× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যা ছিল বলার

মোহাম্মদ রফিক

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৫৮ পিএম

যা ছিল বলার

Patakos : You are a poet. Why do you get milked up in politics?

Ritson, yannis : Poet is the first citizen of his country, and for this very reason it is the duty of the poet to be concerned about the politics of his county.

_Selios patakos, Vice President of the Greek military Junta, to yannis Returns, Geek poet, 1970.

 

ক.

২৪ মার্চ ১৯৮২। আমি ফিরছিলাম খুলনা থেকে। সকালের বাসে। আগের দিন অনুষ্ঠিত হয়েছে, আযম খান কমার্স কলেজের নবনির্বাচিত ছাত্র-সংসদের অভিষেক। আমি ছিলাম প্রধান অতিথি। গরীব নেওয়াজ কোম্পানি (এখন নেই, উঠে গেছে)-এর খুলনা-ঢাকা রুটের লাক্সারি বাস শিরমনি পৌঁছতেই আমাদের স্থানটিকে অতিক্রম করে গেল। দু-তিনটে মিলিটারি ট্রাক। ট্রাকের ছাদ খোলা, গাদাগাদি করে, দাঁড়িয়ে ডজন তিনেক সশস্ত্র মিলিটারি সেপাই, সামরিক পোশাকে। সামান্য খটকা লাগল। তাহলে কিছু কি ঘটেছে, ঢাকায়? ভাবলাম তেমন তো হওয়ার কথা নয়, অন্তত এই সময়ে। যেভাবেই নির্বাচিত হোক না। প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাত্তারের সরকার, কাজ তো মোটামুটি, জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। জনমনে প্রত্যাশাও জেগেছে, হয়তো অমূলক তবু, আগামীতে সুষ্ঠ নির্বাচন হলেও হতে পারে। নচেৎ আদায় করে নেওয়া যাবে, যা-ঠুনকো এই প্রশাসন! শঙ্কা রয়েই গেল। অগত্যা, ক্লান্ত ও নির্ঘুম মাথা এলিয়ে দিলাম সিটে।

হতে পারে বাসের ঝাঁকুনিতে, পাতলা নিদ্রায় জড়িয়ে গিয়েছিল চোখ দুটি, ঘোর কাটল ফরিদপুরের মোড়ে পৌঁছে। টনটন করছিল পা। সামান্য সময় পার হতেই বুঝলাম, পরিশ্রান্ত যন্ত্রদানব এখন খানিকক্ষণ জিরোবে, জল খাবে। উঠে পড়লাম, দাঁড়ালাম বাইরে এসে, বাতাসে। সামনে, একটা ছনছাওয়া ঘর। লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। চায়ের দোকান বোধ হয়। দেরি না করে, আড়মোড়া ভেঙে, পা বাড়ালাম। অর্ডার দিতেই এক কাপ ফুটন্ত চা-ও এসে গেল। এইসব দোকানে, গরম-গরম চা, সদাই প্রস্তুত, ফুটছে উনুনে। স্বাদ যেমনই হোক! ভয়ে-ভয়ে ঠোঁট নেমে এল। দুটি চুমুক দিয়েছি কি দিইনি, সেই চা নামক বিস্বাদ বস্তুতে, সামনে দেখি উৎসুক জনতার ভিড়। বিস্ময় কাটতে না কাটতেই, উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, প্রায় একসঙ্গে, আপনি কোন তরিকার লোক! আপনি কোন পীরের মুরিদ। বুঝলাম, আমার ঘাড় অবধি ছড়ানো চুলের রাশি, তাদের উৎকণ্ঠার কারণ। আমি তরিকাও বুঝি না, পীর চেনার কোনো হেতুও ঘটেনি, ততদিনে। আমি হতবাক দুটি বোকা-বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম। একজন সামান্য এগিয়ে এসে বলল, জানেন না সামরিক আইন জারি হয়েছে! গোয়ালন্দ ঘাটে চুল কাটছে। আপনার চুলও কেটে দেবে। আমার চুল কাটবে, কে? নিজের অজান্তেই কুঁচকে গেলাম, আত্মসম্মান! একজন, বোধ হয় অযাচিতভাবে চারোচাকারি, এগিয়ে এলেন, দেখুন বলবেন, আপনি অমুক পীরের মুরিদ। একজন পীরের নাম-পরিচয়ও বাতলে দিলেন ভদ্রলোক। এতদিনে ভুলে বসে আছি। তাদের উৎসাহ ও উপদেশে, আমার অপমানবোধ শুধু বেড়ে গেল।

এক সময় বাস ছাড়ল। গোয়ালন্দ ঘাটও পার হলাম। বিপত্তি কিছু ঘটল না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও পৌঁছলাম সন্ধ্যে-সন্ধি, অক্ষত। তবে, অপমানবোধ, আত্মসম্মান আমাকে ছাড়ল না। ঘুম হয়নি সে রাতে। সুখে-দুঃখে কেটে যেতে থাকল দিবস-রজনী। ভারাক্রান্ত মন। ক্লাস নিচ্ছি, কাজকম্মও করছি, কিছু কিছু, তবে সামান্যই। হঠাৎ একদিন, দৈনিক বাংলার, প্রথম পৃষ্ঠায়, আবিষ্কার করে বসলাম, বড়-বড় হরফে মুদ্রিত একটি কবিতা। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। ঘটার কথাও নয়। ঘটেওনি ইতঃপূর্বে। রচয়িতা প্রধান সামরিক আইনপ্রণেতা; লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। স্বঘোষিত কবি, তার কবিতা, মুদ্রিত দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায়, উজ্জ্বল হয়েছে। আমার মনে হলো, আমার ব্যক্তিগত অপমান, রূপান্তরিত হলো জাতীয় অপমানে। শুধু তা-ই নয়, এ যেন গোটা বাংলা কাব্যসাহিত্যের অপমান, সমগ্র সাহিত্যের ওপর বজ্রাঘাত। অসহনীয়। শুধু কি অসহনীয়, না, আরও বেশি কিছু! হারাম হয়ে গেল ঘুম, দিনের পর দিন। কোথায় পালাল স্বপ্ন, আত্মধিক্কারে।

১৯৫৮। একটু পেছনে ফেরা যাক। খুলনা জিলা স্কুল থেকে সবে মেট্রিক দিয়েছি। সে কালে বর্তমানের এসএসসিকে বলা হতো মেট্রিক। বয়স ১৫। জারি হলো সামরিক আইন।

শুরু তদানীন্তন অখণ্ড পাকিস্তানে আইউবি সামরিক শাসন। কী দৌর্দণ্ড প্রতাপ তার! মাথার ওপর সর্বক্ষণ বিজাতীয় কালো বুর্থ। প্রাণ খুলে কথা বলারও উপায় নেই, অথচ তখনই তো আমার নিজেকে ব্যক্ত করার কাল, মুক্ত হওয়ার উদার পরিবেশ। চুটিয়ে এলো, চতুর্দিকে প্রতিক্রিয়ার বেড়াজাল। দিন-দুপুরে ছায়া ফেলত বিদেশি ভূতেরা। কী চেহারা তার, আন্দোলন! ৫৮ থেকে ৬৮। দীর্ঘ দশটি বছর। ঢাকা-বগুড়া-রাজশাহী হয়ে ফের ঢাকা। পুরো ছাত্রজীবন সংগ্রাম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে, মুক্তবুদ্ধির স্বপক্ষে, কথা বলার অধিকার চেয়ে লড়াই। লড়াই, সংগ্রাম, জেল, জুলুম, দফারফা হয়ে গেল ছাত্রত্বের। ছাত্রজীবনের স্বাদবঞ্চিত রয়ে গেলাম। আইউবের পর ইয়াহিয়া। অতঃপর উনসত্তরের উত্তাল গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা। কী আশ্বাস ও বিশ্বাস বুকে ভরে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম, মুক্ত স্বদেশে, ভাবতে আজও শরীরের লোম শিউরে ওঠে। কিন্তু সামরিক আইনের ভূত- পেত্নি, অপদেবতা কি পিছু ছাড়ল? না! প্রথমে জিয়াউর রহমান এবং তার লেজে- লেজে এই লে. জে. মুহম্মদ এরশাদ। ভাবলাম, কে চিনত তাকে, এতদিন। মুষড়ে ছিলাম, এখন মর্মও ভেদ হয়ে গেল। যেন নেমে এল, মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘা, তিনি কবি! মেনে নিতে হবে। কাকে? সমগ্র দেশবাসীকে। তার সঙ্গে, আমাকে! আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে যাওয়ার তা হলে বাকি রইল কী আর! ধৃষ্টতা, অপমান। অপমান কার? বাংলা কবিতার কবিকুলের। রবীন্দ্রনাথের! নজরুলের! জীবনানন্দের! অথচ দেখলাম, কোনো কোনো খ্যাতিমান কবিও, ইতোমধ্যে জুটে গেছে, সামরিক শাসকের আশপাশে। পরিষদবর্গ আর কাকে বলে! আর এইসব বরেণ্যের উপস্থিতিও লোকচক্ষুর সম্মুখে কার্পণ্য নেই লে. জে.-এর। না থাকারই কথা। নিজের হাত নিজেই দংশন করা ছাড়া, যেন আর উপায় রইল না।

আত্মধিক্কারের বিষে-বিষে, নীল হতে হতে, এক রাতে বসে পড়লাম, টেবিল- চেয়ারে, সম্মুখে খাতা-কলম বিছিয়ে। মুক্তি চাই, আমি মুক্তি চাই, এই আত্মধিক্কার, অক্ষমতাবোধ, দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই। তবু লেখা আসছিল না সহসাই। হঠাৎ মনে পড়ল, চোখে ভেসে উঠল একটি দৃশ্য। রাজশাহী। ১৯৬১। আমি রাজশাহী সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষ ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। বয়স, ১৭ কি ১৮। গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে সবে, পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে হাফ-হাতা চেকশার্ট। দাঁড়িয়ে আছি এজলাসে। সামরিক আইনে বিচার চলছে আমার, অন্য কয়েকজন সঙ্গীসাথী সহপাঠী সহকর্মীদের সঙ্গে, একই কাতারে। আমি আসামি, মারাত্মক অপরাধ! সামরিক আইনবিরোধী মিছিলে, সমাবেশে, ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়েছি। অদূরে আমার স্কুলশিক্ষক পিতা দাঁড়িয়ে। মুখ চুন। কাঁপছেন। আজ রায় ঘোষণার দিন। এখন পড়া হচ্ছে, বগুড়া থেকে সংগৃহীত পুলিশ রিপোর্ট। যিনি পড়ছিলেন, আমার নাম, উচ্চারণ করেই, থমকে গেলেন। ঢোক গিললেন। কম্যুনিস্ট! আমি কম্যুনিস্ট! আমি হতবাক। তাকিয়ে রইলাম শূন্যে, ঘুরন্ত পাখার দিকে। এই দেশে, বর্তমানে, বোধ হয়, এই আইনে, সবই সম্ভব। মৃদু হাসিতে ভেঙে পড়ে ঠোঁট। হয়তো বিস্মিত হয়েছেন স্বয়ং বিচারকর্তা, প্রিজাইভিং জাজ, আর্মি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কলম হাতে নেমে এলেন আসর ছেড়ে। ঘুরে এসে দাঁড়ালেন আমার মুখোমুখি। কম্যুনিস্ট! এদের আবার দেখা পাওয়া যায় না কি? শুনেছি তো এরা থাকে মাটির নিচে, আন্ডারগ্রাউন্ডে! কী আশ্চর্য, কম্যুনিস্ট! জ্বলজ্যান্ত, নকল নয়। এবার দেখা যাক! তিনি গম্ভীর মুখে ফিরে গেলেন নিজ আসনে। কিছুক্ষণের মধ্যে রায়ও ঘোষিত হলো। আমার দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আমি তখনও হাসছি। ভেঙে পড়লেন পিতা। আমি চমকে গেলাম, হতভম্ব।

ঘোর কাটতেই একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস। তারপরই বেরিয়ে এলো কবিতা। মনে পড়ে, লিখেছিলাম সারারাত। জানালায় আলো এসে টোকা দিতে, চমকে গেলাম। আর কত!

খ.

ধীরে, ভোর হলো। বাইরে তাকিয়ে রইলাম অপলক, ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে রাত-ভেজা মৃদু আলো। গাছের মাথায়, পত্র-পুষ্পে, মাঠে কোথাও কিন্তু টুঁ শব্দটি নেই। শব্দ নেই কারও মুখে, না বুদ্ধিজীবীর, না রাজনৈতিক দলের, গণতন্ত্রÑস্বাধীনতার ধ্বজাধারীদের। ভয়ে না আতঙ্কে, না গোপন আঁতাতের দলে, তারা সবই নিশ্চুপে মেনে নিয়েছে সংবিধান ও গণতন্ত্র-হরণ ও ধর্ষণ। হরণ তো আগে, চলছিলই। এবার পরিপূর্ণ ধর্ষণ। ভারাক্রান্ত হাতে গুটিয়ে নিলাম ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো লেখাটি। এবার ছাপিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে। কে ছাপাবে? মনে এলো, তরুণ কবি আবিদ আজাদের নাম। শত হলেও কবি, রাজি হয়ে যেতেও পারে। কবির কী আর সম্বল, একমাত্র সাহস ছাড়া, ব্যক্তিক দুঃসাহস। কেন জানি প্রত্যয় হলো, সে রাজি হবে। তার প্রেস লালবাগে; আমি চিনি। ইতঃপূর্বে সে আমার ভাষা বিষয়ে পুস্তিকাও ছেপেছে, তার প্রেসে। দেখা যাক।

উঠে পড়লাম ব্যাগ কাঁধে। সাড়ে আটটায় ক্লাস। ধরতে হবে। দুপুরে না খেয়েই একটার বাসে, ঢাকা। সোজা আবিদ আজাদের দপ্তরে। তাকে সবকিছু, পূর্ণাঙ্গ, সবিস্তারে বললাম। প্রস্তাব দিলাম। সে ছাপতে রাজি হলো, তবে একটিমাত্র শর্তে, এই মুহূর্তে কেউ যেন জানতে না পারে। আমি বললাম, আচ্ছা। আমার কথা আমি রেখেছিলাম, রাখতে সক্ষমও হয়েছিলাম, চরম সংকট মুহূর্তেও। মিলিটারি কর্তাদের মুখোমুখি জানিয়ে দিয়েছিলাম, দেখুন, এই কবিতা আমার লেখা, অবশ্যই প্রথম পৃষ্ঠায়ই আমার নাম মুদ্রিত। কিন্তু দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না কোথা থেকে ছেপেছি। আমি বলব না, কিছুতেই বলব না। পারলে আপনারা বের করে নিন। আপনাদের তো অনেক উপায়। তারা দুবার প্রশ্ন করেই থেমে গেছেন। আমাকে আর বিরক্ত করেননি। যা হোক, পরের কথা পরে হবে, প্রসঙ্গান্তরে ফেরা যাক। চা-বিস্কুট খেয়ে আমি আনন্দচিত্তে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়, আবিদের প্রেস ছেড়ে। এখানে, এখন বেশিক্ষণ থাকলে আবিদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। সাবধানের মার নেই, কথায় বলে। জুন কি জুলাই মাস, তারিখ সঠিক মনে নেই।

দ্রুত সপ্তাহের মধ্যেই, যত দ্রুত সম্ভব হলো, কপি হাতে এলো। দেড় হাজারের মতো। এবার বিলি করার পালা। তিন-চারজন বিশ্বস্ত বন্ধুপ্রতিম ছাত্রের শরণ নিলাম। তাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী, একজন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। আরিফ (বর্তমানে বিদেশে), হারুন (বর্তমানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) ওরা নিলো, যথাক্রমে প্রেস ক্লাবের ও কমলাপুর স্টেশনের এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের। বশির (বর্তমানে অ্যাসিসটেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল) দায়িত্বে থাকল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ঢাকা কলেজের। যা ফেলতে হলো অতি সন্তর্পণে, ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। শিক্ষক হয়ে আপন ছাত্রকে তো আর, কোনোক্রমে, জলে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সায় নেই বিবেকের। খুব যে একটা সাড়া পড়বে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি তখন। যা হোক প্রতিবাদ তো একটা করা গেল, এইটুকুই যা তৃপ্তির। কবিতা লিখে যাই, লিখতে চেষ্টা করি, সুতরাং যা-কিছু বলার ছিল, কবিতায় বলেছি, মানসম্পন্ন হলো কি না, সে প্রশ্ন তখন অবান্তর ঠেকেছে। বিশ্বাস করতাম আমার যা কিছু বলার মতো, তার বাহন তো কবিতাই। তা ছাড়া, আর কী-ই বা হতে পারে।

দ্বিতীয়ত আমার আরাধ্য ছিল এবং এখনও, ব্যক্তিক নন্দনের বদলে আমার অস্তিত্ব সামষ্টিক বন্ধন কবিতায়, যেখানে ব্যক্তিকবির রচনায় জায়গা করে নেবে, উঠে আসবে জনমানুষের, সমস্ত মানুষের কণ্ঠস্বর, সমাজের নিনাদ।

 

গ.

কী ভাবা সম্ভব হয়, আর ঘটেই বা কী। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খবর আসতে লাগল, কবিতাটি সেখানেও পৌঁছে গেছে, হাতে-হাতে, কখনও বা মুখে-মুখে। ফটোকপি পাওয়া যাচ্ছে, হাটে-বাজারে। চমকে উঠি। এতটা তো স্বপ্নেও ভাবিনি, কল্পনাও করিনি। কল্পনারও তো সীমা আছে, স্বপ্নেরই বা দৌড় আর কত দূর! একদিন আখলাকুর রহমান আমাকে ডাকলেন। ডেকে বসালেন তার পাশের চেয়ারে। করেছটা কী! পাঁচ হাজার ফটোকপি চীনে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু তারিক আলি দম্পতি তখন মিশরে কর্মরত! এক সন্ধ্যায় ভারতীয় দূতাবাসের একজন কূটনীতিক দম্পতি তাদের বাসায় হাজির। আপনাদের দেশে শুনছি একটা কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, সামরিক শাসন অমান্য করে। অমুক কবির লেখা। দাম এক ডলার। আমাকে জোগাড় করে দিতে পারেন! তারিক আলির স্ত্রী মিলিয়া আলি, উত্তর দিলেন, কবি তো আমার বন্ধু, সহকর্মী। মূল্য এক ডলার নয়, এক টাকা মাত্র। খুব প্রয়োজন! এই নিন। কূটনীতিক হতভম্ব। হাত বাড়িয়ে দিলেন। ধন্যবাদ। মনে থাকবে। দিল্লীতে আমাদের সকল ঊর্ধ্বকর্তার হাতে-হাতে পৌঁছে গেছে। মিলিয়ার মৃদু উত্তর, তাই নাকি! ভালো। মিলিয়া-তারিক সময়মতো আমাকে জানিয়েছে। এর কিছুদিনের মধ্যে আমার কিছু ছাত্র-ছাত্রী, সবাই সংস্কৃতিকর্মী, বিভিন্ন সংগঠনের, বিশেষ করে সংস্কৃতি সংসদ-এর কর্মী এসে প্রস্তাব দিল, স্যার, কবিতাটি আমরা আবৃত্তি ও গানের সাহায্যে সাধারণ শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করতে চাই। আপনি কী বলেন! আমি বললাম, সই! চেষ্টা করে দেখো, কী দাঁড়ায়। স্যার মূল অনুষ্ঠানে গণসংগীতও থাকবে। উৎসাহিত হলাম। তা হলে তো আরও উত্তম। আরও চলল সপ্তাহ দুয়েক ধরে। সবাই মনোযোগী, করিৎকর্মা। বিপুল উৎসাহে মঞ্চস্থও হলো এক সন্ধ্যায়। ছোট ক্লাসঘর। ভিড়ে ও উদ্দীপনায় ফেটে পড়ার অবস্থা।

এর কয়েকদিনের মধ্যেই সাভার ক্যান্টনমেন্টের (৯ নম্বর) এক সিপাহি ভরদুপুরে আমার বাসার দরজায়। স্যার, অমুক দিন বেলা দশটায় আমার স্যারেরা, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক। আপনি যদি... আমি জানতাম এমন একটা কিছু ঘটবে, অচিরেই। মনে-মনে প্রস্তুতই ছিলাম। তাকে বাক্যটি শেষ করতে না দিয়েই, উত্তর দিলাম, হ্যাঁ বুঝেছি, ঠিক আছে। তোমার অফিসারদেরকে বলো, ওইদিন ঠিক ওই সময়ে আমি সশরীরে উপস্থিত হব। চিন্তা করার কিছু নেই। শুধু গেটে যেন কেউ থাকে, আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমি তো ভেতরটা চিনি না। ঠিক আছে, কেউ একজন আসবে। আচ্ছা! কথা শেষ। তড়িঘড়ি বিদায় নিল সে। একটু যেন বিব্রত, দ্বিধান্বিত। রটে গেল ক্যাম্পাসে, স্যারকে মিলিটারি ডেকেছে। কেউ বলল, স্যার কেন যাবে! ডাকলেই যেতে হবে! যদি অ্যারেস্ট করে! উৎকণ্ঠা।

আমি চললাম, হ্যাঁ, ওই জন্য যাব। শুধু দেখাতে যে, মোটেই শঙ্কিত নই, ভীত হওয়া তো দূরের কথা। ওরা তো চাইছে যে, আমি যেন না যাই, ভয়ে। আমি যাব। তিন-চারজন ছাত্র এগিয়ে এলো, আমরাও সঙ্গে যাব স্যার। কোথায়! ক্যান্টনমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব! আপনার যদি কিছু ঘটে! বললাম, না। ঘটলে অবশ্যই যথাসময়ে সংবাদ পেয়ে যাবে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আর তোমরা আমার সঙ্গী হলে, অন্যরকম অর্থ দাঁড় করাতে পারে তারা। মিছামিছি কেন সে সুযোগ দিতে যাই। তবু তারা জিদ করে বসে থাকল। কিন্তু তাদের ইচ্ছার পথে বাদ সাধল, তাদেরই রাজনৈতিক দল। রফিক সাহেবের কাজটা হঠকারি, আমরা তার সঙ্গে নেই। তারপরও তোমরা যদি যাও, দল থেকে খারিজ হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে রক্ষা পেয়ে গেলাম আমি। একা একাই কাজটা করেছি, জানান দিয়েছি নিজস্ব বিবেকের, দায়ভার বইব আমি একাই। কিন্তু বশির আহমেদ, সে মানতে রাজি নয় কোনো নির্দেশ। আমি যাবই স্যার। নো, একা ছাড়ব না আপনাকে। গেটের বাইরে মাঠের মধ্যে, সিনেমা হলের চত্বরে, অপেক্ষায় থাকব। দেখি, কী ঘটে!

অগত্যা নির্ধারিত দিনে দশটা পনের মিনিট আগেই বশিরের মটরবাইকের পেছন সিটে, পৌঁছে গেলাম ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেটে। দেখি এক জোয়ান, অপেক্ষায়। বশিরকে বিদায় জানিয়ে জোয়ানের সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। সেখান থেকে বেশ কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে এলে একটা লম্বা দালান। মাঝে-মাঝে খোপ। তারই একটা খোপের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল জোয়ান, সঙ্গে-সঙ্গে আমিও। স্যার, ভেতরে দরজা খোলা। আমি ঢুকতেই, পেছন থেকে ভেজিয়ে দিল জোয়ান। অন্ধকার হালকা হতেই দেখি, সামনে একটা লম্বা টেবিল ঘিরে, তিন কি চারজন অফিসার প্রস্তুত। একটি খালি চেয়ার দেখিয়ে আমাকে বলল, বসুন। আমি বসলাম। এই ফাঁকে একজন হাতঘড়ির দিকে তাকাল। কাঁটায়-কাঁটায় দশ। সপ্রতিভ নিঃশ্বাস।

দেখলেন তো আমি আমার কথা রেখেছি। এবার এলো আপনাদের পালা। বলতে চাইছিলাম, কিন্তু বললাম না, মুখে এসেও আটকে গেল। শিষ্টাচারবহির্ভূত, তাই! ওদের ভেতর থেকে কেউ একজন নীরবতা ভাঙল, এবার শুরু করা যাক। জিজ্ঞাসাবাদ! ইন্টারোগেশন! দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ। প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা বিস্তৃত। সব তো এখানে বিস্তৃত করা যাবে না। সম্ভবও নয়। ভুলেও গেছি, বহু কিছু। কেউ উৎসাহিত হলে মহাফেজখানায় খুঁজে দেখতে পারেন। নিশ্চয়ই রক্ষিত আছে। এত মূল্যবান দলিল খোয়া যাবার কথা নয়। আর খোয়া গেলে, ধরে নিতে হবে, সত্যি-সত্যি দুর্ভাগা এই দেশ, বহু সাধের ও সাধনার আমার বাংলাদেশ।

আমি স্মৃতি থেকে, তুলে আনতে চেষ্টা করব, যেটুকু টুকরো-টুকরো অবস্থায়, সেখানে ধরা আছে। পাঠক নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন, এই অক্ষমতাকে।

মুখোমুখি একটি টেবিল ঘিরে বসা বিভিন্ন ব্যাজের চারজন সামরিক অফিসার। তার মাঝের জন বোধ হয় এই বোর্ডের প্রধান, দ্রুত একটা ফাইল হাতে নিল। ফাইলটি আলতো করে খুলল। দেখলাম ফাইলের বাঁ পাশে গাঁথা, নিউজপ্রিন্টে ছাপানো আমার কবিতাটি, পরিপাটি আকারে। ডান পাশে বেশ কয়েকটি কাগজে, কবিতাটির ইংরেজি, সঙ্গে ভাষান্তর, হাতে লেখা। টাইপ করাও নয়, বেশ মনে পড়ছে। আজও। বেশ কিছু অংশ, চিত্রকল্প, উপমা ইত্যাদি লাল কালির দাগ দিয়ে চিহ্নিত। অর্থাৎ বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ার প্রয়াস, বোঝা যায়। চকিতে ভেবে নিলাম, অনুবাদকর্মটি কার? কে এই শ্রম দিল! আমাদেরই অতিপরিচিত কেউ নয় তো! হতেও পারে, কে জানে! এবার কথা শুরু হলো, বিনিময়। হ্যাঁ কবিতাটি আমারই লেখা। ওই তো, স্পষ্ট অক্ষরে, প্রথম পৃষ্ঠায়, মুদ্রিত আমারই নামে। ভুল বুঝবার উপায় নেই। তবে, মুদ্রণ ও প্রচার সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে, আমি অপারগ। শুধু সময় ও বাক্য ব্যয় করে লাভ নেই। দেখুন আমাকে ভয় দেখিয়েও লাভ হবে না। ইতঃপূর্বে, যখন আমি প্রায় বালক, পাকিস্তানি সামরিক আদালতে বিচার কার্যক্রমের মুখোমুখি হয়েছি। সেদিন যখন ভয় পাইনি, আজ ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দেখুন আমি কবি না হতে পারি, তবে বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করি। সেই সুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের বংশধর, উত্তরসূরি। তাঁরা কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, আপস করেননি সত্য ও যা অনুভব করেছেন, সচেতনে, স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করে গেছেন। তাঁদেরকে অপমান করার অধিকার আমার নেই। সুতরাং আমার যা-বলার, তা আমি এই লেখায় বলেছি। দেখুন, আপনাদের মর্জি হলে এই মুহূর্তে গ্রেপ্তার করতে পারেন, করতে পারেন ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত। পাঠাতে পারেন জেলে। তারপর আরও ভেবে দেখবেন, ফলাফল কী দাঁড়াবে। আজ হয়তো, আমি, আপনাদের কাছে তেমন কোনো বড় সমস্যা নই। কিন্তু সেদিন যা হয়ে উঠব, ঠেকাবার ক্ষমতা আপনাদের নেই। হয়তো, দেশে ও বিদেশে, এতটাই বিখ্যাত হয়ে পড়ব। যার উপযুক্ত আমি নই, দাবিদারও নই; কিন্তু কে শুনবে আমার কথা! তখন হয়ে পড়ব, আমিও আপনাদের মতো অসহায়। ভেবে দেখুন! কী করবেন! দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টার কথোপকথন। পুরোটা বয়ান করা এখানে সম্ভব নয়, মনেও নেই। মাথার ওপরে ঘড়িতে দেখি দেড়টা। পেটে চোঁ-চোঁ খিদে। বললাম, দেখুন, আড়াইটায় আমার ক্লাস। আমি উঠছি। আমি এখানেই থাকব। এই ক্যাম্পাসে। যখনই স্মরণ করবেন, আমাকে পেয়ে যাবেন। চিন্তার কিছু নেই। দুশ্চিন্তার তো নয়ই। আমি মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে, এখনও সেখানেই আছি। থাকব, যতদিন বাঁচি। আমি চললাম। বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রচণ্ড রোদ্দুর। কেউ বাধা দিল না, পথ আগলেও দাঁড়াল না। বশিরের মটরবাইকের পেছনে পৌঁছলাম স্বগৃহে। কিছু খেয়ে নিয়ে চললাম ক্লাসে। কিন্তু এত সহজে পথ ছাড়েনি।

 

ঘ.

ওরাই জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি আমাদের শুয়োরের বাচ্চা বলেছেন! আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আপনি কি শুয়োরের বাচ্চা, নিজেকে কি তেমনটাই ভাবেন? যদি না হয়ে থাকেন, আমি কি এতটাই গর্দভ এবং নাবালক যে, আপনাকে শুয়োরের বাচ্চা বলব। হ্যাঁ আমি বলেছি, তবে তাদেরকে উদ্দেশ করেই বলেছি, যারা প্রকৃত অর্থে শুয়োরের বাচ্চা। কেউ- কেউ, সুহৃদদের মধ্যেও কেউ-কেউ, আপত্তি তুলেছিলেন, একজন লোক কবিতা লিখবে, তাতে করে আপত্তি করার কী আছে। হ্যাঁ আমিও জানি, কেউ-কেউ লিখলে, অবশ্যই আপত্তি করার কিছু নেই, তার স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু সেই কেউ- কেউ যদি হয় বিশেষ কেউ-কেউ, এবং লেখেন বিশেষ-বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ-বিশেষ সুযোগ নিয়ে, যা কি না জনমানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে, তখন কী করার থাকে, একজন কবির পক্ষে! তা ছাড়া আরও কথা থেকে যায়। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে গেছে। সাংস্কৃতিক জগতে যা শুধু আপত্তিকরই নয়, বিরক্তিকরও বটে! একজন সংবেদনশীল মানুষের কাছে অসহনীয়। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, নিজেদের দাপ্তরিক কর্মে অবহেলা করে, যথেষ্ট মনোযোগ না দিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন কবিতাচর্চায়। যেন এটা এতই সহজ কাজ, যেকোনো প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা যায়। প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এই নান্দনিক ভুবনে। চুপটি করে থাকা অসম্ভব, অন্যায়। নির্বোধের আচরণেরই সমতুল্য।

একজন প্রবীণ রাজনীতিক, আমার এক সময়ের সহপাঠী, কাউকে বলেছিলেন, রফিক তো দেখছি আপনাদেরকেও ছাড়েনি। অস্বীকারের উপায় নেই, সঠিক তার অভিযোগ। উচ্চবিত্তের লোভ, লালসা, লোলুপতা, মধ্যবিত্তের আপসকামিতা, মেরুদণ্ডহীনতা, রুচিহীনতা এবং নিম্নবিত্তের অযাচিত সহনশীলতা, কূপমণ্ডুকতা, প্রায় সর্বব্যাপী। এর সঙ্গে রাজনীতিকদের অনাচার, দুর্বৃত্তপোষণ, বণিকদের স্বার্থপরতা, শোষণ, সকল স্তরের মূল্যবোধ, বাঁচার প্রয়াস ও অভিপ্রায় ধ্বংস করে দিতে শুরু করেছে। বেচা- কেনা চলছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শহীদের রক্তমাংসহাড়। সাধারণ জনের নাভিশ্বাস। সে সময় আমি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরেছি নানা কাজে, প্রয়োজনে। ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে আমি এক দুস্থ-দরিদ্র পিতাকে আপন মেয়েকে বিক্রি করতে স্বচক্ষে দেখেছি। শিউরে উঠেছি। নিশ্চয়ই, সেটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না। ঘটছিল দেশের যত্রতত্র, অন্যত্রও। আমরা খোঁজ রাখিনি, চোখ বুঁজে থেকেছি। নির্বিবেক মধ্যবিত্ত, আত্মসম্মানলোভী মানবসমষ্টি, দেশবাসী। এইসব দুঃখ- বেদনা, আত্মপীড়নের কাহিনিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে কবিতাটি, উঠে এসেছে শব্দে-উপমায় চেতনে বা অবচেতনে। অনেকটা যেন আত্মবিমোচনের সাক্ষী এই সক্ষম রচনা। সর্বজনীন অপরাধবোধ থেকে স্বস্তি পাওয়ার এক দুর্বল অপচেষ্টা মাত্র।

 

ঙ.

ঘটনা বা অঘটনা থেমে রইল না, এগিয়ে চলল নিজ গতিতে। সামরিক গোয়েন্দা খোঁজখবর নিতে থাকল আমার সম্বন্ধে। জিজ্ঞাসাবাদ করল, আমার পিতা-মাতাকে, বিভাগীয় দুএকজন সহকর্মীকে এবং কিছু ছাত্র-ছাত্রীকেও। খোঁজ নিল আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের। সেখানে দেখে, লাল কালির দাগ, ওভার-ড্রাফট চলছে, মাসের পর মাস। সুতরাং হতাশই হলো তারা। মিলল না দ্বিতীয় কোনো পদের যোগাযোগ বা ইন্ধনের নমুনা। পরে শুনেছি। সাতক্ষীরায় আমার মামার বাড়িতেও খোঁজখবর করা হয়েছিল, আমার বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় কি না! কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গোয়েন্দা তৎপরতা ছায়া ফেলেছিল দীর্ঘকাল, বহুদিন ধরে।

৮৩-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান-প্রধান রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, আমার বাসায় আসে। তাদের অনুরোধ, আমি যেন খোলা-কবিতার অনুষ্ঠানটি, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে অনুষ্ঠিত হতে সম্মতি দিই। অসম্মত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। দিন-ক্ষণ নির্ধারিত হয়ে গেল। যত শীঘ্র সম্ভব! তারই প্রস্তুতি চলল সপ্তাহ ধরে। খুব সহজ বিষয় নয়। সার্বিক গোপনীয়তা অবলম্বন একান্ত প্রয়োজনীয়। বাধা-বন্ধকতা যেকোনো সময়, নানা অজুহাতে, হাজিরা দিতেই পারে। জেল, জরিমানা, গ্রেপ্তারের ভয়-ভীতি তো আছেই। যা-হোক, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা সোৎসাহে রাজি। ক্যাম্পাস থেকে ভোর ছটার বাসে উপস্থিত হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ছাত্রনেতৃবৃন্দ অপেক্ষায় ছিল গেটে। বরণ করে নিল। সকাল দশটায় অনুষ্ঠান। ভিড় জমে উঠল, সে কী ভিড়! অপরাজেয় বাংলার পাদদেশজুড়ে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক, বেশ কিছু দোতলার বারান্দায় সমবেত অনুষ্ঠান শুরু হলো। দারুণ এক অনুষ্ঠান। বলতে বাধা নেই, চমকিত হওয়ার মতোই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংহতি জানিয়ে মূল কর্মকাণ্ডেও অংশ নিল, রুদ্র (রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ্), কামাল চৌধুরী, মোহন রায়হান, আহমেদ আজীজ, তুষার দাশ এবং তাদের সঙ্গে অধ্যাপক কবি হুমায়ুন আজাদ। হয়তো আরও কেউ- কেউ, এত দিনে স্মৃতি থেকে ঝরে গেছে। আমি দুঃখিত। অনুষ্ঠান শেষে ছাত্রনেতৃবৃন্দ আবদার করল, স্যার মিছিল করা যাক। আর্টস বিল্ডিং ঘুরে-জুড়ে, সেই বোধ হয়, সামরিক আইনবিরোধী প্রথম সমাবেশ ও মিছিল। মনে পড়ছে একটি অতি উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত প্রতিবেদন লিখেছিল সেদিনের ছাত্র আজাদুল হক মাসুম, সচিত্র সন্ধানীতে।

ফেব্রুয়ারির ১৪। সামরিক বাহিনীর একটা দল, রাত্রে কড়া নাড়ল আমার আস্তানায়। কিন্তু বলতে হবে, তাদেরই দুর্ভাগ্য, আমি সে রাতে ঢাকায়। কবিতা ছাপা হচ্ছে, বাংলা একাডেমির প্রেসে। প্রুফ সংশোধন করতে-করতে গভীর রাত, তখন আর ক্যাম্পাসে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না, উপায়ও নেই। আমার টিকিটিও ছুঁতে ব্যর্থ কর্তাব্যক্তিরা, হুলিয়া জারি করে দিয়ে গেল। আমি খোঁজ পেলাম পরদিন সকালে। বন্ধুজন, শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, না, আপাতত ক্যাম্পাসে ফেরার কথাই ওঠে না। অন্য কোথাও থাকতে হবে, অন্য কোনো নিশ্চিন্ত আস্তানায়। পরে জেনেছি, আমাকে যে রাতে ধরতে এসেছিল, সে রাতেই কিছু ছাত্র-শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায় বাহিনীর লোকজন। এবং বেশ কিছু দিন ধরে তাদের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন, শারীরিক এবং মানসিক। সে ক্ষতের চিহ্ন এখনও বহন করে চলেছে কেউ- কেউ। আমার প্রিয়ভাজন অর্থনীতি বিভাগের এক তরুণ শিক্ষক, এখন দেশান্তরি, ছাড়া পেয়েই সে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। দেশে ফেরার স্বপ্নও আর সে দেখেনি। অথচ কী ছাত্রপ্রিয়ই না ছিল সে ধীমান! তরুণ। দেশের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সমূহ ক্ষতির দায়ভার বইবে কে!

 

চ.

আমার আশ্রয় জুটল পটুয়াখালীর এক সহৃদয় পরিবারে। এপ্রিলে ফিরলাম ঢাকায়। পরদিন ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসে ফিরে মুখোমুখি হলাম এক বিব্রতকর পরিস্থিতির। আমার বেশিরভাগ সহকর্মীই আর যেন চেনেন না আমাকে। দেখলে, বাসে কিংবা পথে-ঘাটে, মুখ ফিরিয়ে নেন, অন্যদিকে চেয়ে থাকেন। যেন আমি এক মারাত্মক ক্ষতির সামাজিক প্রভাব। আমার সংস্পর্শে এলেই বিপদ ঘটতে পারে তাদেরও। কে যেন রটিয়ে দিয়েছে যে, আমার পেছনে- পেছনে সবসময় গোয়েন্দার চর অনুসরণ করে, আমার গতিবিধি, কর্মকাণ্ড। আমি তো বিস্মিত, হতবাক। আজও জানি না সত্যি-সত্যিই কোনো গোয়েন্দা আমাকে অনুসরণ করত কি না। না পুরোটাই তাদের কল্পনাপ্রসূত। তবে, খোলা কবিতা যে কবারই চলেছিল, গোপনে-গোপনে, তার কাছে সামাজিক তৎপরতাও অক্ষম, অসহায়। টের পেলাম, রংপুর গিয়ে। এক যুবক, যুবা কমিউনিস্ট হবে, বলল, আপনাকে আমার মিষ্টি খাওয়াতে হবে। কেন? আপনার খোলা কবিতা ছাড়া আমি বিয়ে করতে পারলাম না। সে কেমন? একটি মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে ভালোবাসতাম, মন বিনিময় চলছিল, কিন্তু টাকার অভাবে বিয়ে করতে পারছিলাম না। খোলা কবিতার ফটোকপি বিক্রি করে একটা গতি হলো। প্রয়োজনীয় টাকার জোগান হলো। বিয়ে করলাম। সে টাকা তো ফুরিয়ে গেছে, এখন আর অবশিষ্ট নেই।

অনেক পরে, বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, ইত্যাবসরে। আমি কলকাতা যাব। বাসের টিকিট সংগ্রহ করতে কলাবাগান মোড়ে বাস কাউন্টারের আসনে এক ২০-২৫ বছরের যুবক। টিকিট চাইলাম। সে প্রস্তুত, মুখ তুলে নাম জিজ্ঞেস করল। নাম বলতে আঃ কী, সে সমীহমিশ্রিত স্বরে জানতে চাইল, আমিই কি খোলা কবিতার কবি? বললাম, হ্যাঁ। যুবক তখন টিকিটের মূল্য নিতেই অস্বীকার করে বসল। বললাম, তা কী করে হয়! ভাড়া তোমাকে নিতেই হবে। শেষ পর্যন্ত একটা দফারফা হলো, সে ভাড়া একশ টাকা কমই নিল। পুরোটা না নিতে সে অনড়। ভাবলাম, যখন খোলা কবিতা প্রচারিত হয়েছে, এই যুবকের বয়স কত ছিল! বড় জোড় দশ কিংবা তার চেয়ে কম। বাড়ি ঝিকরগাছা। অবাক হলাম, আশ্চর্যও। আমার অনুবাদিকা, কেরলিন বি. ব্রাউন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছে। যেতে চায় কক্সবাজার, ভ্রমণে। আমি আরও ব্যস্ত থাকায়, তার সঙ্গী হলো, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বর্তমানে ঔপন্যাসিক প্রশান্ত মৃধা। দূর-পাল্লার বাস। পথে পরিচয় এক অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে। বাড়ি জামালপুরে। কথায়-কথায় বেরিয়ে এলো কেরলিনের পরিচয়। সঙ্গে-সঙ্গে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, আপনারা উঠবেন কোথায়? প্রশান্ত উত্তর দিল, হোটেলে কিংবা অতিথিশালায়, যেখানে জায়গা পাই, সুবিধা হয়। না, তা হচ্ছে না। আমি জল বিভাগের প্রকৌশলী। আমাদের রেস্ট হাউস আছে। অবশ্যই সেখানে উঠতে হবে। কেরলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, খোলা কবিতা অনুবাদ করবেন তো? হ্যাঁ, ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। তা হলে তো কথাই নেই, আপনারা এখন থেকে আমার অতিথি। কেরলিন অন্তত একটা সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরেছিল স্বদেশে, সে যাত্রায়।

আমি তখন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক রাইটিং প্রোগ্রামে। উগান্ডার ঔপন্যাসিক পিটার নাজারেথ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন খোলা কবিতা প্রচার করছ না? দেখবে আমেরিকানরা তোমাকে লুফে নেবে। কী মুশকিলেই না পড়া গেল! সাড়া পড়ে যাওয়া তো দূরে থাক, আমাকে লুফে নেবার প্রস্তাবে আমার কোনো উৎসাহ না দেখে পিটার যারপরনাই মর্মাহত। অবশ্য আমি আমেরিকা থেকে বিদায় নেওয়ার পর, কেরলিন ব্রাউন স্ব-উদ্যোগে কবিতাটির অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করে। প্রচারিতও হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব ম্যাগাজিনে। নিউইয়র্ক ট্রেটনের কিছু অতি উৎসাহী ছাত্র-ছাত্রী কবিতাটি সেখান থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করে একটি চ্যাপা-বুক। প্রচারও করে বিভিন্ন স্কুলে। আমাকেও পাঠিয়েছে।

শেষ হলো খোলা কবিতার ইতিবৃত্ত। সমাপ্ত হলো না।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা