শাদমান শাহিদ
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৯ পিএম
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫২ পিএম
দিন যত গড়ায়
অবাক হওয়ার মাত্রাও বাড়তে থাকে। মামুন কিছুতেই ভেবে পায় না, কীভাবে সম্ভব! তার পরও
তারা অনড়। কোম্পানির নির্দেশ আরও কঠিন করে তুলতে হবে পরিস্থিতি। যাতে কোনোক্রমেই বাইরে
যেতে না পারে, কোম্পানির সীমানায় পা রাখতে না পারে, তাদের চোখ সতর্ক। এসব কড়া পাহারা
অবশ্য শুরু থেকেই পালন করে আসছে। যেদিন থেকে কোম্পানি এখানে শাখা খুলবে বলে পরিকল্পনা
হাতে নিয়েছে, যেদিন থেকে প্ল্যান অনুসারে একের পর এক জমি অধিগ্রহণ শুরু করেছে তখন থেকেই
কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে মামুন টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স চোখকান খোলা রেখে
আসছে। চাহিদা অনুযায়ী জমি কবজায় নিতে যেখানে যাকে ব্যবহার করা দরকার, যেভাবে দরকার,
সেখানে সেভাবেই কাজ করে আসছে। শুধু এখানেই নয়, মোনরগঞ্জ শাখায়ও তাদের কম পরিশ্রম করতে
হয়নি। সেখানেও একটা ঘাড়মোটা ছিল। কোম্পানির কাছে কিছুতেই জমি বিক্রি করবে না। অন্যদের
অপেক্ষা দাম ১০ গুণ বাড়িয়েও কারও কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না, শেষে উপায়ান্তর
না পেয়ে কোম্পানি তার পাশের জমিটাকে পুকুর করে ফেলে। মোটা পাইপ দিয়ে পুকুর থেকে বালি
তুলতে তুলতে এমনই গভীর করে ফেলে যে, একসময় লোকটা বুঝতে পারে যেকোনো সময় তার জমিটা ধ্বসে
পড়বে। শেষে আর কোনো পথ না পেয়ে পানির দরে ছেড়ে যায়। এখানেও তারা ওটাই করত। তার আগেই
লোকটা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে পড়ে। ফলে সে শুধু শক্তই হয় না, আদালতের একটা রায়ও তার পক্ষে
আদায় করে নেয়। রায়ের ফলে লোকটা সপ্তাহে এক দিন বেরোতে পারে। ওই এক দিনই সে বাইরে বেরোয়।
কালচে ধরনের একটা বাজারি ব্যাগ হাতে যখন কোম্পানির করিডোর দিয়ে সিনা টান করে হাঁটে;
মামুন চেয়ে থাকে। যখন ফিরে আসে তার হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। ব্যাগে কোনো দ্রব্য
থাকতে পারে, মামুন তো মামুনই, কোনো পাগলেরও বিশ্বাস হওয়ার কথা না।
কখনও কখনও
ভাবে, লোকটা হয়তো একঘরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। কিছু কিনতে নয়, এমনিই বাইরে বেরোয়।
সপ্তাহে এক দিন সুযোগ পেয়ে বাইরের দুনিয়া দেখার লোভ সামলাতে পারে না। বেভোলার মতো হয়তো
এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। অথবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যায়, যারা কোম্পানির সঙ্গে ঝামেলায়
জড়ানোর জন্য বকাবকি করে। ‘ওরা বড়লোক। বড়লোকেরা হইল গিয়া দেবদেবীর
মতোন। তারা যা ইচ্ছা করতে পারে। দিনকে রাইত, রাইতকে দিন বানাইতে তাগোর একমুহূর্তও লাগে
না। আর তুমি হইলা গিয়া গরিব, ছা-পোষা। মাথা গুঁইজা চলার লোক। তোমার জন্য এইসব হিতে
বিপরীত কাম। এইসব ছাইড়া টেকা কটা বেশি লওন যায় কি না দেখো। বন্দের মাঝখানে একলা টিকতে
পারবা না, ছাইড়া দিয়া পাড়ায় চইলা আসো।’
হয়তো কোথাও
যায় না, বাজারেই যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়, পথে গিয়ে মনে পড়ে, ঘর থেকে টাকা
নিতে ভুলে গেছে। পকেটে টাকা নেই। দোকানদার বাকি দেবে না। এই দাম চড়ার দিনে কেউ বাকি
দিতে চায় না। ফলে কোথাও না যেয়ে উল্টো ফিরে আসে। মামুন লোকটার হাতের ব্যাগে যখনই তাকায়
এমন অনেক ভাবনায় জারিত হয়।
মাঝেমধ্যে
সে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে লোকটার বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি দেয়। চোখে পড়ে কতগুলো নিরীহ
মুখ। পরনে বসনগুলো যথেষ্টরকম মলিন। তাকানো যায় না। নিজের কাছেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা
হয়। ভেবে পায় না, এ কটা নিরীহ মুখের কাছে কোম্পানির হম্বিতম্বি কেন এত মিইয়ে পড়ে। লোকটাই
বা এত হিম্মত পায় কোত্থেকে! দু-তিন বিঘের বাড়িটার ভেতর মামুনের বিস্মিত চোখ ঘুরে বেড়ায়।
জায়গাটা ছোট বলেই হয়তো ফাঁক নেই কোথাও। যেখানে যা রোপণ বা বপন করার প্রয়োজন মনে হয়েছে,
তা-ই করেছে। পেছনের জমিটা ঢালু। মামুন ভাবে, সে হলে ওটাকে গোলবাগান করত। তাদের গ্রামে
গোলগাছের খুব কদর। গাবনা ফলের রস, রস থেকে তৈরি গুড় বিভাগীয় শহরে নিয়ে যেতে পারলে এক
বিঘে জমি থেকে বছরে লাখ টাকা আয় হয়ে যায়।
এখানে লোকটা
করেছে ধান, হয়েছেও বেশ। সামনে একচিলতে ফাঁকা জায়গা, ওটাকে উঠোন করতেই বোধহয় তার লাগোয়া
ছোট একটা ক্ষুদ্র পুকুর কেটেছে। পুকুরের ফুট ফুট শব্দই বলে দেয় মাছে ভরপুর। এক কিশোরীকেও
দেখা যায়। বোধহয় তার বড় মেয়ে। স্কুলে যায় না। সম্ভবত পড়াশোনায় তেমন ভালো না আর তার
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোম্পানির নিষেধাজ্ঞা। ফলে সে ফুরফুরা মনে বাড়িটার ভেতর ঘুরে বেড়ায়।
তরিতরকারির গাছগুলোর যত্ন করে, গরু-ছাগলকে স্নেহ করে, মাছ কুটে, শাক তুলে, ছোট ভাইবোনদের
সঙ্গে চড়ুইভাতি খেলে। মামুন চেয়ে থাকে তার মলিন ফ্রকে। ওখানে গোপনে বেড়ে উঠছে দুটো
শালগম। মেয়েটা কখনই তার দিকে তাকায় না। হয়তো মা-বাবার কড়া নিষেধ। হয়তো বলে রেখেছে মামুনরা
তাদের শত্রু। তাদের ভিটেটা গিলে ফেলতে চায়। পাহাড়িদের মতো তাদেরও ঠেলে দিতে চায় দিগন্তের
দিকে। যেখান থেকে প্রায়ই চিৎকার ওঠে, আর্তনাদ হাহাকার ওঠে। তাদেরও চিৎকারের ভেতর, হাহাকারের
ভেতর ঠেলে দিতে চায়। মামুনরা কোম্পানির লোক, শত্রু। শত্রুর দিকে হাত বাড়াতে নেই। শত্রুকে
বাড়িঘরের ফাঁকফোকর দেখিয়ে দিতে নেই।
মামুন বুঝতে
পারে, মেয়েটা বুঝে ফেলেছে সব। বুঝে ফেলেছে তার চোখের ভাষাও। হয়তো এজন্যই কদিন ধরে বুকের
ওপর একটা বাড়তি কাপড় পরে নেয়।
দুই.
একদিন রাতে
হঠাৎ খেয়াল করল, ওরা রাতে বাতি জ্বালায় না। বিদ্যুৎ নেই, তা তার অনেক আগ থেকেই জানা।
লোকটার বাড়িতে বিদ্যুৎ যাওয়ার রাস্তাও নেই। বিদ্যুৎ নিতে হলে কোম্পানির জায়গা ব্যবহার
করতে হয়, তা কখনই হওয়ার নয়। এমন ভালোবাসা কোম্পানি কখনই দেখাবে না।
বিষয়টা খেয়ালে
আসার পর থেকে রাতে যখনই ওদিকের জানলাটা খুলে দেখে চারদিকে ফরসা, মাঝখানে একটা কালো
স্তূপ। বিদ্যুৎ যখন নেই তখন কেরোসিনের কুপি বা একটা মোমবাতির আলো সে প্রত্যাশা করছিল,
দীর্ঘদিন খেয়াল করে দেখে, না, সন্ধ্যার পর থেকে কোনো প্রকার আলোই জ্বালায় না। তার মানে
তারা বেইলভাতা খেয়ে সন্ধ্যার লগবগই শুয়ে পড়ে।
এসব দেখতে
দেখতে তিন বছর পেরিয়ে যায়। একদিন বদলির আদেশ চলে আসে। অবশ্য মামুনও মনে মনে তা-ই চেয়েছিল।
দিন দিন নাবিলা হাঁপিয়ে উঠছে। পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হওয়ার পর থেকে তার আচরণ সহিষ্ণুতার
সব মাত্রাই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নাবিলার মা-বাবার কথা হচ্ছে, যেভাবেই হোক বদলি হয়ে মামুন
যেন নিজ জেলায় চলে আসে। তাহলে তারাও সময় সময় এসে দেখভাল করতে পারবে। মামুন যে এসব ভাবে
না, তা নয়। যখন ভাবে তখন নিজের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের মুখও এক এক করে ভেসে ওঠে। দূরে
থাকে বলে নিজের গ্রাম থেকে নিকট আত্মীয়স্বজনদের কেউ তেমন এখানে আসে না। যে কারণে কোম্পানি
থেকে প্রাপ্ত বেতনে কোনোরকম চলে যায়। তবে মাঝেমধ্যে কোথাও থেকে উপরি কিছু পেয়ে গেলে
বাবা-মার হাতখরচের জন্য পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এখন বদলি হয়ে যাবে নিজ জেলা শহরে। নিয়মিত
খরচা হয়তো বাড়বে না, তবে নিজ জেলা হওয়ার আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়া নিশ্চিত বেড়ে যাবে।
তখন ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে বাড়াতে হবে খাবারের মানও।
এসব ভেবেই
এতদিন কারও কথায় কান দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে আর দেরি করার জো নেই। একদিকে নাবিলার অবস্থা,
অন্যদিকে আসাদ জামান আর কামরুল আলম দুই সুহৃদ বদলি হয়ে চলে যাওয়ায় এখানে শূন্যতা তৈরি
হয়েছে। বলতে গেলে তার অবস্থা এখন ডাঙায় তোলা মাছের মতো, অবসরে আড্ডা দেওয়ার মতো কেউ
নেই। প্রাণ খুলে গল্প করার মতো কেউ নেই। যারা আছে তারা সবাই জুনিয়র। জুনিয়রদের কেবল
অর্ডার করা যায়। কারণে অকারণে মা-বোন জড়িয়ে গালি দেওয়া যায় অথবা ঘন ঘন ডেকে টেবিলের
ওপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। এর বাইরে জুনিয়রদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে নেই। তাদের
কোনো আবদার রক্ষা করতে নেই। জুনিয়র এসে বলবে, ‘স্যার, মার
অসুখ, হসপিটালে ভর্তি। অথবা বাচ্চাটার নিউমোনিয়া, বুকে নাকি সমুদ্রের ঢেউ। তিন দিনের
ছুটি লাগব।’ এসব কেবল শুনেই যেতে হবে, গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে
কাজে পাঠিয়ে দিতে হবে। এরপরও চাপাচাপি করলে তার চোখমুখের ভাষা বুঝে গল্পের ফাঁদ তৈরি
করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গল্পের প্রধান চরিত্রটা উত্তমপুরুষ হলেই ভালো। মন্ত্রের মতো কাজ
করে। সব জুনিয়রই বসের জীবনে ঢুকতে চায়। তাকে ঢোকার সুযোগ করে দিতে হবে। বলতে হবে, এমনি
এমনিই কি এই চেয়ারে বসেছি রে! এরচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি জীবনের ওপর দিয়ে গেছে। তারপর একটা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলতে হবে, একদিন আম্মা কলপাড় পড়ে গেল, ফোন দিল তোমার ভাবি, তখন
সে বাড়িত থাকত, বেতন কম, স্ত্রী নিয়ে কোয়ার্টার ভাড়া করে থাকার মতো অবস্থা ছিল না।
অন্য বাড়িতে তোমার ভাবি ছাড়া আর কেউ ছিল না, আব্বা গেছিল পটুয়াখালী শহরে। জমি নিয়ে
চাচাদের সঙ্গে মামলা। এমন বিপদেও বসের কড়া হুকুমÑ ‘কাজে যাও।
তোমার আম্মারে প্রতিবেশীর কেউ না কেউ হাসপাতালে নেবে। ওটা নিয়া ভাবাভাবির কিচ্ছু নাই,
কিন্তু চাকরি! চাকরি চলে গেলে ভাতের অভাবে মরবা, গোষ্ঠীসুদ্ধ মরবা। যাও, যখন তখন এসব
ধানাইপানাই নিয়া সামনে এসো না।’ এভাবে কত বসের লাত্থিওষ্ঠা যে খেয়েছি...
তোমার বেলায়ও আমার একই কথা। যাও। জীবনে উন্নতি করতে হলে এসব সমস্যা এড়িয়েই করতে হয়।
যাও, কাজে যাও। আল্লার ওপর ভরসা কর।
এভাবেই জুনিয়রকে
বুঝিয়ে দিতে হয়, কোম্পানিতে সে নিম্নপদস্থ কর্মচারী। ফলে মেন্দা মার্কা হলে মাথা গুঁজে
সামনে থেকে চলে যাবে, অন্যথায় কষে একটা লাথি মারবে চাকরির মুখে। তখন সিনিয়র হিসেবে
বাড়তি একটা সুবিধা পাওয়া যায়। কিছু লয়েটয়ে নতুন একজন নিয়োগ করা যায়। অর্থাৎ কোনোমতেই
জুনিয়রকে লাই দেওয়া যাবে না।
জুনিয়রদের
ভালোবাসা, আদর করা, সুখদুখের ছায়া করা চাকরির নিয়মে যেন এমনই অন্যায়। পাপ। তাহলে তাবৎ
দুনিয়ায় উপনিবেশ ভেঙে পড়ে। কোম্পানি ভেঙে পড়ে। হাভাতে পরিণত হয় উপনিবেশ পৃথিবী। এমন
সব কথার পর আর কথা থাকতে পারে না। মামুনেরও
কোনো কথা নেই। ওপর থেকে যা-ই অবতীর্ণ হয়, হুবহু তামিল করাই তাদের যত নড়নচড়ন। একঘরে
পরিবারটার সিদ্দতের কথা চিন্তা করে অনেকবারেই ভেবেছে, ইচ্ছে করলে সে একটু সহযোগিতা
করতে পারে। মেয়েটারে নাবিলার কাছে এনে অথবা নাবিলাকে তাদের ওখানে পাঠিয়ে দিতে পারে।
এতে উভয় পক্ষেরই সুবিধা। নাবিলাও কথা বলার একটা পরিবার পায়, অন্যদিকে তারাও নাবিলাকে
দিয়ে মেয়েছেলেদের পড়িয়ে নিতে পারে। এসব ভেবে যতবারই মনটা হালকা করার চেষ্টা করেছে,
ততবারই মন্ত্রে পাওয়া সাপের মতো ঝিমিয়ে পড়তে হয়েছে। চাকরিটা তার এমনই সম্পদ।
ফিরে এলো।
আসার আগে কেন জানি একটা দুষ্টবুদ্ধি চাপল মনে। একদিন দেখে লোকটা বাজারের ব্যাগহাতে
সন্ধ্যায় ফিরছে। মামুন তখন দুজন জুনিয়র নিয়ে পথ আটকে দেয়। বলদের ওলের মতো কুঁচকে থাকা
ব্যাগখানা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়। এরপর ঝেড়ে দেখে কাগজে মোড়ানো কেজিখানেক একটা লবণের টুবলা।
জুনিয়র দুজন কিচ্ছু না বুঝলেও মামুন বুঝে ফেলে। বুঝে ফেলে এটাই লোকটার একমাত্র দুর্বল
জায়গা। ওটা যদি সে ফলাতে পারত, তাহলে কোনো দিন বাড়ি থেকে বেরোত না। বেরোনোর দরকারও
পড়ত না।