× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাংলা ভ্রমণসাহিত্য

হাসনাত আবদুল হাই

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩ ১৩:০৪ পিএম

বাংলা ভ্রমণসাহিত্য

ঘরের বাইরে বেড়াতে বের হলেই সেটা ভ্রমণ, তা সে দেশে হোক কিংবা বিদেশে। কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করলেও যদি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দেখা হয় পথের নানা দৃশ্য, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠে সাময়িক সখ্য, সেই অভিজ্ঞতা হতে পারে আনন্দময়। এমনকি উদ্দিষ্ট কাজের কৌতুককর অভিজ্ঞতাও ভ্রমণের অংশ হয়ে পরিব্রাজকের মনে করতে পারে গভীর রেখাপাত। বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালেখিই ভ্রমণসাহিত্য।

রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের বেশকিছু চিঠিতে দেখ যায়- দেশের ভেতর প্রবাসকালীন সময়ের পর্যবেক্ষণ আর চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ, যা একই সঙ্গে পত্র এবং ভ্রমণসাহিত্য। তাঁর চিঠিতে রয়েছে প্রকৃতিপ্রেম, শিল্পচিন্তা, আধ্যাত্মবোধ, স্বদেশচিন্তা এবং আত্মবিশ্লেষণ। শিলাইদহ থেকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছেন : পৃথিবী যে বাস্তব, কি আশ্চর্য সুন্দর তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয় এই- যে ছোট নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন-নিঃশব্দ চরের ওপরে প্রতিরাতে শত-সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ-সংসারে এ যে কি একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা, তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়। (নভেম্বর, ১৮৮৯)। ছিন্নপত্রের লেখায় প্রকৃতি বর্ণনায় ঋতু এসেছে ঘুরেফিরে। শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীমতী রানুকে চিঠিতে তিনি লিখেছেন : এতদিন শ্রাবণের দেখা ছিল না, যেই বিশে-একুশে হয়েছে অমনি যেন কোনোমতে ছুটতে ছুটতে শেষ ট্রেনটা ধরে হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির(৬ আগস্ট, ১৯১৮)।

সাহিত্যের অন্যান্য বেশকিছু শাখার মতো ভ্রমণকাহিনী লেখায়ও রবীন্দ্রনাথই পথিকৃৎ। তাঁর ভ্রমণগ্রন্থের সংখ্যা দেখে মনে হবে তিনি বুঝি প্রধানত ভ্রমণকাহিনী লেখক। জাপান থেকে পারস্য এবং রাশিয়া হয়ে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা- তিনি শুধু পরিব্রাজকের কৌতূহল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ- দেশান্তর। ছোটগল্প লেখার মতো ভ্রমণকাহিনী লেখাতেও তিনি স্থাপন করেছেন এই শাখার আদর্শ এবং লক্ষ্য। পাঠকের নিছক বিনোদন নয়, চিন্তার খোরাক দেওয়াও যে ভ্রমণকাহিনী লেখার উদ্দেশ্য, এটা মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁর লেখা প্রথম থেকেই। কেবল তথ্যের সমাবেশ নয়, মগজকে উস্কে দেয়াও যে তাঁর ভ্রমণকাহিনীর উদ্দেশ্য, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ রাখেন না তিনি। যে ভ্রমণকাহিনীতে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং দূরদৃষ্টির পরিচয় সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সেটি রাশিয়ার চিঠি। তিনি লেখাটি শুরু করেছেন এই ভাবে : রাশিয়ায় আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে। এরপরই তিনি লিখেছেন : এর মধ্যে গলদ যে কিছু নেই, তা বলি নে- গুরুতর গলদ আছে। সে জন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে- কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনও টেকে না- জীবনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে। এ কথা তিনি লিখেছিলেন ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের ১৭ বছর পর। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া তার লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য যে বাইরের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি, সে কথাও তিনি বলেছেন। তিনি পত্রপ্রাপককে লিখেছেন : মনে আছে, এরা লীগ অব নেশন্সে অস্ত্র বর্জনের প্রস্তাব পাঠিয়ে কপট শান্তিকামীদের মনে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। কেননা, নিজেদের প্রতাপ- বর্ধন বা রক্ষণ সোভিয়েতের লক্ষ্য নয়- এদের সাধনা হচ্ছে জনসাধারণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্নসম্বলের উপায়-উপকরণকে প্রকৃষ্ট প্রণালিতে ব্যাপক করে তোলা। (রাশিয়ার চিঠি, ১৯৩০)। মাত্র কয়েকদিনের সফরে একটি দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন অন্তর্ভেদী পর্যবেক্ষণ রবীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণধী মননের পরিচয় দেয়। একজন সৎ ভ্রমণলেখককে যে সারাক্ষণ চোখ-কান খোলা রেখে সবকিছু দেখতে হয়, সব কথা শুনতে হয়, এ কথা রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনী পড়ে উপলব্ধি হতে সময় নেয় না।



ঠিক ভ্রমণকাহিনী হিসেবে লেখ হয়নি, কিন্তু এই শ্রেণিতেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সঞ্জীবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পালামৌ। শুধু প্রকৃতির বর্ণনাই যে ভ্রমণসাহিত্য হতে পারে, এটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ লেখাটির বেশ প্রশংসা করেছিলেন। দেবেশ দাস এবং অন্নদা শঙ্কর রায় প্রায় একই সময়ে, একই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলেন যথাক্রমে ইউরোপা এবং পথে-প্রবাসে। দুজনই ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে, যে সময় কৌতূহলী হয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন ইংল্যান্ডের জীবন এবং ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে লিখেছেন সেই অভিজ্ঞতা। দুজনের মেদহীন ঋজু গদ্য যোগ করেছিল ভ্রমণসাহিত্যে নতুন গদ্যশৈলী। তাঁদের পর এক অভিনব ভ্রমণকাহিনী   লিখেছিলেন যাযাবর ছদ্মনামে বিনয় মুখোপাধ্যায় নামে এক তরুণ সাংবাদিক। মাত্র কয়েকদিনের দিল্লি সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যে ভ্রমণকাহিনী লেখেন, তা বাংলা ভ্রমণসাহিত্যে ক্লাসিক হয়ে আছে। যাযাবরের দৃষ্টিপাতে-এর বিপুল জনপ্রিয়তার পিছনে রয়েছে তাঁর অনবদ্য গদ্যশৈলী এবং হাস্য-কৌতুক বোধ। পরিশেষে একটি মর্মস্পর্শী ট্রাজিক প্রেমের কাহিনী বইটির যে আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে তাতে সন্দেহ নেই। তিনিই বোধ করি একমাত্র ভ্রমণকাহিনী লেখক, যার বইয়ের ছোট ছোট প্রাজ্ঞ বাক্য (aphorism) পাঠকের মুখে মুখে ঘুরেছে দীর্ঘকাল। যেমন- বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।' যাযাবরের অনবদ্য গদ্যশৈলী এই বইটিকে যে আভিজাত্য দিয়েছে তা প্রায় অননুকরণীয়।

তীর্থযাত্রা ভ্রমণকাহিনী লেখার একটি জনপ্রিয় উৎস। প্রবোধ কুমার সানালের মহাপ্রস্থানের পথে হিমালয়ে হিন্দু তীর্থস্থান হরিদ্বার হৃষিকেশ এবং অন্যান্য মন্দির ভ্রমণের অনবদ্য কাহিনী। ভূমিকা সামান্য হলেও এই কাহিনীতে রানু নামের নারী চরিত্র মানবিক মাত্রা যোগ করেছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। সমরেশ বসুর অমৃত কুম্ভের সন্ধানে এবং অবধূতের মরুতীর্থ হিংলাজ একইভাবে তীর্থযাত্রার বিচিত্র এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার পরিবেশনায় সফল। এদের আগে সৈয়দ মুজতবা আলী সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তাঁর মজলিশী ভঙ্গিতে লেখা দেশে-বিদেশে লিখে; যেখানে গৃহপরিচারক আবদূর রহমান অনেক পাঠকের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। প্রায় একই সময়ে লেখা সতীনাথ ভাদুরীর প্যারিস প্রবাস নিয়ে লেখা সত্যি  ভ্রমণকাহিনীতে পাওয়া যায় ভিন্ন স্বাদের ভ্রমণগদ্য। পঞ্চাশের দশকে লেখা শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের মুখর লন্ডন বাঙালি পাঠককে ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় রাজধানীর সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিল তার দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা দিয়ে। লন্ডন তখন বহুশ্রুত হলেও ছিল অনেক বাঙালির অদেখা, যার জন্য বইটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।

জ্যোতির্ময়ী দেবীই মনে হয় প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি দেশে লেখপড়া, শেষ করে লন্ডন গিয়েছিলেন তিরিশের দশকের শুরুতে। কয়েক বছর সেখানে থাকার পর দেশে ফিরে লিখেছিলেন লন্ডন প্রবাস জীবনের পটভূমিতে বেশ কয়েকটি গল্প, যা বিলেত দেশটা মাটির শিরোনামে ছাপা হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। গল্পের আদলে হলেও লেখাগুলো ছিল আত্মজৈবনিক এবং সেই জন্য বলা যায় এক ধরনের  ভ্রমণকাহিনী। সেই সময়ে ভারতীয় মহিলাদের ইংল্যান্ডে বসবাসের বিড়ম্বনা নিয়ে এমন ডিটেইল বর্ণনা প্রায় দুর্লভ।

চল্লিশের দশকে লেখা ভূপর্যটক রমানাথ বিশ্বাসের লাল চীন বিপ্লবের আগে কুওমিন্টাং শাসনকালে চীন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে সেটিই ছিল আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনী পাঠ। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় খগেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা

তৈমুরলঙের দেশে আমাকে পরিচিত করিয়েছিল সমরখন্দ আর বোখারা- এই দুটি শহরের নামের সঙ্গে যাদের আকর্ষণে অনেক পরে হলেও আমি গিয়েছিলাম সরেজমিনে দেখার জন্য। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে সমরখন্দ- বোখারা নামে আমার লেখা ভ্রমণকাহিনী ছেপেছে সন্দেশ প্রকাশনী। একইভাবে কোলরিজের লেখা কুবলাই খান কবিতা পাঠের স্মৃতি মনে রেখে ১৯৯৭ সালে আমি জাপান থেকে ফেরার পথে ডিট্যুর করে গিয়েছিলাম উত্তর মঙ্গোলিয়া, কুবলাই খানের সামার প্যালেসের ভগ্নস্তূপ আবিষ্কারের জন্য। এই ভ্রমণ নিয়ে পরে লেখা হয় যানাডু, ইংরেজি এবং বাংলায়। মনে হয় এটিই একমাত্র দ্বি-ভাষিক  ভ্রমণকাহিনী।

দেশ ভাগের আগে পূর্ববঙ্গের খুব কম বাঙালিই বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, যার জন্য পদ্মা নদীর এপারের লেখকদের ভ্রমণকাহিনী লেখার তেমন সুযোগ হয়নি। পঞ্চাশের দশকে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে ফেরার পর লিখেছিলেন বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন, যাকে বলা যায় লন্ডন শহরের ট্রাভেল গাইড। লন্ডন নিয়ে এমন তথ্যবহুল বই মনে হয় দ্বিতীয়টি নেই। নামকরণের জন্য বইটি অবশ্য উপহসিত হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের কালাপাহাড়ি সাহিত্যপত্রিকা অগত্যার সম্পাদকের (ফজলে লোহানী) হাতে। সিভিল সার্ভেন্ট কবি সানাউল হক সমুদ্রপথে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে বন্দর থেকে বন্দরে নামে যে বই লেখেন, সেটি সমকালের মর্যাদাপূর্ণ আদমজী পুরস্কার পেয়েছিল।

১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাহিত্যপাতায় দেশান্তরের দিন নামে ধারাবাহিক বেরিয়েছিল আমার আমেরিকা প্রবাসের অভিজ্ঞতার কাহিনী। লেখাগুলো পড়ে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আমাকে বলেছিলেন, তুমি বাঙালির সহজাত হাস্য- কৌতুক বোধের পরিচিতি নতুন করে দিয়েছ এই লেখায়। বাংলাদেশ হওয়ার পর এই লেখাগুলো ট্রাভেলগ নামে বের হয় ১৯৮০ সালে। এর পর একই দশকে বের হয় ট্রাভেলগ-২ নামে আমার দ্বিতীয় ভ্রমণকাহিনী, যেটি পড়ে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আমার সম্বন্ধে লিখেছিলেন ট্রাভেলগের রাজা অভিহিত করে। আশি এবং নব্বই দশকে বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্য মূলত ছিল রাবেয়া খাতুন এবং আমার লেখা নিয়ে সরব। সেই সময় সংবাদের সাহিত্যপাতায় ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল আমার আফ্রিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাফারি নামের  ভ্রমণকাহিনী। একই পত্রিকায় ছাপা হয় আন্দালুসিয়া নামে স্পেনে এক সপ্তাহের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বিবরণ। সেখানে প্রাধান্য পেয়েছিল স্পেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এবং মুরদের শাসনের অন্তিম পর্বের বিবরণ। কেবল নেরুদার তিনটি বাড়ি দেখার জন্য আমি গিয়েছিলাম চিলির সান্তিয়াগো, এলা নিগ্রা এবিং ভিনা দেল মার, যে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখেছি ট্রাভেলগ-২ বইতে।

নতুন শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে এক ঝাঁক নবীন এবং প্রতিভাবান লেখকের লেখায়। এদের মধ্যে রয়েছেন মঈনুস সুলতান, ফারুক মঈনউদ্দীন, কামরুল ইসলাম, সেলিম সোলাইমান এবং শাকুর মজিদ। মঈনুস সুলতান এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি  ভ্রমণকাহিনী লেখেন সরস গল্পের মতো, যেখানে নারী চরিত্র রোমান্সের মাত্রা যোগ করে। তাঁর ভাষা ঘরোয়া, মজলিশী ঢঙে, যা পাঠকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে তুলতে বেশ সহায়ক। ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক হিসেবে অনেক বেশি ইন্টেলেকচুয়াল। তাঁর  ভ্রমণকাহিনী বুদ্ধিদীপ্ত এবং শানিত বর্ণনায় সমৃদ্ধ। কামরুল ইসলামের কৃতিত্ব তিনি খুব নগণ্য স্থানের ভ্রমণকে অল্প কথায় করে তোলেন মনোগ্রাহী। শাকুর মজিদ ডকুমেন্টারি ঘরানায় ভ্রমণকাহিনী লিখতে সিদ্ধহস্ত। চীনের ওপর তার সচিত্র বইটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এদের সবার বইতে যে ছবি থাকে, তা বর্ণনার পরিপূরক হয়েছে। সেলিম সোলাইমানের পিকিং ম্যানের দেশে বইটি অনবদ্য গদ্যের জন্য পড়া খুব আনন্দদায়ক। লেখার বিষয়ে তিনি বেশ যত্নশীল। প্রবীণ লেখকদের মধ্যে আনোয়ারা সৈয়দ হক সম্প্রতি কয়েকটি ভ্রমণকাহিনী লিখে বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যে তাঁর আসন পাকা করে নিয়েছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁর ভ্রমণকাহিনী লেখা।এঁরা ছাড়াও আরও অনেকে এখন ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন, যাদের সবার নাম আমি চটজলদি (একদিনের মধ্যে লেখাটি দিতে হচ্ছে) মনে করতে পারছি না।

২০১০ কি,২০১৪ সালে এলিজা বিনতে এলাহি নামে একটি মেয়ে ইংরেজিতে তার লেখা Eliza's Travel Diary বইটির মোড়ক উন্মোচনে আমাকে আমন্ত্রিত করে অবাক করে দিয়েছিল শুধু শিরোনামের জন্য। সেই শিরোনামে ছিল লেখা ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বর্ণনায় নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। লেখা পড়ে সেই বিশ্বাস অতিরঞ্জিত মনে হয়নি। সেই বই লেখার পর এলিজা সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করেছে বলা যায়। আর বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রায় বিলুপ্ত হেরিটেজের সন্ধানে তার মতো আর কেউ ঘোরেনি। কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্ন লেখা ছাড়া এ পর্যন্ত তার কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ বই পাওয়া যায়নি। আশা করা যায় তিনি কেবল ভ্রমণ করবেন না, বাংলা ভ্রমণসাহিত্যে মূল্যবান অবদান রাখার যে প্রতিশ্রুতি তার মধ্যে ছিল, তা তিনি পূরণ করবেন।

ফাতেমা জাহান নামে ভারতে পড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রী জালাল উদ্দিন রুমির প্রতি তার ভক্তি এবং তাঁর দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে রুমির তীর্থস্থান কোনিয়াসহ তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে যে ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন, সেটি বেশ আকর্ষণীয়। তিনি তার আগ্রহের বিষয়কে বেশ ভালোভাবে উপস্থাপিত করেছেন পাঠকের কাছে। গত বইমেলায় প্রকাশিত তার নতুন ভ্রমণকাহিনী লাখনৌনামা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তার লেখা বেশ গবেষণাপ্রধান এবং সচিত্র।

বর্তমানে ভ্রমণ এবং প্রবাস জীবনযাপন বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ সাধারণ এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের সবাই যে লিখবেন, তা আশা করা যায় না। কিন্তু যাদের লেখার অভ্যাস আছে, তারা নিজেদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য লিখবেন, এটা আশা করা নিশ্চয় খুব বেশি হবে না। ভবিষ্যতের সৃজনশীল সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে ভ্রমণকাহিনী দিয়ে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আশা করা যায় এই সাহিত্য সৃষ্টিতে বাংলাদেশি লেখকরা পিছিয়ে থাকবেন না। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা