× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শস্যের কাল

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৩ পিএম

শস্যের কাল

হাওয়াকে সে বলতেই পারত; কিংবা হাওয়া, সে-ও তো বলতে পারত তোজামকে, এইখানে থেকে যাওয়া যায়। এখানেই বরং থেকে যাই, নাকি? বলা কি যেত না অমন করে? এমন কিছু বলার ফাঁদ তো তখন পাতা হয়ে গেছে তাদের দুচোখজুড়ে, তাদের শরীরজুড়ে। কিন্তু হাওয়া বলতে পারছিল না। সে বরং জড়ো করা ধানের ঢিবির চারপাশে ঘুরঘুর করছিল আর অযথাই পা দিয়ে ঠেলছিল সেটাকে।

কিন্তু থাকার কাল তো ফুরিয়েই এসেছে, চলেই যখন যাবে, তখন কী করবে এখন! কী করবে?

ফিরে যাবে রাতের ট্রেনে?

কোনখানে? কোন গাঁয়ে? নাকি সেই রাজধানীতে?

মাথা কেমন গুলিয়ে ওঠে হাওয়ার। আবারও সেই ঢাকায়, সাড়ে ৩২ ভাজা ঢাকায়, নুলো টিনশেডের ছাপড়ায় তাহলে ফিরতে হবে! আর গ্রামকে তো সে ভুলেই গেছে, কিংবা ভোলে নাই। কিন্তু মনে রাখারও কোনো উপায় নাই। মেম্বারের ব্যাটা কাশেইম্যা সেই যে কোন বছর তাকে ঢাকায় নিয়ে এলো, গাঁয়ে আর তো ফিরে যাওয়ার উপায় রাখল না, চেনা গাঁ তার অচেনা হয়ে গেল। তবে এত দুঃখের মধ্যেও খানিকটা আরামই লাগে, যখন মনে হয়, টাউনে এনে তাকে বিক্রি করে দেওয়ার বছর দেড়েক পর তার সঙ্গে আবারও কাশেমের দেখা হয়েছিল। দেখা হোক, সেটাই তো চেয়েছিল সে। আর তাই দেখা হতে না হতেই ঠোঁটটাকে বেশ খানিকটা গুছিয়ে এনে মুচকি হাসি দিয়ে চোখ মেরেছিল। কাশেম একেবারে গলে খসে পড়েছিল, হুঁশ ছিল না হাওয়ার ঘরে তখন দৈনিক হাজিরা দেয় কে। একেবারে লুঙ্গি তুলে ধেই ধেই করে ছুটে এসেছিল হারামিটা; মানে ঘটনাটা ঠিক ওরকম ভাবে ঘটে নাই, তবে কাশেমের দশা তখন ওরকমই হয়েছিল বলা চলে। তা না হয় ওইরকমই হলো, তাতে সমস্যা নাই। যা-ই ঘটুক না কেন, কাশেমই তো তার প্রথম পিরিতি। কিন্তু হারামজাদা ঢাকায় এনে তাকে যে পথে বসিয়ে দিল, তার কী হবে! হারামজাদার শিশ্নটাকে নিজের হাতে কেটে দিতে পারলে খুবই ভালো হতো, পুরো এক বছর ধরে ওইরকম প্ল্যান-প্রোগ্রামই তো সে করে এসেছে; মনটায় পাত্থর বেঁধে গার্মেন্টসে যাওয়া-আসা করেছে, আবার মনসুরের অন্যায় আবদারেও আপত্তি করে নাই। শিশ্নটা সে-ই কাটবে, মনসুরকে সে তা জানিয়েও ছিল; কিন্তু রাগে আর উত্তেজনায় ও তখন ক্ষ্যাপা সিংহ- শালার চিরিরবন্দরের মিচকা কাশেম তার বাঁধা মেয়ের ছাপড়ায় হাজিরা দিতে চায়!

আইতে দে- আইতে দে- তাড়াতাড়ি আইতে কইস। রাইত আটটায়ই আসে য্যান। কইবি, এইভাবে কইবি- মনসুর হারামজাদাটা ১১টা বাজতি না বাজতিই আমার জইন্যে পাগলা কুত্তা হইয়া যায়, কাম সারতে চাইলে রাইত আটটা-নয়টার মইধ্যেই আসতে হইব।

পাগলা এই কুত্তাটাকে এড়াতে নেড়ি কুত্তাটা হাঁপাতে হাঁপাতে রাত আটটার মধ্যেই হাজির হয়েছিল। সবকিছুই ঠিকমতো হয়েছিল, খালি দেশি বলাকা ব্লেডটা দিয়ে ওর শিশ্নে পোঁচ দেওয়ার ভাগ্যটা আর হয়নি হাওয়ার। গজরাতে গজরাতে ও কাজটা মনসুরই করেছিল।

তারপর কী আর হবে, দুই দিনের মাথায় গাঁও থেকে বাপ-ভাইদের ঢাকায় চলে আসার খবর পেয়েছিল হাওয়া। তা ভালোই হয়েছিল তাতে। জমিজমা নাই, কাজকাম নাই- আসতেই তো হতো একদিন, আগে আর পরে। তবে আসার পরেও দেখা আর হয়নি হাওয়ার বাপ-ভাইদের সঙ্গে। দেখা হোক, সেরকম ইচ্ছাও কেন যে হয় না, কে তা জানে!

তা ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু মিচকা কাশেমকে অ্যাটেম টু মার্ডারের কেসে মনসুরকে পুলিশ জেলে ভরল। যদিও হাওয়ার মনে হয় না, মিচকাটার অত পাওয়ার আছে যে, পুলিশকে খুশি করে মনসুরকে জেলে ভরার বন্দোবস্ত করতে পারবে। মনসুর যদি মেয়েমানুষ হতো, সহজেই বলা যেত, দুর্গার মতো দশ হাত; কিন্তু সে উপায় তো নাই, এখন কেমনে সে বলবে, ওর কতগুলো হাত! তার ওপর পুরুষমানুষ! তা হলে কার সঙ্গে ওকে তুলনা করবে সে! কত্তগুলো হাতওয়ালা পুরুষমানুষ, কিন্তু তার পরেও জেলে পচতে হচ্ছে মনসুরকে। কার লেজে যে ওর পা পড়েছিল, কে তা জানে! কতগুলো বছর কেটে গেছে, জামিন পর্যন্ত জোটাতে পারছে না। ইদানীং অবশ্য কাউকে কাউকে বলতে শুনেছে হাওয়া, ইচ্ছে করেই নাকি জেলের মধ্যে মনসুর পচে গলে গড়িয়ে পড়ছে। বাইরেই নাকি বেশি ভয় তার- মৃত্যুর ভয়, নিশ্চিত গুলিতে মরে যাওয়ার ভয়। মনসুর হারামিটা তার পিছে লেগেছিল বলে কতই না কেচ্ছা আর দগদগে ক্ষত জমল তার এই জীবনে। তবু ভালোই তো লাগে এই জীবনটাকে, ইচ্ছে করে না মরে যেতে। কেমন বেশরম, বেলাহাজ জীবন,- এত কিছুর পরও পুরুষমানুষকে ভালো লাগে, ইচ্ছে করে কারও বুকে মাথা রেখে খানিকটা নিঃশ্বাস টানতে। নিঃশ্বাস নিলেই না কেবল টের পাওয়া যায়, কতটুকু হয়রান হয়েছে সে। তা ছাড়া আজকাল মনে হয়, পেটেও তো একটা কিছু ধরা দরকার, বাপের পরিচয় থাকুক না থাকুক, একটা কিছু না হলে জানটা ঠিক জমে উঠছে না। হয়ে যাক একটা কিছু, সনদে না হয় একটা নাম বানিয়েই বসিয়ে নেবে!

তা দৈনিক এরকম একটু-একটু ভাবতে শুরু করেছিল হাওয়া। কিন্তু করোনা ধেয়ে এলো- বেশরম, বেলাহাজ ঠিকমতো সে আর হতেই পারল না। কী যে ভয়ানক তাফালিং শুরু হলো, গার্মেন্টসও আর খোলা থাকল না। দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে শহর ছাড়তে শুরু করল সবাই। বাসে ট্রেনে হেঁটে যে যেভাবে পারে রওনা হলো গাঁয়ের দিকে।

কিন্তু হাওয়া যাবে কোনখানে! হঠাৎ করেই বুঝতে পারল সে, মরার এই শহরটাকে এত যে আঁকড়ে ধরে আছে সেই কাশেমের কাছ থেকে ধোঁকা খাওয়ার পর থেকে- লোমওঠা সেই ঘেয়ো নেড়িকুত্তার মতো শহরটাও কি না তাকে আপদ মনে করে! তা যা-ই মনে করুক, সে আর কোনখানে যাবে। মেস তখন বলতে গেলে ফাঁকা; আছে শুধু ওই নূরী, তাদের গার্মেন্টসের লাস্ট চালানটা আজকালের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। সে-ও উড়াল দেবে তখন। মেসের মালিক রুহুল আমিন চোখজুড়ে অন্ধকার দেখার পরও আওয়াজটাকে কী যেন কোন কায়দায় ষোল আনাই চড়া করে রেখেছে, কইছি তো, একজনায় থাকো, আর দশজনায় থাকো, রুমভাড়া পাঁচ হাজারের এদিকেও যাবে না, ওদিকেও যাবে না। অতএব কোনো উপায় নাই, মেস তাকে ছাড়তেই হবে নূরীর সঙ্গে সঙ্গে। তা মেস না হয় নূরীর সঙ্গেই ছেড়ে দেবে, কিন্তু যাবে কোনখানে! অন্য কোনো সময় হলে চুপেচাপে কোনো পুরুষের সঙ্গে ঝুলে পড়া যেত, মনসুরের সঙ্গে সে তো ওভাবেই থেকেছে বছরের পর বছর, আর জেলে যাওয়ার পরও তো লোকটা বহুদিন কথা বলেছে সেখান থেকেই। কার ফোন থেকে যে কথা বলত, আল্লা মালুম, কিন্তু বলত প্রায় প্রতিদিনই, সোনা চান, ও আমার সোনা চান, চিন্তা কইর না, আমি তাড়াতাড়িই বারায়া আমু।

কিন্তু এখন আর মনসুর ফোন করে না, এখন আর ও আসতেও চায় না জেল থেকে বেরিয়ে, ভয়ে ভয়ানক সিঁটকে গেছে, জামিন কিংবা ছাড়া পাওয়ার কথা শুনলেই নাকি আঁতকে ওঠে, বের হওয়ার মানেই নির্ঘাৎ মৃত্যু- হয় ওই পুলিশদেরই হাতে, না হয় ওই বিরুদ্ধ পার্টির কারও হাতে। অত বেশি চাড় ছিল না হাওয়ার, তবু মনসুরের এক দোস্তোর প্যানপ্যানানিতে একদিন গিয়েছিল কেরানীগঞ্জের জেলে; তা ভাগ্য তার ভালোই বলতে হবে, মনসুরই নাকি চায়নি কোনো কথা বলতে। শুনে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে সে, যাক, আপদ গেছে! এই মনসুরটার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা মানে, সারা জীবন পুলিশের দৌড়ানির ওপর থাকা। তা আপদ গেছে বটে, কিন্তু এই যে মন আর এই যে শরীর, খুবই ভয়ানক বেলাহাজ, খুবই বেশরম- করোনা না এলে সে যে কী কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে বসত, কে তা জানে! নাকি করোনা এসেছে বলেই সে এটা টের পাচ্ছে ভয়ানকভাবে!

পোঁটলা বাঁধতে বাঁধতে নূরী বলেছিল, আমাগারে গাঁয়ে যাবি? ভাই তো ফোন দিছিল, গাঁয়ে ওইসব করোনা-ফরোনা নাই-

করোনা নাই, খিদ্যা তো আছে-

হ, তা আছে। চিন্তা করিস না, বাড়িঘরে কাজকামের কুনু অভাব নাই।

তা নূরী একেবারে মিথ্যা বলে নাই, দেখেছিল সে, ভদ্রঘাটে গিয়ে। যমুনার এই পাড়ে তার জীবনেও আসা হয় নাই। একটা পাড়ই পেরিয়েছিল, শীতলক্ষ্যার পাড়; কিন্তু পেরোতে না পেরোতেই পড়েছিল বাঘের মুখে। অথচ তখনও সে কেবল মনের সুখই নিতে জানে টেনেটুনে, শরীরের সুখ তখনও শেখেনি খুব করে শুষে নিতে। কিন্তু এখন কিসের মন আর কিসের শরীর! পেটের ক্ষুধায় শরীর-মন সব কোনখানে যে গেছে! নূরীর বাড়ি যেদিন গেল, ভালোই কাটল সেদিন। কিন্তু দুই দিন যেতে না যেতেই ভাত-তরকারি কমতে শুরু করল শানকির মধ্যে। অথচ নূরী যে বলেছিল, বাড়িঘরে কাজকামের কুনু অভাব নাই, কেবল সেই কাজকামেরই কোনো খবর মিলছিল না। তিন দিনের দিন বেলা চড়তে লাগল, কিন্তু বাড়িঘরে নূরীরও আর দেখা পেল না হাওয়া। নূরী যে কোথায় গেছে, কাজে গেছে নাকি অকাজে গেছে, তা বোঝাও ভারী দায় হয়ে উঠল।

সারা বাড়িতে কেবল একটামাত্র মনুষ্যি তখন, আর সে হলো নূরীর দাদি। তা সে বুড়ি না শোনে কানে, না দেখে চোখে। আবার মেরুদণ্ডও এমন বাঁকার বাঁকা যে শুয়ে থাকাও পোষায় না তার। একটা গোলাকার পিণ্ড হয়ে বসে থাকে প্রায় সারাক্ষণ, শুয়ে পড়লেও দেখা যায় একই রকম। কোনো উত্তর পাওয়ার আশা ছাড়াই আন্দাজে দরকারে-অদরকারে কথাবার্তা বলে বুড়ি, তার স্বরে চেঁচিয়ে জানাতে থাকে, তার এখন কী প্রয়োজন। এভাবেই চলছে নাকি বছরের পর বছর। সেই বুড়ি বারবার চিৎকার করছিল, ক্যারে, আমাক তো আইজ কিছুই দিলি না? আমার ভুখ লাগে না?... ক্যা রে খাইবার দিস না ক্যা? আমি কি মইরা গেছি নাকি? আমার কি এই দইনায় কেউই নাই?

সূর্য ঠিক মাথার ওপর চড় চড় করছে, তখন দেখা মিলল নূরীর। ম্লান চোখে আর ম্রিয়মাণ কণ্ঠে সে শুধু বলল, খিয়ারে যাবি নাকি সই? এহন তো ধান কাইটবে- কামের অভাব নাই।

সই-বাড়ি পর্যন্ত টেনেটুনে নিয়ে এসে খেতে দিতে পারে না, তার আবার শখ-আহ্লাদ কত! তা-ও ভালো, একটা কাজকামের খোঁজ নিয়ে এসেছে। হোক চাষাবাদের কাজ,- কাজ তো। কতদিন যে কৃষিকাজ করে না, তা আর মনে পড়ে না হাওয়ার। কিন্তু এরকম তো না যে, একেবারে ভুলে গেছে সবকিছু। ধান ওড়ানো, ধান ঝাড়া এমনকি ধান কাটা- কী আর এমন কঠিন কাজ! হালও তো বয়েছে সে আর হাল বওয়ার কপাল থেকে রেহাই পাওয়ার লোভও কি কম ছিল ওই মিচকা কাশেইম্যার পিছু পিছু ছুটতে। কিন্তু এখন কি আর পারবে আগের মতো ওইসব কাজকাম করতে? যেদিন থেকে সে পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করেছে, সেদিন থেকেই তার এসব কাজের শিক্ষাদীক্ষা সবকিছু গেছে, সবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার পুরুষমানুষকে যে একটু মন খুলে অবিশ্বাস করবে, তা-ও তো পারে না সে ভালো করে। কী যে এক যন্ত্রণায় পড়ে গেছে হাওয়া, কাকে বোঝাবে।

তবে কাজবাজ নেই, গার্মেন্টস খুলি-খুলি করছে শোনা যায়, কিন্তু খোলে না। এখন নাকি আর অর্ডার-টর্ডারও নাই। নূরীর কথায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় হাওয়া। দেখা যাক না, এখনও কাস্তে ধরে ধানের গোড়ায় ফ্যাঁস দিতে পারে কি না, এখনও ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে হাঁটতে পারে কি না আলপথ দিয়ে।

অতএব পরদিন ভোরে নূরীর সঙ্গে ট্রেনে চেপে বসেছিল সে। বেলা বাড়ছিল, গরম সবখানে গনগন করছিল। আবার কী সুন্দর বাতাসও ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, অনেক- অনেক দিন পর সে ট্রেনে চেপেছে আর কাজকর্ম না থাকলেও ঠিক কোনো দুশ্চিন্তা নেই মনে।

আর বড়াল ব্রিজ স্টেশনে এসে নামার আগেই হাওয়াদের পরিচয় হয়েছিল তোজামদের সঙ্গে। গায়ে তোজামের স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া কোনো কিছু নাই। লুঙ্গিটা খাটো করে পরা। গলায় একটা গামছাও আছে অবশ্য। আর হাতের মুঠোয় আছে একটা বড়সড় হাইসা। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়েছিল হাওয়ার, নামবে, এই পুরুষটা নিশ্চিত বড়াল ব্রিজেই নামবে। যাবে, এই পুরুষটা তাদের মতোই খিয়ারে যাবে। ট্রেনটা তখন প্রচণ্ড জোরে দুলে দুলে উঠছিল আর হঠাৎ করেই যেন টের পেয়েছিল হাওয়া, অনেক- অনেক মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে।

বড়াল ব্রিজ আসতে না আসতেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তা সে নিজেও খানিকটা হুড়োহুড়ি শুরু করেছিল অবশ্য। কেন, তা সে নিজেও জানে না। যেতে যেতে, পেছন থেকে নূরীকে আগলে রেখে এগোতে এগোতে চড়া গলায় বলতে বলতে এগিয়েছিল, সরেন, সরেন, মেয়েমানুষেক আগে যাইবার দ্যান।

তখন তোজাম, যার এই নামটাও তখন পর্যন্ত জানে না হাওয়া, তার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হেসেছিল। আর হাওয়াও ঠোঁটটা এমনভাবে পাকিয়েছিল যে, মনে হয়েছিল থু থু ফেলছে, থু থু ফেলবে। তা তখন কি আর সে বুঝেছিল, আসলে ঘটবে অন্যরকম কিছু!

স্টেশনের টিকিটঘরের কাছে, যেখানে একজন মুচি আর একটা কুকুর নির্বিঘ্নে পারস্পরিক সহাবস্থান করছিল, সেখানে বসে শুকনো রুটি চিবাতে চিবাতে তাদের সবার মধ্যে কথা হয়েছিল। তোজাম তার আর নূরীর দিকে সিধা চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কাজবাজের কথা কার সাতে হইছে?

তখনই রেলস্টেশনের বেড়া ডিঙিয়ে হাওয়ার চোখ আটকে গিয়েছিল ধু-ধু খোলা প্রান্তরের ধান ক্ষেতের দিকে। সবুজ ধান বয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য এক গতিতে, অবিশ্বাস্য এক স্থিরতায়। কতদিন পর যে এই দৃশ্য দেখতে পেল হাওয়া, সে চিন্তা মাথায় আসার আগেই শিউরে উঠেছিল। এইরকম ধানের দিনই তো তার সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। আবারও কি কোনো সর্বনাশ হবে তাহলে? কার সর্বনাশ? তার? কত আর সর্বনাশ হবে তার?

বড়াল নদে তখন একটু-একটু করে জল জাগছে। পাকা-আধাপাকা ধান তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার তাড়া জোতদারদের। কিন্তু কামলা কোথায়? সর্বস্বান্ত মানুষটাও এখন কামলা হওয়ার চেয়ে রিকশাওয়ালা হতে পছন্দ করে। কেউ ঝাড়ি দিলে পাল্টা ঝাড়ি দেওয়া যায়, প্যান্টশার্ট পরা ধোপদুরস্ত মানুষজন যত বড়লোকই হোক না কেন, মা-বোন তুলে গালি দিলে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা গালি দিয়ে তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে গর্ভবতী করে ফেলা যায়। অতএব কামলা পাওয়া বড় দায়। পুরুষ কামলার দাম এখন ক্ষেতখোলা বুঝে দিনে ৬০০-৭০০ টাকা, তিন বেলা খাওয়া দিলে ৫০০-৬০০ টাকা। তা-ও আসরের নামাজের আজান পড়ার সময় ছেড়ে দিতে হবে। ধরে রাখলে দিতে হবে ওভারটাইম। আর মেয়েমানুষ, তাদের মজুরি অবশ্য অর্ধেক; সেটাও দিতে নিমরাজি গাঁয়ের সিকদারের ব্যাটারা; কিন্তু যতই নিমরাজি হোক, কাজের কামলা নাই, ঢেঁকি না গিলে তো উপায়ও নাই।

হাওয়ারা চুলা পাতল স্কুলঘরটার পাশে ঝোপঝাড়ের ধারে, তিন বেলা খাওয়াদাওয়া দেওয়ার অসিলায় মজুরি ১০০ টাকা কমিয়ে ফেলবে, এতই সোজা? তা ছাড়া গিরস্থ বাড়িতে থাকার নানা ঝামেলা, সন্ধ্যার পরও ঠ্যাকা কাজে ডাকবে। এ জায়গা ও জায়গা থেকে আসা কামলাজামলা মিলিয়ে ১৫-১৬ জনের বড় একটা দল তাদের দাঁড়িয়ে গেছে ওই বড়াল ব্রিজ রেলস্টেশনেই। আর সবাই মিলে গাঁতাও বেঁধেছে শক্ত করে। তোজাম তাদের সবার হয়ে সিকদারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল, দিনরাইত খাইটা ধান কাইটা মলন মইলা শুকায়া দিয়া যামু চাচা। সব মিল্যা কত দিবেন, সেইটা কন।

তোমরা তো তা-ই কইবা, গাঁতা বাইন্ধা আছো, তিন দিনের কাম এক দিনে নামায়া দিবা, আর আমরা দিন বাও কামের কতা কইলেই এক দিনের কাম চৌদ্দ দিন লাগাইবা!- ঘড় ঘড় করে উঠেছিল সিকদার।

এইরকম উড়ামতাড়াম কথাবার্তা! পোষায় নাই তাদের, দিনবাও কামলা খাটার চুক্তি করেছিল তারা।

তারপর কতদিন যে গেছে, কাস্তে চালাতে গিয়ে হাওয়ার হাত থমকে গেছে, খরখরে তীব্র রোদের মধ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসে যেন আগুনের হলকা খেলা করছে। পাকা ধানের গোছা সোনার মতো হলুদ হয়েও রাজি নয় নুয়ে পড়তে; কোনো ক্ষেতে আবার তা শুয়ে পড়তে চাইছে শস্যের ভারে। কোনটাকে সে টেনে নেবে মনের ভেতর? নুয়ে পড়বে শস্যের ভারে, নাকি শস্য এসে ভরিয়ে তুললেও উদ্ধত কিষানির মতো দাঁড়িয়েই থাকবে?

কয়দিনের আর কাজকর্ম! বড়জোর দিনবিশেক। কিন্তু এর মধ্যেই টের পেতে শুরু করেছে হাওয়া, অন্যরকম হয়ে গেছে সে, ওই বড়াল নদের মতো জেগে উঠছে একটু একটু করে, চর নয়- জাগছে বান, চরডোবানো বান; অন্যরকম হয়ে উঠছে সে, চরাচর ঢাকতে ওই চলনবিলের মতো থইথই হয়ে উঠছে; এসব শস্যে ভরা ধানের মতো বয়ে যেতে চাইছে। কে যে তার এই সর্বনাশ করল! নাকি নিজেই নিজের সর্বনাশ করেছে সে, নিজেই দংশন করেছে নিজেকে!

সিকদার মানুষটাকে অবশ্য যত খারাপ মনে করেছিল তারা, দিনকে দিন তত খারাপ আর মনে হয় না। তালের পাঙ্খা দিয়ে নিজেই নিজেকে বাতাস করতে করতে লোকটা বলেছিল একদিন, তরা চাষা, আমিও চাষা- চাষাগারে কুনু ধনীগরিব নাই, বুঝলি? এই যে মনে কইরতাছিস, কত বড়লোক আমি! তে ধর, এহন যদি আগুইরা ঢল নামে, বান আসে, ক্ষ্যাত ভাইসা যায়, তহন কী হইব? আমি হমু ফকির- পুরা ফকির। কিন্তু কারু কাছে কইবার পারমু না। তোরা কইল ঠিকই কামলা বেইচা তহনো প্যাট ভরাইবার পারবি।

তা কথা সিকদার খারাপ বলে না। কখনও কখনও তার গলার স্বর আরও নরম হয়ে আসে। একবার তোজাম আর আরেকবার হাওয়ার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, থাইকা যাও তোমরা। এইহানেই ঘরগেরস্তি করো। না কী কইস তোজাম?

কী কন চাচা? আমার ঘরদোর আছে না? ঘরামির ছয় মাস চলতেছে!

পুরুষমানুষের আবার ঘর! শোন, ঘর হয় মেয়েমানুষের। এই যে কইলি, ছয় মাস চলতেছে... ঘর কইল তোর বউয়েই বানায়ে ফেলতেছে, তোর বউয়েই করতেছে। আর তুই একবার বাড়িভিটায়, আরাকবার খিয়ারে ন্যাটাপ্যাটা খাইতেছিস। এই জইন্যেই কইতেছি রে, এইহানে থাক, একটা ছাপড়া তুইলা দেই, ধান ওঠার সময় খিয়ারে আইলি, বানের সময় আবার বাড়ি চইলা গেলি। না কী কইস হাওয়া?

হাওয়া কিছু বলতে পারে না। কিন্তু নূরী হাহা করে হাসে, হাসতেই থাকে। আর হাওয়া ভাবে, মানুষ কত পদেরই না আছে, আর তাদের গতিকও না কত পদের!

কিন্তু সময় ফুরিয়ে এসেছে। এখন এই দুই দিনের বাড়িঘর ফেলে আবারও তাদের ফিরতে হবে। কোনো পিছুটান নেই। তবু কাল রাতে, অন্ধকার যখন আরও অন্ধ হয়ে উঠতে চাইছে, তখন তোজাম বলেছিল তাকে, মনে মনে দোষ দ্যাও আমাক? অন্যায় করছি?

না, অন্যায় কেন হবে! আর ন্যায়-অন্যায়েরই বা কতটুকু বোঝে সে! আর এখন তো সর্বনাশ হওয়ার কিছু নাই। এই জগৎটাকে হাওয়া এখন ভালো করেই চেনে। বরং সে শহরেই ফিরে যাবে। কয়দিনের এই চাষবাসের জীবন ফের ভুলে যাবে। প্রতিদিন শস্যের মতো ভরে উঠবে, নুয়ে পড়তে চাইবে, কিন্তু মাথাটা উঁচু করে সে বসে কিংবা দাঁড়িয়েই থাকবে। কৌতূহলী কেউ যদি জানতে চায়, সোয়ামি কী করে, কোনখানে থাকে, বিয়োবে কবে, সঙ্গে সঙ্গে হিসহিসিয়ে উঠবে, হারামজাদার কতা জিগান? খাইবার দিবার পারে না, প্যাট বাঁধায়া ভাগছে...

বলতে বলতে তার মনে পড়ে যাবে, কী সুন্দরই না ছিল দিনগুলো, ধানের ক্ষেতে কী সুন্দর ঢেউ বয়ে যেত, শিমুল তুলো বাউড়ি দিয়ে উড়ে বেড়াত আকাশজুড়ে, আর সন্ধ্যা হতে না হতেই কী ভীষণ অন্ধকার তখন প্রতিদিন নেমে আসত!  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা