স্বপন বিশ্বাস
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৪ পিএম
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৫৯ পিএম
নুড়ো গাছটা
বুড়ো হয়েছে। এখন আর সে গাছের যৌবন নেই। যৌবনকালের সেই ঝাঁকড়া পাতার বাহারও নেই। ডালে
ডালে নুড়ো ঝুলে থাকে। তার মাঝে মাঝে রঙিন ফিতে, সুতো, কাপড়ের আঁচল। দূর থেকে দেখলে
মনে হয় গাছে ফুল ফুটে আছে। ফুলের সঙ্গে পাখি। কান পাতলেই যেন কিচিরমিচির শোনা যাবে।
একসময় এ গাছে সবাই খড়ের নুড়ো বাঁধত। এখন কালে কালে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। সবাই
আর এখন খড়ের নুড়ো বাঁধে না। হাতের কাছে যা পায় তা-ই সই। নুড়োবাবা গত হয়েছেন বহুদিন
আগে। তাই তার নামে বহুরকমের গল্পও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনো এক রাতে নাকি তার আবির্ভাব
হয়েছিল এই শেওড়া গাছের নিচে। রাতটা অমাবস্যার নাকি পূর্ণিমার ছিল তা নিয়ে ভিন্নমত
আছে। তখন গাছের নিচে একটা খড়ের গাদা ছিল। তিনি ওই খড়ের গাদায় বসে থাকতেন। কেউ কাছে
এলে হাতে খড়ের নুড়ো ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করতেন ডালে বাঁধার জন্য। নিজেও বাঁধতেন। এ বিষয়েও
ভিন্নমত আছে। গাছের নিচে নাকি কোনো খড়ের গাদাই ছিল না। তিনি যখন রাস্তায় হাঁটতেন তখন
খড় কুড়িয়ে আনতেন। তিনি বেশ লম্বা ছিলেন নাকি বেঁটে ছিলেন, গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা ছিল
নাকি কুচকুচে কালোÑ এসব বিষয়েও দ্বিমত আছে। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত যে তিনি খুব একটা
কথা বলতেন না। বেশির ভাগই ছিল ইশারা। যা কিছু কথা বলতেন সে ভাষা মানুষ বুঝত না। তবে
কথা না বুঝলেও মানুষ নুড়ো বাঁধার মাহাত্ম্য বুঝে ফেলেছিল। নুড়ো বাঁধলেই নাকি মনের
আশা পূরণ হয়। কোর্টকাচারির মামলা জেতা যায়। খুনের আসামি ছাড়া পায়। বাঁজা বউয়ের পেটে
বাচ্চা হয়। বোবা ছেলের মুখে বোল ফোটে। নুলো পায়ে বল ফিরে পায়। অন্ধ মানুষ দৃষ্টি পায়।
অভাবের সংসারে আয় উন্নতি হয়। সেসব কথা বাতাসের আগায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ে এক গাঁ থেকে
আরেক গাঁয়ে। দলে দলে মানুষ আসে। নুড়ো গাছে নুড়ো বাঁধে। এসব কথা এখনও বিশ্বাসী মানুষ
বিশ্বাস করে। অবিশ্বাসীরা অবিশ্বাস করে। তারা বলে নুড়োবাবা ভিনদেশের মানুষ। এ দেশে
যুদ্ধ করতে এসেছিল। যুদ্ধ শেষে আর দেশে ফিরে যেতে পারেনি। ছাড়া পড়ে গেছে। সেই থেকে
মাথা খারাপ। কেউ বলে যুদ্ধের সময়ই মানুষ মারতে মারতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই আর ফিরে
যেতে পারেনি। কেউ কেউ বলে সে ছিল বিদেশি চর। পাগলের বেশ ধরে থাকত। গদাধর এসব বিশ্বাস-অবিশ্বাস
কোনো দলেই নেই। খালে বিলে মাছ মারে। জালে মাছ উঠলে মন ভালো হয়। বাজারে মাছ বেচে চাল-ডাল-আনাজপাতি
কেনে। জালে মাছ না উঠলে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয় ছোট মেয়েটার কথা ভেবে। ঘরে খাবার
না থাকলে মেয়েটা ভয় পায়। ভয় পায় তার মাকে নিয়ে। সংসারে অভাব দেখা দিলে গদাধরের বউটা
পাখি হয়ে উড়ে যায়। এ ঘটনাও সবাই বিশ্বাস করে না। তবে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী দুই পক্ষের
মাঝেই নানানরকম গল্প চালু আছে। বিশ্বাসীরা গদাধরের বউকে বেশ গুনিন বলে মান্য করে। তারা
বলে গদাইর বউটার ওপর দেবদেবতার ভর হয়। তা না হলে কি একটা জ্যান্ত মানুষ এভাবে পাখি
হয়ে যেতে পারে? বিশ্বাসী মানুষ বিপদে পড়লে যেমন নুড়ো গাছে নুড়ো বাঁধে, তেমন গদাধরের
বউয়ের কাছ থেকে ঝাড়ফুঁক, জল পড়া নিয়ে যায়।
গদাধরের শ্বশুর
জগাই হালদারের বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল। জমিজায়গা আছে। তাতে ফসল ফলে। বাজারে মাছের বড়
আড়ত। একমাত্র মেয়ে ফুলেশ্বরী। ফুলের মতোই সুন্দরী। মেয়েকে আট-নয় ক্লাস লেখাপড়াও শিখিয়েছিল।
শুধু মেয়ের এমন উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্য বড় ঘরে বিয়ে দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত গদাধরকে
পাত্র পেল। গদাধর মাঝেমধ্যে আড়তে মাছ দিত। মাঝেমধ্যে ফাইফরমাশ খাটত। একদিন হঠাৎই জগাই
হালদার বাড়িতে ডেকে আদর করে খাওয়াল। নতুন জামাকাপড় দিল। তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেয়ের
সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিল। ফুলেশ্বরীর এমন উড়নচণ্ডী স্বভাবের কথা গদাধর আগে থেকেই জানত।
তবু বিয়েতে আপত্তি করেনি। গদাধরের নিজের বলে তো কেউ নেই যে, বিয়ে নিয়ে মতামত দেবে।
বিয়ের খবর শুনে গাঁয়ের অনেকেরই হিংসা হলো। বলল, গদাই শালা এবার বড় গাছে নাও বেঁধেছে।
জগাই হালদারের রাজত্ব-রাজকন্যা সবকিছুরই মালিক এখন গদাই। কেউ বলল, জগাই হালদার কাজটা
ভালো করে নাই। গদাই ছেলেটাকে বোকা পেয়ে তার উড়নচণ্ডী মেয়েটাকে গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
তবে এই মেয়ে গদাইয়ের সঙ্গে থাকবে না। গদাইয়ের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে আবার কারও সঙ্গে
পাখি হয়ে উড়ে যাবে! গদাধর নির্বিবাদ মানুষ। এসব কোনো কিছু নিয়েই ভাবে না। ভাবতেও চায়
না।
বিয়ের পর বউয়ের
ইচ্ছায় আর শ্বশুরের সাহায্যে গদাধরের সংসারে কিছুটা জেল্লাই ফেরে। মা মারা যাওয়ার পর
গদাধর নিজে রান্না করে খেত। এখন বউ রাঁধে। বাসন মাজে। সকালে উঠোন ঝাড়ু দেয়। বিকালে
চুল বাঁধে। সন্ধ্যায় পিদিম জ্বালে। সেই পিদিমের আলোয় গদাধর বউয়ের মুখের দিকে অবাক চোখে
তাকিয়ে থাকে। ফুলেশ্বরী তার চোখের চাউনি আর অঙ্গভঙ্গিতে কত কিছুই বোঝাতে চায়। তারপর
একরাশ রাগ ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে মুখ ঝামটি দিয়ে পিদিম নিভিয়ে দেয়।
গদাধরের মেয়ে
কুনি মায়ের গলা ধরে শোয়। ফুলেশ্বরী মেয়েকে তখন ঘুমপাড়ানি গান শোনায়। আয় রে পাখি লেজ
ঝোলা, খেয়ে যা পাখি দুধকলা...। কুনি মাথা তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
তুমি যখন পাখি হও তখন কি দুধকলা খাও?
সেটা নির্ভর
করে কোন জাতের পাখি তার ওপর। কোন সময় মাঠে ঝরে পড়া শস্য খাই। ফুলে বসে মধু খাই। কোন
সময় পোকামাকড় ধরে খাই।
তাহলে তুমি
আর পাখি হবে না। ছি ছি পোকামাকড় কেউ খায়? ঘেন্না ঘেন্না। আচ্ছা মানুষ মরে গেলেও কি
পাখি হয়?
হয়তো! কাক
হয়। কিছুদিন বাড়ির আশপাশে ঘোরে তারপর উড়ে স্বগ্গে চলে যায়।
কাকেরা তো
নোংরা আবর্জনা খায়। তাহলে তুমি মরবে না। বল, মরবে না! মরলেই তোমাকে আবর্জনা খেতে হবে।
কেন? তুই কাকবলি
দিবি। আমি তো তখন কাকবলি খাব।
কাকবলি কী?
কাকবলি কি কোনো খাবার?
মানুষ মারা
যাওয়ার পর কাক হয়ে যখন বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়ায় তখন কাককে খাবার দিতে হয়। উঠানের মাঝখানে
বাঁশ পুঁতে বাঁশের মাথায় মাটির সরাতে চালের সঙ্গে দুধকলা মেখে কাকবলি দিতে হয়। দেখিসনি,
কালাচাঁদের মা মারা গেলে উঠানে চারটা বাঁশ পুঁতে কাকবলি দিয়েছিল।
গদাধর মা-
মেয়ের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই জাল নিয়ে ছোটে মাছ ধরতে।
রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। নুড়োতলার খালে জাল ফেলতেই পা পুঁতে গেল কাদায়। টান দিয়ে
পা তুলতে গিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া চটি জোড়া গেল ছিঁড়ে। বেশ কিছুদিন চটি পায়ে দিয়ে একটা
বাবুগিরি ভাব এসেছিল। চটিটার ওপর মায়া জন্মেছে। জালের রশি ছেড়ে কাদামাখা ছেঁড়া চটিটা
পরখ করে দেখল। দেখে নিজের ওপর বড্ড রাগ হলো। কী দরকার ছিল চটি পায়ে কাদায় নামা? শেষে
মনের দুঃখে চটি জোড়া ছুড়ে মারল রাস্তায়। ভোরের ফাঁকা রাস্তা জনমানুষ্যি নেই। মাঝেমধ্যে
দুয়েকটা খালি ভ্যানগাড়ি শহরের দিকে যাচ্ছে। দোকান খুললে মাল কিনে ফিরবে। আলাই মেম্বার
সে সময় নুড়োতলা দিয়ে হাঁটতে ছিল। নতুন ডায়াবেটিসের রোগী। চটি জোড়া হঠাৎ সামনে এসে
পড়ায় চমকে উঠেছিল। কিছুটা ভয়ও পেয়েছিল। খালের ধারে গদাধরকে দেখে রাগে মাথাটা চক্কর
দিয়ে উঠল। শালা জাইলির বাচ্চা গদাই, তোর এত বড় সাহস! চটি ছুড়ে মারিস। কিছুদিন আগে
হলে আলাই মেম্বার গদাইকে চটিপেটা করত। সেদিন নিজেকে সামলে নিল। হঠাৎ উত্তেজিত হতে ডাক্তারের
বারণ আছে। ডায়াবেটিসের সঙ্গে ব্লাড প্রেশারের ওষুধ খেতে হচ্ছে। রক্তনালিতে দুটো ব্লক
ধরা পড়েছে। তাই যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। ভালো মানুষের ঠান্ডা মাথা থেকে
যেমন ভালো বুদ্ধি বের হয়, তেমন খারাপ মানুষের ঠান্ডা মাথা থেকে আরও বেশি কুবুদ্ধি বের
হয়। আলাই মেম্বার চটিটা তুলে নিয়ে নুড়ো গাছের ওপর ছুড়ে মারল। পকেট থেকে মোবাইল ফোন
বের করে ছবি তুলল। তারপর ডাকল, ওই শালা গদাই, ওপরে উঠে আয়। তোর এত্ত বড় সাহস তুই আমার
সামনে নুড়ো গাছে চটি ছুড়ে মারিস!
মাছে লেবেন
কত্তা? দাঁড়ান, আর দুটো খ্যাপলা মাইরে লেই।
তোর মাছ মারার
সাধ আজ জম্মের মতো মিটায়ে দেব। তুই ওপরে উঠে আয়।
গদাধর জাল
রেখে কাঁচুমাচু মুখ করে আলাই মেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াল।
মেম্বার তার
হাতের মোবাইলটা ঘুরিয়ে গদাধরের দিকে তাক করল। গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
নুড়ো গাছে ওই চটি কার রে?
গদাধর মোবাইলে
ছবি তোলা দেখে মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল, ওই চটি তো আমার। রাস্তায় কুড়োয়ে পাইচিলাম।
তো, তুই নুড়ো
গাছে চটি ছুড়ে মারলি ক্যা? তোর এত্ত বড় সাহস! তুই জাইলির বাচ্চা হয়ে নুড়ো গাছে চটি
ছুড়ে মারিস। এই বুদ্ধি নিশ্চয় তোর শ্বশুরের দেওয়া। বাঁচতি চালি দোষ স্বীকার কর। বল,
তোর শ্বশুরের বুদ্ধিতে তুই এ কাজ করিচিস।
গদাধর ভয় পেয়ে
কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল, চটি তো আমি রাস্তায় ছুড়ে মারলাম। চটির কি পাখা গজাল? চটি
গাছে উঠল কীভাবে?
চটির পাখা
গজায়নি, হারামজাদা। তোর পাখা গজিয়েছে। তোর পাখা কীভাবে ভাঙতে হয় দেখাচ্ছি দাঁড়া। একটা
মিথ্যা কথা বলবি না। আমি সাক্ষী। আমার চোখের সামনে তুই নুড়ো গাছে চটি ছুড়ে মেরেছিস!
এই ভিডিও আমি ভাইরাল করে দেব। দেখি তোর শ্বশুর কীভাবে তোকে বাঁচায়।
গদাধরের শ্বশুর
জগাই হালদারের ওপর আলাই মেম্বারের পুরোনো রাগ। একসময় ফুলেশ্বরীকে স্কুলে যাওয়া-আসার
পথে বিরক্ত করত বলে জগাই হালদার সালিশ ডেকে আলাইকে অপমান করেছিল। পারিবারিকভাবে ফুলেশ্বরীকে
বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল আলাই। জগাই হালদার তড়িঘড়ি গদাধরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।
এ অপমান আলাই ভুলতে পারে না। ফুলেশ্বরী শুধু দেখতে সুন্দর তাই না, জগাই হালদারের একমাত্র
মেয়ে। ফুলেশ্বরীকে ঘরে তুলতে পারলে জগাই হালদারের সব সম্পত্তির মালিক হতে পারত আলাই।
সেই লোভ এখনও তাকে তাড়া করে ফেরে। মনের সেই কষ্ট যেন তুষের আগুনের মতো এখনও তাকে পোড়ায়।
ফুলেশ্বরীকে বিয়ে করে গদাধর কোনো অন্যায় করেনি। তবু গদাধরকে দেখলেই যেন তার বুকের ভেতর
জ্বলতে থাকা সেই তুষের আগুন উস্কে ওঠে। মেম্বার হওয়ার পর থেকে তাই সুযোগের অপেক্ষায়
ছিল আলাই। আজ এ সুযোগ তার হাতের মুঠোয়।
ভোরের আলোয়
পথচলতি লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা মেম্বারের পাশে এসে দাঁড়ায়। গাছের মাথায় চটি
ঝুলতে দেখে। মোবাইলে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সংবাদ পেয়ে এলাকার
চেয়ারম্যান আসে। লোকজন ধীরে ধীরে মারমুখী হয়ে উঠতে থাকে। যেসব মানুষ, যেসব যুবক ছেলে
নুড়ো গাছে বিশ্বাস করে না তারাও আজ খুব সোচ্চার। গদাধরের মতো এমন একটা ছোট জাতের লোক
নুড়ো গাছের মতো এমন একটা পবিত্র গাছে চটি ছুড়ে মারবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা
ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। বিপদ আঁচ করে চেয়ারম্যান থানায় খবর পাঠায়। থানা থেকে পুলিশ এসে
মারমুখী জনতার হাত থেকে গদাধরকে রক্ষা করে। আলামত হিসেবে গাছ থেকে ছেঁড়া চটি সংগ্রহ
করে। তারপর গদাধরকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়।
দিনের ঘটনা
এখানেই শেষ হয়ে যায়। তবে রাতের অন্ধকার ঘন হয়ে এলে তার ভেতর থেকে কিছু অচেনা মানুষ
বেরিয়ে আসে। তারা জগাই হালদারের বাড়িতে, মাছের আড়তে আগুন জ্বেলে দেয়। তারপর সেই অচেনা
মানুষের দল ছুটতে থাকে গদাধরের বাড়ি দিকে।
কুনি বাঁশঝাড়ের
ভেতর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে একদল অন্ধকার চেহারার মানুষ তাদের ছোট্ট ঘরটার ওপর লাফিয়ে
পড়ছে। মায়ের চিৎকার শুনতে পায়। কুনির মা ফুলেশ্বরী পালাতে চায়নি। বলেছে সে পাখি হয়ে
উড়ে যাবে। তবে কি মা পাখি হতে পারেনি? মায়ের চিৎকার থেমে গেল ছোট্ট ঘরটাতে দাউ দাউ
করে আগুন জ্বলতে থাকে। মায়ের জন্য কুনির বুকটা হুহু করে ওঠে। শব্দ করে কাঁদতে পারে
না। ভয়ে গুটিসুটি মেরে বাঁশঝাড়ের ঘন অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে রাখে।
শেষরাতে অন্ধকার
কিছুটা ফিকে হয়ে এলে কুনি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে বাড়ির দিকে। তখনও বাড়ির ভিটায় নিভে
যাওয়া আগুনের ধোঁয়া উঠছে আর কালো কালো ছাই জমে আছে। কুনি পোড়া ছাইয়ের ভেতরে মাকে খুঁজতে
থাকে। ভোরের মৃদু বাতাসে ওড়া ছাই আর ধোঁয়ার ভেতর থেকে একটা কাক কুনির চোখের সামনে
দিয়ে উড়ে গেল। কুনি ডাকে, মা মা। দূর থেকে ভেসে আসে তার প্রতিধ্বনি, কা কা।