁড়ির কাছে এক আলো-আঁধারির
খেলা দৃশ্যমান হচ্ছে।
নিতাইয়ের কথা
স্মরণে আসে। সদ্য পেড়ানো মড়ার জ্বলন্ত ছাইয়ে গঙ্গাজল দিয়ে ভিজিয়ে তারপর সেই ভেজা ছাই
গামছায় নিতে হবে। সেই সঙ্গে মরার মাথার দিকের খানিক ভেজা মাটি।
গঙ্গারাম এবার
আর স্থির না থেকে নিজের কাজে লেগে যায়। নিমাই আবার ভয়ের কথাও আবছা বলেছেও, এ কাজ কিন্তু
বেশ কঠিন। বুকে সাহস সঞ্চয় করে করতে হয়। মাঝরাত্রের ব্যাপার, শ্মশানে ভূত-পেত্নী বা
অশরীরী আত্মা কিন্তু সহজে হাতছাড়া করবে না কাউকে নাগালের মধ্যে পেলে... সে কারণে সঙ্গে
আবার গরুর একটা হাড় এনেছে গঙ্গা। যেভাবেই হোক না, এই মারাত্মক কাজ তাকে যে করতেই হবে।
তাই সে আটঘাট বেঁধে এসেছে জীবন-মরণের তোয়াক্কা না করে। নিতাই গুণিন যা বলে তাই অক্ষরে-অক্ষরে
সে ফলিয়ে দেখায়। ছলচাতুরী কাকে বলে এসব ক্ষেত্রে সে সাধারণত করে না! এটা তার ব্যবসার
কারসাজি।
গঙ্গা জীবন
দিয়ে ভালোবাসে শংকর ধাঙড়ের মেয়ে পাখিকে। বাল্যকাল থেকেই পাখির সঙ্গে একটা মাখো মাখো
সম্পর্ক। তখন থেকেই পাখি ছিল শুধুমাত্র গঙ্গার। হাঁড়িপাড়ার ভেতর দিয়ে কালীমন্দিরের
পাশ কেটে যাওয়ার সময় পাখির জন্য আড় চোখে তাকিয়ে থাকত। কখন পাখি পাখনা মেলে এদিকে তাকায়
খানিক, তাতেই জীবন যেন সার্থক হয়ে যায়।
বুকের সরোবরে
কি একটা পাখি ডুবসাঁতার খেলে যায়! দিনমান টনটন করতে থাকে চোখের পাতা, চোখের ভেতর জ্বলে
ওঠে আগুনের শিখা। এবারই কটমটিয়ে চিবিয়ে খাবে বৈদ্যনাথের হাড়-মাংস। আর কোনো সুযোগ দেবে
না এজন্মে। অনেক বেড়ে গেছে আর সে কারণে একটু ঝেড়ে দিতেই হবে।
সামন্ত মণ্ডলের
মাথাটা এপার-ওপার করতে গিয়েই বড় বিপদ হলো গঙ্গার। কাজ হাসিল করার পর মনিব লালকৃষ্ণ
বাগদির আর পাত্তা নেই। শালা কোথায় গায়েব হয়ে গেল স্বেচ্ছায়। হাতেনাতে এভাবে ধরা পড়বে
তাই-বা কে আন্দাজ করেছিল। মনসা মন্দিরের বাস রাস্তায় যখন বলাকা এসে থামে, সামন্ত মণ্ডল
নেমে হাঁটতে হাঁটতে সাঁখরাইলের পূর্বের মেঠো রাস্তা ধরে যেতে থাকে।
আচম্বি ব্যানার্জিদের
বাঁশবাগানের ভেতর থেকে চকচকে কুড়ুল হাতে বেরিয়ে আসে গঙ্গা। সেদিনও ছিল অমাবস্যার বিদঘুঁটে
কালোরাত্রি। ঝলমলে পৃথিবীটাকে খেয়ে ফেলেছে অমাবস্যা। তারপরও সরু রাস্তা ক্রমশ স্পষ্ট
হতে থাকে সামন্ত মণ্ডলের চোখে। শহর থেকে বেলাবেলি ফিরে আসতে বড় দেরি হয়ে যায় বলে এতেই
ভোগান্তি। কয়েক মাস আগে চোখের ছানি কাটা হয়েছে বলেই না রক্ষে, দূরের জিনিস এখন বেশ
স্পষ্ট দেখা যায়। গঙ্গারামকে কাকতালীয়ভাবে দেখেই সামন্ত ভড়কে যায়। যেন ভূত দেখছে চোখের
সামনে। মুখ ফুটে কিছু বাক্য বের করার আগেই কানে ভেসে আসে ঝিঁ ঝিঁর ডাক আর বাঁশঝাড়ের
শোঁ শোঁ কট কট চিরাচরিত শব্দ। শুকনো বাঁশপাতার ওপর পোকামাকড় হেঁটে যাওয়া হতে পারে,
আবার তার পায়ের নিচে ভেঙে যাওয়া পাতার শব্দও হতে পারে। এক সময় গঙ্গা সমস্ত শক্তি দিয়ে
কুড়ুল মারতে থাকে সামন্ত মণ্ডলের শরীরে। ক্ষত-বিক্ষত সামন্ত মাটির বুকে চিতপটাং হয়ে
পড়ে যায়। রক্তের ঝরনা বইতে থাকে। অমাবস্যার কালো পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়েও গঙ্গা প্রত্যক্ষ
করে রক্তের স্রোতধারা। দূরে নাকি কাছেপিঠে কোথাও শিয়াল ডেকে ওঠে। রক্তপ্রবাহ থেমে যাওয়ার
পর সে মুখ ফিরিয়ে দক্ষিণ দিকের জটাধারী বুড়ো বটগাছের সাপে চলা সরু পথ ধরে হাঁটতে থাকে।
অলক্ষ্মীর মাঠ পেরিয়ে চাপড়িডাঙার খাঁড়ি জমিটার দিকে। শিয়ালের ডাকটা তখনও কানের মধ্যে
সিঁধিয়ে আছে। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে যাচ্ছে, নেশাটা বড় টানে এমন সময়।
অকস্মাৎ শামছু
চৌকিদারের একেবারে সামনাসামনি এসে পড়ে। নলহাটির ওদিক থেকেই সাইকেলে চেপে আসছিল সে।
এমন সময় শামছুকে দেখে গঙ্গা চুপসে যায় খানিক। কোনোভাবে নিজেকে আলগোছে সরাতে আপ্রাণ
চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সামন্তকে মারার সময় বুক ধড়ফড় না করলেও শামছু চৌকিদারকে একদৃষ্টি
দেখেই শরীরের সমস্ত রক্ত হিমশীতল হয়ে যায়। কোথায় যেন একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে আন্দাজ
করে তখন।
সকালে খুনটা
নিয়ে চারদিকে বেশ হৈ-চৈ পড়ে যায়। সন্দেহজনক অনেকের নাম মানুষের মুখে মুখে ঘোরেফেরে।
কিন্তু সবাই গা টেপাটেপি করে নিজেদের মধ্যে স্থির থাকে। হাঙ্গামায় জড়াতে কেউ সচরাচর
চায় না। সামন্তকে খেঁজুরের পাটিতে জড়িয়ে মুড়িয়ে ভ্যানে প্রথমে থানা, তারপর হাসপাতালে
পোস্টমর্টেমের জন্য চালান করে দেয়। গাঁয়ের লোকে নির্বাক হয়ে দেখে। এদিকে গঙ্গা সে রাত্রে
শামছুকে দেখেই গ্রাম ছেড়ে একেবারে পগার পার। সবার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, ওমন এক জ্বলজ্যান্ত
মানুষ কোথায় সিঁধিয়ে থাকল।
অবশেষে শামছু
থানায় ছোটবাবুর কাছে সমস্ত ঘটনা খোলসা করে বয়ান দেয়। সামন্ত মণ্ডলের খুনের একমাত্র
সাক্ষী শামছুর কথা শুনে দমে যায় লালকৃষ্ণ বাগদি । সাক্ষীসাবুদ শামছু সবিস্তারে জবানি
দেওয়ার ফলে অনেকটা আপনা থেকেই খোলসে ঢুকে পড়ে ইঁদুরের মতো। নিজের নাম প্রকাশ হওয়ার
আশঙ্কায় গঙ্গারামের পক্ষ না নিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে লালকৃষ্ণ। ভূমিকাহীন তাকিয়ে
থাকে অসহায়ভাবে কিছু কৌতূহলী মানুষের মতো। কিন্তু মনেপ্রাণে খুশিও হয়, চিরকালের শত্রু
সামন্ত, তার পথের অগ্রভাগ থেকে চিরকালের মতো নির্বাসিত হয়েছে আজ।
সাত মাসের
মাথায় গঙ্গারাম ধরা পড়ে এক রাত্রে। মাঘ মাসের শীতের রাতের অন্ধকারে নিজেকে জড়িয়ে গ্রামে
আসে মাকে দেখতে ও পাখির সঙ্গে কথা বলতে। পাখিটা তার প্রাণ। পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে
না, সাগর ছাড়া নদী, তেমনি পাখি ছাড়া গঙ্গারাম কীভাবে বাঁচে? খবরটা কে যে দিল গঙ্গা
ঘুণাক্ষরে টের পায়নি। এমন এক কারসাজি কে বা করতে পারে! সটকে পড়ার সময়টুকু পায়নি সে।
পাখিকে বাড়ি থেকে নিয়ে দক্ষিণের শেতলামন্দিরের পাশে ঝোপের মধ্যে যখন কথা বলছিল, অষ্টাদশী
বাঁকা চাঁদের শরীরের মতো পাখির শরীরের বাঁধনও খানিক খুলে গিয়েছিল। আদরে-আদরে ভরিয়ে
তুলেছিল তাবৎ শরীরের কাঠামো। শঙ্খচূড় যেন-বা ভাঙা মন্দিরের চাতালে। আচমকা থানার মেজো
বাবুর কণ্ঠস্বর গঙ্গার কানের পর্দা ভেদ করে। পাখি ডানা ঝাপটে তুলে দেয়, নাকি বুকের
গভীর সন্নিকটে টেনে উষ্ণ ওম দিয়ে পালকের মধ্যে সিঁধিয়ে নেয়, গঙ্গা একটুও বুঝতে পারেনি।
কেমন যেন একটা অঘটন ঘটে যায় চোখের সামনে। থানার পুলিশেরা ঘিরে ফেলে তারপর।
মনিব লালকৃষ্ণ
বাগদি গঙ্গার পক্ষ নিয়ে খালাসের ব্যাপারে সামান্যতম
চেষ্টাও করেনি । পাছে গ্রামের লোকের মধ্যে একটা কানাকানি পড়ে যায়। সে যে বরাবরই ইউনিয়ন
পরিষদের মেম্বার। গাঁ-গ্রামের দশজনের মাথা হিসেবেও মান্যগণ্য। থানার বড়বাবু-মেজোবাবু
পর্যন্ত হাতলওয়ালা গদি চেয়ার ছেড়ে দেয় কোনো কাজেকর্মে থানায় পা দিলে। অথচ সে কি না
গঙ্গার জন্য চেষ্টা-তদবির কিছুই করল না। সমাজের কানাঘুষোর ভয়ে নিজেকে একেবারে নিরপেক্ষ
রাখল। কাজ যখন হাসিল হয়ে গেছে তখন আর কি? নিশ্চুপ থাকাটাই উত্তম। কে বা সাতেপাতে থাকে
অসময়!
শামছুর প্রত্যক্ষ
জবানিতে গঙ্গারামের জেল সাজা হওয়ার পর, গঙ্গার মাথায় আরও একটা খুনের নেশা চাড়া দেয়।
আর তা হলো মুসলমান শামছুর মাথাটা চিবিয়ে খাবে ছাড়া পেলে। কিন্তু বারো বছর পর গ্রামে
ফিরে দেখে শামছু পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে কবে।
কৃষ্ণচূড়া
গাছের মাথায় অন্ধকার কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘন হয়ে আছে। গঙ্গারামের মাথা ক্রমশ খোলসা হচ্ছে
একটু একটু। জেল থেকে ফিরে এসে শোনে পাখিকে বিয়ে করেছে বৈদ্যনাথ ধাঙড়। প্রথমে ইচ্ছে
করছিল কুড়ুল দিয়ে একটা কোপ মেরে বৈদ্যনাথের ধড়-মুণ্ডু আলাদা করে দিতে। আগে শুয়োর চড়াত
বিলে-নর্দমায়, ডোবা-ভাগাড়ে নয়ানজুলি বা নালায়-ডাস্টবিনে। এখন থানার হাসপাতালে সুইপারের
চাকরি পেয়ে দেমাক বড়! সেই দেমাকে পাখির নরোম উষ্ণ বুকের উপর উঠে জাকামদানি। খচ্চরের
বাচ্চার আসল যন্ত্ররটাকেই সাবড়াতে হবে আগে। দেখবে ওখানে কত শক্তি!
মনিব লালকৃষ্ণ
বাগদির নির্দেশে সামন্ত মণ্ডলের শরীর থেকে প্রাণটা বের করেছে বারো বছর আগে। এবার বৈদ্যনাথের
যন্ত্ররটা কেটে আগুনে ঝলসে শিককাবাব বানিয়ে খাবে। ধড় থেকে মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন করে ফুটবল
খেলবে। প্রয়োজনে আরও বারো বছর কাটিয়ে আসবে চৌদ্দশিকেয়। লালবাড়ির মায়া সহজে যায় না!
এদিকে মনের ক্ষোভও যায় না কিছুতেই। সেদিন আবার গঙ্গা শুনেছে, পাখিকে কড়া শাসনে রাখে
বোকাচোদা। সুন্দরী বউ যদি তার মতো কালো কুচকুচে গন্ডারকে ছেড়ে পালিয়ে যায় অন্য কারও
হাত ধরে। সে চিন্তায় ছুঁচো পেরেশানে থাকে বোঝা যায়। ওদের গ্রামের সুরেন সাঁওতালের বউ
দুলন নাকি ভেগেছে জগন্নাথ কুমারের সঙ্গে। দুলন সাঁওতালের মেয়ে হলেও ওর চোখে-মুখে কিসের
এক মায়াবী পেলবতা ছড়িয়ে থাকত সবসময়। সেই টইটম্বুর রমণীয় সৌন্দর্যই জগন্নাথকে আর্কষণ
করত বড় বেশি। টাকি মাছের মতো ছটফটিয়ে নিজের পৌরুষ জানান দিত। দুই সন্তানের মা দুলনকে
নিয়ে পালিয়ে যায় কুমোরটুলিতে। ভালোবাসার টান বড় উন্মাতাল। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ বয়স কিছুই
মানতে চায় না।
বৈদ্যনাথের
মাথা কচ করে কেটে নিয়ে সরস্বতী নদীর মাঝ বরাবর ফেলে দিলে জগতের কারও বোঝার সাধ্য নেই,
কে ওমন কর্মটি করেছে। কিন্তু পাখির মন-প্রাণ কি পরিপূর্ণ পাবে আর? যদি কোনোদিন প্রকাশ
হয় পাখিকে পাওয়ার জন্য বৈদ্যনাথকে খুন করেছে গঙ্গা। আর তাই ওপথে পা না বাড়িয়ে একটু
ঘোরালো রাস্তায় হাঁটলে মন্দ নয়। নিতাই গুণিনের যাদুমন্ত্রর কখনও বিফলে যায় না। দারুণ
তার যশ-খ্যাতি! কত মানুষের মনস্কামনা পূর্ণ হলো নিতাই ওঝার মন্ত্র জাদুটোনায়।
সন্ধ্যের মুখে
বিদ্যাপতি রাজবংশীর ঠেকে গঙ্গারাম ঢুকে কয়েক বোতল বাংলা চোলাই গোগ্রাসে গিলেছে। টেম্পোওয়ালা
সাধুচরণ ঠাকুর বাংলা মদের সঙ্গে কষা মাংস খাচ্ছিল বেশ আয়েস করে ওপাশের বেঞ্চে। গঙ্গাকে
দেখেও না চেনার ভান করে শালা জোচ্চর! সাধুচরণ আগে লালকৃষ্ণ বাগদির আড়তে ম্যানেজারি
করত। সেই থেকেই গঙ্গার সঙ্গে আলাপ-সাক্ষাৎ। একদিন লালকৃষ্ণের ছোট মেয়ে নদীয়াকে নিয়ে
চম্পট দিল। কোথায় উধাও হয়ে থাকল কয়েকদিন! পরে অবশ্যই জানাজানি হয়, ওদের মধ্যে দীর্ঘদিনের
মন দেওয়া-নেওয়া চলছিল। মা মরা পদ্মপাতার মতো নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে শেষমেষ লালকৃষ্ণ
মেয়েজামাইকে চার মাসের মাথায় মেনে নেয়। গঙ্গারামের কৃতিত্বটা ছিল অবশ্য সবচেয়ে বেশি।
লালকৃষ্ণ একটা আড়তের মালিকানা দেয়, কিন্তু তাতেও নবাবপুতের মন বসে না। কিছুদিন যেতে
না যেতেই যেইকে সেই অবস্থা। ছুক-ছুক করে নতুন মাগীর কাছে যেত। এভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই
আড়তের ব্যবসা শিকেয় তুলে বসে। এবার লালকৃষ্ণ অন্য পথে নিয়ে যায় জামাইকে। হাজার হোক
মেয়েজামাই! ইচ্ছে করলেই তো আর পায়ে ঠেলে দিতে পারে না। আর তাই টেম্পো কিনে দেয়। কাঁচা
পয়সা যদি কোনো উন্নতির রাস্তা দেখাতে পারে এ এক ভরসা!
গঙ্গারাম পেট
ভরে চোলাই খেয়ে বিদ্যাপতি রাজবংশীর ঠেক থেকে যখন বাইরের দুনিয়ায় পা রাখে, তখন একেবারে
রাত্রি গভীর। কালো ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজেকেই চেনা দায়। ভেজা ছাই আর মাথার দিকের মাটি
গামছায় জড়িয়ে পেছন ফিরতেই আচম্বি আঁতকে উঠে দাঁড়ায়। একটা লম্বা পা রাঁধাচূড়া গাছে,
আরেকটা পা ওপাশের ডোবার দিকের অর্জুন গাছের নিচে ঝুলছে। আর হাত দুটো পাঁকাটির মতো ছড়িয়ে
রেখেছে দুদিকে। গঙ্গার বুক দুরুদুরু ভয়ে কাঁপছে। কি করবে এ মুহূর্তে কিছু ভেবে কূল-কিনারা
পায় না। মদের নেশা অনেক আগেই ছেড়ে গেছে। কিন্তু তারপরও শরীর তার কাঁপছে মৃদু মৃদু।
একচিলতে হাজামজা খাল, তার বুকেও কেমন একটু রেশমি আলো ফেলে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় গঙ্গার
বুক ভেদ করে বড় একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। আশপাশের গাছ থেকে লক্ষ্মীপেঁচা ডেকে ওঠে।
চোখের পলকে মনে হয় অমাবস্যা না যেন থকথকে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না চারদিক আলোকিত করে আছে।
কালো মিসমিসে পৃথিবীতে রুপালি আলো কে দিল বুঝে উঠতে পারে না। গঙ্গা চারপাশটা ভালো করে
পর্যবেক্ষণ করতে থাকে নিবিড়ভাবে। কোথা থেকে এত এত আলো মিছিল করে আসে। মনে একটু আতঙ্ক
অনুভূত হয়। শরীরের শিরা-উপশিরা সংকুচিত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে যে শ্মশানে মৃত মানুষের
পোড়ানো ধূসর ছাই দেখেছিল এখন সেখানে গনগনে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দাউ দাউ জ্বলতে দেখছে।
অকস্মাৎ প্রচণ্ড
বজ্রপাতসহ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আজকের বৃষ্টিতে সব ভেসে যাবে অনুমান করা যায়। গঙ্গারামের
সম্পূর্ণ শরীর অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। এখন সে সত্যিই কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না।
বহুদিন প্রকৃতির এমন বীভৎস রূপ দেখেনি। ভয়াবহ আর রাগী চেহারা দেখে সে ভয় পেয়ে যায়।
কখনও ভীষণ
গর্জন করে দূরে বা আশপাশে কোথাও বজ্রপাতে গঙ্গার কান ঝালাপালা ধরিয়ে দেয়। ক্ষণিকের
সে মৃদু আলোতে স্পষ্ট অবলোকন করে দুটো সড়ক দুদিকে সিধা নাক বরাবর চলে গেছে। সামনের
সড়ক পার হলেই মেছোবাজার। নাককাটি বাগানটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে মামলা চলছে কয়েক বছর ধরে।
রবি স্যাকরা জিতলে নাকি বাগানের চারদিকে আম-কাঁঠাল, লিচু-নারিকেলের গাছ লাগাবে। দক্ষিণ-পশ্চিম
কোণে বাঁশঝাড় করবে। গঙ্গাকে সেবার কথাটা বলেছিল রবি। বাগানের তদারকির দায়িত্বটা গঙ্গাকে
দিলে মাসকাবারে না হোক বছরান্তে কিছু পয়সা তার ভাঁড়ারে আসবে, শুনে মনটা ভালো হয়ে যায়।
তা ছাড়াও রবি স্যাকরার নয়ানতলী হাটের পাটের ব্যবসার দেখভালের কাজটা পেলেও বর্তে যাবে।
সে স্বপ্নে গঙ্গার মন টগমগ।
হতচ্ছাড়া বৃষ্টি
এজন্মে থামবে না মনে হচ্ছে। সামনের দিকে যেতেও পারছে না গঙ্গা। লম্বা পা দুটো এখনও
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের একনাগাড়ে ডেকে যাওয়া হুক্কা হু
হুয়া...উ..উ... সেই সঙ্গে ঝিঁ ঝি বা অন্য আরও দশটা পোকামাকড়ের একটানা মন্ত্রোচ্চারণ।
ক্রমশ গঙ্গার দুই পা জড়িয়ে আসে ভয়ে নাকি আড়ষ্টতায়, নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ নিজেই স্পষ্ট
শুনতে পারে না।
হঠাৎ গঙ্গারাম
দেখে পাখি যেন ডানা মেলে উড়ে আসছে অথবা দৌড়ে যাচ্ছে ওপাশের ন্যাড়া খালপাড়ের খাড়ি জমির
দিকে। শরীরের তাবৎ শক্তি বৃদ্ধি পায় গঙ্গার। ভয়ের রেশটা খানিক পাতলা হয়। তার সাধনা
মন্ত্র জাদুতে কাজ হয়েছে তাহলে। পাখি কি স্বামীর ঘর ছেড়ে এই বিদঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে
তার কাছে ছুটে আসছে! মুহূর্তে খানিক থম মেরে যায় গঙ্গা। মাথায় তার কিছু কাজ করছে না।
আচমকা পাখির ছুটে যাওয়ার দিকে দৌড় দেয় সে। ছুটতে ছুটতে এক সময় দেখে অনেক দূরে চলে এসেছে,
সামনে কোনো বাধা নেই। পাখির অস্তিত্ব কোথায় বুঝে উঠতে পারে না। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়াতে
থাকে কিছু সময়। অমনি টালমাটাল শরীর নিয়ে টাল খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। ভেজা মাটির মধ্যে
গড়াগড়ি দিতে থাকে গঙ্গা। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নিংড়ে নিয়েছে কেউ, শরীর অবশ এখন তার।
তৎক্ষণাৎ গঙ্গা
চোখ খুলে দেখে তার সামনে পাখি নয়, দাঁড়িয়ে আছে পাখির স্বামী বৈদ্যনাথ। রক্তচক্ষু দিয়ে
দেখছে, কখন থেকে এভাবে দেখছে বুঝে পায় না। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। এক সময় লক্ষ্য করে
বৈদ্যনাথের হাতে চকচকে একটা মস্ত হেঁসো নাকি ড্যাগার, আন্দাজ করতে সময় লাগে। পরক্ষণে
অনুভূত হয়, হেঁসোখানা নাকি ড্যাগারটি গঙ্গার বুকের পাঁজর বরাবর বিদ্ধ করে চলে যায়।
চিৎকার করতে পারে না। মুখে কেউ কি গামছা দিয়ে বেঁধে রেখেছে, নাকি গলার নলি আগেই কেটে
এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলেছে। গলা দিয়ে বিশ্রী শব্দ বের হয়। দূরে কোথাও শিয়ালের পাল ডেকে
ওঠে। এতক্ষণ শিয়ালগুলো কোথায় ছিল, ভাবতেই নিজের অনুভূতি আর কাজ করছে না বুঝতে পারে।
কঠিন গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে একটু একটু।
বৈদ্যনাথ হাসতে
হাসতে বাড়িমুখো হয়। ঘরের দাওয়ায় উঠে বেড়ার বাঁকারির গায়ে যন্ত্রখানা সযত্নে আটকে রাখে।
পাখি কাছে এগিয়ে এলে জানায়, আজ তোমাকে প্রচণ্ড আদর করব।
-আহা মরণ!
প্রতিদিনই তো তুমি লাগামছাড়া সোহাগ করো... সাধ মেটে না বুঝি...
-না, মেটে
না। আজ একেবারে অন্যরকম। এডাল্ড ছবির ভালোবাসাবাসির মতো বুঝলে!
-বুঝি তুমি
দিনে দিনে নতুন ষাঁড় হয়ে উঠছো।
-ষাঁড় বলো
না, বলো বুঁনো শুয়োর...
-মুখে দেখি
কিছু আটকায় না!
-আমি কি ধ্বজভঙ্গ
খাটাশ...
পাখি কিছু
বুঝে ওঠার আগেই আচমকা জাপটে ধরে পাঁজাকোলা করে চৌকির কাছে নিয়ে যায়। কানের কাছে মুখ
নিয়ে কি সব কথা বলে। পাখি না-হা না... না হা শব্দটুকু উচ্চারণ করে, উঠতি বয়সি তরুণীর
মতো একসময় খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। ওর হাসি অনেক দূর অবধি শোনা যায়। বৈদ্যনাথ মহাসমুদ্রের
ডুবুরি তখন। গোয়ালের গরুটা তখন হাম্বা-হাম্বা স্বরে ডাকতে থাকে। বাড়ির কুয়োতলার কুলগাছে
কি একটা পাখি ডেকে যায়। গাঁয়ের কুকুরগুলো এক জটলা হয়ে ঘেঁউ ঘেঁউ ডাকছে অনেকটা সময়।