× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দৈনিক স্বরাজের রবিবাসরীয় সম্পাদক জীবনানন্দ দাশ

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৩৪ পিএম

দৈনিক স্বরাজের রবিবাসরীয় সম্পাদক জীবনানন্দ দাশ

জীবিকার প্রয়োজনে সারা জীবনে কবি জীবনানন্দ দাশ নানা বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করার পর কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে ইংরেজি বিভাগের টিউটর হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ সংকটের কারণে সিটি কলেজের কর্তৃপক্ষ জীবনানন্দ দাশকে চাকরিচ্যুত করে ১৯২৮ সালে। এতে জীবিকার গভীর অনিশ্চয়তায় নিপতিত হন জীবনানন্দ।

পরবর্তীকালে ১৯২৯-এ খুলনার বাগেরহাটে পি.সি. রায় কলেজে মাত্র তিন মাস অধ্যাপনা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এরপর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৩০-এর মার্চ মাস পর্যন্ত দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।

জীবিকার তাগিদে নানা কাজ করেছেন তিনি। নানা কাজের কথা ভেবেছেন। এ সময় কলকাতায় অবস্থান করেছেন চাকরির খোঁজে। উল্লেখ্য যে, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সাহিত্যিক প্রয়োজনে তাকে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী কলকাতাতেই থাকতে হবে। কলকাতায় বাড়িতে গিয়ে ছাত্র পড়ানো বা টিউশনি ছিল তার প্রধান জীবিকা। এতে টিকে থাকবার মতো আয়-রোজগার হলেও তিনি টিউশনি করা পছন্দ করতেন না। ৬ ডিসেম্বর ১৯৩০ তারিখে দিনলিপির খাতায় জীবনানন্দ ইংরেজিতে লেখেন `Tuition Waste of time. কিন্তু কার্যত এ সময় আরও টিউশনি খুঁজছিলেন তিনি। কয়েকদিন পর ১৫ ডিসেম্বর প্রাইভেট টিউশনির জন্য সম্ভাব্য ছাত্রীর মাকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি।

এ সময় তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন, কিন্তু বলা যায় প্রকাশ করেননি একটিও। কবিতার সঙ্গে গল্প-উপন্যাস রচনা শুরু করেন তিনি। তবে কোনো একটি গল্পও বা উপন্যাস প্রকাশ করেননি।

১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসে জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে টিউটর (সহকারী প্রভাষক বলা যায়) হিসেবে নিযুক্তি লাভ করলে তার দীর্ঘ বেকার জীবনের অবসান ঘটে। পরের বছর এপ্রিল মাসে লেকচারার (প্রভাষক) পদে পদোন্নতি হয় তার। ১৯৪৬-এ কলকাতায় স্থানান্তরের পূর্ব পর্যন্ত এ কলেজেই চাকরি করেছেন তিনি। তবে কলকাতায় যাওয়ার চেষ্টা তিনি করে গেছেন। পরের বছর কবি বুদ্ধদেব বসুকে লিখিত পত্রপাঠে বোঝা যায় সিটি কলেজে পুনর্নিয়োগের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এ ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসুর প্ররোচনা থাকতে পারে।

 

২.

কলকাতার দৈনিক স্বরাজ পত্রিকায় সম্পাদকীয় পদে চাকরি লাভের বিষয়ে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের (জন্ম ১৯০৯) সঙ্গে জীবনানন্দের (জন্ম ১৮৯৯) বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তবে ঠিক কবে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে জীবনানন্দের পরিচয় হয়েছিল এবং কীভাবে তা আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। দেখা যায় ১৯৪৩ সালে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবননান্দ দাশের কবিতা নিয়ে নিরুক্ত পত্রিকায় (আষাঢ় ১৩৫০) প্রশংসামূলক দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য কুমিল্লা থেকে পূর্ব্বাশা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩২ সালে। পরের বছর থেকে পূর্ব্বাশা প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে।

১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রকাশনা সংস্থা পূর্বাশা লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় জীবননান্দ দাশের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ মহাপৃথিবী। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত তুলনামূলকভাবে অখ্যাত কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা থেকে এটি কম কথা ছিল না; কারণ এর আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ জীবনানন্দ দাশ নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে জীবনানন্দের পত্রবিনিময় হয়েছিল। কিন্তু সেসবের কোনোটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। যেগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো স্বরাজ-পরবর্তীকালের।

প্রায় প্রতিবছর পূজার ছুটিতে কলকাতায় কাটাতে চেষ্টা করেছেন বরিশালবাসী জীবনানন্দ দাশ। ১৯৪৬-এ ব্রজমোহন কলেজ থেকে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে কলকাতায় গমন করেন তিনি আগস্ট মাসের শেষভাগে। ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিনা বেতনে ছুটির জন্য দরখাস্ত করেন। এ সময় দৈনিক স্বরাজ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বন্ধু সত্যপ্রসন্নের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল জীবনানন্দের। তিনি জীবনানন্দকে দৈনিক স্বরাজের ব্যাপারে অবহিত করেন এবং বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে এ পত্রিকায় কাজ করার ব্যাপারে প্রণোদিত করেন।

সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে স্মৃতিচারণক্রমে জানিয়েছেন পত্রিকায় কাজ করার বিষয়ে জীবনানন্দের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল দৈনিক স্বরাজ-এর পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরিটি হয়ে যায়। এ চাকরিপ্রাপ্তিতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভূমিকা ছিল মুখ্য। ১৯৪৭-এর জানুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশ দৈনিক স্বরাজ পত্রিকায় যোগদান করেন। পদমর্যাদায় তিনি ছিলেন একজন সহকারী সম্পাদক। তার মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় ২৭০ টাকা। এ সময়ই তিনি স্থির করেন যে, বরিশালের পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে যাবেন। কলকাতায় থিতু হয়ে সাহিত্যচর্চার আকর্ষণ ছিল, কিন্তু ব্রজমোহন কলেজের মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের তুলনায় স্বরাজের মাসিক ২৭০ টাকার আকর্ষণও ছিল একটি নিয়ামক।

 

৩.

দৈনিক স্বরাজ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। কলকাতার কোনো জাতীয় লাইব্রেরি বা অভিলেখগারে এ পত্রিকাটির কোনো কপি নেই। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও জীবন নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করার সময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ক্লিনটন বুথ সিলি চতুরঙ্গ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক আতোয়ার রহমানের নিকট থেকে জেনেছিলেন, ১৯৪৭ সালের ২৬ জানুয়ারি দৈনিক স্বরাজ-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।

দৈনিক স্বরাজ-এর সম্পাদক ছিলেন রমেশচন্দ্র বসু। অফিস ছিল ১০ ক্রিক রোডে। নিজস্ব প্রেস ছিল। বেশি চলেনি পত্রিকাটি। এক সময় আর্থিক সংকটে পড়ে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

স্থির হয়েছিল, অন্যান্য দৈনিক পত্রিকার মতোই স্বরাজ প্রতি রবিবার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। এই ক্রোড়পত্রে কবিতা, গল্প, নিবন্ধ মুদ্রিত হবে। জীবনানন্দ হলেন এই রবিবাসরীয়র সম্পাদক। যথারীতি তার প্রধান কাজ লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য নির্বাচন। প্রতি মাসে চারটি রবিবাসীয় ক্রোড়পত্রের জন্য তাকে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। লেখার সঙ্গে অলংকরণের বিষয় ছিল। তখন লাইনো ব্লকে ফটো মুদ্রণও শুরু হয়েছে। ফটো বাছাইয়ের কাজও তাকে করতে হতো।

শুরুতে এ কাজটি জীবনানন্দের পছন্দ হয়েছিল। মে মাসে (১৯৪৭) তিনি বরিশাল গিয়ে মালপত্র ও পরিবারের সদস্যদের কলকাতায় নিয়ে আসেন। ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন রোডে অনুজ অশোকানন্দ দাশের বাসাতে ওঠেন তিনি।

সম্পাদনার কাজটি জীবনানন্দের জন্য জটিল কিছু ছিল না। কিন্তু দৈনিক স্বরাজ-এর পরিবেশ তার জন্য অনুকূল ছিল না। অন্যদিকে তিনিও মানিয়ে নেওয়ার মতো লোক ছিলেন না। দ্রুত পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষের কারও কারও ব্যবহার ছিল অপমানজনক। অচিরেই স্বরাজ হয়ে ওঠে অমর্যাদাকর কর্মস্থল।

৩০ জুলাই ১৯৪৭ তারিখে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছেন, স্বরাজের কাজ মন্দ ছিল না। কিন্তু কোনো কোনো কারণে ভালো লাগছে না। অন্য কিছু পেলেই কিংবা আগেই চলে যেতে হবে। বরিশালে ফিরে যেতে চাই না।…’

 

৪.

স্কুল ব্যবহার্য বাহাদুর মার্কা লাল মলাটের রুলটানা এক্সারসাইজ খাতায় অনেক দিনলিপি লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এরকম একটি খাতায় ১৯৪৭ সালের কিছু দিনলিপি লিখেছেন তিনি, যার প্রথম অংশে তার স্বরাজ দিনের অভিজ্ঞতার কিছু বিবরণ রয়েছে। এ খাতাটির দ্বিতীয় অংশে রয়েছে স্বরাজ পরবর্তী কিছু ঘটনার প্রসঙ্গ।

দিনলিপির শুরুর দিকে স্বরাজ পত্রিকার আলংকারিক চিত্রকর কান্তি বলকে স্মৃতিচারণ রয়েছে। এরপর নানা বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ এসেছে। অসংকোচে জীবনানন্দ স্বীয় জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। উঠে এসেছে অনেক আপাত মামুলি প্রসঙ্গ, যার মধ্যে আমরা এক পর্যবেক্ষণশীল, সূক্ষ্মদর্শী মানুষের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করি। স্বরাজ পত্রিকায় চাকরির অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার কথা প্রতিফলিত হয়েছে। আর্থিক সুবিধা থাকলেও মানসিক শান্তির ব্যাঘাতের কথা লিখেছেন। তার কবিতার অনুরাগী পাঠক প্রভাকর সেনের সঙ্গে কথোপকথন ও কলকাতার কফি হাউজে যাতায়াতের কথা বিস্তর পরিসর নিয়েছে। জীবনের ব্যর্থতা ও হতাশার কথা, অচরিতার্থ কামনা ও হস্তমৈথুনের কথা, নিজের খৎনার কথা, আত্মহননের মধ্য দিয়ে সব সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্যতার কথা ইত্যাদি লিখেছেন জীবনানন্দ, যখন যা মনে এসেছে। এক জায়গায় লিখেছেন  স্বরাজের চাকরি কেবল ভিন্ন আদলে সমান এক নরকভোগ।

অন্যত্র আমরা পড়ি জীবনানন্দ লিখেছেন প্রায় প্রতিরাতেই ভাবছি জীবনের সমস্যাজট আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ার কথা... কারণ (১) স্বরাজ পত্রিকায় চাকরির অনিশ্চয়তা; (২) কলকাতার জীবন একদম একঘেঁয়ে, তিক্ত এবং একাকী; (৩) পৃথিবীর কোথাও না আছে নিশ্চয়তা, না আছে মর্যাদা; (৪) কোনো মেয়েমানুষ নেই কোনো প্রেম নেই আর আমি দ্রুত বার্ধক্যগ্রস্ত হয়ে পড়ছি; (৫) হেরোডিয়াসের কন্যারা; (৬) ব্যর্থতার অতলান্ত হতাশাবোধ।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, বারবার আত্মহত্যার কথা লিখলেও আত্মহত্যা করার মতো মানুষ ছিলেন না জীবনানন্দ। তার দিনলিপিতে আত্মহনন প্রসঙ্গ তার গভীর হতাশার কথা তুলে ধরেছে মাত্র। এক জায়গায় লিখেছেন, তবে আরও কয়েকটি বই প্রকাশ এবং আমার পাণ্ডুলিপিগুলোর একটা পরিপাটি ব্যবস্থা না-করা পর্যন্ত আত্মহত্যা আমি করব না।

 

৫.

উপরোক্ত দিনলিপিতে জীবনানন্দ এক জায়গায় লিখেছেন, কান্তি (অজিতের লোক) সুশীল রায়ের গল্প রাহুর যে ইলাস্ট্রেশন সে করেছে, সেটি চিত্তাকর্ষক এবং যদিও কোনো একটি বিদেশি ম্যাগাজিনের অনুকরণে করা (ওরা এ কাজ প্রায়ই করে থাকে), এ গল্পটির সঙ্গে খুব যায়। সে স্বরাজের শিল্পী হিসেবে নিযুক্তির চেষ্টা করছে।

কান্তির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ সে গল্প পড়ে দেখে। মনে হয় কেমন অলংকরণ দরকার, সে বিষয়ে ধারণা লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু পরমার্শও চায় এ ব্যাপারে আমি খুব একটা সাহায্য করতে পারি না (আমি নিজেই কি যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে গল্পগুলো পড়ি?)... তবে মোক্ষম পরামর্শ দেওয়ার অনেক লোকজন আশপাশে আছে।

পত্রিকায় যারা লিখতেন বা অলংকরণ করতেন, তাদের সম্মানী প্রদানে স্বরাজ কর্তৃপক্ষের হাতটান ছিল। এ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন নীতিও ছিল না। জীবনানন্দ দিনলিপিতে লিখেছেন আমার কোনো ধারণাই নেই কোন ছবি বা কোন ব্লকের জন্য কত টাকা প্রদেয় হতে পারে, বা কেমন করে বিল বানাতে হয় এবং কীভাবে তা অনুমোদন করতে হয়।

জীবনানন্দ লিখেছেন, কান্তির উদ্ভট অভ্যাস হলো সব সময় বাড়িয়ে বিল করা, আর অফিসে নয়, ব্যক্তিগত বাড়িতে এসে আমাকে দিয়ে ওগুলো অনুমোদন করিয়ে নেওয়া। সে হয়তো ধরে নিয়েছে আমি একটা নিরেট গর্দভ।’… বাড়িয়ে বানানো বিল অনুমোদনে জীবনানন্দ অনীহ ছিলেন।

চিত্রকর কান্তির প্রতি জীবনানন্দের সহানুভূতি থাকলেও গোবিন্দ চক্রবর্তীর গল্প অন্ধকার বনপথের জন্য তার করা অলংকরণটি বিপর্যয় ডেকে আনে। চারদিক থেকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বলা হলো এটি বটতলার বইয়ের উপযুক্ত হয়েছে, বলা হলো এটি রমা ও মোহন জাতীয় অলংকরণ। জীবনানন্দ লিখেছেন আমি যারপরনাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম আমার উচিৎ ছিল ছবিটা বাতিল করে দেওয়া, এমনকি ইলাস্ট্রেশন ছাড়াই গল্পটি ছেপে দেওয়া এমনকি কান্তি নিজে আমাকে দুষতে লাগল এবং যদিও অজিত কে. প্রমুখ ছবিটা অনুমোদন করে দিয়েছিল টুঁ শব্দটি না করে এবং আমাকে এটি ছাপতেই হতো কারণ একটি বিকল্প ছবির ব্যবস্থা করার কোনো সময়ই হাতে ছিল না এবং ইলাস্ট্রেশন ছাড়া গল্প মুদ্রণ (আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও) অন্য কারও কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি কিন্তু আমার যুক্তিটা অজিত কে. এবং কান্তি (ভণ্ডের দল) কারো মনঃপূত হল না।

দিনলিপি থেকে আমরা জানতে পারি, পূর্ব্ববসন্তর ইলাস্ট্রেশন একেবারে কান্তিকে শেষ করে দেয় এবং পদক-এর ইলাস্ট্রেশন দিয়ে স্বরাজে গোপালের উত্থান ঘটে। জীবনানন্দ লিখেছেন, কিছু দিন ও বেশ পাত্তা পেল, কিন্তু প্রতিবাদ-এর ইলাস্ট্রেশন ওকে ডুবিয়ে দিল।

 

৬.

সেকালেই দৈনিক পত্রিকা থেকে শারদোৎসব সংখ্যা প্রকাশের চল হয়েছিল। নতুন দৈনিক হলেও স্বরাজের কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, স্বরাজ শারদোৎসব সংখ্যা প্রকাশ করবে। এ সংখ্যার জন্য সম্পাদকীয় দায়িত্ব দেওয়া হয় জীবনানন্দ দাশকে। তাতে অফিসে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি তার দায়িত্ব পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন। পরিচিত-অপরিচিত সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন উপযুক্ত লেখা সংগ্রহের জন্য।

৩০.০৭.৪৭ তারিখে কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন স্বরাজের পূজো সংখ্যার জন্যে তোমার একটি শ্রেষ্ঠ গল্প পাঠিও। সর্বোচ্চ দক্ষিণা পঞ্চাশ টাকার কম হবে না। তোমাকে সর্বোচ্চ দক্ষিণাই দেওয়া হবে।’… উল্লেখ্য যে, জীবনানন্দের অনুরোধের সূত্রে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার হাট-বাজার গল্পটি পাঠিয়ে ছিলেন এবং তা মুদ্রিত হয়েছিল। তবে অচিন্ত্যকুমার প্রতিশ্রুত পঞ্চাশ টাকা পেয়েছিলেন কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। লেখকদের সম্মানী প্রদানের বিষয়ে স্বরাজ কর্তৃপক্ষের হাতটান জীবনানন্দকে অনেক সময় বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিত।

স্বরাজ শারদোৎসব সংখ্যা প্রকাশের আগেই জীবনানন্দের চাকরির অবসান ঘটে। তবে ক্লিনটন বুথ সিলি ২৭২ পৃষ্ঠার স্বরাজ শারদোৎসব সংখ্যা দেখেছেন। তার মতে, মুদ্রণ ও প্রকাশ দেখার সুযোগ না পেলেও সব লেখা যে জীবনানন্দেরই সংগ্রহ তাতে সন্দেহ নেই। এ সংখ্যায় নীহাররঞ্জন রায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার শিরোনাম স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি। কবি অমিয় চক্রবর্তীর রচনাটির শিরোনাম ছিল বাংলা নাট্যমঞ্চের ভবিষ্যৎ। বারটি কবিতার মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর একটি কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল। এ কবিতার শিরোনাম ছিল সাহারার মেয়ে সাবেরা। তবে জীবনানন্দের নিজের কোনো কবিতা স্বরাজের শারদোৎসব সংখ্যায় ছিল না।

দুঃখের বিষয়, স্বরাজ শারদোৎসব সংখ্যার সর্ববিধ সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করলেও সম্পাদক হিসেবে গঙ্গাপত বসু ও নারায়ণ ভৌমিকের নাম মুদ্রিত হয়েছিল।

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তারিখে দৈনিক স্বরাজের সহকারী সম্পাদকের পদ থেকে কবি জীবনানন্দ দাশকে বিদায় দেওয়া হয়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা