মঈনুস সুলতান
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৯:০০ পিএম
পায়ে চলা ট্রেইলটি ছেড়ে আমরা বেরিয়ে আসি খোলামেলা
ওপেনিংয়ে। এখানে ছোটখাটো একটি প্রান্তর খানিক গড়িয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে- তেমন উঁচু
নয়, এ রকম একটি পাহাড়ে। দীর্ঘ ঘাস মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের চোখেমুখে এসে লাগে
আলাভোলা হাওয়ার উষ্ণ ঝাপটা। আমাদের পদশব্দে ঘাসের শীষ খোঁটা কিছু পাখি ওড়াউড়ি
করে। এদের সংখ্যা প্রচুর, একসঙ্গে উড়লে ধূসরে শুভ্রতা ছড়ানো পালকে রোদ পড়ে সৃষ্টি
হয় এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম।
স্কারলেট কপালে হাত রেখে ভাসমান মেঘমালার দিকে তাকিয়ে
বলে, ‘হিয়ার ইট ইজ, আওয়ার গুড ওল্ড মাউন্ট রেনেয়ার...
লুক হাউ হি ইজ প্লেয়িং হাইড অ্যান্ড সিক উইথ দ্য ক্লাউড’। চলার গতি স্লো করে আমি পাহাড়ের ওপরে বিস্তৃত দিগন্তের দিকে তাকাই।
ওখানে চোখে পড়ে কেবলই মেঘের লীলাবৈভব, হরেক আকারের গম্বুজ, খিলান ও মিনারে বিস্তৃত
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ; যেন তৈরি করে নিয়েছে প্রাসাদোপম স্থাপত্য। আমি মাউন্ট রেনেয়ারকে
আলাদাভাবে ঠিক শনাক্ত করতে পারি না।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে অনুভব করি অনিশ্চয়তাজনিত স্ট্রেস। উদ্বেগ যেন নীরবে কাঁকড়াবিছার মতো লোমশ পায়ে ঘাড় অতিক্রম করে হেঁটে যাচ্ছে মেরুদণ্ড বেয়ে। সচেতন হই যে, আমার এ দুশ্চিন্তা সম্পর্কে ভ্রমণসঙ্গী স্কারলেটের বোধ করি কোনো ধরণাই নেই। ভাবি, থাকুক না হয় নারীটি আরও দিন কয়েক তিমিরে। ঘটনা হচ্ছে, সপ্ত দিন হলো আমরা ইয়াকিমা ভ্যালির প্রান্তিকে- একটি ক্যাম্পিংসাইটে টিপি বা তাঁবুতে বাস করছি। প্রতিদিনই কিছু না কিছু হাইক করছি, হেঁটে যাচ্ছি প্রান্তর কিংবা বনানীতে মাইল-কে-মাইল, হ্রদ কিংবা স্রোতস্বিনীর তালাশ পেলে সেরে নিচ্ছি অবগাহন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো গন্থব্যে পৌঁছাচ্ছি না। ঘুম ভাঙলেই সড়কে দাঁড়িয়ে চলমান কোনো গাড়িতে লিফট নিয়ে চলে আসি একটি বিচিত্র ক্যাফেতে। স্কারলেট কথাবার্তা বলে অন্য হাইকার বা খনিজ-খোঁজা কোনো মাইনারের সঙ্গে। যাত্রাপথের যৎসামান্য আন্দাজ নিয়ে এরপর আমরা পা চালাই। ঠিক বুঝতে পারি না, আজ সে আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলারও সে তাগিদ অনুভব করে না।
আমরা চলার বেগ বাড়াই, দ্রুত হেঁটে চলে আসি
পাহাড়টির নিচের দিকের ধাপে। ঠিক তখন চলমান ট্রেনের জানালায় দেখা নিসর্গপটের মতো
মেঘের অলিন্দ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে তুষার-মোড়া পর্বতটি ফের চলে যায় দ্রুত ভাসমান
মেঘমালার অন্তরালে। আমরা সাবধানে বেশ বড় বড় বোল্ডার ডিঙিয়ে উঠে আসি মাঝামাঝি একটি
ধাপে। দম ফেরাতে দাঁড়িয়ে পড়ে স্কারলেট ডায়েট পেপসির ক্যান ওপেন করে। খানিকটা গলায়
ঢেলে আমার দিকে ক্যানটি বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চায়, ‘হেই, ডিড আই টেল ইউ দ্য স্টোরি অব দ্য ব্ল্যাক সোয়ান?’ ঠিক বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করি, ‘হোয়াট অ্যাবাউট দ্য ব্ল্যাক সোয়ান? টেল মি।’ কুচকুচে কালো একটি সোয়ান প্রজাতির বিরাট রাজহাঁস নিয়ে গল্প
করতে করতে আমরা ফের ওপরে উঠতে থাকি।
কালো সোয়ানের কাহিনিটি স্কারলেট একটু আগে ক্যাফেতে
আসা একজন খনিজ-ধাতু খোঁড়া সিজনড মাইনারের কাছ থেকে শুনেছে। মাইনার ভদ্রলোক গেল
পুরো দশক ধরে অনেকবার ইয়াকিমা ভ্যালিতে এসে তাঁবু খাটিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করছেন।
প্রতিবছরই আসছেন, এদিককার একটি হ্রদে তিনি সাঁতার কাটাও খুব এনজয় করেন। বছর সাতেক
আগে সরোবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার নজরে পড়ে, জলে ভাসমান একজোড়া কালো সুদর্শন সোয়ান।
সোয়ানদের আদি হাবিটাট অস্ট্রেলিয়ায়, তবে
যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো সরোবরে মাঝেসাজে একটি দুটি কালো সোয়ানের সন্ধান পাওয়া
যায়। মূলত হ্রদের অলংকার হিসেবে এদের পোষা হয়েছে। এরা পছন্দ করে বছরে একবার
অরণ্যের নির্জন জলাশয়ে উড়ে গিয়ে ব্রিডিং করতে। তো মাইনারের ভাষ্যমতে, সোয়ান জোড়া
ফি বছর এ হ্রদে ব্রিড করতে আসত। তারপর খোকাখুকু একটু বড় হলে তাদের উড়িয়ে নিয়ে ফিরে
যেত। বছর চারেক আগে, সম্ভবত কোনো শিকারির ভুলক্রমে ছোড়া তীরের আঘাতে মৃত্যু হয়
মর্দা সোয়ানের। সোয়ানরা সংসারজীবনে মনোগোমাস বা একদারনিষ্ঠ। তারা সচরাচর
দ্বিতীয়বার দোসর খুঁজে ঘর বাঁধে না। তো মর্দা সোয়ানটির মৃত্যুর পরও নাকি মাদি
সোয়ান এ হ্রদে ফিরে এসেছে একাকী প্রতিবছর। এবারও সে এসেছে। তার সাইটিংয়ের সংবাদ
ইয়াকিমা ভ্যালির স্থানীয় পত্রিকা ছেপেছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, স্কারলেট সরোবরে গিয়ে
ব্ল্যাক সোয়ানটিকে চাক্ষুষ করতে চায়। আমি সোয়ান প্রজাতির বিরাট আকারের হাঁসদের
শুধু ছবি দেখেছি, এবার সামনাসামনি দেখতে পাব- এ সম্ভাবনা আমাকে উদ্দীপ্ত করে তোলে।
পাহাড়ের চাঁদিতে এসে স্কারলেট সামিট-রক বেয়ে ওপরে
উঠে যায়। মাউন্টেন বাইক হাঁকানোর জন্য সে চক্রাবক্রা ডিজাইনের টাইটস পরে আছে, রকে
বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়ার সময় জেগে ওঠা চরের মতো পোশাক ভেদ করে ফুটে ওঠে শরীরের
অনেকগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতি কার্ভ। আমিও সামিট রকে উঠে তার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আলতো
করে খোলা-কাঁধ স্পর্শ করি। ঘুরে তাকিয়ে সে স্মিত হেসে বলে, ‘ম্যান... নট নাউ... লুক হোয়াট আই ডিসকভারড’।
তার হাতের ইশারা অনুসরণ করে আমি দিগন্তের দিকে
তাকাই। হালকা বনানীর ফাঁকফোকর দিয়ে আয়নার ভাঙাচোরা টুকরাটাকরার মতো দৃশ্যমান হচ্ছে
হ্রদের রুপালি জলরেখা। আমার হাত চেপে দিয়ে সে বলে, ‘উই হ্যাভ অ্যাবাউট আ মাইল টু গো।’ তারপর চোখে
দুষ্টুমি ফুটিয়ে বলে, ‘হ্রদে কালো সোয়ানটির সাক্ষাৎ পেলে... আই উইল ব্লেস
ইউ উইথ অল দ্য কিসেস ইউ ওয়ান্ট।’ আমি সামিট রক থেকে নামার পথে ভারসাম্য রক্ষা
করতে তাকে সাহায্য করি।
সে দাঁড়িয়ে পড়লে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে
জানতে চাই, ‘ইজ দ্যাট অল আই অ্যাম গোনা গেট?’ পাহাড়ের ফ্ল্যাট সারফেসে নেমে এসে সে ফের লাইট হার্টেডভাবে
জানতে চায়, ‘হোয়াট এলজ ডু ইউ ওয়ান্ট?’ আমি জবাবে কিছু বলি না, তবে তার চোখে আমার দৃষ্টি লক হয়ে যায়।
সে ফিক করে হেসে পাহাড় থেকে নামতে নামতে বলে, ‘অলরাইট, লেকের কাছে
প্রথমে পৌঁছি, তারপর... আই উইল থিং অ্যাবাউট...’।
বুনোফুল মাড়িয়ে হালকা অরণ্যানির কাছে আমরা চলে
আসি, আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক কম সময়ে। বনতলের ঝরাপাতা মাড়িয়ে কদম কয়েক সামনে
বাড়তেই হ্রদের সর্পিল জলরেখা দেখতে পাই। সরোবর দেখতে পেয়েই ‘হিয়ার ইট ইজ, উই অ্যারাইভড, দিস ইজ কুল’ বলে স্কারলেট উল্লাস ছড়ায়। তাকে কেন জানি একটু ইমোশনালও দেখায়।
সে আমার কবজি চেপে দিয়ে বলে, ‘দেয়ার ইজ নো ওয়ে আই উড হ্যাভ কাম হিয়ার অল অ্যালোন, ট্রেইলে অন্য
কোনো হাইকার নেই, জংলামতো জায়গায় একটি মেয়ে একাকী অব দ্য ট্রেইল হাইক করছে, দিস ইজ
সিম্পলি নট সেফ... ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস?’ আমি তার মন্তব্য
বোঝার চেষ্টা করি। সে আরও নিবিড় হয়ে কাছে এসে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর হাইকিং উইথ মি... তুমি কাছে কাছে হাঁটলে আমি কীরকম যেন
সেফ ফিল করি।’ তার কথা শুনে মনে মনে ভাবি, হাইকিং
ট্রেইলগুলোয় মেয়েরা সেফ বলে যে কথাবার্তা শুনি, এ ধারণা কি আদৌ সত্য নয়?
হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রসারিত জলের রুপালি শরীরের
দিকে তাকাই, সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ তর হয়ে যায়। দেখি, খানিক দূরে সাদা পশমের তুলতুলে
একটি কুকুর ঘাসে বসে চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে থির জলের দিকে। জংলা
জায়গায়, ‘ট্রিকসি, কামঅন বেইবি,’ বলে আওয়াজ হয়। কুকুরটির কান খাড়া হয়ে ওঠে, কিন্তু সে নড়ে না।
ফের ঝরাপাতায় ছরছর শব্দের সঙ্গে ভেসে আসে, ‘ট্রিকসি, সুইট বেইবি, কাম
টু মামি।’ কুকুরটি ঘুরে তাকায়। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে
লাঠি ভর দিয়ে বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা এই মহিলা কায়ক্লেশে
কুকুরটির দিকে আগ বাড়েন, তার বাঁ হাতে ধরা রাবারের একটি রিং।
ট্রিকসি নামক কুকুরটি কাছে গিয়ে লেজ নেড়ে তাকে
শোঁকে। সবুজাভ তরলে পূর্ণ প্লাস্টিকের স্বচ্ছ ডাঁটিওয়ালা জার হাতে একটি কিশোরী
ঝোপের আবডাল থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দেয় বৃদ্ধার সঙ্গে। বালিকাটির বয়স তেরো কিংবা
চৌদ্দ, তার বাড়ন্ত শরীরে নারীত্বের নওলকুঁড়ি কেবল কলি হয়ে ফুটছে। সে আমাদের দিকে
তাকিয়ে হাত নেড়ে হ্যালো বলে।
বৃদ্ধা ট্রিকসিকে টেনে সামান্য দূরে নিয়ে যেতে
চাচ্ছেন। সারমেয়টি অনিচ্ছায় একপা দুপা করে আগ বাড়ছে। তাকে সামলাতে গিয়ে মহিলার
মাথার স্কার্ফটি খুলে পড়ে। কিশোরী মেয়েটি জার মাটিতে রেখে ছুটে যায় ওইদিকে। কিন্তু
বৃদ্ধা তার সাহায্য নেন না। তিনি ট্রিকসিকে ‘সিট ডাউন’ বলে কাঁপা হাতে স্কার্ফটি বাঁধার চেষ্টা করেন। মেয়েটির কাছে
দাঁড়িয়ে থাকাও বোধ করি তার পছন্দ হয় না। তিনি কিশোরীটির দিকে তাকিয়ে খিটমিটিয়ে বলে
ওঠেন, ‘জেসিকা, গো অ্যান্ড ট্রাই টু সেল ইয়োর লেমোনেড, আই
ক্যান টেক কেয়ার অব মাইসেল্ফ।’
বৃদ্ধাকে ছেড়ে খানিক দূরে হেঁটে গিয়ে জেসিকা একটি
বোল্ডারের ওপর লেমোনেডের জারটি রেখে আমাদের দিকে তাকায়, সে অসহায় ভঙ্গিতে হাসে।
বৃদ্ধা ট্রিকসিকে টেনে ঠিরঠিরিয়ে আরও খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আকাশের দিকে
তাকিয়ে কী একটা হিসাব করে জলে ছুড়ে দেন রিংটি। ট্রিকসি লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে যাচ্ছে
ওই দিকে।
বৃদ্ধা জলে রিং ছুড়তে ছুড়তে হ্রদের পাড় ধরে লাঠি
ভর দিয়ে হিলহিলিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। জেসিকা আমাদের দিকে তাকিয়ে, ‘হেই ইউ টু, ওয়ানা বাই সাম ফ্রেশ লেমোনেড ফ্রম মি?’ এ প্রশ্নে সাড়া দিয়ে আমরা হেঁটে যাই তার কাছে। জেসিকার
হাসিখুশি শিশুর মতো সরল মুখটি আমার ভালো লাগে। সে কোয়ার্টার বা সিকির বিনিময়ে
বিক্রি করছে কাগজের পেয়ালায় লেমোনেড। আমরা তা কিনি, এক ডলারের ভাংতি না থাকলে
স্কারলেট তাকে চেঞ্জ রেখে দিতে বলে, জেসিকা খুশি হয়ে হেসে মিনমিনিয়ে উচ্চারণ
করে, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ গাইজ।’
তারপর লাজুক হেসে ফের জানায়, ‘আই অ্যাম সো পুওর, আজকে এক গ্লাসও লেমোনেড বিক্রি করতে পারিনি।’ স্কারলেট স্নেহভরে তার কাঁধে হাত রেখে কথাবার্তা বলতে শুরু
করে। লেবুর তাজা সৌরভ ছড়ানো সবুজাভ রঙের পানীয়টি স্বাদে চমৎকার। তো আমি কাগজের কাপ
হাতে একটু দূরে ঘাস ধামসে পড়ে থাকা একটি গাছের কাণ্ডে বসি।
জেসিকা মনে হয় শরীরে যতটা বেড়েছে, সে অনুপাতে তার
মন পরিণত হয়নি। বালিকাটির অত্যন্ত ফ্র্যাংক কথাবার্তা আমাকে অবাক করে! বৃদ্ধা
সম্পর্কে তার মাতামহী। কিছুদিন আগে ক্যানসার-সংক্রান্ত সার্জারি থেকে রিকভার
করেছেন। কেমোথেরাপির প্রতিক্রিয়ায় তার তাবৎ চুল পড়ে গেছে। রোগমুক্তির পর একা একটি
বাড়িতে বসবাস করছিলেন, তখন আক্রান্ত হন ডিপ্রেশনে। তো জেসিকার মা তাকে নিয়ে এসেছেন
তাদের বাড়িতে। মহিলা আজকাল রেগুলার মেজাজ প্রসন্ন করার পিল নিচ্ছেন। কিন্তু তাতে
তেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। সারাক্ষণ খিটিমিটি করেন, রেগে যান কোনো কারণ ছাড়াই।
স্কারলেটের সঙ্গে কথাবার্তায় জেসিকা তার নানির
পেশা সম্পর্কে একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য দেয়। তিনি নাকি তারুণ্যে ছিলেন পেশাদার ডগ
ট্রেইনার। একসময় নিজে ব্রিড করে বিক্রি করতেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরছানা। তো
নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য জেসিকার মা তাকে ট্রিকসি নামক এই বাচ্চা কুকুরটি কিনে
দিয়েছেন। মহিলা এ মুহূর্তে ট্রিকসিকে সাঁতরে রিংটি মুখে নিয়ে পাড়ে ফেরার ডগ-ট্রিক
শেখাচ্ছেন। তিনি খুবই ইনডিপেনডেন্ট মাইন্ডেড মহিলা, নিজ হাতে সব কাজ সম্পন্ন করা
পছন্দ করেন; জেসিকা তাকে হেল্প করতে গেলে বাধে বেজায় খিটিমিটি।
এ পর্যন্ত জেসিকার কাহিনি শুনে স্কারলেট প্রশ্ন
করে, ‘হোয়ার ইজ ইয়োর মাদার নাউ?’ মেয়েটি সরোবরের মাঝামাঝি ভেসে থাকা একটি ছোট্টমোট্ট দ্বীপাণুর
দিকে ইশারা করে জানায়, মায়ের নতুন বয়ফ্রেন্ড কায়াক জাতীয় নৌকায় মাকে তুলে নিয়ে
গেছে ওই গাছপালায় নিবিড় ভাসমান ডাঙায়। জেসিকার বাবার সঙ্গে মায়ের ডিভোর্স হয়েছে
বছর চারেক আগে। তার বাবা আলাস্কার একটি মিলিটারি বেইসে কাজ করছেন। তিনি জেসিকাকে
শুধু জন্মদিনে একবার টেলিফোন করেন।
গেল চার বছরে তার মায়ের জুটেছে পরপর তিনটি
বয়ফ্রেন্ড। এদের মধ্যে বর্তমানটি মারকুটে ধরনের। মায়ের এই পুরুষ বন্ধুটি সম্পর্কে
জেসিকা ‘আই সিম্পলি হেইট হিম’ বলে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায়। কী যেন ভেবে সে এরপর গলার
স্বর নামিয়ে স্কারলেটকে বলে, ‘দিস গাই ইজ আ হর্নি টাইপ,
আই সো হিম হেভিং সেক্স উইথ মাই মাম অন দি কিচেন ফ্লোর...। উইকেন্ডে মা আমার সঙ্গে
একটু সময় কাটাক, এটা সে পছন্দ করে না, কোনো না কোনো অজুহাতে মাকে সে ডেকে নিয়ে
বেডরুমে ঢুকিয়ে ডোর লক করে দেয়।’
কথা বলতে বলতে কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে
জেসিকা আর্তস্বরে বলে ওঠে, ‘ওঃ মাই গাড, গ্র্যান্ডমাকে ওষুধ খাওয়ানোর সময়
পেরিয়ে গেছে।’ সে ব্যাকপ্যাক থেকে পানির বোতল ও ওষুধের
স্ট্রিপটি হাতে ছুটে যায় তার নানির দিকে। আমি ও স্কারলেট ফের সরোবরের পাড় ধরে
হাঁটি।
হাঁটতে হাঁটতে স্কারলেট জেসিকাকে নিয়ে
সংবেদনশীলভাবে কথা বলে। সংসারে বাবা অনুপস্থিত, মা খুঁজে বেড়াচ্ছে সঠিক পুরুষ
সঙ্গী। এ পরিস্থিতিতে ডেভেলপমেন্টালি চ্যালেঞ্জড একটি টিনএজারের বেড়ে ওঠার সমস্যা
নিয়ে কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠস্বর আবেগের কুয়াশায় বুজে আসে। সে অজানা একটি মেয়েকে
নিয়ে এত ইমোশনাল হচ্ছে কেন? বিষয়টা আমাকে অবাক করে!
বৈঠা বেয়ে আমরা আরও খানিকটা ভেসে যাই। স্কারলেটের
অস্ফুট আওয়াজে আমি চমকে উঠি। সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘লুক, হোয়াট আ স্টানিং ব্ল্যাক সোয়ান!’ আমি ঘাড় ফেরাই,
কুচকুচে কালো পালকের বিরাট একটি রাজহাঁস পানিতে তার ডানার তাড়নে সৃষ্ট বৃত্তের
দিকে দিশা ধরে তাকিয়ে আছে।
স্কারলেট স্বগতোক্তির মতো ফের বলে, ‘সো গ্ল্যাড দ্যাট আই অ্যাম অ্যাবোল টু সি দিস গ্রেসফুল সোয়ান।’ তার প্রতিক্রিয়ায় অব্যক্ত কী একটা আছে, যা আমি ঠিক ধরতে পারি
না, তাই ভেসে যেতে যেতে প্রশ্ন করি, ‘দিস সোয়ান ইজ
রিমার্কয়েবলি বিউটিফুল... কিন্তু একে একনজর দেখা তোমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন,
স্কারলেট?’
চোখ তুলে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়, ‘ক্যানসার সারভাইভার হলে দিনযাপনের হিসাবনিকাশে মৃত্যুর বিষয়টা বারবার
ফিরে আসে, ডাক্তার খোলাখুলি সম্ভাব্য মৃত্যুর ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়, পরামর্শ দেয়
মনে মনে প্রস্তুত থাকার জন্য।’
তার মন্তব্য নিয়ে নীরবে প্রতিফলন করতে চাই, কিন্তু
মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, ‘আই থিঙ্ক আই আন্ডারস্ট্যান্ড দিস... কিন্তু
গর্জিয়াস এই কালো সোয়ানকে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তুমি তোমার সম্পর্কে যা বললে তার
কানেকশনটা কোথায়, স্কারলেট।’ খুব ম্লান হেসে সে জাবাব দেয়, ‘আমি চলে যাওয়ার পর আমার পুরুষ সঙ্গী বাকি জীবন একাকী কাটাবে, এটা
অবাস্তব প্রত্যাশা, এ ব্যাপারে আমি খুবই সচেতন, কিন্তু রাইট আফটার মাই ডেথ-
কিছুদিন হলেও কেউ আমাকে মনে রাখছে, এটা ভাবতে ভালো লাগে।’
‘লেটস নট টক অ্যাবাউট দিস অ্যানিমোর’ বলে স্কারলেট ফেরার জন্য বোটখানি বাঁকিয়ে ঘোরাতে মন দেয়। আমরা
অন্যদিকের পাড় ঘেঁষে খানিকক্ষণ চুপচাপ ভাসি। পানির ওপর কাঠে গড়া একটি ভিউয়িং
প্ল্যাটফর্মের কাছে এসে স্কারলেট হাত দিয়ে ইশারা করে বলে, ‘হোয়াট আ লাভলি লিটিল টয় সাইলবোট।’
কাঠের পাটাতনে অপরাহ্ণের প্রসন্ন আলোয় সাইলবোটের
ছোট্টমোট্ট মডেলখানি আমার মধ্যে কাগজের নৌকা ভাসানোর উদ্দীপনা তৈরি করে। উৎসাহের
সঙ্গে বলে উঠি, ‘আই ওয়ান্ট ওয়ান অব দিস।’
বৈঠা বাইতে বাইতে স্কারলেট মন্তব্য করে, ‘তোমার জন্মদিন অবধি তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকো... পারহেপ্স আই উইল বাই
আ মডেল সাইলবোট অ্যাজ আ বার্থডে গিফ্ট।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি
কিছু বলি না, তবে মনকে মৃত্যুসংক্রান্ত ভাবনা থেকে বিযুক্ত করার জন্য একটি মডেল
সাইলবোট উপহার পাওয়ার সম্ভাবনাকে কল্পনা করি। এ ধরনের একখানা শিশুতোষ নৌকার মডেল
নিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারলে- কল্পনা করি, চাঁদনিরাতে আমাদের বসতবাড়ির বাইরের
দিঘিতে তা ভাসানো যায়।
পানি থেকে বোটখানা টেনে তুলে স্কারলেট প্রশ্ন করে, ‘আর ইউ স্টিকিং অ্যারাউন্ড উইথ মি টিল ইয়োর বার্থডে?’ আমি জবাব দিই, ‘ইয়েস, আই উড লাইক টু রিসিভ মাই ফার্স্ট মডেল সাইলবোট।’ সে ‘ও-কে, দ্যাটস আ ডিল’, বলে আমার দিকে তাকায়। তখনই অনুভব করি, আমার স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ফের দূরে সরে গেল।