রাজীব নূর
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৩ পিএম
‘এর নাম ধানসিড়ি
বুঝি?’ জীবনানন্দ
দাশের ‘সে’ কবিতায় প্রশ্নটি
আছে। প্রায় দুই যুগ আগে নদীটির তীরে দাঁড়িয়ে আমার মনেও এই প্রশ্নটিই জেগেছিল। আমার
প্রশ্নে হতাশা ছিল। জীবনানন্দের কবিতার প্রশ্নে আছে কাব্যিক দ্যোতনা।
'এর নাম ধানসিড়ি
বুঝি?' এ প্রশ্নের পর কবিতায় জীবনানন্দ দাশ যা লিখেছেন, তা থেকে বোঝা যায়, প্রশ্নটা
করেছিল মাছরাঙারা। তাদের ওই প্রশ্নের উত্তরে যা বলা হয়েছিল, তা থেকে বোঝা যায় এটাÑ
'মাছরাঙাদের বললাম;/ গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।/ আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;/ জলের
অপার সিঁড়ি বেয়ে/ কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।'
কবিতায় ‘ষোলো আনা নাগরিক
যদি না হয়ে’ ধানসিড়ি নদী হওয়া যেত, তাই ভালো হতোÑ এমন গভীর
এক আক্ষেপের কথা আছে। গভীর মেয়েটি কি দিয়েছিল ধানসিড়ি নাম? আমার অনুসন্ধান বলে, নদীটির
আগেকার নাম ছিল 'ধানসিদ্ধ'। এখনও বয়োবৃদ্ধরা নদীটিকে ধানসিদ্ধ নামেই জানেন। একদা এই
নদীতীরবর্তী এলাকা ধান-চালের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। তখন এর উভয় তীরে চাল ব্যবসায়ীরা
বড় বড় উনুন তৈরি করে দিন-রাত ধান সিদ্ধ করতেন এবং সে সময় কলকাতাসহ দূর-দূরান্ত থেকে
ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে চাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। নদীর দুই তীরে ধান সিদ্ধ হতো
বলেই এই নদীর নাম হয়েছিল ধানসিদ্ধ। কবে, কখন যে এর নাম বদলে ধানসিড়ি হয়েছে, সে তথ্য
কারও জানা নেই। কবি হেনরী স্বপনের ধারণা, নামটা নদ-নদী ও জনপদের নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের
স্বাভাবিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়নি। কবি জীবনানন্দের কাব্যখ্যাতি এবং তাঁর বহু কবিতায়
এ নদীটিকে ধানসিড়ি হিসেবে উল্লেখ করায় নামটি কালে কালে বদলে গেছে।
হাজারো নদীর
অববাহিকায় যে দেশ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা নদীতটে যার অবস্থান, সেই দেশের আধা-নাগরিক
আমি দুই দশক আগে বরিশালে বেড়াতে গিয়ে ধানসিড়ি নদীর খোঁজ করলাম। জানা গেল জীবনানন্দ
দাশকে বরিশালের কবি বলে চিনলেও তাঁর কবিতায় বহুবার বহুভাবে উদ্ধৃত নদীটার অবস্থান ঝালকাঠিতে।
ঝালকাঠি জেলা শহরের অদূরে গাবখান ব্রিজের পাশ থেকে নেমে কিছুদূর এগোলে চারটি নদীর মোহনা
দেখা যায়; বিষখালী-সুগন্ধা-গাবখান ও ধানসিড়ি নদীর মোহনা এটি। এই মোহনার উত্তর-দক্ষিণে
যে নদীটি বয়ে গেছে, সেটিই হলো কবি জীবনানন্দ দাশের ধানসিড়ি। সুগন্ধা হচ্ছে ঝালকাঠি
জেলা শহরের নদী। উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত বিষখালী নদীটি দক্ষিণ-পশ্চিমে কাঁঠালিয়া,
বরগুনার দিকে বয়ে গেছে। আবার উত্তর-পশ্চিম দিকে কাউখালী, পিরোজপুরের দিকে প্রবাহিত
হচ্ছে গাবখান নদীটি। ফলে সুগন্ধা-বিষখালী-গাবখানের মুখোমুখি সংযোগস্থল থেকেই ধানসিড়ি
নদীর শুরু। ঝালকাঠি জেলার গাবখান ইউনিয়নের বৈদারাপুর গ্রাম থেকে ধানসিড়ির যাত্রা শুরু।
বৈদারাপুর থেকে ধানসিড়ি বয়ে গেছে ছত্রকান্দা গ্রাম হয়ে প্রিংড়ি, হাইলাকাঠি ও মঠবাড়ীর
শুক্তগড় ইউনিয়নের কোল ঘেঁষে রাজাপুর থানা সদর হয়ে জাঙ্গালিয়া নদীতে মিশেছে। ধানসিড়ি
হচ্ছে ঝালকাঠি থেকে রাজাপুরের যোগসূত্রের প্রাণভোমরা। এককালে এই নদী দারুণ স্রোতস্বিনী
ছিল। এখন নদীটির সেই স্রোত নেই, যৌবন নেই। কালের প্রবাহে এই নদী কেবল শীর্ণ হতে হতে
মৃতপ্রায় আজ। শীতকালে জল শুকিয়ে এমনই হয় যে, হেঁটে হেঁটে নদীটি যেন অবলীলায় পার হওয়া
যায়। যদিও বর্ষা মৌসুমে কিছুটা স্রোত বয়ে চলে এবং দুকূল প্লাবিতও হয়।
২০১৫ সালে
সাহিত্যের নদী নিয়ে ‘সমকাল’ পত্রিকায়
একটা সিরিজ প্রতিবেদন করতে গিয়ে আবারও ধানসিড়ি নদীর খোঁজ করি। সাহিত্যের নদী শব্দ দুটি
খুব সরলার্থ হয়ে যায়, বলা ভালো, যে নদীগুলো নিয়ে সাহিত্যকর্ম সৃজিত হয়েছে, তার কয়েকটি
নিয়ে ছিল ওই সিরিজ প্রতিবেদনটি। সেই সময় প্রতিবেদনটির প্রয়োজনে কথা বলেছিলাম কবিবন্ধু
হেনরী স্বপনের সঙ্গে। ও আমাকে চমকে দিয়ে বলল, আদতে ধানসিড়ি বলে কোনো নদীই ছিল না। ঝালকাঠির
মৃতপ্রায় যে নদীটিকে আমরা ধানসিড়ি নামে জানি, ধারণা করা হয়, এ নদীর এই নামটি জীবনানন্দের
দেওয়া।
২০১৫ সালে
সাহিত্যের নদী নিয়ে ওই সিরিজ প্রতিবেদন তৈরির সময়ই কথা হয়েছিল আরেক কবি আলফ্রেড খোকনের
সঙ্গে। বরিশালের সন্তান আলফ্রেড বলছিলেন, সর্বশেষ ২০১২ সালের শেষদিকে ধানসিড়ির তীরে
গিয়েছিলেন বরিশাল নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রয়োজনে। প্রামাণ্যচিত্রে এটিই যে
ধানসিড়ি নদী, এটা বোঝানোর মতো কোনো দৃশ্য পাচ্ছিলেন না। অবশেষে তিনি একটি জামে মসজিদ
খুঁজে পেলেন, যেটিতে লেখা আছে ধানসিড়ি জামে মসজিদ।
প্রাকৃতিক
নিয়মে নদীর মৃত্যু হয়, এমন মৃত্যু খুব দুর্লভ, নদীকে মেরে ফেলা হয় বললেই চলে। ধানসিড়ির
মতো সাহিত্যের কারণে বিখ্যাত আরেক নদী তিতাস। ‘তিতাস একটি
নদীর নাম’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের
উপন্যাস। ঋত্বিক ঘটকের হাতে চলচ্চিত্রায়িত হয়ে অমরত্ব পেতে বসা তিতাস নিয়ে ২০১৫ সালে
লেখা আমার সিরিজ প্রতিবেদনের একটি ছিল, ‘হয়তো একদিন
তিতাসের নামটিই শুধু থাকবে।’ অথচ অদ্বৈত তাঁর উপন্যাসের শুরুতেই
লিখেছিলেন, “তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ,
প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে,
দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে
না।”
‘কূলজোড়া জল,
বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস’ আমি তিতাস নদীতে কোনোকালেই দেখিনি।
আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর সব নদী আমার, নদীতীরে আমার হাঁটবার-বসবার অধিকার আছে। আল মাহমুদের
কবিতায় বারবার এসেছে তিতাসের কথা। এসেছে আমার গ্রাম ভাদুঘরের কথাও। আল মাহমুদ তাঁর
বন্ধু চণ্ডীপদ চক্রবর্তীকে উৎসর্গিত 'রাস্তা' নামের একটি কবিতায় লিখেছেন, 'যদি যান,/কাউতলী
রেলব্রিজ পেরুলেই দেখবেন/মানুষের সাধ্যমত/ ঘর-বাড়ি।' এটাই আমার গ্রাম। শহরতলির আর সব
গ্রামের মতো আমাদের গ্রামটিও ঘনবসতিপূর্ণ, গ্রামের মানুষের মধ্যে শহুরেপনার সঙ্গে গ্রাম্যতা
মিলেমিশে ছিল। বিগত তিন দশকে শহর অনেকটা এগিয়ে গেছে আমাদের গ্রামের দিকে। ফলে গ্রামের
মানুষ আরও শহুরে হয়েছে, গ্রাম্যতা ঘুচেছে গ্রামটির, পুরোপুরি বিসর্জিত হয়েছে গ্রামীণ
আবহ। নেই আল মাহমুদের কবিতায় বর্ণিত 'চাষা হাল বলদের গন্ধে থমথমে হাওয়া'। 'লাউয়ের মাচায়
ঝোলে সিক্তনীল শাড়ির নিশেন' এখন বিগত দিনের স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। তবে আছে 'কিষাণের
ললাটরেখার মতো নদী'টা, যে নদীর তীর ধরে মালোপাড়ার পাশ দিয়ে 'শুঁটকির গন্ধে পরিতৃপ্ত
মাছির আওয়াজ' শুনতে শুনতে আমরা যেতাম কুমারপাড়ায়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর
নাম' উপন্যাসের মালোদের অনেকেই ছিল আমাদের এই গ্রামেও। এখন আর নেই তাদের কেউ। গ্রাম
ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাদের ললাটরেখা হয়ে আছে আমার তিতাস নদীটা।
আমি কিন্তু
নদীর মালিকানা দাবি করছি না। নদী নিজেই 'জীবন্ত সত্তা’। আমাদের আদালত
নদীকে ‘লিভিং এনটিটি'
বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। নদী বাঁচাবার জন্য আদালতের এই আদেশের পরও নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে,
তিতাস তেমন বিপন্ন একটি নদী। খোদ ঢাকা শহরে দোলাই, নড়াই নামে নদীগুলোর অস্তিত্ব নেই
আর।
দোলাই নিয়ে
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের একটি জীবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায় সমরেশ বসুর 'কোথায় পাবো তারে'
উপন্যাস থেকে। এটি সমরেশের কালকূট ছদ্মনামে লেখা উপন্যাসগুলোর একটি। কালকূট নামে সমরেশের
ভ্রমণোপন্যাসগুলোতে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিও আছে। 'কোথায় পাবো তারে' উপন্যাসে ছেলেটা
নামে যে চরিত্রটি দোলাই থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত কোষা নৌকা চালিয়ে যায়, সেই ছেলেটা
শৈশবের সমরেশ হবেন, যার নিজের ছেলেবেলাটা কেটেছে কখনও ঢাকায়, কখনও আবার বিক্রমপুরে,
গত শতাব্দীর বিশের দশকের দ্বিতীয় ও তিরিশের দশকের প্রথমভাগে। উপন্যাসের ছেলেটার চরিত্রটি
থাকে জিয়সের গলিতে, যে গলি থেকে একদৌড়ে চলে যাওয়া যায় একরামপুরের বড় রাস্তায়। একদিন
সে নৌকা চালিয়ে বুড়িগঙ্গায় যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নারিন্দার পুল পেরিয়ে এগিয়ে
যায়। নারিন্দার পুলের নিচে তখন 'বহে যায় তরতরানো খাল'। এই খালটিই দোলাই, তা একটু পরে
ছেলেটি নিজেই জানিয়ে দেয়। গেণ্ডারিয়া যাবে বলে পুলের কাছে এক মহল্লা থেকে কোষা নৌকা
ভাড়া করে সে সীতানাথের আখড়ার মাঠ পেরিয়ে বাঁয়ে গেণ্ডারিয়া, ডানে কলুটোলা রেখে এগিয়ে
যায়। 'গেণ্ডারিয়ার খেয়াঘাট পেরিয়ে ডিঙ্গা তখনো সূত্রাপুর বাজারের কাছে। সামনে লোহার
পুল। চওড়া বড় ঝোলানো পুল, তার ওপর দিয়ে গাড়ি ঘোড়া চলে। পুল পেরিয়ে আবার একটা বাঁক।'
পথে সে বুড়িগঙ্গা থেকে শহরের দিকে ফেরা জেলেদের দেখে। ছেলেটি 'লোহার পুল পেরিয়ে, ফৌজী
ব্যারাকের ডাঙা ছুঁয়েছে। এবার ডানদিকে বাঁক। তারপর বাঁক নিলেই বুড়িগঙ্গা।'
বুড়িগঙ্গা
আছে এখনও, নেই দোলাইয়ের অস্তিত্ব। পুরান ঢাকায় এখনও ধোলাইখাল নামে একটি এলাকা আছে,
যে এলাকাটি মোটরপার্টসের দোকানের জন্য বিখ্যাত। আছে লোহারপুল ও কাঠেরপুল। পুল দুটি
ছিল দোলাইয়ের ওপর। ধোলাইখাল, লোহারপুল, কাঠেরপুল, দোলাইরপাড় ইত্যাদি নাম মনে করিয়ে
দেয় মৃত এক নদীর স্মৃতি। অথচ মোগল আমলের শুরুতেও দোলাই ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ
ছিল বলে জানিয়েছেন সুলতানি ও মোগল আমল নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত ঐতিহাসিক ড. আবদুল
করিম।
ইতিহাস বলে,
তুরাগতীরে মোগল আমলের একটি বন্দর ছিল। কিন্তু কোথায়? ‘ঢাকা, দ্য
মোগল ক্যাপিটাল’ বইয়ে সুলতানি ও মোগল আমল বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল করিম
বলছেন, বন্দরটি ছিল ঢাকার মিরপুরে এবং ওই বন্দরের নাম ছিল শাহ বন্দর। প্রাচীনকাল থেকে
আশির দশকের শুরু পর্যন্ত ঢাকার মধ্যাঞ্চলের প্রধান নৌপথ ছিল নড়াই নদী। এই নদীর দুই
তীরে পাল, সেন, সুলতানি ও মোগল আমলের বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন প্রমাণ দেয় এখানে শহর
গড়ে উঠেছিল অনেক কাল আগে থেকেই। পূর্বদিকের বালু নদী থেকে পশ্চিমদিকের তুরাগ নদ পর্যন্ত
বিস্তৃত ছিল নড়াইয়ের ধারাটি। বর্তমানে এর পশ্চিমাংশ পুরোই ভরাট করা হয়ে গেছে। মাঝের
অংশটি হাতিরঝিল নামে পরিচিত। তবে একেবারে পূর্বদিকের অংশটি এখনও প্রবহমান এবং স্থানীয়ভাবে
নড়াই নদী নামেই পরিচিত।
নদী ও নদীতীরবর্তী
জীবন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক গান, কবিতা, উপন্যাস রচিত হয়েছে। নদী কখনও কখনও অনুষঙ্গও
হয়েছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানে সুরমা নদীর যে গাঙচিল ডানা ভেঙে কলৈকাত্তার ওপর পড়ে,
সে তো দেশভাগের বেদনা তুলে আনে। ধল্লা নদীর পাড়ে ফান্দে পড়িয়া যে বগা কান্দেÑ সে কোন
গল্প বলে? আমার গ্রাম ভাদুঘরের রাস্তায় কাউতলী রেলব্রিজ বলে ব্রিজের কথা আল মাহমুদের
কবিতায় আছে, সেই ব্রিজটির অবস্থান কুরুলিয়া বলে এক খালের ওপরে। আমরা খাল বলে ডাকলেও
কুরুলিয়া কাগজে-কলমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি নদী বলে স্বীকৃত। কুরে কুরে (খুঁড়ে
খুঁড়ে) যে খাল খনন করা হয়েছে, তার নাম কুরুলিয়া। কুরুলিয়াকে এন্ডারসন ক্যানেলও বলা
হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢলের তোড় থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরকে রক্ষা করার
জন্য ব্রিটিশ আমলে মহকুমা প্রশাসক এন্ডারসন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে শহরের কাউতলী ও
ভাদুঘরের মাঝখান দিয়ে একটি কৃত্রিম খাল খনন করেছিলেন। এই খালের কথাও আছে আল মাহমুদের
কবিতায়Ñ “তোমার হাতে
ইচ্ছে করে খাওয়ার/ কুরুলিয়ার পুরনো কই ভাজা;/ কাউয়ার মতো মুন্সী বাড়ির দাওয়ায়/ দেখবো
বসে তোমার ঘষামাজা।” শুধু কবিতায় নয়, “নাও দৌড়াইরে
কুরুলিয়ার খালে” সারি গানেও আছে অখ্যাত এই নদীটির কথা। ‘লুসাই পাহাড়ত্তুন
লামিয়েরে যারগই কর্ণফুলী’Ñ মলয়ঘোষ দস্তিদারের লেখা আঞ্চলিক এ
গানটিতে বলা হচ্ছে। এই গানে আছে নদীর নামকরণের বৃত্তান্তÑ ‘পাহাড়ি কন
সোন্দরী মাইয়া/ ঢেউঅর পানিত যাই/ সিয়ান গরি উডি দেখের/ কানর ফুল তার নাই/ যেইদিন কানর
ফুল হাজাইয়ে/ হেইদিনত্তুন নাম কর্ণফুলী।’ অবশ্য মলয়
ঘোষের অনেক আগে কর্ণফুলী নদীর নামকরণ নিয়ে কবিতা লিখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামওÑ
‘ওগো ও কর্ণফুলী/
তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি/ তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোনো তরুণী, কে
জানে/ সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
‘পদ্মা নদীর
মাঝি’, তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’, হুমায়ুন
কবীরের ‘নদী ও নারী’, সমরেশ বসুর
‘গঙ্গা’ ও আবু ইসহাকের
‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ বাংলা সাহিত্যের
নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস হিসেবে সর্বাগ্রে আলোচনায় আসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের
ইতিকথা’র পটভূমি যে
গাওদিয়া গ্রাম সেটির অবস্থান বিক্রমপুরের পদ্মাপারে। ‘পুতুলনাচের
ইতিকথা’তে আমরা কীর্তিনাশা
পদ্মাকে দেখি, কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘কাঁদো নদী
কাঁদো’ উপন্যাসে
বাঁকাল নামে যে নদীর উপাখ্যান শোনান, সেই নদীটা কোথায় পাই? পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বাঁকা
বলে একটা নদীর সন্ধান জানতে পেরেছি আমি, কিন্তু ক্রন্দনরত বাঁকাল নদী, নদীতীরবর্তী
কুমুরডাঙ্গার সন্ধান পাইনি। তবে চেতনাপ্রবাহে অনুভব করি আরও অনেক নদীর দীর্ঘশ্বাস,
শুনি কান্নার ধ্বনি।