মঈনুস সুলতান
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৯ পিএম
ভ্যাসন দ্বীপের সমুদ্রসৈকতে বেশ কিছু সূর্যস্নানার্থীর
আগমন হয়েছে। আমরা নুড়ি পাথর ও বালুকায় জুতা খুলে হাঁটতে শুরু করলে আজকের সঙ্গী হলেনের
বন্ধু ডেভিড জলে নাও ভাসানোর জন্য আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হন। আমরা ভেঙে পড়া ঢেউয়ের
প্রান্ত ঘেঁষে হেঁটে যেতে যেতে নীল নোনাজল স্পর্শ করি। সূর্যালোকে ছলকে যাওয়া সাগরের
পানি এমন হিম হয়ে আছে যে, আন্দাজ করি এখানে ডুব দেওয়া দুরূহ হবে। জলে ভাসে পাল তোলা
নৌকা ও বেশ কটি কায়াক। ডেভিড এখন তার নাওখানা টেনে জলে নামিয়ে তাতে পাল জুড়ে দিতে চেষ্টা
করছেন। আমরা সৈকতের বালুকায় আধশোয়া বা ইজিচেয়ারে বসা সূর্যস্নানরতদের দিকে তাকাই। চেষ্টা
করি একটি স্পট খুঁজে বের করতে, যেখানে নিরিবিলিতে প্লাস্টিকের চাদর বিছিয়ে বসে তরঙ্গের
উথালপাথাল দেখা যাবে। চারদিকে ইতিউতি তাকাতে হঠাৎ করে লক্ষ্য করি, গতকাল ফেরি জাহাজে
দেখা হওয়া সাদা লাঠি হাতে মাঝবয়সি লোকটিকে। মানুষটি বালুতে মাদুর বিছিয়ে আকাশের দিকে
চেয়ে শুয়ে আছেন। আমি হলেনকে তার উপস্থিতির কথা বলি। সে সঙ্গে সঙ্গে ওদিক পানে গিয়ে
তাকে গ্রিট করতে চায়। কিন্তু সে বালুকায় চাদর বিছিয়ে আয়েশ করে সূর্যস্নানের প্রস্তুতি
নিচ্ছে। তাই একটু হেঁটে গিয়ে আমিই তাকে- হ্যালো, হাউ ইজ সান টুডে বলে সম্ভাষণ করি।
ভদ্রলোক মনে হয় কানের কাছে ছোট্ট রেডিও রেখে নিউজ শুনছিলেন। আমাদের সাড়া পেয়ে তা বন্ধ
করে উঠে আধশোয়া হয়ে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে চেয়ে শূন্যতায় কিছু একটা শুঁকেন।
তারপর হেসে বলেন, হাই বাংলাদেশি, হোয়ার ইজ ইয়োর বিউটিফুল ওয়াইফ? ইজ সি হাইডিং বাহাইন্ড
ইউ? হলেন সত্যি সত্যিই আমার পেছন পেছন ঘাপটি মেরে এসেছে। সে ওখান থেকে রিনঠিন করে হেসে
ওঠে। আমরা বালুকায় তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একটু-আধটু কথাবার্তা বলি। আজকের আবহাওয়ার
কথা উঠতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আলগোছে রিমার্ক করেন- ওয়ান মোর ভেরি প্রিটি
ব্রাইট সানি ডে। তারপর অনুযোগ করেন- এবারের সামার তো প্রায় মেঘে মেঘে কাটল। উই ডিড
নট হ্যাভ টু মেনি ব্রাইট সানি ডেইজ। হলেন তার কথা শুনতে শুনতে কপালে হাত রেখে দিগন্তের
দিকে তাকায়। সে একটু বিষণ্ন হয়ে বলে, বাট আই ডোন্ট সি মাউন্ট রেঁনেয়ার ইন দ্য হোরাইজন।
মানুষটি যেন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এমনভাবে বলেন, হ্যাভ সাম পেসেন্স গার্ল। আরো ঘণ্টা
দেড়েক যাক। সূর্যালোক যখন তেরছা হয়ে জলে পড়বে, আই টেল ইউ- দিগন্তে তখন ঠিক ঠিকই মাউন্ট
রেঁনেয়ার ভেসে উঠবে।
আকাশজুড়ে কয়েকটি হাঁস ক্রং ক্রং করে ধাতব আওয়াজ
ছড়িয়ে চক্রাকারে উড়লে হলেন বলে ওঠে- দে আর ফাইন কানাডিয়ান গিজ। সাদা লাঠির মানুষটি
এবার রীতিমতো দাঁড়িয়ে পড়ে কপালে হাত রেখে খোলা দৃষ্টি মেলে আকাশে তাকান। তারপর বালির
দিকে চেয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনেন পাখির ডাক। তিনি মাদুরে বসতে বসতে বলেন, এগুলো সব শিশু
গিজ। দে আর জাস্ট বেবিজ। এই বাচ্চা হাঁসগুলোর এ দ্বীপেই জন্ম। এরা মাইগ্রেট করার মতো
এখনও ম্যাচিউর হয়নি। এখন তারা লাগাতার ওড়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দেখতে দেখতে পাখিগুলো
এবার নিচু হয়ে আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। হলেন এক্সাইটেড হয়ে বলে, লুক দুটি অ্যাডাল্ট
পাখি ইয়ংদের ওড়া শেখাচ্ছে। আমি তার মন্তব্য অনুসরণ করে অবাক হয়ে দেখি- সত্যি সত্যি
এক জোড়া বড়সড় মরালের পেছন পেছন উড়ছে পাঁচটি সংক্ষিপ্ত ডানা ছোট্ট শিশু মরাল। মাদুরে
শুয়ে শুয়ে ভদ্রলোক চারদিকে হাতড়ান। সাদা লাঠি নেড়েচেড়ে তা দিয়ে স্পর্শ করে অবশেষে রেডিওটি
খুঁজে পেয়ে তা অন করতে করতে তিনি আমাদের বলেন, হোয়ার ইজ ইয়োর ডটার নাও? আই কান্ট সি
হার? তোমাদের মেয়ে কোথায়? না, সে এখানে নেই, আমি তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি না।
আমাদের ভেতরে একসঙ্গে কিছু হারিয়ে ফেলার অনুভূতিতে ধক্ করে ওঠে। আমরা তাকে কোনোরূপ
বিদায় সম্ভাষণ না করেই উঠে পড়ি। চারদিকে নোনা নীল জল, সৈকতে ছড়ানো-ছিটানো সূর্যস্নানরতদের
শোয়া, বসা, কথোপকথনরত প্রায়-নগ্ন দেহরাজি। আধভেজা বলিতে ছড়িয়ে আছে সবুজ শ্যাওলা, জলজ
গুল্ম। আমরা ভাঙা ঝিনুক, মৃত তারা মাছ এড়িয়ে জলের ধার ঘেঁষে হাঁটি। আমাদের উদ্বেগ বাড়তে
থাকে। আপাতদৃষ্টিতে সি বিচের কোথাও কাজরিকে দেখা যায় না।
বেশ খোঁজাখুঁজির পর আমাদের মেয়েকে অবশেষে পাওয়া
যায়। সৈকতের এক প্রান্তে কোমরে হাত দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আরও তিনটি সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে
কথাবার্তা বলছে। কাজরির হাতে বেতের তৈরি একটি লাও বল। একটি ছোট্ট ছেলে তারস্বরে তাকে
জিজ্ঞেস করে, হোয়াট কাইন্ড অব বল ইজ দিস? সে সমস্বরে গলা চড়িয়ে জবাব দেয়- দিস ইজ ফ্রম
দ্য কানট্রি অব লাওস। ডু ইউ ওয়ান্ট টু লার্ন হাউ টু প্লে লাও স্টাইল ফুটবল? ইউ হ্যাভ
টু প্লে উইথ ইয়োর ফুটস অ্যান্ড ল্যাগস অনলি। আরেকটি ছোট্ট মেয়ে জানতে চায়-হোয়ার ইজ
লাওস? ইজ দিস আ কানট্রি? কাজরি ঘুরে হলেনের দিকে চেয়ে বলে- মামি টেল দেম হোয়ার ইজ লাওস?
বিষয়টি জমে উঠছে দেখে আমি তাদের এখানে রেখে সৈকতে আরো খানিক হাঁটাচলা করতে মনস্থ করি।
হলেনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে ইশারায় আমার একাকী এক্সপ্লোরেশন অনুমোদন করে। সৈকতে
বাচ্চারা বালু খুঁড়ে দেয়াল, অলিন্দ ও টাওয়ারের নক্সা এঁকে তাতে জলজ গুল্ম গুঁজে দিয়ে
স্যান্ড-ক্যাসোল তৈরি করছে। আমি বালির কেল্লাগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটি। বেইদিং স্যুট পরা
এক তরুণী কেল্লার ভেতর মহলের মিনারে ঝিনুকের পাথর বসাতে বসাতে রোদ চশমার ফাঁক দিয়ে
আমাকে দেখে। তার কেল্লার দোরগোড়ায় বসে আছে রক্ত-মাংসের এক বুলডগ। আমি সারমেয়র চোখে
সংশয় দেখে অন্যদিকে চোখ ফেরাই। এদিকে সৈকত তরঙ্গে প্লাবিত হতে হতে সার্প বাঁক নিয়েছে।
আমি পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে হাঁটু-অব্দি জলে ডুবিয়ে অন্যদিকে চলে আসি সম্পূর্ণ
বিচ্ছিন্ন ভিন্ন এক সৈকতে।
এদিকটা তুলনামূলকভাবে নির্জন। আমি একটি ভেসে আসা গাছের গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্র্রের ঢেউয়ের তাড়নে থেকে থেকে দুলে ওঠা জলের দিকে তাকাই। তরঙ্গের প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অল্প বয়সি এক দম্পতি। তারা দুজনে হাতে ধরে আছে খাঁচার মতো দেখতে একটি দোলনা। তারা ধরাধরি করে দোলনাটি শুকনো বালিতে রাখে। এবার আমি দোলনার ভেতরে ছোট্ট এক শিশুকে ছটফট করতে দেখি। শিশুটি রেলিং ধরে উঠে বসে মা-বাপের দিকে চেয়ে হাসে। মা বাচ্চার হাতে ঝুনঝুনি জাতীয় খেলনা তুলে দেয়। বাচ্চাটি বারকতক জোরে ঝুনঝুনি বাজিয়ে তা আবার ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে দিয়ে পিতা-মাতার দিকে চেয়ে হাসে। বাপ ঝুনঝুনি আবার বাচ্চাটির হাতে দিলে সে আগের মতো তা বাজিয়ে আবারও ফেলে দেয়। বাপ এবার মায়ের দিকে চেয়ে দুই হাত দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে কিছু বলছে। তরুণী মা স্কার্ট ব্লাউজ খুলতে খুলতে দুই হাত দিয়ে শূন্যে নানা রকমের আকার-আকৃতি ও প্রতীক এঁকে জবাব দেয়। তারা দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হাসে। বাচ্চাকে ঝুনঝুনি আরেকবার তুলে দেওয়া হয়নি বলে সেসব শরীর ঝাঁকিয়ে বো বো শব্দ করে বাপ-মাকে আকৃষ্ট করতে চায়। বাপ আবারও ঝুনঝুনি তুলে দিয়ে তার স্ত্রীকে দুই হাতের ইশারায় কিছু বলে। তরুণী এখন কেবল বিকিনি পরে সমুদ্র স্নানের উদ্যোগ নিচ্ছে। সে দেখতে তেমন সুশ্রী না। খানিক পৃথলা গোছের শরীর দুলিয়ে এবার সে হেঁটে গিয়ে জলে নামে। তার চলিষ্ণুতায় অথবা জলের ছোঁয়ায় মেয়েটির অঙ্গে ফুটে ফলন্ত কুমড়া লতার মতো এক ধরনের ডুগডুগে তারুণ্য। সে এবার হিম শীতল জলে সাঁতার কাটছে। সাঁতরাতে সাঁতরাতে সে তার স্বামী অথবা পুরুষ সঙ্গীর দিকে চেয়ে ক্রমাগত হাত ও আঙুলের ইশারায় কথা বলে চলছে। বেশ কিছুক্ষণ তাদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে আমি যেন তাদের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা সাংকেতিক ভাষা বেশ বুঝতে পারি। মনে হয় মেয়েটি তার পুরুষ সাথিকে জলে নামতে প্ররোচিত করছে। পুরুষ টি-শার্ট খুলে ঘুরে দাঁড়ায়। আমি এবার পরিষ্কারভাবে তার মুখ ও প্রোফাইল দেখতে পাই। তীব্র সূর্যালোকে বালিতে তার দীর্ঘ ছায়া পড়ে। তার ছায়া শরীরকে গ্রিক ভাস্করের গড়া মার্বেলের মূর্তির মতো ঋজু মনে হয়। পুরুষ এবার আমার দিকে পেছন ফিরে সন্তরণরতা স্ত্রী অথবা তার বান্ধবীকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের সংকেতে কিছু বলছে। আমি তার হাতের নড়াচড়ার ছায়ার দিকে তাকিয়ে তার বক্তব্য পড়তে চেষ্টা করি। মনে হয় সে ঠান্ডার দোহাই দিয়ে জলে নামতে চাচ্ছে না। দোলনা থেকে বাচ্চাটি তারস্বরে বো বো করে তাদের নজর আকর্ষণ করতে চায়। শিশুর কণ্ঠের আওয়াজ শুনে আমার মন কেন জানি খুশি হয়ে ওঠে।
সৈকতের এদিকে বালিতে বিস্তর ধারালো নুড়ি পাথর।
খালি পায়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়। তাই আমি বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ডিগি দিয়ে দিয়ে হাঁটি।
এরকম খানিক চলতেই বালির আস্তরণ হয়ে আসে আবার মসৃণ ও সাদাটে। সৈকতটি এখানে শেষ হয়েছে।
এদিকে তেমন কেউ নেই দেখে, যে-ই ফিরে যাব ভাবছি, হঠাৎ করে নজরে পড়ে বেশ দূরে বালিতে
অর্ধেক শরীর সেঁদিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে এক যুবতী। মেয়েটির বালিতে ঢাকা নিম্নাঙ্গের কাছে
উবু হয়ে বসে কী যেন করছে কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণ। বিষয়টি আরেকটু কাছ থেকে না দেখে যেতে ইচ্ছা
হয় না। তাই মৃদু পায়ে আগ বাড়ি। মেয়েটির বালিতে সেঁদানো কোমর ও নিম্নাঙ্গকে মৎস্যকন্যার
শরীরের মতো মনে হয়। কদম ছাঁট চুলের কালো ছেলেটি তার পায়ের কাছে বসে ভাঙা ঝিনুকের টুকরা
দিয়ে শিল্পীর নিষ্ঠায় বালুকায় এঁকে যাচ্ছে মাছের আঁশ। মেয়েটি আধশোয়া হয়ে চেয়ে আছে দূরের
নীল জলছোঁয়া দিগন্তের দিকে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে হেসে বলে ওঠে- আর ইউ হেভিং ফান
ইন দিস আয়ল্যান্ড? আমি তার কাঁধ ছেয়ে নেমে আসা পার্পোল বর্ণের চুলের দিকে তাকিয়ে এবার
আর তাকে চিনতে ভুল করি না, তাই সৌজন্যবশত বলি, হাই আবাগেইল। আই থট ইউ আর আ রিয়েল মারমেইড।
তোমাকে সত্যি সত্যিই মৎস্যকন্যার মতো দেখাচ্ছে। কালো ছেলেটি তার ঊরুর কাছে বালিতে মৎস্যকন্যার
আঁশ আঁকতে আঁকতে বলে, সি ইজ আ মারমেইড। ইজ নট সি? বলে ছেলেটি তার ঊরুর নিচে বালুকায়
আঁকিবুকি করে মাছের পুচ্ছের শেইপ দেয়। আবাগেইল খিল খিল করে হেসে ওঠে। তার বুকে ভেজা
বালি দিয়ে তৈরি কাঁচুলি ঝুর ঝুর করে ভাঙে। আমি এবার সৈকতে শুয়ে থাকা অর্ধেক মাছ ও অর্ধেক
নারী শরীরের দিকে প্রশংসাসূচকভাবে তাকাই। ঈষৎ তেরছা হয়ে আসা সূর্যালোকে তার নাভিমূল
ও দুই ভুরুতে বেঁধানো তিনটি রুপালি আংটি ঝকঝক করে ওঠে। আমি স্বগতভাবে বলি, ইউ আর ভেরি
প্রিটি আবেগেইল। আবেগেইল তার গ্রীবা ঈষৎ বাঁকা করে বলে, ইয়েস আই অ্যাম। ডু ইউ হ্যাভ
আ ক্যামেরা? ইউ ওয়ানা টেক আ পিকচার অব মি? কথোপকথনে তার কাঁচুলি থেকে ভেঙে পড়ে আরেক
চাকলা বালি। আমি ঈষৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যামেরাহীনতার কথা বলি। সে ঠোঁট গোল করে আফসোসের
অস্ফুট ধ্বনি করে।
সৈকতের মাঝামাঝি কাজরি ও হলেনের কাছে ফিরে আসি
অবশেষে। তাদের চারপাশে এখন গোটাপাঁচেক শিশু ও এক জোড়া অ্যাডাল্ট। মনে হয় সবাই নিচু
হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। হলেন হাতে শামুকের ভাঙা খোল নিয়ে বালুকায় বসে।
বালুকার মসৃণতা জুড়ে আঁকা অনেকটা বিশ্বম্যাপের আকৃতি। থাইল্যাড, চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার
মাঝামাঝি ছোট্ট ভূভাগে ইংরেজি হরফে লেখা লাওস। একটি মেয়েশিশু জানতে চায়-ডু দে হ্যাভ
এমিউজমেন্ট পার্ক দেয়ার? কাজরি জবাব দেয়- নো, বাট দে হ্যাভ আ লট অব টেম্পোলস দেয়ার।
ইউ ক্যান প্লে, রান অ্যারাউন্ড ইন দ্য টেম্পোল গ্রাউন্ড। দে হ্যাভ গ্রিন রাইস ফিল্ডস
এজওয়েল। কিডস রাইড ওয়াটার বাফেলো ওভার দেয়ার। শিশুদের মহিষের পিটে চড়ার বর্ণনা শুনে
বাচ্চাদের মধ্যে আশ্চর্যবোধক ‘ওয়াও’ ধ্বনি ওঠে। কাজরি হলেনকে বালিতে জাহাজ এঁকে দিতে
বলে। শামুকের ভাঙা খোল নিমিষে পটুয়ার তুলিতে রূপান্তরিত হয়। হলেনের হাতের আঁচড়ে ক্রমে
ফুটে ওঠে সমুদ্রগামী জলযানের রূপরেখা। কাজরি বালুতে আঁকা জাহাজটি দেখিয়ে সবাইকে বলে,
ইউ নো দিস শিপ ইজ ব্রিংগিং অল মাই টয়জ। মাই স্টাফড খরগোস, কাকাতুয়া, হরিণ, মাই পুতুল
বর্বিজ, অ্যান্ড এডভিথিং অ্যাজ ইজ কামিং বাই দিজ শিপ। বাট উই ডুন্ট হ্যাভ আ হাউস ইন
আমেরিয়া টু কিপ অল দিজ স্টাফ। একটি শিশু জানতে চায়- ইজ দ্য ক্যাপটেন অব ইয়োর শিপ ভেরি
কেয়ারফুল? দেয়ার ইজ আ লট অব প্রাইরেটস আপ ইন দ্য হাই-সি। সমুদ্রে পাইরেট বা জলদস্যুর
উপদ্রবের কথা শুনে কাজরি তাড়াতাড়ি কোনো জবাব দিতে পারে না। সে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস
করে, জাহাজের ক্যাপটেন সাবধানী কি না? সে কি জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে
তার খেলনাগুলো? আমি তাকে আশ্বস্ত করি। শিশুটি আবার কমেন্ট করে- ওয়াচ আউট ফর দ্য পাইরেটস।
দে আর ক্রেইজি। হুঁশিয়ার জলদস্যুরা বেজায় উদ্দাম।
পড়ন্তবেলার সূর্যালোক বাঁকা হয়ে আসতেই সৈকতে যেন
হুড়াহুড়ি পড়ে যায়। অনেকে তাদের ইজিচেয়ার, ম্যাট ইত্যাদি দিগন্তমুখী করে রি-এডজাস্ট
করে। আমরা বালিতে বসে ফেনায় ফেনায় নৃত্যরত সূর্যালোক দেখি। একঝাঁক মরাল পঙক্তি বেঁধে
উড়ে যায় দিগন্তের দিকে, যেখানে মেঘমালা নীলাভ হতে হতে পরিবর্তিত হয় গোলাপিতে। কিছু
কিছু ভাসমান মেঘখণ্ড এবার রূপান্তরিত হয় অরেঞ্জ ও ক্রিমসন বর্ণে। সাদা লাঠি হাতে মানুষটি
বোধ করি ফিরে যাচ্ছেন ঘরে। তার মাদুর ভাঁজ করে বগলে গোঁজা। অন্য হাতে তিনি ধরে আছেন
ছোট্ট রেডিও। লাঠি দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে তিনি ধীরে ধীরে পথ চলেন। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে
গিয়ে লাঠি দিয়ে বালুতে পড়ে থাকা মৃত তারা মাছের দেহটিকে খোঁচান। তারপর কিসের যেন অপেক্ষায়
চেয়ে থাকেন দিগন্তের দিকে। আমাদের কানের কাছে খিলখিল হাসির রিনিঝিনি ঝংকার বাজে। আমি
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাই। কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি চামচে ভাজা মাছ তোলার মতো দুই হাতে বয়ে নিয়ে আসছে
আবেগেইলের বালুকাময় দেহ। মেয়েটি বুঝি ঈষৎ কাতুকুতুতে ক্রমাগত খিলখিলিয়ে চলছে। কদম ছাঁট
চুলের ছেলেটি বর্তনে ফিশফ্রাই তুলে দেওয়ার মতো করে আবেগেইলে সৈকতে স্থাপন করে। সে
এবার বসে জলে ভেজা কুকুর যেরকম শরীর ঝাঁকিয়ে জল ঝরায় সেরকম ঝাঁকি দিয়ে দেহ থেকে বালি
ঝরাচ্ছে। কাজরি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে- ডু ইউ নো হাউ টু সেইল আ বোট? আমি নিজের অক্ষমতা
তার কাছে গোপন করি না। সে আবার কথা বলে- বাট মামি নোজ হাউ টু সেইল আ বোট। উই ক্যান
টেইক গ্র্যান্ড পা’জ বোট অ্যান্ড সেইল অল দি ওয়ে টু লাওস। আমি পাল
তোলা নৌকায় চড়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবশেষে মেকং এর জলধারায় ভেসে লাওসে ফিরে যাওয়ার
আইডিয়াটি নিয়ে ভাবি। আমাদের চোখের সামনে মেঘের রঙ দ্রুত বদলায়। জলে ভাসমান কায়াক ও
ছোট নৌকাগুলো একে একে ফিরে আসছে জেটিতে। কেবল একটি নৌকা দূরের জলে আনমনা ভাসে। নাওটির
পাল গোটানো। হালে বসে ডেভিড রিমার্ক করে চলেছেন তার বাঁকানো পাইপ। রঙ্গমঞ্চের কার্টেনের
মতো দুই পাশে মেঘ সরে যেতে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মাউন্ট রেঁনেয়ারের তুষার শুভ্র চূড়া।
হলেন ধবল গিরির দিকে তাকিয়ে বলে, অ্যসম! দ্যাটস আ প্যানোরমা আই মিসড ইন লাওস। সত্যিই
লাওসে ধানের ক্ষেতে বাতাস বয়ে যায় বটে, তবে আমরা সেখানে কখনও তুষার ধবল পাহাড়ের শুভ্র
চূড়া দেখিনি।