আন্দালিব রাশদী
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৭ পিএম
একেকটা সময়
আসে, সদ্যোজাত শিশুদের একই রকম নাম রাখার ধুম পড়ে যায়। ১৯৪৭-এর পর জন্ম নেওয়া অনেক
বাঙালি শিশুর নাম জিন্নাহ। ১৯৫৮-র পরে জন্ম নেওয়া বহুসংখ্যক আইয়ুবের দেখা মেলে। জিন্নাহ
কিংবা আইয়ুবকে যত গালাগালই দিই, শেষ পর্যন্ত মেনে নিই- দুজনই বিখ্যাত মানুষ। আইয়ুব
জমানার শেষদিকে জন্ম নিয়ে আমার বাবা হয়েছেন আইয়ুব আলী মৃধা। একাত্তরের পরপর মুক্তি
নামের কন্যাশিশুর ছড়াছড়ি। সুমন নামের বিখ্যাত কেউ যে ছিলেন না এটা নিশ্চিত। তবুও সুমন
নাম এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে আমি যখন লালবাগ ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রির ছাত্র,
ক্লাসে তখন তিনজন সুমন। একই নামের একাধিক ব্যক্তি হলে চেনার সুবিধার জন্য নামের সাথে
একটা কিছু নির্ঘাত বসিয়ে দেওয়া হয়।
আমার নামের
আগে বসেছে গিটঠু। আমি গিটঠু সুমন। আমার শরীরে গিটঠু লেগে গেছে। কঠিন গিটঠু, শরীর আর
বাড়ছে না। আমার রোল নম্বর ৯।
রোল নম্বর
২৭ মাইগ্যা সুমন। তার বৈশিষ্ট্য শরীরে নয় কণ্ঠে, স্বর এবং কথা বলার ধরন মেয়েলি। মেয়েদের
বেলায় এটাই ঠিক, কিন্তু ক্লাস থ্রির মোটাসোটা ছাত্রের জন্য এটা বেখাপ্পা। তার নাম মটকু
সুমনও হতে পারত। কিন্তু আগেরটাই চালু হয়ে গেছে।
আমরা দুজনই
ক্লাস ওয়ান থেকে পড়ে আসছি, খেতাবটা এসেছে তৃতীয় বছরে। ক্লাস থ্রিতে সরাসরি ভর্তি হওয়া
শেষ ছাত্রটির চোখে চশমা ছিল, চোখ সম্ভবত একটু ট্যারাও। সেও সুমন। ক্লাসের একমাত্র চশমাধারীকে
আমরা ধরে নিয়েছিলাম ফুটানির চশমা। কিন্তু পরে বুঝতে পারি চোখে চশমা না থাকলে ব্ল্যাকবোর্ডের
লেখা সে দেখতে পায় না। তার নাম হয়ে গেল দেড়ব্যাটারি সুমন। চশমার সাথে ব্যাটারির সম্পর্ক
কী তখন বুঝিনি, এখন বুঝি এটা ভূমিকার ঐক্য। চর্ট লাইটে ব্যাটারি না ভরলে শত টেপাটেপি
করেও লাইট জ্বালানো যাবে না, চশমা চোখে না দিলে সুমনও দূরের কিছু দেখবে না। কিন্তু
পুরো দুই না হয়ে দেড় ব্যাটারি কেন, এখনও আমার কাছে অজ্ঞাত। তা ছাড়া অর্ধেক কোনো ব্যাটারি
এ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি।
ফ্রি প্রাইমারি
স্কুলগুলো কো-এডুকেশন স্কুল হয়ে থাকে। আমাদের পঞ্চাশ কি বায়ান্ন জনের অর্ধেকের বেশিই
মেয়ে। আমার আমলে মেয়ে সন্তানই বেশি জন্মগ্রহণ করত। কাজেই ক্লাসে বেশি মেয়ে হবে এটাই
স্বাভাবিক। আমার বোনের সংখ্যা ভাইয়ের ঠিক দুইগুণ- দুই ভাই, চার বোন, এর মধ্যে দুই বোন
এমি আর মিমি টুইন, তবে আইডেন্টিক্যাল টুইন নয়। এমির মুখমণ্ডল লম্বাটে। মিমির গোলগাল,
এমিকে ফর্সাই বলা যায়, মিমি ফ্যামিলিতে সবচেয়ে কালো। বাবার চেয়েও, আমার চেয়েও। শুনে
এসেছি, ছেলেদের গায়ের রঙে কিছু এসে যায় না, মেয়ে ফর্সা না হলে বিয়ে আটকে যেতে পারে।
অবশ্য ২০১৯-এর বিশ্বসুন্দরী মানে মিস ইউনিভার্স জোজি তুনিজ যথেষ্ট কালো। জোজি দক্ষিণ
আফ্রিকার। ২০১১-এর মিস ইউনিভার্স অ্যাঙ্গোলার লিনা লোপেজ তার চেয়েও বেশি কালো। কালো
মেয়ের বিয়ের বাজারে চাহিদা বেশি। সাদা মেয়েদের তুলনায় বেশি সংখ্যক স্বামীর সাথে বসবাসের
রেকর্ড তাদের। বাংলাদেশ, হয়তো ভারত আর পাকিস্তান ব্যতিক্রম। সাদা হলেও লিন্ডা টেয়লরকে
নিশ্চয়ই কেউ আকর্ষণীয় কিংবা সেক্সি বলবে না, অথচ আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ বার বিয়ে করে রেকর্ড
করেছেন, আর অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক কতজনের সাথে সেটা তো আর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের খাতায়
ওঠেনি।
এবার নিজের
কথা বলি। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়কার আমি যে গিটঠু সুমন, সে গিটঠু আর ছাড়াতে পারিনি।
আমি বামন হিসেবে বেড়ে উঠছি বলা ঠিক হবে না, কারণ আমি বাড়িনি, বরং বলতে পারি বয়স বাড়িয়ে
ফেলেছি। বামনদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান রীতিমতো গর্ব করার মতো।
আমি জানি ৪
ফুট ১০ ইঞ্চি বা ১৪৭ সেন্টিমিটার উচ্চতা যারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও অতিক্রম করতে
পারেনি, তারাই বামন। আমার বেলায় ৪ ফুটই অনতিক্রম্য রয়ে গেছে। গত উনিশ বছরে আমার সর্বোচ্চ
উচ্চতা ৩ ফুট সোয়া ১১ ইঞ্চি, ১২০ সেন্টিমিটার বলা যায়। ৯ থেকে ১৯ পর্যন্ত দশ বছরে আমার
উচ্চতা এক মিলিমিটারও বাড়েনি। বাড়লে খুব যে একটা উপকার হতো এমন নয়।
একই সঙ্গে
বামন ও দানবাকৃতির হওয়ার রেকর্ড করেছিলেন অ্যাডাম রেইনার। ১৯১৭ সালে তার বয়স ১৮ বছর,
তখন তার উচ্চতা ৪ ফুট সিকি ইঞ্চি, সেন্টিমিটারের হিসেবে ১২২.৫৫। এ পর্যন্ত বেশ ভালোই
ছিল তার জীবন। তারপর হঠাৎ তিনি লম্বা হতে শুরু করলেন। ১৪ বছর পর ১৯৩১-এ তিনি যখন ৭
ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতায় পৌঁছলেন, তার পায়ের মাপের জুতো পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। ডাক্তাররা
পরীক্ষা করে তার পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার আবিষ্কার করলেন। টিউমার সরানো হলো, সার্জনের
নাম ডাক হলো, পশার বাড়ল, কিন্তু অ্যাডাম রেইনার ততদিনে দাঁড়াবার শক্তি হারিয়েছেন। তাকে
একটি বৃদ্ধনিবাসে রেখে সরকারি খরচে চিকিৎসা চালানো হলো, আরও কিছুকাল বেঁচে থেকে ৭ ফুট
৮ ইঞ্চি উচ্চতায় পৌঁছে ৪ মার্চ ১৯৫০ জীবনের অর্ধশতক পেরিয়ে ৫১তম বর্ষে মৃত্যুবরণ করলেন।
নিজের এই গিটঠু লেগে থাকা আবার হঠাৎ গিটঠু ছুটে যাওয়ার পর ম্যান মাউন্টেন হয়ে ওঠা কোনোটার
ওপরই তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু তিনি শেষ পর্বে যথেষ্ট ভুগেছেন। তার কোনো আত্মজীবনী
কিংবা স্মৃতিকথা আছে কি না জানার চেষ্টা করেছি, নেই। থাকলে ভালো হতো, আমার অভিজ্ঞতা
ও অনুভূতির সাথে মিলিয়ে দেখতে পারতাম।
আমি আমার গিটঠু
জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছি। মন খারাপ দুয়েকবার হয়নি এমন নয়, কিন্তু গিটঠু খুলতেই যদি ম্যান
মাউন্টেন হয়ে পড়ি, নিজের ভার বইতে আমার পা অস্বীকার করে, আমাকে যদি বৃদ্ধ নিবাসে পাঠিয়ে
দেওয়া হয়, রাষ্ট্র যদি আমাকে...। রাষ্ট্রের কথা থাক।
আমি ঠিক করেছি
আমার গিটটু জীবনের স্মৃতি লিখে রেখে যাব। অন্তত মুখবন্ধটা তো লিখি।
যেভাবেই হোক
সনদ বাগিয়ে সেই কোটার সিভিল সার্ভেন্ট ছিলেন আমার বাবা। যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলেন।
বিলোনিয়া রণাঙ্গনে যখন যুদ্ধ চলছে... বাবা এটুকু বলতেই আমি বাধা দিই, না বাবা কামালপুর।
আগেরবার কামালপুর বলেছিলে।
বাবা চিৎকার
করে ওঠে, চুপ কর হারামজাদা। বড়দের কথার মধ্যে নাক গলাচ্ছিস।
আমি হাতে নাক
ঢাকি। নাক না গলানোর সিদ্ধান্ত নিই। বাবা বলতে থাকেন, গুলিটা এসে ঠিক বাম পায়ের হাঁটুর
নিচে... বাবা কথা শেষ করতে পারেননি। আমি বলি, না বাবা ডান হাঁটুর একটু ওপরে।
এবার মুখে
নয়, জোরে চড় কষাতে যাচ্ছেন, আমি বলে উঠি, আগেরবার তো তাই বলেছিলে। ভুলে গেছ নাকি? বানিয়ে
বানিয়ে বললে এমনই হয়।
বাবার আশেপাশে
দুয়েকজন সিভিল সার্ভেন্ট থাকেন। তাদের একজন বাবাকে আটকে দেয়, স্যার বাচ্চামানুষ, বলুক।
বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, কিসের বাচ্চা? ওর বয়স কত তোমার ধারণা আছে? হি ইজ সিক্সটিন প্লাস।
শেষ পর্যন্ত
আমার মার খেতে হয়নি। এখন আমি নাইনটিন। আমার উচ্চতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
পৌনে এক ইঞ্চি বাড়লে পুরো চার ফুট হতো। ভালো দিকটা হচ্ছে, আমি প্রপোরশনেট ডোয়ার্ফ বা
সমানুপাতিক বামন। ডিসপ্রপোরশনেট বা অসমানুপাতিক বামনদের মর্যাদা ও চাহিদা কম। তাদের
মাথাটা পূর্ণবয়স্ক স্বাভাবিক মানুষের কিন্তু শরীরটা শিশুর কিংবা পা খুবই ছোটো, স্বরও
ছোট। সমানুপাতিক বামনের বেলায় সুবিধে অনেক। অর্ডার দিয়ে জামা-প্যান্ট বানাতে হয় না।
কাপড়ের দোকানে ছোট ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট, জুতোর দোকানে স্কুল কেডস চাইলেও পাওয়া যায়।
সুন্দর সুগঠিত বামন হিসেবে আমি চাকরির অফার পেয়েছি চাইনিজ রেস্তোরাঁ এবং বিউটি পার্লারের
ডোরম্যান, এমন আশ্বাসও পেয়েছি- এফডিসিতে একবার ঢুকতে পারলে সাকিব খানকেও কাত করে দিতে
পারব। ডান-বাঁয়ে পয়সা কামাই করা আমলা বাবার ছেলের ডোরম্যানের চাকরি না হলেও চলবে।
আমেরিকার স্ট্যান্ডআপ
কমেডিয়ান ব্র্যাড উইলিয়ামসও অ্যাকন্ড্রেপ্লাসিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন আমার কবছর
আগে। সিনেমা, টেলিভিশন আর মঞ্চ মাতিয়ে ব্র্যাড এখন বিলিয়নিয়র হওয়ার পথে। কিম কার্দাশিয়ানকেও
নাকি পাত্তা দেন না।
আমার ধাঁচটা
কমেডিয়ানদের নয়, ইন্টেলেকচুয়ালদের। গতবার কিউ টিভির ঈদ জলসায় আমার সাক্ষাৎকার প্রচারিত
হয়েছে। বাবা রাজি ছিলেন না, কখন কোন কথা বলে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলি। বাবার এক্সটেনশন
নেওয়ার সময় এসে গেছে, এ সময় আঁতেল ছেলের কারণে সরকার অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে যদি ফিরিয়ে
দেয় এই ভয়। টেলিভিশনে যাওয়ার আগে বাবা একটি ব্রিফিং দিয়েছেন, উস্কানিমূলক প্রশ্নের
মুখেও যেসব বিষয়ে ঠোঁটজোড়া সুপার গ্লু আটকা থাকবে সেগুলো হচ্ছে : বাঙালি ও বাংলাদেশি
জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, নির্বাচন, ধর্ম, মানি লন্ডারিং, বেগমপাড়ার বাড়ি, রাজনীতি ইত্যাদি।
ঈদ জলসার উপস্থাপক
যখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছেন, তার কাজটা আমিই সহজ করে দিলাম বললাম- আমিই বরং
বলি। বলতে শুরু করলাম, আমাকে যেভাবে যে বিশেষণ ব্যবহার করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হোক না
কেন, আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি ক্লাস থ্রিতে পাওয়া পরিচিতিটি- গিটঠু সুমন।
ধন্যবাদ গিটঠু
সুমন, শুনেছি আপনি মজার মানুষ। মজার কথা শুনতে চাই আপনার মুখে।
আমি বলি, দেখুন
আমি স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান নই। তা ছাড়া আমাদের সহনশীলতা খুবই কম। আমি যা-ই বলব, কেউ
না কেউ ভেবে বসবেন, এতে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে, মানহানির মামলা করবেন। তার চেয়ে
বরং সর্দারজির একটা গল্প শোনাই। সর্দারজি টিকেট না করেই ট্রেনে চড়েছেন, তিনি শুনেছেন
মন্ত্রীরা ভাড়া দেন না। তিনিও প্রস্তুতি নিলেন। টিকেট চেকার টিকেট চাইতেই সর্দারজি
বললেন, আমি একজন মন্ত্রী।
টিকেট চেকার
নিজেও একজন সর্দার, কিন্তু মন্ত্রীকে ঠিকভাবে চিনতে না পারায় জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু
আপনি কোনজন?
সেই মুহূর্তে
একমাত্র ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া আর কারও নাম সর্দারজির মনে পড়ল না। তিনি অবলীলায় বলে ফেললেন,
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।
টিকেট চেকার
থ হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নুইয়ে পা ছুঁয়ে তাকে প্রণাম করে বললেন, এই
প্রথম আপনাকে সামনাসামনি দেখলাম ম্যাডাম।
উপস্থাপক কী
বুঝলেন তিনিই জানেন, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান
নিয়ে তিনিও দুমিনিট বলে ফেলার সুযোগ ছাড়লেন না।
উপস্থাপক বললেন,
জনাব গিটঠু সুমন, আপনার কোনো অতৃপ্তি আছে কি?
আমি বললাম,
আছে। আমি এখনও আঠারো না হওয়ায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারছি না।
উপস্থাপক আমার
আগ্রহে সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, এটাই তো সচেতন নাগরিকের লক্ষণ। আপনি নিশ্চয়ই ভোটাধিকার
প্রয়োগ করবেন।
মোটেও না।
আমার কাছ থেকে হরণ করার মতো কিছুই নেই। তখন অন্তত একটা কিছু হরণ করার অভিযোগ জানাবার
সুযোগ পাব।
উপস্থাপক বললেন,
বুদ্ধিদীপ্ত জবাবের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ,
সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে বুদ্ধিজীবীরাই থাকেন। যখনই জাতির কোনো সঙ্কট, দেখেন খুব দ্রুত
কচ্ছপের মতো গলাটা শক্ত খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেন। সময়মতো গলা ও গর্দান রক্ষা করার
যে তৎপরতা তা বুদ্ধিবৃত্তির নিরাপত্তা সচেতনতা থেকেই আসে।
কিউ টিভির
গাড়ি আমাকে বাড়ির দরজায় নামিয়ে দেয়। বাড়িতে ঢুকেই দেখি বহুবছর আগে প্রয়াত আমার দাদার
একটি বড় পোর্ট্রেট ক্ল্যাম্প দিয়ে ড্রইং রুমের দেয়ালে আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একজন
নামি চিত্রশিল্পী পোর্ট্রেটটা করেছেন। বেশ বড় ছবি। কিংবা আমি নিজে ৩ ফুট সোয়া ১১ ইঞ্চি
হওয়ার কারণে ছবিটা আমার কাছে আরও বড় মনে হচ্ছে। ছবির কাজটা শিল্পীই করেছেন কিন্তু তত্ত্বাবধানের
কাজটা করেছেন বাবার প্রাইভেট সেক্রেটারি আহমেদ খায়রুজ্জামান, তিনিও বিসিএস ক্যাডার।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হয়েছে?
আমি বললাম,
কোনটা? ছবিটা না ছবির নিচের লেখাটা?
দুটোই।
বললাম, আমি
যখন খুব ছোট, টাকাপয়সার কী এক গোলমালে দাদাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমার স্মৃতিতে
জীবন্ত দাদা নেই, ছবি দেখেছি, এটা ছবির চেয়ে ভালো। বিশিষ্ট মানুষ মনে হচ্ছে।
আর লেখাটা?
আমি একটু এগিয়ে
গিয়ে পড়লাম : এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ : ভাষাসৈনিক গোলাম হাক্কানি।
তারপর জিজ্ঞেস
করলাম, কে ভাষাসৈনিক?
তোমার দাদা,
স্যারের বাবা।
কোন ভাষার?
খায়রুজ্জামান
বললেন, ইউ মাস্টবি প্রাউড অব ইয়োর দাদা। আমরা চেষ্টা করছি, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়ে
যাবেন। তার সম্পর্কে লেখার জন্য রাইটারদের এনগেজড করা হয়েছে।
পরদিন দাদার
ছবিকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে আমার বাবা যে সাক্ষাৎকার দিলেন, শুনে আমিও অবাক হলাম। ভাষাসৈনিক
গোলাম হাক্কানি কখনও চাননি তার নাম প্রচারিত হোক। সে সময় মানে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি
পুলিশের ডিআইজি আর ঢাকার ডিসির মাঝখানে যে আধলা ইট এসে পড়ে সেটি কে ছুড়েছিলেন ইতিহাসে
লেখা নেই। সেটি ছোড়েন আমার মরহুম আব্বাজান গোলাম হাক্কানি। আমরা যদি সচেতন জাতি হতাম
তা হলে সেই আধলা ইট জাতীয় জাদুঘরের কাসকেটে প্রদর্শনীতে থাকত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম
দূর থেকে সেই ইটকে চুম্বন করে ধন্য হতো।
সাক্ষাৎকার
গ্রহণকারী বললেন, কিন্তু ভাষাসৈনিক মরহুম গোলাম হাক্কানি তো এখনও তার প্রাপ্য স্বীকৃতি
পাননি।
বাবা বললেন,
তিনি তো স্বীকৃতির লোভে জীবন বিলিয়ে দেননি। স্বাধীনতার বৈরী শক্তির হাতে ক্লোজ শটে
গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। এ নিয়েও পরিবারের পক্ষ থেকে কখনও কিছু বলা হয়নি। আব্বাজান
ছিলেন প্রচারবিমুখ।
আমিও অবাক
হই। আমি যত খাটোই হই না কেন, আমার দাদা এত বড়মাপের শহীদ এবং ভাষাসৈনিক ছিলেন এটা আমি
জানব না এবং এ নিয়ে গর্ব করব না তা কেমন করে হয়!
কিন্তু আমি
যে জানি ভিন্ন কথা। ব্যবসার মূলধন আত্মসাতের কারণে দাদার ক্ষুব্ধ বিজনেস পার্টনার আলী
নওয়াজ খান পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক গুলি করে তাকে হত্যা করেছেন। অন্য ছেলেরা যখন মামলা করতে
যাচ্ছে আমার বাবাই তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে ভাইদের বলেছে, আলী নওয়াজ মারেননি,
অন্য কেউ মেরেছে। মামলায় টাকা নাশ হবে, আলী নওয়াজ তখন লোক লাগিয়ে সত্যিই আমাদের মারবেন।
এ কাহিনি আমাদের জানা, আমার দাদি আমার মাকে বলেছে। বাবা এ কী বলছেন?
ইতিহাস এভাবেই
লেখা হয়। উইনার্স রাইট হিস্ট্রি। আমার প্রশ্নটা ভিন্ন : চাকরিতে এক দুবছরের এক্সটেনশনের
জন্য বাবার আয়োজনটা কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
একজন অবসরপ্রাপ্ত
সরকারি কবি বাবার পেছনে ঘুরঘুর করছেন, গোলাম হাক্কানির বায়োগ্রাফি লিখবেন। বাবা তাকে
গাইড লাইন দিচ্ছেন; ফ্যামিলির হিস্ট্রিটা এতে কনসোলিডেট করতে হবে। ইটস অ্যা ফ্যামিলি
টোটালি ডেডিকেটেড টু দ্য নেশন।
***
ঠিক পরের দিন
সন্ধেবেলা থেকে টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখানো হচ্ছে : সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠ
পুত্র আহমেদ মোত্তাকিন বাবু চট্টগ্রামের জঙ্গি আস্তানায় গুলিবিদ্ধ ও নিহত।
মা হাউমাউ
করে কেঁদে উঠতেই বাবা তার মুখ চেপে ধরেছে, সাবধান, কোনো কথা নয়- আহমেদ মোত্তাকিন বাবু
আমাদের কারও সন্তান নয়। কেউ মুখ খুলবে না। সামনের সময়টা খুব ক্রিটিকাল। আমার হাতে অনেক
কাজ। ফর গড’স সেইক, হেল্প মি।
বাবু আমার
চেয়ে নয় বছরের বড়। তার মানে বাবু আটাশ। আমাদের মাঝখানে রিমি, এমি ও মিনি এবং চুমকি।
রিমি তার পেট্রোকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর সাথে কুয়েতে। এমি ও মিমি ঢাকায়, চুমকি
দার্জিলিংয়ের একটি রেসিডেন্সিয়াল কলেজে। এমি আর মিমি যে কী করে আমার জানা নেই। পার্টিতে
যায়, রাত করে ফেরে। দুজন একবারই মডেল হয়েছিল- ম্যাডোনা স্যানিটারি ন্যাপকিন। অসাধারণ
শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন, আট ঘণ্টার নিশ্চিন্ত জীবন। রিমি ম্যাডোনার বিশাল প্যাকেটের ওপর
বসে পা দুলিয়ে বলছে, ম্যাডোনা আমার প্রাণ। ঠিক উল্টোদিকে দ্বিগুণ আকৃতির একটি প্যাকেটে
বসে মিমি বলছে, আমারও।
সয়াবিন তেল
কিংবা বেবি ফুডের বিজ্ঞাপন হলে বাবা কিছু মনে করতেন না। কিন্তু স্যানিটারি টাওয়েল বা
কনডমের বিজ্ঞাপনে তার সম্মতি নেই। সুতরাং এমি মিমি দুজনকে ডেকে বলেছেন, এটাই শেষ। আর
যেন কোনোটাতেই না দেখি। তারা কথা রেখেছে। অথবা বিজ্ঞাপনটি ফ্লপ করায় তারা আর কোনো কাজ
পায়নি।
বাবু ভাইয়া
বাড়ি ছেড়েছে নয় মাস আগে। আমার অ্যান্ড্রয়েড টাচফোনটি তারই কিনে দেওয়া। যেদিন বাড়ি ছেড়ে
যায়, ওয়েইং স্কেলে দাঁড় করিয়ে আমার ওজন নেয়- সাড়ে ২৬ কেজি।
বাবু ভাইয়া
বলল, ২০০ গ্রাম বেড়েছে। সাবধানে থাকিস। পাকা পাকা কথা বলিস না। বাবার সামনে মুখ খুলিস
না। হি ইজ অ্যা প্যাথোজেনিক লায়ার। আমি প্রত্যেক ফ্রাইডে রাতে ফোন দেব। বাবার কথা ছাড়া
খুব সংক্ষেপে সবার কথা বলবি।
তুমি কোথায়
যাচ্ছ ভাইয়া?
আমি হিজরত
করছি।
হিজরত!
তুই বুঝবি
না।
বাবা চিটাগাংয়ের
গুরুত্বপূর্ণ কাউকে বলে দিয়েছেন, ডেডবডি ঢাকা পাঠাবার কোনো দরকার নেই। ওখানেই সামলে
নিও। টাকা যা লাগে খরচ করো।
সে রাতেই আমি
অ্যাডাম রেইনারকে স্বপ্নে দেখি। ডোয়ার্ফ নয়, ম্যান মাউন্টেন। আমাকে বললেন, গিটঠু সুমন,
দেরি করিস না। পিটুইটারি গ্ল্যান্ড চেক করিয়ে নে। গিটঠু ছুটে গেলে সমস্যা বাড়বে।
আমি বলি, স্যার
আপনি বাংলা বলছেন?
অ্যাডাম ফিরেও
তাকায় না, লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।
আমার খালাতো
বোন এবং একসময়ের ক্লাসমেট পাপড়ি কলেজ হোস্টেল থেকে আমাকে দেখতে আসে। পাপড়ি আমাকে এখনও
পিচ্চিই ডাকে। আমার চেয়ে সাড়ে চার মাসের বড়, মানে কুড়ি ছুঁই ছুঁই। লম্বা ৫ ফুট সাড়ে
৫ ইঞ্চি, শরীরটা একটু ভারীই, পাপড়িই বলেছে সাড়ে ৬৬ কেজি। গায়ের রঙটাও বাংলাদেশি ছেলেদের
প্রত্যাশিত রঙ নয়। পাপড়ির সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
আপাতত একটু ছোঁয়াছুঁয়ির সম্পর্ক হলেও গভীরতা একটু বেশি। আমিই বলেছি, শেষ পর্যন্ত ভালো
কোনো পাত্র যদি না পাস আমি তো আছিই।
পাপড়িও সায়
দেয়, গায়ের রঙটা কালো, শরীরটা মোটার দিকে, ছাত্রী খারাপ, মা নেই, বাবা জেলে- আমার পাত্র
পাওয়ার সম্ভাবনা নেই রে পিচ্চি। তুই কিন্তু বিট্রে করিস না।
পাপড়ির বাবা
জেলে সঙ্গত কারণেই, পাপড়ির মাকে খুন করেছে। পাপড়ির মা আমার মায়ের ছোট বোন। পাপড়ির ভাই
দুটো চাচাদের সাথে আছে, সে নিজ উদ্যোগে হোস্টেলে উঠেছে, চাচাদের কাছ থেকে দুহাজার পায়,
একটা টিউশনি, আমার হাতে কিছু জমলে তাও দিয়ে দিই। নিতে চায় না, তবুও জোর করে দিই আর
বলি, ধনী হাজবেন্ড পেলে পকেট মেরে আমাকে কিছু পাঠিয়ে দিস।
গত রাতের স্বপ্নের
ঘোরটা পাপড়িকে দেখে কেটে যায়। পাপড়িকে ছুঁতে চেষ্টা করি।
পাপড়ি বলে,
পরে হবে। আগে একটা গোপন জিনিস দেখাই। জিজ্ঞেসও করে, মিমি আপু কি বাসায়?
জানি না। বাসায়
থাকলেও দেখা তো তেমন হয় না।
পাপড়ি আমার
গা ঘেঁষে বসে। তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে একটা লিঙ্ক ক্লিক করতেই ভেসে ওঠে : মিমি অন ইন্টারনেট,
ডাউনলোড ফ্রি।
ওহ্ মাই গড!
মিমি আপু! গায়ে এক ফোঁটা কাপড়ও নেই। কিন্তু লোকটা কে? এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে
মিমি আপুকে দিয়ে জোর করে কেউ এই ট্রিপল এক্স ভিডিও করাচ্ছে। কেমন খিলখিল করে হাসছে।
এ ছবি স্পাই ক্যামেরার নয়, বোঝা যাচ্ছে ক্যামেরার দিকে চোখ রেখেই মিমি আপু এসব করছে।
হঠাৎ লোকটাকে একঝলক দেখে আমি চিনতে পারি- ওয়ালিদ খান, মডেল। কিন্তু ভিডিওটা ইন্টারনেটে
কে আপলোড করল? কেন করল?
আমি বললাম,
পাপড়ি আমার যে আর দেখতে ইচ্ছে করছে না। মিমি আপু না হয়ে অন্য কেউ হলে নিশ্চয় সবটাই
দেখতাম।
পাপড়িকে ছুঁয়ে
দেখার ইচ্ছেটাও কেমন মরে গেল।
পাপড়ি বলল,
পিচ্চি আর একটা কথা বলি?
বল।
আমাদের কেমিস্ট্রির
লেকচারার কাশেম স্যার আমাকে প্রপোজ করেছে। জবাব দেওয়ার জন্য তিন দিন সময় দিয়েছে। আজ
থার্ড ডে।
শেষ দিন আমাকে
বললি?
তোকে কেমন
করে বলি এটা ভাবতে ভাবতেই দুদিন গেল। তুই ছাড়া আর তো আমার বলার মতো কেউ নেই।
তুই কি আমার
অনুমতি চাচ্ছিস?
চাচ্ছি। তুই
রাজি হলেই তবে হ্যাঁ বলব।
তাহলে এক্ষুনি
যা, তাড়াতাড়ি গিয়ে হ্যাঁ বল, ছেলেমানুষের ঠিক নেই। কাশেম স্যার মাইন্ড চেইঞ্জ করে ফেলতে
পারে।
পাপড়ি হঠাৎ
আমার সামনে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় আমাকে কোলে তুলে নিল। সাড়ে ছাব্বিশ কেজি এমন বেশি কোনো
ওজন নয়। তিন চার বছর বয়সি ছেলে যেমন মায়ের কাঁধের ওপর মাথা রেখে আঁকড়ে ধরে থাকে, আমিও
তাই করলাম। এখন তো সারা শরীর দিয়ে পাপড়িকে ছুঁয়েছি। কিন্তু আমার সেই শিহরন নেই কেন?
পাপড়ি যেন
তার শিশু সন্তানকে ঘুম পাড়াচ্ছে, আলতো করে ডান হাতের চাপড় দিচ্ছে আর বলছে, আহমেদ মোস্তাকিম
সুমন, তুই আমার লক্ষ্মীসোনা।