পেঙ্গুইন বুকস
আহমাদ শামীম
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৯:১৯ পিএম
দেশ-বিদেশের
বই যারা ভালোবাসেন, তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়Ñ কমলা রঙের ডিম্বাকৃতির বৃত্তের মাঝে একটা
পেঙ্গুইনের ছবি আঁকা, এটা কী? সচেতন পাঠক নিমেষেই বলে দেবেনÑ এটা একটা লোগো, ‘পেঙ্গুইন বুকস’-এর লোগো।
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভপর্বে মানুষের পাঠাভ্যাস বদলে দেওয়ার বিপ্লবের অন্যতম কারিগর
এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি। ‘পেপারব্যাক’ বইকে গণমানুষের
কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে তথা মানুষের পাঠাভ্যাসকে বদলে দিতে ‘পেঙ্গুইন বুকস’ বিশ্বজুড়ে
বিপ্লবই সাধন করেছে বলা যায়। ১৯৩৫-এ অ্যালেন লেন নামের ইংরেজ ভদ্রলোকের সাহস ও একরোখা
মনোভাব থেকে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম।
কিন্তু ১৯৩৫
সালের পর পেপারব্যাক মানেই যেন পেঙ্গুইন বুকÑ এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বইপ্রেমীদের
মনে। অ্যালেন লেন যে কীর্তি গড়েছেন, সেই গল্পে যাওয়ার আগে আমাদের যেতে হবে আরেকটু পেছনে,
প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৬৮ সালে। ইংল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চল উত্তর ডেভনের এক কৃষক
পরিবারের সন্তান জন লেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজ এলাকা ছেড়ে জন পাড়ি জমান লন্ডনে। এখানে
এসে ইউস্টনের রেলওয়েতে ছোট একটি কাজ নেন। কিন্তু এই কাজ তাকে টানেনি কখনও। কয়েক বছর
পর জন লেন অবসর সময় কাটানো এবং কিছু বাড়তি আয়ের জন্য পুরোনো বই কেনা-বেচা শুরু করেন।
এভাবে আরও কয়েক বছর কাটিয়ে ১৮৮৭ সালে ডেভনের আরেক বইপ্রেমী এলকিন ম্যাথিউসকে সঙ্গে
নিয়ে একটি পুরোনো বইয়ের দোকান শুরু করেন লন্ডনের ভিগো স্ট্রিটে। প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন
অক্সফোর্ড লাইব্রেরির কিউরেটর স্যার থমাস বডলির নামের সঙ্গে মিল রেখে ‘দ্য বডলি হেড’। বইয়ের দোকান
দেওয়ার পরে জন লেনের মাথায় ভূত চাপে বই প্রকাশের। এক বন্ধুর কাছ থেকে দুই হাজার পাউন্ড
ধার করে কবিতা, প্রবন্ধসহ বেশ কিছু বই প্রকাশ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই ‘দ্য বডলি হেড’ লেখক ও পাঠকদের
মধ্যে বেশ পরিচিতিও পায়। সাত বছর পর এলকিন ম্যাথিউসের সঙ্গে চিন্তার বনিবনা না হওয়ায়
তাকে অংশীদারত্ব থেকে বাদ দিয়ে জন লেন একাই ব্যবসা সামলাতে থাকেন। ইতোমধ্যে নিজ কাজে
প্রতিষ্ঠিত জন বিয়ে করেন আমেরিকার এক ধনাঢ্য বিধবা মহিলাকে। এনি এইচবার্গ নামের এই
নারী নিজেও সাহিত্য ভালোবাসতেন, লিখতেন গল্প-কবিতা। জন ও এনি লেনের যুগলবন্দিতে ‘দ্য বডলি হেড’ এগিয়ে যেতে
থাকে।
জন ও এনি লেন
ছিলেন নিঃসন্তান। জন লেন তার এক বোনের ছেলেকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। কিশোর অ্যালেন
উইলিয়াম নামের এই ভাগ্নেরও ছিল বইয়ের প্রতি অগাধ আগ্রহ। লেখাপড়ার পাশাপাশি সময় দিতে
থাকেন মামার বইয়ের ব্যবসায়। নিঃসন্তান জন লেন ব্যবসার খাতিরে ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে
অ্যালেনকে ‘দত্তক’ নিলেন। অ্যালেনও
নাম বদলে নিজের নাম করেন অ্যালেন লেন। তার আরও দুই ভাই এক বোনও নামের সঙ্গে ‘লেন’ জুড়ে দেন।
অ্যালেন অল্প বয়সেই বই প্রকাশ-সংশ্লিষ্ট সব কাজেই দক্ষ হয়ে ওঠেন। পুরস্কার স্বরূপ মাত্র
২১ বছর বয়সেই ‘দ্য বডলি হেড’-এর একজন ডিরেক্টর
হয়ে যান। ১৯২৫ সালে জন লেন মারা যান। দুই বছর পরে এনিও মৃত্যুবরণ করেন। ফলে অ্যালেন
ও তার ভাই-বোন সবাই মামার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে যান। জন লেনের মৃত্যুর পর
প্রকাশনীর ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন অ্যালেন। ততদিনে ইংল্যান্ডের বইয়ের
বাজারে দেখা দেয় মন্দা, ‘দ্য বডলি হেড’ও ঋণের বোঝায়
জর্জরিত। এ অবস্থায় নতুনভাবে, নতুন কোনো চিন্তা নিয়ে বাজারে আসতে চাইলেন অ্যালেন। কিন্তু
কী হবে সেই উপায়, সেটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না যেন। একদিন লেখক বন্ধু এজরা পাউন্ডের সঙ্গে
দেখা করে ফেরার পথে রেলস্টেশনের এক বইয়ের দোকানে ট্রেনে বসে পড়া যায় এমন কোনো বইয়ের
খোঁজ করছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে এমন কিছুই পাননি যেটা সুখপাঠ্য, সহজে বহনযোগ্য এবং
অল্প সময়ের মধ্যে পড়ে শেষ করা যাবে। তখনই তার মাথায় চিন্তা এলো তিনি কেন এমন বই প্রকাশ
করছেন না!
এ বিষয়ে বোর্ড
থেকে তেমন সাড়া না পেলেও দুই ভাইয়ের কল্যাণে পুরোনো দশটি আলোচিত ও পাঠকনন্দিত বই পেপারব্যাকে
বাজারজাত করার চিন্তা করেন। নাম রাখেন ‘পেঙ্গুইন বুকস’। বইয়ের প্রচ্ছদ
করেন নিরেট দুই রঙে। লেখক ও বইয়ের নামকেই প্রচ্ছদে দেওয়া হয় প্রাধান্য। আকারেও আনেন
পরিবর্তন। সাড়ে সাত বাই পাঁচ ইঞ্চি হবে আকার, যা একজন পাঠক চাইলে পকেটেও রাখতে পারবেন।
অ্যালেন আরও ভাবেন, বইকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। শুধু বুকস্টোরেই বই পাওয়া যাবে
এমন না। বই পাওয়া যাবে সব দোকানে। এবং দামও থাকবে সবার নাগালে। বইয়ের দাম ধরা হয় মাত্র
‘সিক্স পেন্স’। নিজের চিন্তা
বাস্তবায়নে অনেকটা একরোখা হয়েই কাজ চালিয়ে যান।
নতুন চিন্তার
কারণে বই বিক্রেতাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়াই পান অ্যালেন। ১৯৩৫ সালের ৩০ জুলাই প্রতিটি
বইয়ের বিশ হাজার কপি করে ছাপা হয়। বলা বাহুল্য, এই বাজিতে শেষ পর্যন্ত জয় হয় অ্যালেনের
একরোখা মনোভাবেরই। দিন দিন ইংল্যান্ডের নানা দিক থেকে বইয়ের চাহিদা আসতে থাকে। সাধারণ
পাঠক পছন্দ করে ‘পেঙ্গুইন বুকস’কে। এভাবেই
ধীরে ধীরে ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে আমেরিকার বইয়ের বাজারও দখল করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
পরবর্তী কয়েক
দশকে ‘পেঙ্গুইন বুকস’ নানান স্বাদের
বই নিয়ে প্রতিনিয়ত হাজির হয়েছে পাঠকের দুয়ারে। বিভিন্ন নামে প্রকাশনীটি বেশ কয়েকটি
বইয়ের সিরিজ প্রকাশ করে। যেমনÑ খ্যাতিমান লেখকদের আলোচিত বই নিয়ে ‘পেঙ্গুইন ক্ল্যাসিকস’, একাডেমিক
নন-ফিকশন নিয়ে ‘পেলিকান বুকস’, শিক্ষাবিষয়ক
বই নিয়ে ‘পেঙ্গুইন এডুকেশন’, লেখকদের
নতুন বই নিয়ে ‘পেঙ্গুইন স্পেশালস’, শিশু-কিশোরদের
জন্য ইলাস্ট্রেটেড নন-ফিকশন বই ‘পাফিন’, নির্বাচিত
লেখকদের পকেট সাইজ বই নিয়ে ‘কিং পেঙ্গুইন বুকস’সহ ম্যাগাজিন
ও স্থাপত্যবিষয়ক কিছু সিরিজও প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন বুকস।
১৯৬৫ সালে
চিফ এডিটর টনি গডউইন ও বোর্ড অব ডিরেক্টররা তাকে পেঙ্গুইন বুকসের প্রধানের দায়িত্ব
থেকে অপসারণ করেন। অপসারিত হয়ে অ্যালেন লেন ফ্রেঞ্চ কার্টুনিস্ট সিনের ম্যাসাকার নামের
একটি নতুন ছাপা বইয়ের পুরোটাই জ্বালিয়ে দেন। যদিও খুব বেশিদিন কাজ করার সুযোগ পাননি
তিনি। ১৯৭০ সালে অন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বইপ্রেমী
একরোখা স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটি।
বই প্রকাশে
আলোচনার জন্ম যেমন দিয়েছে পেঙ্গুইন বুকস, তেমনি মাঝে মাঝে তাদের কিছু বইয়ের কারণে হতে
হয়েছে সমালোচনার শিকারও। তবুও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নতুন পাঠক তৈরি এবং বইকে সাধারণের
মধ্যে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটির তুলনা সত্যিই অতুলনীয়।