আহমাদ শামীম
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩ ১২:৪৮ পিএম
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৬ পিএম
‘আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে/ ভাষাবিহীন অজানিতের গানে’, রবি ঠাকুরের এই পঙক্তি ক’টি ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনের কথা। আকাশের ডাকে
ওই দূরের পানে, অজানা কোন বাঁশির সুরে পাগলপারা হয়ে মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়, সেটা তো
নতুনকে জানার উদ্দেশ্য নিয়েই। নিজের সেই অভিজ্ঞতা অনেকে লিখে গিয়েছেন নতুন পাঠকদের
উদ্দেশ্যে। কালে কালে সেই সব লেখা, যা ভ্রমণসাহিত্য আকারে পাঠকদের মন জয় করে নিয়েছে।
আজ বলবো করব দেশের বাইরের কিছু চিরন্তন ও পাঠকপ্রিয় ভ্রমণবিষয়ক বই নিয়ে, যা আগামীতেও
ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মনের খোরাক জোগাবে।
দ্য ট্রাভেল অব মার্কো পোলো
ত্রয়োদশ শতকে ইতালিয়ান ব্যবসায়ী ও পর্যটক মার্কো
পোলো ব্যবসা এবং ভ্রমণের জন্য নিজ দেশ ছেড়ে বেরিয়েছিলেন এশিয়া মহাদেশকে উদ্দেশ্য করে।
বেশ কয়েক বছরব্যাপী সেই যাত্রায় তিনি এশিয়া মহাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা পাড়ি দিয়েছিলেন।
চীন, তিব্বত, ভারতসহ ১০০টিরও বেশি দেশ ছিল এই তালিকায়। ইউরোপের মানুষ এশিয়ার বিভিন্ন
দেশের বর্ণিল সংস্কৃতি, সমাজ, মানুষ, খাদ্যাভ্যাস, স্থাপনা এবং প্রাকৃতিক বিস্ময় সম্পর্কে
মার্কো পোলের বয়ানের মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারে। এই ট্রাভেলগ লিখতে তাকে সহায়তা করেছিলেন
রাশতিসেলো ডে পিজা নামের এক ফ্রাঙ্কো-ইতালিয়ান লেখক। ইতালির জিনোয়ার জেলে বন্দি থাকা
অবস্থায় তারা এ গ্রন্থ রচনা করেন।
দ্য জার্নালস অব ক্যাপ্টেন কুক
বিখ্যাত ব্রিটিশ ভ্রমণকারী, মানচিত্রকার এবং নাবিক ক্যাপ্টেন জেমস কুক। ১৭৬৮ থেকে ১৭৭৯ সাল পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরে তিনি তিনটি অভিযান পরিচালনা করেন। তার এ যাত্রার সীমা ছিল কুমেরু থেকে আর্কটিক সাগর পর্যন্ত। তিনি উত্তর আমেরিকা ও কানাডার অনাবিষ্কৃত কিছু অঞ্চল- যা তখন নিউফাউন্ডল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল, সেই সব এলাকাকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান দিয়েছেন। এ ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, হাওয়াই ও তাহিতি দ্বীপের মানুষ এবং ওই অঞ্চলগুলোর অজানা অনেক কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। তার এই লিখিত অভিজ্ঞতার মলাটবদ্ধ নাম ‘দ্য জার্নালস অব ক্যাপ্টেন কুক’। এ রচনাগুলোয় ভয়ঙ্কর সুন্দর যাত্রাপথে তার দেখা দেশ, মানুষ, এখানকার বিভিন্ন প্রথার কথামালা ব্যক্ত হয়েছে।
দ্য ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা
১৩২৫ সালে উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোর তানজিয়ার
প্রদেশের নিজ বাড়ি থেকে মক্কায় হজ পালনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন ২১ বছর বয়সি এক যুবক।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে প্রায় ৩০ বছর পর তিনি ঘরে
ফেরেন। মানুষটির নাম ইবনে বতুতা। দীর্ঘ এ যাত্রায় তার দেখা বিভিন্ন বিষয় টুকে রাখতেন
ডায়রিতে। সেই ডায়রির গ্রন্থিত রূপ ‘দ্য ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা’। ইবনে বতুতা ঘুরে বেড়িয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ
এবং সেখান থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। ইসলামপ্রধান দেশগুলোই যদিও ছিল তার প্রধান লক্ষ্য-
এসেছেন আমাদের এই বঙ্গ অঞ্চলেও। ৭শ বছরেরও বেশি সময় আগেকার এক অদেখা পৃথিবীর সন্ধান
পাওয়া যায় তার এই ভ্রমণগদ্যে।
ওয়ার্ল্ডওয়াক
আমেরিকার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক স্টিভেন নিউম্যান।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ করবেন তিনি। শুনতে অবাক লাগলেও,
সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নও তিনি ঘটান। ১৯৮৩ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে বের হন। চার
বছর পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান পাঁচ মহাদেশের ২১টি দেশ। এই যাত্রায় তাকে হাঁটতে হয় ১০ হাজার
মাইলেরও বেশি পথ। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের ওপর নির্ভর করে কাটানো সময়গুলোয় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার
মলাটবন্দি রূপ ‘ওয়ার্ল্ডওয়াক’। যাত্রাপথে
তিনি সাক্ষাৎ পেয়েছেন হাজারো মানুষের। আতিথেয়তা নিয়েছেন অনেকের কাছ থেকে। তার এই যাত্রার
ফলাফল ছিল, পৃথিবীর দেশগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও এখানকার মানুষগুলো আসলে একই রকম।
দ্য ভ্যালি অব দ্য অ্যাসাসিনস
১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ ভ্রমণসাহিত্যিক
ফ্রেয়া স্টার্কের ইরান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রন্থ ‘দ্য ভ্যালি অব দ্য অ্যাসাসিনস’। ফ্রেয়া
স্টার্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন একজন নার্স হিসেবে। সেখান থেকে দেশে ফিরে
১৯৩০ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন তৎকালীন পারস্য তথা ইরান ঘুরে বেড়াবেন একা। একজন ইউরোপিয়ান
নারীর জন্য যা চ্যালেঞ্জিংই বটে। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই একলা একা ঘুরে বেড়িয়েছেন ইরানের
প্রত্যন্ত অঞ্চল। মিশেছেন দেশটির মানুষদের সঙ্গে, দেখেছেন তাদের সংস্কৃতি, আচার ও অন্যান্য
নানা বিষয়।
এ শর্ট ওয়াক ইন দ্য হিন্দুকুশ
১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত
এরিক নিউবাই হঠাৎই মনস্থির করলেন তিনি আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাহাড় জয় করতে
যাবেন। হিমালয় পর্বতশ্রেণির পশ্চিম অংশের নাম হিন্দুকুশ। যা আফগানিস্তানের নুরিস্তান
প্রদেশে অবস্থিত। এ যাত্রায় তিনি সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন সেই সময়ে ইরানে অবস্থানরত
বন্ধু হিউ চার্লসকে। দুই বন্ধু মিলে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিন্দুকুশ পবর্তরাজির
মির সামির পাহাড় আরোহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অল্প অভিজ্ঞতা নিয়েই তারা দুজন দুর্গম পাহাড়
জয় করতে চললেন। যদিও প্রায় চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে তাদের ফেরত আসতে হয়। এই অভিযানের গল্প
এবং আফগানিস্তানের মানুষ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভ্রমণবিদ এরিক নিউবাইয়ের লেখা চিরায়ত ভ্রমণ
গ্রন্থ ‘এ শর্ট ওয়াক ইন দ্য হিন্দুকুশ’।
দ্য মোটরসাইকেল ডায়রিস
মার্কসবাদী আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারা।
১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি ২৩ বছর বয়সে মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে বন্ধু আলবার্তো
গ্রানাদোকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে বেরিয়ে পড়েন ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণে। আর্জেন্টিনা
থেকে শুরু করে চিলি, পেরু, কলম্বিয়া হয়ে ভেনিজুয়েলায় এসে থামেন তারা। একই বছরের ২৬
জুলাই ভ্রমণশেষে তারা পাড়ি দেন প্রায় আট হাজার মাইল পথ। তার সেই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা
নিয়ে লেখেন রোমাঞ্চকর বই ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়রিস’। এই যাত্রায় তিনি অবলোকন করেন এসব দেশের মানুষের অবস্থা, সামাজিক
অসাম্য, তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ১৯৯৩ সালে চের মৃত্যুর প্রায় ২৬ বছর পরে বইটি আলোর
মুখ দেখে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় এর ইংরেজি সংস্করণ। আপাতদৃষ্টিতে ভ্রমণবিষয়ক রোমাঞ্চকর
অভিজ্ঞতার বইটিকে চে গুয়েভারার বিপ্লবী পথযাত্রার প্রস্তুতিপর্বও বলা যায়।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল : অ্যান ইরেভেরেন্ট গাইড
আমেরিকান সাংবাদিক, শেফ ও টিভি শো উপস্থাপক অ্যান্থনি
বোর্ডেন কাজের প্রয়োজনে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের ৪৩টিরও বেশি দেশ। তার এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার
গ্রন্থিত রূপ ‘ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল : অ্যান ইরেভেরেন্ট গাইড’। তার যাত্রাপথে ছিল নিজ শহর নিউইয়র্ক সিটি থেকে শুরু তরে দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার বোরেনো দ্বীপ থেকে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ারস, চীনের সাংহাই, আফ্রিকার তাঞ্জানিয়া-
এমনকি ওমানের নির্জন মরুভূমি পর্যন্ত। তার দেখা দেশগুলোর মানুষ, এখানকার সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি,
প্রাকৃতিক নিদর্শন এবং অবশ্যই খাবারদাবারের বর্ণনা উঠে এসেছে এই বইয়ে স্থান পাওয়া রচনাগুলোয়।
এ ছাড়া এসব স্থানে যাওয়ার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি বইয়ের বিভিন্ন লেখায়। ২০১৮ সালে
অ্যান্থনি বোর্ডেনের মৃত্যুর পর তার দীর্ঘদিনের সহচর লরি উলভার বিভিন্ন সময়কার লেখা
ও সাক্ষাৎকারগুলো গ্রন্থনার মাধ্যমে বইটি প্রকাশ করেন।
অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ট্রেইনস : এ
ফর্টি ফাইভ মাইল অ্যাডভেঞ্চার
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক মনিষা রাজেশ
ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তবে তার এই ভ্রমণ গতানুগতিক ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে কিছুটা আলাদাই
বলা চলে। কেননা, বিশ্বের ১৫টি দেশ তিনি ঘুরেছেন ৮০টি ট্রেনে চড়ে! তিন মাসের এই যাত্রাপথে
তিনি ভ্রমণ করেছেন পঁয়তাল্লিশ হাজার মাইল রেলপথ। এই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার পাঠকপ্রিয়
বই ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ট্রেইনস : এ
ফর্টি ফাইভ মাইল অ্যাডভেঞ্চার’। ভারতের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ট্রেন দিয়ে শুরু
করে যাত্রা শেষ করেছেন জাপানের বুলেট ট্রেন দিয়ে।
লোনলি প্ল্যানেট দ্য ট্রাভেল বুক : এ জার্নি থ্রু
এভরি কান্ট্রি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড
১৯৭৩ সাল থেকে ট্রাভেল গাইড প্রকাশ করে আসছে লোনলি
প্ল্যানেট নামের প্রকাশনা সংস্থা। তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের ২৩০টি দেশের
৮৫০টি ছবি, মানচিত্র এবং প্রতিটি দেশের বর্ণনাসহ বই ‘লোনলি প্ল্যানেট দ্য ট্রাভেল বুক : এ জার্নি থ্রু এভরি কান্ট্রি ইন
দ্য ওয়ার্ল্ড’। প্রতিটি দেশ থেকে লোনলি প্ল্যানেট নির্বাচিত
ব্যক্তির লেখা ও ছবিসমৃদ্ধ সমগ্র বইটিই যেন বিশ্বের এক অনন্য ছবি। বইয়ে আছে কোন দেশ
কখন ভ্রমণ করা উচিত, কোন কোন জায়গা থাকতে পারে ঘুরে দেখার তালিকায়; পাশাপাশি আছে সে
দেশের সংস্কৃতিবিষয়ক বর্ণনাও।