× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমার নায়ক-নায়িকা

সুলতান ও নভেরা

হাসনাত আবদুল হাই

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫০ পিএম

আমার নায়ক-নায়িকা

আমি এ পর্যন্ত সত্তরটি উপন্যাস লিখেছি। যার মধ্যে বিভিন্ন প্রজন্মের পাঠকদের কাছ থেকে দুটি উপন্যাসের নাম উল্লিখিত দেখেছি সবচেয়ে বেশি : সুলতাননভেরা। দুজনই শিল্পী এবং প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-শিক্ষার বাইরের মানুষ। সুলতান অবশ্য দুই বছর কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়েছিলেন; কিন্তু অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে পড়েন ভারত ভ্রমণে। তুলনায় নভেরার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল না। যে বিষয়ে প্রাইভেট ট্রেনিং নিয়েছেন তা ছিল ধ্রুপদি নাচ- প্রথমে সাধনা বোসের কাছে, পরে দক্ষিণ ভারতে গিয়ে বৈজয়ন্তীমালার কাছে। সুলতান এবং নভেরার শিল্পী হওয়ার পেছনে কাজ করেছে ভেতরের তাড়না, দৃশ্যমান জগতের প্রকৃতি, মানুষ ও পশুপাখি। এদেরকে সংহতি দিয়ে রূপ দিয়েছিল জন্মগত প্রতিভা।

সুলতান ও নভেরা সম্বন্ধে এসব কথা এখন কিংবদন্তি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি যখন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সুলতানকে নিয়ে এবং সেই দশকের শেষভাগে নভেরার জীবন ও শিল্প নিয়ে উপন্যাস লিখি, সেই সময় তারা দুজন সীমিতসংখ্যক পরিচিতজনের বাইরে প্রায় অজানাই ছিলেন। এই তুলনামূলক অজ্ঞতার মধ্যে আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না।

শিল্পী সুলতান সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি আহমদ ছফার কাছ থেকে। সে তখনও মহামতি অভিধায় ভক্তকুল দ্বারা অভিষিক্ত হয়নি, জার্মান কালচারাল সংস্থা গ্যেটে ইনস্টিটিউটের এক প্রকল্প হাতে নিয়ে গ্যেটের ফাউস্ট-এর অনুবাদ করছে, কাজ করছে গণকণ্ঠ পত্রিকায়। একদিন সে আমাকে মূলভূমি নামে একটা অনিয়মিত ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা পড়তে দিল, যেখানে অভিনব উদ্ভাসন শীর্ষক তার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ বের হয়েছে। প্রবন্ধটি পড়া শুরু করে আমি বাকরুদ্ধ, লেখার অভিনব শৈলীর জন্য তো বটেই, যাঁর প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে তাঁর পরিচিতি পেয়ে। অতিরঞ্জন আছে, এ কথা মনে রেখেও বোঝা যায় সে একজন অসাধারণ মানুষের কথা লিখেছে। সে শুরু করেছে এইভাবে : এসকল সুঠামকান্তি কিষান, এসকল সুন্দর সূর্যোদয়, সুন্দর সূর্যাস্ত, রাজহাসের পাখনার মতো নরোম তুলতুলে এসকল শুভ্র শান্ত ভোর, হিঙ্গুল বরণ মেঘ-মেঘালির অজস্র সম্ভার, প্রসারিত উদার আকাশ, অবারিত মাঠে গগন ললাট, তালতমাল বৃক্ষরাজির সারি, দীঘল বাঁকের নদীতীরের এসকল দৃষ্টি-শোভন চর, মাঠের পর মাঠে থরে থরে ঢেউ খেলানো সোনার ধান, কলাপাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাক-জ্বলা এমন মোহিনী অন্ধকার, আঁকাবাঁকা মেঠোপথের বাঁকে বাঁশ-কাঠে গড়া কিষানের এসকল সরল আটচালা, এসকল আহ্লাদী বাছুর এবং পরিণত বয়স্ক গবাদিপশু; সর্বোপরি গোটা জনপদের জনজীবনে প্রসারিত উৎপাদন-শৃঙ্খলে আবদ্ধ সভ্যতার অভিযাত্রী অজেয় মানুষ; তারা যেন দৈনন্দিন জীবনধারণের স্রোতে কেলকলারসে যুগ থেকে যুগান্তর পেরিয়ে অনন্তের পথে ভেসে যাচ্ছে। ক্যানভাসে তাদের প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ ঋজু গতিভঙ্গিমা এমনভাবে বাঁধা পড়েছে, মনে হবে সমস্ত নিসর্গ দৃশ্য ছাপিয়ে মেঘেতে ঠেকেছে তাদের মস্তক এবং পাতালে প্রবিষ্ট হয়েছে মূল, তাদের শ্রম-ঘামের ঝংকার, চেষ্টার সংগত সমস্ত প্রাকৃতিক কোলাহল ভেদ করে আকাশগঙ্গার কিনারে কিনারে ছলাত ছলাত ধ্বনিতে একসঙ্গে ফেটে পড়ছে।

শুধু দীর্ঘ এক বাক্য গঠনের কুশলী নিদর্শন নয়, যাঁর আঁকা ছবি সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত এসব কথা বলা হলো, স্বভাবতই তাঁর প্রতি কৌতূহল জেগে উঠল মনে, সেই সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবি দেখার বাসনাও। ছফাই নিয়ে গেল গুলশানে এক শিল্পরসিকের বাড়ি, যেখানে যাকে বলে ওয়াল টু ওয়াল তেলরঙের গ্রামীণ প্রকৃতি আর তার কোলে পেশিবহুল এবং গার্হস্থ্য কাজে ব্যস্ত পৃথুলা রমণীদের ছবি দেখে ছফার প্রশস্তি যে অতিরঞ্জিত নয় তার প্রমাণ পেলাম। ছবি দেখার পর ছফার যদ্যপি গুরু- অধ্যাপক রাজ্জাকের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মুখে সুলতানের প্রথাবিরুদ্ধ জীবনযাপনের কথা শুনে মনে হলো, এই উপমহাদেশে কেন, ইউরোপেও সুলতানের মাপের শিল্পী কেউ তাঁর কাছাকাছি নেই, ভ্যান গঘ অনেকটা তুলনীয় হতে পারেন lust for life লাইফ-এর নিরিখে। জীবনের যে অংশে মানুষ উদ্দাম যৌবনের জলতরঙ্গে টগবগিয়ে ছোটে ধাবমান অশ্বের কেশর সজোরে টেনে, সেই সময় থেকে জীবনসায়াহ্নে এসে সুলতান যাপন করেছেন বোহেমিয়ান জীবন এবং সেই জীবনের নানা অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খলতা। কিন্তু তাঁর ভেতরের শিল্পসৃষ্টির তাগিদ উপেক্ষা করেন মুহূর্তের জন্যও যার জন্য আজীবন এঁকে গিয়েছেন অজস্র ছবি-ড্রয়িং, জলরঙ, তৈলচিত্র, এই সব মাধ্যমে। বিশাল তাঁর ছবির ক্যানভাসে যেসব পেশিবহুল স্বাস্থ্যবান মানুষের ফিগার, সবই তাঁর কল্পিত, ছবি আঁকার জন্য কখনোই মডেল ব্যবহার করেননি তিনি। ছফা আর অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে এসব তথ্য জানার পর সুলতানের জীবন ও শিল্প নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা মাথায় এলো প্রায় অবশ্যম্ভাবীভাবে।

শুরু হলো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানার প্রক্রিয়া। দেখলাম শিল্প মহলে তাঁর শিল্পকর্মের উৎকর্ষ নিয়ে বেশ রিজার্ভেশন আছে। কারণ তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন। কেউ বলল, তাঁর ড্রয়িং ঠিক হয় না। কারও মতে, তাঁর পারসপেক্টিভ জ্ঞানে ঘাটতি আছে। আবার কেউ বললেন, তিনি যে ভেষজ রঙ ব্যবহার করেন, তার ফলে ছবির উজ্জ্বলতা হারিয়ে যায়। সেই সঙ্গে টেকসইও হতে পারে না। মোট কথা নবীন, প্রবীণ শিল্পীদের কেউ তাঁকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। এর মধ্যে আশির দশকে তাঁর দুটি একক প্রদর্শনী হয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে এবং গ্যেটে ইনস্টিটিউটে। বাংলাদেশের শিল্পজগতে তিনি ধীরে হলেও তাঁর আসনটির আভাস পেতে শুরু করেছেন, কালেক্টরদের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু এসবের মোহ তাঁকে নিয়মে আর শৃঙ্খলে বাঁধতে পারেনি। তিনি তাঁর পছন্দের মুক্ত জীবনযাপন করে যাচ্ছেন নাগরিক জীবনের কৃত্রিমতা থেকে দূরে, চিত্রা নদীর তীরে মাসিমদিয়া গ্রামে।

সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম নড়াইলে মাসিমদিয়া গ্রামে। পরিষ্কার সাদা লুঙ্গি আর লম্বা সাদা পায়জামা পরিহিত কুচকুচে কালো বাবরি চুল আর স্মিত হাসিমুখের যে শীর্ণকায় মানুষটিকে দেখলাম তিনিই যে শিল্পী সুলতান, যাঁর তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে বিশাল দেহের সব মানুষের ছবি, সে কথা বিশ্বাস হতে চাইল না সঙ্গে। তাঁর পর্ণ কুটিরে গিয়ে যখন দেখলাম বিশাল ক্যানভাসে কাঠ-কয়লা দিয়ে স্বাস্থ্যবান কিষান-কিষানির ফিগারের আউটলাইন আঁকছেন, মনে হলো একটু আগে দেখা মানুষটি নয়, অন্য কেউ। পারিপার্শ্বিকের সব চিন্তা ভুলে যে তন্ময় ভাব নিয়ে তিনি এঁকে যাচ্ছেন, সেই দৃশ্য দেখে মনে হলো তাঁর ভেতর অন্য এক শক্তি এসে ভর করেছে। বুঝলাম এই তন্ময়তাই তাঁকে নিয়ে যায় সেই জগতে- যেখানে এ দেশের খেটে খাওয়া কিষান-কিষানি এখনও প্রকৃতি এবং পরিবেশের শক্তিকে অধীনস্থ করে প্রসন্নচিত্তে তৃপ্ত হয়ে সরল জীবনযাপন করে যাচ্ছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, শোষিত হওয়ার আগে গ্রামের মানুষ এমন ছিল এবং একদিন এমন হবে। নস্টালজিয়া নয়, ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখে ছবি এঁকেছেন সুলতান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে, ছবি দেখে আমার এই কথা মনে হলো।

ঢাকায় গ্যেটে ইনস্টিটিউটের পরিচালক পিটার জাভিটসের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বললেন, সুলতান রেনেসাঁ যুগের গ্রেট মাস্টারদের মতো ছবি আঁকেন। তিনি যে বড়মাপের শিল্পী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখার উপকরণ সংগ্রহের জন্য আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হলো। কিন্তু কেউই আহমদ ছফার মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করল না। অধিকাংশের ভাবখানা হলো : আছে... কিন্তু। বুঝলাম, তাঁর প্রথাবিরোধী জীবনযাপন আর ছবির বিষয় তাঁর স্বীকৃতি লাভের পথে বিশাল অন্তরায়। কিন্তু এও জানা হয়ে গিয়েছে যে, জাগতিক কোনো কিছুর প্রতিই তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তিনি নিজের শর্তেই জীবনযাপন আর ছবি এঁকে যেতে দৃঢ়সংকল্প। সরকারের ভাতাও তাঁকে ঢাকায় ধরে রাখতে পারেনি।

উপন্যাস লেখার জন্য কয়েকবার নড়াইল গিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। পশুপাখির জন্য অগাধ মমতার পরিচয় পেয়েছি তাঁর বাড়ির ছোট চিড়িয়াখানা দেখে। খাওয়ার টেবিলে একপাল বিড়াল এসে বসলে নিজে খাওয়ার আগে তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে দেখে চিরকুমার মানুষটির সংসার যে সাধারণের বাইরে- সেই উপলব্ধি হয়েছে। অল্পদিন ঘোরাঘুরি আর কথা বলেই আবিষ্কার করেছি তাঁর ভেতরের চিরশিশুকে। আমার বাসায় এসে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ক্যাসেট দেখে খুশি হয়ে শুনতে চেয়েছেন। তাঁর প্রিয় ছিল ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁর পিয়া বিনে ক্যায়সে। যতক্ষণ গান হতো চোখ বুজে তন্ময় হয়ে শুনতেন। তাঁর এক গুণগ্রাহীর মুখে শুনেছি, এই গান কয়েকবার শুনে রাত পার করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর মনে কি কোনো দুঃখ ছিল, কারও জন্য বিরহ বেদনা? জিজ্ঞাসা করলে মুখের স্মিতহাসি আরও একটু বড় করতেন শুধু, কোনো কথা বলতেন না।

সুলতানকে নিয়ে উপন্যাস লেখা আমার জন্য ছিল এক বিশাল অ্যাডভেঞ্চারের মতো। সৃষ্টির জগৎ কত বিচিত্র, কী গভীর রহস্য প্রচ্ছন্ন রয়েছে সেখানে, কত তৃপ্তি, এষণা আর অধরার পেছনে অন্বেষণ নিত্যই ডাক দিয়ে যায়- সেসবের কিছু আভাস পেয়েছি লেখার সময়। সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে এই উপলব্ধি- নির্লোভ, সরল জীবনযাপনে যে প্রশান্তি আর সুখ, তার সঙ্গে তুলনীয় আর কিছু নেই। সুলতানকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ফলে তিনি লাভবান হননি, জীবন সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ হয়েছে বহুগুণ।

নভেরার সঙ্গে সুলতানের পার্থক্য শুধু বয়সের নয়, জীবনযাপনেও- যদিও ক্ষীণভাবে হলেও বোহেমিয়ান স্বভাবের একটা মিল ছিল কোথাও। তাঁকে প্রধান চরিত্র করে উপন্যাস লেখাটাও ছিল আকস্মিক, একেবারেই পরিকল্পনাহীন। সুলতান ভাইয়ের (পরে এই নামেই ডাকতাম তাঁকে) মতো নভেরাও ছিলেন আমার অপরিচিত। তফাত এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে পড়ার সময় তাঁকে দেখেছি দূর থেকে। দেখে যে দারুণ অবাক হয়েছি- সে শুধু তার রূপের জন্য নয়, তাঁর বেশভূষা আর চলাফেরা দেখে। পরনে কটনের কালো শাড়ি, জামা; মাথায় সন্ন্যাসিনীদের মতো চুড়োবাঁধা চুল, কপালে মস্ত বড় কালো টিপ তাঁকে অন্য মেয়েদের থেকে শুধু পৃথক করেনি, দিয়েছিল এক স্বাধীনচেতা মুক্ত মানবীর ভাবমূর্তি। সেই পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে এমন সদর্পে প্রায় বেপরোয়া ভঙ্গিতে পুরুষ বন্ধুদের নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করতে পারে, এ ছিল অকল্পনীয়। আমাদের বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল, যা বেড়ে গেল অচিরেই তাঁর একক ভাস্কর্যের প্রদর্শনী দেখে। রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের ছেলেদের ছবি আঁকাই ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ। সেখানে মূর্তি গড়া, সেও আবার একজন মেয়ে, এ ছিল এক মহাবিদ্রোহ। কিন্তু কোনো অঘটন যে ঘটেনি তার কারণ মৌলবাদী চেতনা তখন একেবারেই ছিল না, থাকলেও নির্জীব হয়ে ছিল। নভেরাকে এভাবে দূর থেকে দেখে ১৯৬০ সালে আমি বিদেশ চলে যাই। চার বছর পর যখন দেশে ফিরি, নভেরাকে ক্ষীণভাবে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ছিল পুরোনো এয়ারপোর্টের কাছে এক দোতলা বাড়ির সামনের লনে পেট ফুটোওয়ালা এক গরুর দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্য। তাঁর সম্বন্ধে আমার বা পরিচিতদের কোনো আগ্রহ বা কৌতূহল ছিল না। তিনি কোথায় আছেন, সে খবরও কেউ রাখত না। লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ আড়ালে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

১৯৮৯ সালের এক দুপুরে ইস্কাটন রোডে আমার বাসায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা বসেছে, মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে পান চলছে। পাশে বসে শিল্পী আমিনুল ইসলাম আমাকে বললেন, নভেরাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখেন না! আমি অবাক হয়ে বললাম, নভেরা? তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানি না। ছাত্রজীবনে, সেই ১৯৬০ সালে তাঁকে কয়েকদিন দূর থেকে দেখেছি আর তাঁর হেনরি মুর-সুলভ ভাস্কর্যের প্রদর্শনীতে গিয়েছি একদিন। এই নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়? তাঁর ওপর লেখা কিছু চোখেও পড়েনি। লেখার উপকরণ কোথায়?

আমিনুল বললেন, আমার কাছে তাঁর প্রদর্শনীর একটা ব্রোশিউর আছে। আপনাকে দেব?

আমি বললাম, সেটাই যথেষ্ট হবে? কী যে বলেন! উপন্যাস লিখতে অনেক মালমসলা লাগে। সেসব কোথায় পাব?

আমিনুল বললেন, আমি যা জানি সেসব বলব আপনাকে। অন্য যারা তাকে জানত, তাদের নামও দেব আপনাকে। তাদের ইন্টারভিউ নিলে নভেরা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আমি বললাম, নভেরা এখন কোথায়? তাঁর কোনো খবর নেই। বিদেশে নাকি? আমিনুল বললেন, প্যারিসে গিয়েছিল বাংলদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে। শুনেছি সেখানেই মারা গিয়েছে।

আমি বললাম, আপনি কী জানেন বলুন শুনি।

আমিনুল বললেন, আমি তখন ফ্লোরেন্সে। একদিন লন্ডন থেকে শিল্পী হামিদুর রহমান ফোনে জানাল ফ্লোরেন্স আসছে। আমার সঙ্গে থাকবে। কয়েকদিন পর সে এলো, কিন্তু একা না। সঙ্গে নভেরা। বলল, আমার সঙ্গে থাকবে কয়েকদিন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম শুনে। তাদের বললাম, আমার একটাই ঘর, একটা খাট। তোমরা দুজন থাকবে কোথায়? এবারে নভেরা বলল, এর খুব সহজ সমাধান আছে। বিছানায় আপনারা দুই বন্ধু দুপাশে শোবেন, আমি শোব মাঝখানে। দুপাশে দুটো বালিশ রাখা হবে বর্ডার হিসেবে। কেমন, সমাধান হয়ে গেল না?

আমি বললাম, ঠাট্টা করল ওকথা বলে?

আমিনুল বললেন, না। আমরা ওইভাবে থাকা শুরু করলাম।

আমি বললাম, দারুণ।উপন্যাস লেখা যাবে মনে হচ্ছে। যা বললেন, ওটা দিয়েই শুরু করা যাবে। এখন যারা নভেরাকে জানে, তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবে, আমাকে তাদের নাম দিন।

শুনতে পেলাম নভেরার এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বিয়ে হয়, কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। তাঁর সেই স্বামী উচ্চপদে থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন ধানমন্ডি থাকেন, আমার বাসার কাছেই। তাঁকে চেনেন এমন একজনকে দিয়ে যোগাযোগ করে আমার কথা বলা হলো। তিনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হলেন না। আমি তা আঁচ করতে পেরেছিলাম। কেননা এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে কেউ কথা বলতে চায় না।

নভেরা সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশদ তথ্য দিলেন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তিনি তার সংস্থার সদস্য করেছিলেন নভেরাকে। তাঁকে এক অনুষ্ঠানে নাচের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। নভেরা তখন নাচ শিখছেন। তিনি মঞ্চে নাচে অংশ নিয়েছিলেন। মাহবুব ভাই দীর্ঘ আলোচনায় শুধু নভেরা না, তাঁর পরিবার সম্পর্কে অনেক তথ্য দিলেন, যা তাঁকে চিনতে সাহায্য করেছিল। তিনি বলেছিলেন, নভেরার পরিবার খুব উদার এবং সংস্কারমুক্ত ছিল। যার জন্য নভেরা ছেলেদের সঙ্গে খোলাখুলি মিশতে পারত, বাসায় তাঁর পুরুষ বন্ধুদের আসা-যাওয়া ছিল অবাধ। বেশ একটা চক্র গড়ে উঠেছিল নভেরাদের বাসায় তাঁকে মধ্যমণি করে। তাঁর অনুরাগীদের মধ্যে মাহবুব ভাইও একজন ছিলেন তা বোঝা গেল। এও জানা গেল, নভেরার বন্ধুদের কেউ কেউ একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেও তিনি একটা সীমারেখা রক্ষা করে চলতেন। অর্থাৎ বন্ধুত্ব মানে প্রেম-ভালোবাসায় গড়াতে হবে, এটা বিশ্বাস করতেন না। মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে যে বিশদ তথ্য পাওয়া গেল তার ভিত্তিতে একজন নিজের ওপর আস্থাশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়সংকল্পসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখা দিলেন নভেরা। সেই সঙ্গে তাঁর শিল্পী হওয়ার বাসনা এবং আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধেও জানা গেল। তরুণ বয়স থেকেই তিনি জানতেন জীবনে কী হবে তাঁর লক্ষ্য, কী তিনি চান ভবিষ্যতে। তবে তিনি যে বেশ খামখেয়ালি আর হেঁয়ালিপূর্ণ ছিলেন, এটাও জানা গেল। তাঁর অনেক পুরুষ বন্ধু যে তাঁকে ছলনাময়ী মনে করতেন, এ কথাও বলেন মাহবুব ভাই। তারপর হেসে বললেন, মেয়েদের একটু রহস্যময়ী হতে হয়, স্বচ্ছ হয়ে গেলে আকর্ষণ থাকে না।এটা কি জানতেন নভেরা, না তাঁর স্বভাব হয়েছিল? উত্তরে মাহবুব ভাই বললেন, সে বেশ অভিনয় করতে পারত, মানে মানুষের সঙ্গে। যা তার সম্বন্ধে অন্যের ভুল ধারণার সৃষ্টি করেছিল।

এরপর একদিন আমি আমার বাসায় যারা নভেরাকে জানতেন, তাদেরকে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানালাম। উদ্দেশ্য- কথা বলে নভেরা সম্বন্ধে তাদের ধারণা জেনে নেওয়া। সিনেমাজগতের খান আতাউর রহমান এলেন, নাট্যকার সাঈদ আহমেদ নভেরা সম্বন্ধে বলতে রাজি হলেন। তাঁর ভাই শিল্পী হামিদুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘকাল লিভ টুগেদার করেছিলেন নভেরা। পুরান ঢাকায় বেশ কিছুদিন ছিলেন তিনি। এতে হামিদুর রহমানের বাড়ির কেউ কিছু মনে করেনি। শুনে আমি সাঈদ ভাইকে বললাম, তখন ঢাকা এত লিবারেল ছিল, ভাবাই যায় না! উত্তরে তিনি বলেছেন, আমরা ঢাকাইয়া হইলে হইব কী, লাইফ স্টাইলে জবর মডার্ন। হে হে। কত আর কমু। নভেরার কথা কি এক দিনে কইয়া শেষ করণ যায়? আরেক দিন ডাকো। আমি হেসে বললাম, বেশ ত। ডাকা হবে। শুরু যখন করেছ, শেষ করতে হবে।

খান আতাউর রহমান লন্ডনে তাঁর সঙ্গে যে কদিন দেখা তার স্মৃতিচারণ করলেন। তিনি জানালেন, সেই সময় নভেরা স্লেড আর্ট স্কুলে পড়তেন, থাকতেন হামিদুর রহমানের সঙ্গে। একটু পর শহীদ মিনারের নকশা কি একা হামিদুর রহমান করেছিলেন, না সেটা ছিল তাঁর এবং নভেরার যৌথ প্রয়াস- এ নিয়ে তর্ক হলো। সাঈদ আহমেদ জোর দিয়ে বললেন, ডিজাইন করা ছিল হামিদুর রহমানের একার কাজ। অন্যেরা মত দিলেন এই বলে যে, নভেরা ভাস্কর হিসেবে নিশ্চয় কিছু অবদান রেখেছিলেন।

উপস্থিতদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম ছিলেন। তিনি ফ্লোরেন্সে স্বল্পদিনের অবস্থানের সময় নভেরা সম্বন্ধে আরও তথ্য দিলেন, যা থেকে জানা গেল এক ইতালিয়ান ভাস্করের সঙ্গে নভেরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা হামিদুর রহমানের জন্য ছিল বেশ মনঃপীড়ার কারণ।

মুর্তজা বশীর লাহোরে নভেরার অবস্থানকালের কথা বললেন। সেই সময় কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সঙ্গে নভেরার পরিচয় এবং সম্পর্ক নিয়ে তিনি মন্তব্য করলেন। তাঁর কথা শুনে মনে হলো নভেরা চরিত্রে তিনি বেশ স্ববিরোধিতা দেখতে পেয়েছিলেন। মোট কথা, নভেরাকে তাঁর খুব একটা পছন্দ হয়নি।

নভেরার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী লুতফুনের সঙ্গে আলাপের জন্য চট্টগ্রাম গেলাম। তার কাছে নভেরার পরিবারের ভেতরের বেশকিছু খবর পাওয়া গেল। এর মধ্যে ছিল নভেরা এবং তাঁর বোনদের মধ্যে সম্পর্কের কথা। লুতফুন জানালেন, তাঁর বোনরা নভেরাকে বেশ হিংসা করতেন তাঁর জনপ্রিয়তার জন্য।

এইভাবে নভেরা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে আমি উপন্যাস লিখে ফেললাম। এখানে আমিও একটি চরিত্র। বইটি ১৯৯১ সালে বের হওয়ার আগে ঈদসংখ্যা বিচিত্রায় ছাপা হয়। দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় উপন্যাসটি ছাপার সঙ্গে সঙ্গে। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অচেনা। প্রবীণদের মধ্যে যারা তাঁকে চিনতেন, তারা তাঁকে ভুলেই গিয়েছিলেন। নভেরা উপন্যাস নভেরাকে পুনর্জন্ম দিল যেন। বই হয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেল। তারপর বইটির অনেক সংস্করণ বের হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে নভেরা উপন্যাসের জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে।

১৯৯৮ সাল। আমি প্যারিস গিয়ে শুনলাম নভেরা বেঁচে আছেন; কিন্তু কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা করেন না। আমি অনেক কষ্টে তাঁর ঠিকানা জোগাড় করে ফরাসি ড্রাইভার নিয়ে বের হলাম আমার জনপ্রিয় কাল্ট উপন্যাস নভেরা নায়িকার সন্ধানে। শহরতলির এক গির্জার বিপরীতে বইয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়ি। আগেই ফোনে জানানো হয়েছিল আমার আসার কথা। দেখা গেল দোকানের দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি। ফরাসি ড্রাইভার তাঁকে গিয়ে আমার কথা বলার পর সে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে কী যেন বলল। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার এসে বলল, লোকটি নভেরার স্বামী। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন না। কেননা আমি যে বই লিখেছি, সেখানে ভুল তথ্য আছে। আমি ড্রাইভারকে বললাম, তাকে বল আমি অন্যের মুখে যা শুনেছি তাই লিখেছি। নিজে কিছু বানিয়ে লিখিনি। ড্রাইভার আবার গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর ফিরে এসে বলল, লোকটি বলছে নভেরার সঙ্গে কেন কথা বলোনি তুমি লেখার সময়?

আমি বললাম, কথা বলার উপায় ছিল না। সবাই মনে করেছে তিনি মরে গেছেন।

আমার এই কৈফিয়তেও কাজ হলো না। ড্রাইভার ফিরে এসে উত্তেজিত হয়ে বলল, লাইব্রেরি ইজ পাবলিক প্লেস। সে আমাদের আটকাতে পারে না। যাব নাকি পুলিশের কাছে?

আমি বললাম, দরকার নেই। ফিরে চলো।

আসবার সময় মনে হলো ভেতরে যেন কে বসে আছে। মাথায় সাদা চুল, পরনে ধূসর রঙের ঢোলা পোশাক। আমার উপন্যাসের শেষে তাঁকে এই রূপেই বর্ণনা করা হয়েছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা