× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হাসান আজিজুল হকের নাট্যানুসন্ধান

সৈকত আরেফিন

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৫২ পিএম

হাসান আজিজুল হকের নাট্যানুসন্ধান

মানুষকে সামনে রেখেই আমাকে আমার চারপাশের জীবনের, আমার কালের, আমার পৃথিবীর বাস্তবকে ব্যাখ্যা করে যেতে হবে। তবে যদি আমার লেখায় বিন্দুমাত্র উপযোগিতা আমি খুঁজে পাই। যে বাস্তবের মধ্যে আমি বেঁচে আছি তার ব্যাখ্যাই আমার লেখার শেষ লক্ষ্য।

নিজের দিকে ফিরে : হাসান আজিজুল হক

 

হাসান আজিজুল হককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই যারা তাঁকে চেনেন, এই নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত করেই তারা তাঁকে ছোটগল্পকার এই অভিধায় অভিহিত করবেন। হাসান আজিজুল হক নিজে যদিও এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন- আমি যখন লেখালেখি শুরু করেছি, তখনই ভেবেছি উপন্যাস লিখব। উপন্যাস আমাকে যতটা টানত, কবিতা ততটা টানত না। পড়তে পড়তে যখন ভেবেছি আমিও লিখব, তখনই ঠিক করেছিলাম উপন্যাস লিখব। বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের উপন্যাস পড়তে গিয়ে বারবার ভেবেছি উপন্যাস লিখব। লেখা শুরুও করেছিলাম। ১৯৫৭ সালে একটি উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছিলাম। সেটি ছাপাও হয়েছিল পূর্বমেঘ পত্রিকায় শামুক নামে। তারপরে ১৯৬০-এ এসে লিখলাম শকুন। সবাই সেটাকে বলল গল্প। আমিও গল্প বলেই মেনে নিলাম। তারপরে পূর্বমেঘ পত্রিকায় একটি গল্প ছাপা হলো। সেটিও দেখলাম সমালোচকদের প্রশংসা পেল। তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাম্প্রতিক ধারার গল্প নামে একটি গল্প সংকলন বের করেন। সেখানে আমার বৃত্তায়ন ছাপা হয়। ৬৯-এর দিকে শিউলি নামে আরেকটি লেখা প্রকাশ হয়। তারপরে গল্প লেখাই শুরু করি। হতে চেয়েছিলাম ঔপন্যাসিক, লোকজন বানিয়ে ছাড়ল গল্পকার। [আমি আমার পুকুরে ইচ্ছেমতো সাঁতার কাটি : হাসান আজিজুল হক। মাসিক উত্তরাধিকার, সম্পাদক : ড. সরকার আমিন, ৯ মে ২০১৩] তখন, ছোটগল্পকার অভিধার বিপরীতে পরবর্তী জীবনে লেখা আগুনপাখি কিংবা সাবিত্রী উপাখ্যানের নিরিখে কিঞ্চিন্মাত্রায় ঔপন্যাসিক বলতে পারলেও আমরা তাঁকে কিছুতেই কবি বলতে পারি না। যদিও বিভিন্ন ছোটকাগজ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় খুঁজলে হাসান আজিজুল হকের কবিতাও ঠিক পেয়ে যাব। কিন্তু যে পরিচয়টি ঘুণাক্ষরেও আমাদের মনে আসবে না- নাট্যকার হাসান আজিজুল হক। এ প্রসঙ্গে কথা বলতেই এ উন্মোচন-পর্ব।

 

১.

হাসান আজিজুল হকের নামে নাট্যকার পরিচিতি আমাদের শোনার অনভ্যস্ততায় একেবারেই মানানসই মনে হয় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদলে তাঁর অভিনয়ের খবর আমাদের জানা আছে। এও জানা আছে যে, অভিনয়ও তিনি একেবারে খারাপ করতেন না। বস্তুত তিনি যাই-ই করুন না কেন, সেই করার মধ্য দিয়ে তার একটা আদর্শমান তিনি স্থাপন করেছেন বা করতে চেয়েছেন- এ কথা বললে হয়তো বাড়িয়েও বলা হবে না। চন্দর কোথায় নাটকটি হাসান আজিজুল হকের মৌলিক নাটক নয়। জর্জ শেআদের ভাসকো নামের এই নাটকটিকে ভাষান্তর করতে গিয়েও হাসান আজিজুল হক তাঁর আদর্শমানকে ভুলে যাননি। নিজস্ব ধরনে ভাষান্তর বা রূপান্তর করে ভাসকোকে বলতে গেলে মৌলিক নাটকের স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। জর্জ শেআদে লেবাননের কবি ও নাট্যকার। তাঁর জন্ম ১৯১০ সালে, আলেকজান্দ্রিয়ায়। তিনি বাস করতেন লেবাননের রাজধানী শহর বৈরুতে। এই বৈরুত শহরের একটি হোটেলেই অজ্ঞাত কারণে মারা গিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ১৯৬৩ সালে। যা হোক, জর্জ শেআদে লিখতেন ফরাসি ভাষায়। তাঁর অন্যান্য নাটক মসিয় বব্ল(১৯৫১), দ ইভনিং অব প্রোভার্বস (১৯৫৪), দি ভয়েজ(১৯৬১), এবং দি ইমিগ্রান্ট ফ্রম ব্রিসবেনভাসকো প্রথম মঞ্চস্থ হয় জুরিখে, ১৯৫৬ সালে। দর্শকরা সোৎসাহে গ্রহণ করেন নাটকটিকে। এক বছর পর প্যারিসে ভাসকো যখন প্রথম মঞ্চস্থ হয়, তখন বাদানুবাদের ঝড় বয়ে যায়। নিন্দা ও প্রশংসা দুই-ই তোড়ে চলতে থাকে। কেউ বলেন, ভাসকো ধিক্কারেরও অযোগ্য, কেউ বলেন, যিনি এই নাটক আক্রমণ করবেন, তিনি আর আমার বন্ধু থাকবেন না।

 

২.

ভাষিক ধরনের নিজস্বতা সত্ত্বেও চন্দর কোথায়-এ হাসান আজিজুল হকের যে স্বীকরণ, সে বিষয়ে সন্দেহাতীত হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতাও অস্বীকার করা যায় না। কেননা আমাদের হাতে জর্জ শেআদের ভাসকোর অনুপস্থিতি। ফলে দুটোকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করার মতো অবস্থায় আমরা নিশ্চিত ভাবেই নেই। এ জন্যে, এই সীমাবদ্ধতা মেনে, সবেধন নীলমণি চন্দর কোথায়কেই অবলম্বন করে এ লেখার প্রয়াস ফলত, অপূর্ণাঙ্গ ও দুর্বল বিশ্লেষণে পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনাটুকুও আমাদের মনে রাখতে হবে। তবে আশার কথা হলো, আমরা এর গতিমুখকে তুলনার দিকে নয়, বরং হাসান আজিজুল হকের ভাষান্তরের সফলতা ও চন্দর কোথায়-এর বক্তব্যের দিকেই নিতে চাইব।

ছটি অঙ্কের এই নাটকটির কুশীলবের নামের দিকে দৃকপাত করলেই হাসান আজিজুল হকের নিজস্ব ধরন ও সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। যে নাটকে পণ্ডিতের নাম ডুণ্ডুপতি; প্রধান সেনাপতির নাম তাকৎজঙ্গ; সেনাধ্যক্ষের নাম হোঁৎকপাল, কার্তিক, দুর্দান্ত; সান্ত্রীর নাম তলব শাহ, কলমগীর, বেদিল; সেপাইয়ের নাম হাড়গিলা, বদন; সৈনিকের নাম গলৎসিং, উচ্চিংড়েলাল; চাষির নাম রণ্ডাল, ঢুঢশা; বোনের নাম রুরুতি, বুড়ির নাম খোসাবুড়ি আর কন্যার নাম মায়াবী, নাপিতের নাম চন্দর সে নাটকের রূপান্তরসাফল্য নিয়ে নিঃসংশয় হওয়াই যায়।

নাটকটির আখ্যানভাগজুড়ে আছে এক ধরনের বিভ্রান্তি আর উদ্ভট শৃঙ্খলা। বনের মধ্যে একটুখানি ফাঁকা জায়গার পটভূমিকায়, যেখানে আশপাশের গাছগুলোতে কতকগুলো কাক স্তব্ধ হয়ে আছে- সেখানে আগাগোড়া বাতাসের আর্তচিৎকারের মধ্যে যে তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে নাটকের উদ্বোধন হয়, তাদের উচ্চারিত সংলাপের উদ্ভটত্ব আমাদের বিভ্রান্ত করে। সেনাধ্যক্ষ কার্তিক আসে পণ্ডিত ডুণ্ডুপতির কাছে। আসলে সে আসে সেনাপ্রধান তাকৎজঙ্গের বার্তা নিয়ে। যুদ্ধে গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহারের জন্য সে আসে চন্দরের সন্ধানে।

বস্তুত চন্দর-ই এ নাটকে একটি উপলক্ষ, ভরকেন্দ্র বা গন্তব্যবিন্দু।

কিন্তু চন্দরের ঠিকানা মায়াবী কিংবা মায়াবীর পিতা পণ্ডিত ডুণ্ডুপতি অনায়াসে কার্তিককে দেয় না। নাটক থেকে পাঠ করা যাক-

কার্তিক : আচ্ছা, আমাকে কি চন্দরের বাড়িটা কোনদিকে দেখিয়ে দিতে পারো?

ডুণ্ডুপতি: ও! চন্দরের বাড়িটা কোনদিকে দেখিয়ে দিতে হবে? এটা তো ভালো করে চিন্তা না করে করতে পারা যাবে না। একটু দেরি করো, আমি গাড়ি থেকে নেমে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।...

মায়াবী : (মুখ বাড়িয়ে) এই যে, কী খবর? ভালো তো?

কার্তিক : চন্দরের বাড়িটা কোথায় জানো?

মায়াবী : আমার বাপ তোমার সাথে কথা বলবে। ও-বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি অন্য কিছু বিষয় জানি। (চোখ টিপে, একটু থামে, কোনো উত্তর নেই) তোমার কি কোনো ব্যাপারেই আগ্রহ নেই? এই যে হু হু করে হাওয়া বইছে, তাতে কি তোমার কিছু এসে যাচ্ছে না, কিন্তু আমার ভিতরটা মোলায়েম হয়ে উঠেছে। (থামে) আমার দিকে তাকাও... তোমার নাম কী?

সংলাপের এ অংশে, কার্তিকের প্রশ্নে বাবা-মেয়ে দুজনই সতর্ক হয়ে কথা বলে। এবং যে ধরনের ভাষায় এই সংলাপভাষ্য নির্মিত হয় তাতে হাসানের অনুরাগী পাঠকমাত্রই হাসানকে চিনে নিতে শুরু করেন। আর তখনই চন্দর কোথায়ও অনুবাদ-উত্তীর্ণ হয়ে হাসানীয় হয়ে ওঠে।

 

দুটো প্রশ্ন করা যায়।

১. চন্দর কে? ২. চন্দর কী?

কিছুটা বিভ্রান্তিকর এই প্রশ্ন দুটির উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে হয়, আর কোনো একটি বস্তুকে। প্রথমত, আমরা যখন একজন মানুষের সন্ধানে ব্যাপৃত হই, একটি গাঁয়ে পুরনো একটি বাড়ি খুঁজে পাই- যেখানে আলকাতরা দিয়ে লেখা আছে চন্দর নাপিতের বাড়ি, এখানে চুল কাটা হয়। অর্থাৎ যাকে আমরা খুঁজে পাই সে একজন নাপিত। কিন্তু চুল কাটার জন্য সে কোনো লোক খুঁজে পায় না। সবাই যুদ্ধে চলে গেছে। দুজন কৃষক, বৃদ্ধ, রণ্ডাল আর ঢুঢুশা; এই দুজন সাধারণ মানুষের আলাপচারিতায় উঠে আসে তাদের ব্যক্তিগত দুঃখ, যা ব্যক্তি ছাপিয়ে নৈর্ব্যক্তিকতা স্পর্শ করে। যেমন-

 

ক.

রণ্ডাল: বসা যাক তাহলি। (দুজনে বালতি মাটিতে নামিয়ে রাখে)

          ঢুঢুশা : বলাডা ঠিক নয়, কিন্তুক ছেলেপুলেরা লড়াইয়ে যাওয়ার পরে আমাদের বুড়োদের ওপর ভারি চাপ পড়িছে।

রণ্ডাল : ভোরবেলায় উঠতে হচ্ছে।

ঢুঢুশা : কাজকম্ম সেরে ঘুমুতি দেরি হচ্ছে।

রণ্ডাল : কাজ করার আর ক্ষ্যামতা নাই।

ঢুঢুশা : বড়ো ছেলেডা চলে যাবার পর আর পারতিছি না।

রণ্ডাল : আমারও বড়ো ছেলে আর ভাইপোডা চলে যাবার পর...[চন্দর

কোথায়, দ্বিতীয় অঙ্ক]

 

খ.

রণ্ডাল : হুঁ, ফুৎ ফুৎ করে তিনবার কর্নেট, দমাদম দুচারডে ঢোলের বাড়ি আর একটা হুকুম- ব্যস, আমাদের ছেলেপুলেদের বাড়িছাড়া করতি এই য্যাথেষ্ট... ঐখানে ইয়ের ঐখানে (একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত করে) কামানের গোলা

ভরতিছে, কামানের খোরাক হতিছে।

ঢুঢুশা : কিন্তু দেশের কথা কনে গেল? ছোডোবেলা থেকে যে শুনি, আর

লোকে যে ফাডায়ে বক্তিমে করে- সেই দেশের কথার কী হলো?

রণ্ডাল : দেশ? ক্যানো, দেশ মানে তো আমার আমগাছগুলোন, তোমার মুলোক্ষেত, আমার ধানের চারা, তোমার গাই গরুডা। [চন্দর কোথায়, দ্বিতীয় অঙ্ক]

রণ্ডাল আর ঢুঢুশার আলাপচারিতার এই অংশটি খুব মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে আমরা দেখব যুদ্ধের কারণে খুব ব্যক্তিগত দুঃখ যখন সর্বমানবিক হয়ে উঠতে চায় তখন খুব সাধারণ মানুষের কথাবার্তায়ও দেশ ও রাজনীতি একটি ভিন্নমাত্রা নিয়ে হাজির হয়। একক ব্যক্তির আমগাছ, ধানক্ষেত বা মুলোক্ষেত তখন এককত্ব উত্তীর্ণ হয়ে সকলের হলে তখন দেশও আর বিমূর্ত থাকে না, দৃশ্যমান সত্তা হয়ে ওঠে। কিন্তু রণ্ডাল আর ঢুঢুশার কথার ফাঁকে চকিতে জানালায় একবার চন্দরকে দেখা যায়। একবার দেখা দিয়েই সে অদৃশ্য হয়ে যায়, যেন, চোখের সামনে দিয়ে একখণ্ড মেঘ চলে যায়। চন্দরের এই লুকিয়ে যাওয়া আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে। সম্ভবত সে লুকিয়ে থাকতে চায়- ভয়ে, লজ্জায়। সবাই যখন যুদ্ধে গিয়ে লড়াই করছে তখন তার বাড়িতে থাকার লজ্জা অনুভব করে চন্দরের বোন রুরুতি। নাটকে রুরুতির প্রথম উপস্থিতিতে তাকে কাঁদতে দেখা যায়। সে কাঁদে, নাক ঝাড়ে আর চিৎকার করে-

রুরুতি : চন্দর, ও চন্দর, তোর জন্যি আমি লজ্জায় মরে যাই। বলি, শুনতে পাচ্ছিস? জানালা দিয়ে একবার মুখ বাড়িয়ে তাকা, কেঁদে কেঁদে তোর বুনডির কী দশা হয়েছে দ্যাখ। সবাই লড়াইয়ে গেল, গরু, ভেড়া, মানুষ সবাই। তুই যাবি না ক্যানো? যুদ্ধে গেলি কত ভালো হতো। তোষামৎ বুড়ো বলে লড়াইয়ে গেলে তুই কী না হতে পারতিস। এই দৌড়াচ্ছিস, ঘেউ ঘেউ করছিস, সুযোগ সন্ধান করে দিচ্ছিস- কতরকমের কাজে আসতিস, তোর মতো সামান্য এক নাপিতের ভাগ্যে কী না হতে পারতো বল দিকিন! বড়ো বড়ো সেনাপতির সঙ্গে মিশতি পারতিস। [চন্দর কোথায়, দ্বিতীয় অঙ্ক]

রুরুতির হাহাকারে আমরা বুঝি, চন্দর যুদ্ধে না গিয়ে তাদের জন্য কেবল লজ্জাই নিয়ে আসেনি, তারা যে গৌরব ও সম্মানের অংশী হতে পারতো তা থেকে তাদের বঞ্চিত করেছে। কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণ একদা কবিতায় বলেছিলেন-

   যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা

   যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা

আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, যুদ্ধবাজরা সবসময়েই শান্তির কথা বলেই যুদ্ধ বাধায়। কিন্তু এ নাটকে রুরুতি ও অন্যারা যুদ্ধকে গৌরবের মনে করে। চন্দরের উদ্দেশ্যে রুরুতি আকুতি করে- বলি তুই কীসের ভয় পাতিছিস? এখানে এট্টা গুলি ফাটলি তার মানে তুই কি মরে যাবি? শুধু পা দুডো ফাঁক করে দাঁড়ালেই তো হলো। তোষামৎ বুড়ো তো তাই বলে। আর রাত্তিরবেলায় ঘুমুলে তুই অদৃশ্য হয়ে যাবি। তাহলে তোর ভয়ডা কিসির? তুই সকলের চেয়ে মাথায় খাটো, কাজেই তোর তো কোনো বিপদ নেই।... সবাই যা করছে, তুইও তাই কর চন্দর, লড়াইয়ে যা। [চন্দর কোথায়, দ্বিতীয় অঙ্ক] রুরুতির কাছে লড়াই একটা মজার জিনিস। টিনের বাক্সে ছুরি, কাঁচি ভরে নাচতে নাচতে লড়াইয়ে চলে যাওয়া যায়। অবশ্য তার মনে কিছুটা সংশয় আছে- মনে করিস না, আমার পরানে দয়ামায়া নেই। তোর কিছু একটা হলি তা কি আমার বুকে লাগবে না ভাবিস? কিন্তু তবু তোকে লড়াইয়ে যেতে হবে। [চন্দর কোথায়, দ্বিতীয় অঙ্ক] কারণ লোকে রুরুতিকে অকর্মা চন্দর নাপিতের বোন হিসেবে চিহ্নিত করে। লোকের সামনে সে মুখ দেখাতে পারে না। এমনকি তাকে কাজেও ডাকে না এ জন্যে। চন্দরকে সে বলে- দ্যাখ চন্দর, কোনো চুল নেই যে কাটবি, গোঁফ নেই ছাঁটবি। সবাই লড়াইয়ে মারা পড়িছে, আর রাঁড় মাগিগুলো কী ঘেন্নাই না আমাদের করতিছে। চন্দর তোরে বলছি আমি, যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাব আমি, সন্নিসিনী হব, ভগোমান আমার সাথে থাকবে- হাতে তরোয়াল কার্তিক দেবতা আমার ভাই হবেনে। চন্দর তোকে বিদায়, আমাকে বিদায়, আর এই লড়াইকে নমো। [চন্দর কোথায়, দ্বিতীয় অঙ্ক] এবং শেষ পর্যন্ত তোষামদের প্রণোদনায় যেভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছিল, রাজাকার, আল বদর, আল শামস যেভাবে নিরীহ বাঙালিদেরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল- সেভাবেই চন্দরকে তোষামৎ কার্তিকের কাছে তুলে দেয়। 

 

৪.

চন্দরকে মায়াবী ভালোবাসে। যুদ্ধের আবহে অন্ধকার নেমে আসা পৃথিবীতে হয়তো ভালোবাসাই প্রতিষেধক। চন্দরের যে মায়াবীর মধ্যে জাগ্রত হয় যে ভালোবাসা তা যুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়ায়। মায়াবী আর তার বাবা পণ্ডিত ডুণ্ডুপতি খুঁজে পেতে চন্দরের বাড়ি খুঁজে পায়। কিন্তু তার আগেই চন্দরকে নিয়ে চলে যায় কার্তিক। মায়াবী চন্দরের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যখন মনে মনে গায়- আমি মায়াবী, এক যে ছিল নাপিত- তার ভালোবাসার ধন... তখন চন্দরকে নিরস্ত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। ছোট পাহাড়ের কাছে একটি ছাউনির সামনে যেখানে কোনোরকমে লেখা আছে ছাউনি-১, সেখানে সেনাধ্যক্ষ হোঁৎকপাল চন্দরকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে বললে চন্দর জানায়- এইডা আমি কখনো করতি পারবোনানে। বিটি মানুষ সাজতে গিয়ে গুলি খেয়ে পডোল তুলতি পারবোনানে। কিন্তু হোঁৎকপালের ভাষায় গাড়োল চন্দরের সারল্য আমাদের আশ্বস্ত করে না। হোঁৎকপাল মায়াবীদের যে ছাউনিতে নিয়ে যায় সেখানে চন্দরের দেখা হয়। কিন্তু তখনও মায়াবী জানে না একেই সে খুঁজে ফিরছে। চন্দরের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে মায়াবী যখন সম্পূর্ণ একা হয়ে ভাবে-

আমি এখন একেবারে একা। আমাদের কুকুর বিশ্বেসী আর এই ঢোলকের সঙ্গে আমি এখন একা। নিজের কাছে নিজেকে নিয়ে একা। রাত্রির ছায়া কাঁপে।... আমার বাবা গিয়েছে খাবারের খোঁজে, আমাকে বিশ্বেসীর কাছে একা ফেলে। তারারা অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে। চাঁদের মানুষটি গাছের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে- আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষের মুখ খুঁজছি... ছায়ার পেছনে দৌড়ুচ্ছি বলে যারা আমাকে পাগল ভাবে, তারা কি কোনোদিন জানে, পাশে শুয়ে থাকা তাদের ভালোবাসার মানুষকে যখন তারা বুকে জড়িয়ে ধরে, তখন কি থাকে তাদের হাতের মধ্যে? ভালোবাসার স্বপ্ন ছাড়া আর কী কাজেই আমার চেয়ে সুখী তারা কেমন করে হবে?

[চতুর্থ অঙ্ক, পৃ. ১৮১]

তখন আমাদের ভালোবাসার শক্তি সম্পর্কে একটা ধারণা হয় বা আমরা বুঝতে পারি ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা যুদ্ধের কিংবা অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্তি ও আলো নিয়ে আসতে পারে। এই ভালোবাসা হয়তো চন্দরকেও ছুঁয়ে যায়। মায়াবীর দিকে তাকিয়ে তার একটা নিঃশ্বাস বড় হয়ে আসে- ওহানে তারে আমি দেহেছিলাম, (স্বপ্নাবিষ্টের মতো) আর তারপরের থেহে আমার বুকের মধ্যি কী যে করতিছে... আমার অন্তর ভেঙে গেইচে, না আধভাঙা হইচে। এ কথা শুনে কলমগীর তাকে সহানুভূতি জানিয়ে অদূর ভবিষ্যতেই বন্দুকের গুলিতে তার হৃদয় ঝাঝরা করে দেওয়ার ইঙ্গিত করে, তখন চন্দরের বলা কয়েকটি সংলাপ পড়ে নিতে চাই-

চন্দর : (নরম গলায়) হ্যাঁ, ভেতরে সিসের গুলি বা ভালোবাসা ঢুকলি ফর আর উপায় নেই কলমগীর দাদা। (দুর্দান্তকে) আমি এটু ক্যামন হয়ে গেলাম হুজুর- এমন আর কহনো হোয়নি আমার।

দুর্দান্ত : ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে যাও।

চন্দর : মিয়েটা এট্টা ঢাকের পাশে বসেছিল, নিজের চোহের জলপড়া দেখতিছিল- ওদিকি রাত্তিরের আঁধারও ঘনায়ে আসতিছিল। সেইজন্যি আমি যহন তার কাছে অ্যালাম, সে আমারে মনে করল বুঝিবা ভূত আইছে। (স্বপ্নালু) সে আমারে কলো, এহানে আপনি কী করতিছেন, আপনি কেডা? কী যে সোন্দর সে, আপনারে আর কী কবো- ফুলরে আর মেয়েলোকেরে কিসে যে এত সোন্দর করে কবে কেডা!

[পঞ্চম অঙ্ক, পৃ. ১৯৮]

এখানে আমরা দেখতে পাই- সরল, সুন্দর এক চন্দরকে, যে নিজে ভালোবাসে, ভালোবাসায় এবং বিশ্বাস করে। কিন্তু বিশ্বাস ও ভালোবাসা যখন ভঙ্গুর ও অপসৃয়মাণ তখন জর্জ শেআদ যেভাবে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের পক্ষে অবস্থান নেন, হাসান আজিজুল হক তাঁর নিজস্ব শক্তিমত্তা দিয়ে সেই প্রতীককে অবমুক্ত করেন চন্দরের ভেতরে। যদিও জর্জ শেআদ ভাসকোয় কী করেছিলেন আমাদের জানা নেই কিন্তু চন্দর কোথায়-এ হাসান আজিজুল হক চন্দরের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে এক বোধ আমাদের মনে জাগিয়ে তোলেন।

নাটকের শেষে শাদা কাপড় দিয়ে একটি মৃতদেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে মায়াবী। পাশে কুকুর বিশ্বাসী। ডুণ্ডুপতি মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। এ লাশ চন্দরের। হাসান আজিজুল হক যে প্রশ্নবোধক নামে চন্দর কোথায় অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন সেই চন্দরকে এভাবে দেখতে আমাদের ভালো লাগে না। চন্দর তো মূলত চন্দ্র, মানে আলো, যার উৎসকেন্দ্র সূর্য মানে ভালোবাসা। চন্দর সেই আলো ও ভালোবাসা যে অন্ধকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমস্ত শুভতার প্রতীক। আমরা জানি, আলো ও ভালোবাসা কখন হারতে পারে, নিহত পারে কিন্তু বিনাশ হতে পারে না। হাসান আজিজুল হক তাঁর নাট্যানুবাদে আমাদের সেই মন্ত্রটি শিখিয়ে দিতে পারেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা