× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির বাড়িতে

ফারুক মঈনউদ্দীন

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩ ১২:৪০ পিএম

ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির বাড়িতে

ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়িদের গল্প বলে যে কালনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেটি যে বর্ধমান জেলার একটা মহকুমা শহর তা জানা ছিল না, বহু প্রাচীন মন্দিরের জন্য এটাকে মন্দিরের শহরও বলা হয়। সেই কালনার এক ছিমছাম মহল্লা সিদ্ধেশ্বরী পাড়া থেকে আমাদের দেশের ইজিবাইকের মতো টোটোতে চড়ে যখন বের হই তার চালক জানায়, মহিষাসুরমর্দিনী মেলা বসবে বলে বেশ কয়েকটা রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ, তারপর বলে, দেখা যাক কতদূর যেতে পারি। শব্দহীন ত্রিচক্রযানটি পাড়ার সরু রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় এসে পড়লে সত্যিসত্যিই এক জায়গায় পুলিশ পথ আটকে দেয়। টোটোওয়ালাটি বেশ তালেবর বুঝলাম। সে নেমে গিয়ে পুলিশকে আমার হাতের বড় লেন্সের ক্যামেরা দেখিয়ে গাড়িতে বিদেশ থেকে আসা সাংবাদিক আছে ইত্যাদি বলে-কয়ে অনুমতি আদায় করে নেয়। নেহাত মফস্বল শহরের পুলিশ বলে ছেড়ে দিয়েছিল।

ছাড়া পেয়ে সে আমাদের সোজা নিয়ে যায় কালনার অন্যতম দ্রষ্টব্য পুরনো রাজবাড়ির প্রতাপেশ্বর শিব মন্দিরে। রাজবাড়ি মানে মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুরের প্রাসাদ। ১১০ টি ঘরের সেই রাজপ্রাসাদ আজ নেই, সামনের বাগানটি এখন খেলার মাঠ, রাজবাড়ির সমাধিমন্দিরের সাথের সমাজবাড়ি হয়েছে কালনা মহিষমর্দিনী উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, আর প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ সংস্কার করে সেখানে হয়েছে রাজ্য সরকারের অফিস। ঢুকতেই বেদির ওপর বসানো একটা পুরনো কামান, তেমন আহামরি কিছু নয়, তবে রাজবাড়ির স্মারক বলে বেশ যত্নে রাখা। ওটা পেরিয়ে গেলে প্রতাপেশ্বর দেউল মন্দির। এটাকে জলেশ্বর মন্দির নামেই চেনেন কেউ, আবার কেউ বলেন প্যারীকুমারী মঠ। মন্দিরটি যতখানি ছোট, ততখানি আকর্ষণীয় এটার গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটা টাইলসগুলো। মন্দিরটা যেন বাংলাদেশের দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরের মিনি সংস্করণ, বয়সও কান্তজির মন্দিরের চেয়ে প্রায় একশ বছর কম। কান্তজির মন্দিরের উচ্চতা আদিতে ছিল ৭০ ফুট, ভেঙে ভূূমিকম্পে যাওয়ায় কমে হয়েছে ৫০ ফুট, আয়তন ৩৬০০ বর্গফুট। আর প্রতাপেশ্বর মন্দিরটির উচ্চতা ৪৫ ফুট, আয়তন মাত্র ২২৫ বর্গফুট।


উঁচু ভিত্তির ওপর তৈরি নির্মিত প্রতাপেশ্বরের মন্দিরটির চার দেয়ালে রয়েছে পোড়ামাটির টালির ফলক। ভেতরে ঢোকার একটি দরজা, সেটা দিয়ে চোখে পড়ে গর্ভগৃহের কেন্দ্রে পাথরের শিবলিঙ্গ। চারপাশের অপরিসর বারান্দায় দাঁড়িয়ে পোড়ামাটির ফলকগুলোর চেহারা স্পষ্ট হয়। দরজার ওপরের দেয়ালের ফলকগুলোতে রামসীতার অভিষেকের দৃশ্য, তার নিচে বাদকদল। অন্য দেয়ালগুলোতে লঙ্কাযুদ্ধের দৃশ্য, দশভুজা দুর্গা, রাম-রাবণের যুদ্ধ, গৌড়নিতাইয়ের কীর্তনদল, বানরসেনাদল, রাধাকৃষ্ণলীলার দৃশ্য, কালীমূর্তি, সখীপরিবৃত কৃষ্ণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবসহ নানান দেবদেবী ও মুনিঋষির মূর্তি। আরো আছে কোনো থিম ছাড়া বিচ্ছিন্ন নারীপুরুষ, ঘোড়সওয়ার-এসব। এদের মধ্যে ভিনদেশী পোশাকে একদল বিদেশিনীর মূর্তিও আছে, তবে ভারতীয় পুরাণের চরিত্রদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কী, বোঝা যায় না। 


মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে অদূরে কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দিরের চূড়ারাজি। মোট পঁচিশটি চূড়া রয়েছে এটিতে, প্রথম স্তরে চার কোণে তিনটি করে বারোটি, দ্বিতীয় স্তরে দুইটি করে আটটি, তৃতীয় স্তরে একটি করে চারটি আর শীর্ষে একটি-এভাবেই মোট পঁচিশটি। ওটার কাছে গেলে চূড়াগুলো একসাথে দেখতে পাওয়া যাবে না। ছোট মন্দিরটি থেকে নামলে হাতের দুপাশে সাজানো ঘাসে ঢাকা প্রশস্ত লন, তার মধ্য দিয়ে বাঁধানো পায়ে হাঁটা পথ ধরে এগিয়ে গেলে হাতের বামে রাসমঞ্চ। এই রাসমঞ্চ তৈরি হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহেরও একশ বছর আগে, ১৭৫৮ সালে। রাজবাড়ির সাথে রাসমঞ্চ থাকবে না এমন হতে পারে না। আট কোণবিশিষ্ট রাসমঞ্চের আটটা খোলা দরজা, ওপরে গম্বুজাকৃতি ছাদ। মূল মঞ্চের বাইরে আর একটা ছাদবিহীন অষ্টকোণাকৃতি ক্ষেত্র, প্রতিটি বাহুতে তিনটি করে মোট চব্বিশটি খোলা দরজা। একসময় ছাদ থাকলেও ভেঙে পড়ার পর সরকারি সংস্কার ফিরিয়ে এনেছে বর্তমান রূপ।


রাসমঞ্চ ফেলে এগিয়ে ডানে ঘুরলে হাতের বামে রূপেশ্বর শিব মন্দির। এটির ওপর গম্বুজ চূড়া কিছুই নেই, সাধারণ সমতল ছাদ, নেই টেরাকোটার বিশেষ কোনো কাজও। এমন সমতল ছাদবিশিষ্ট মন্দির আগে কখনো দেখিনি। মন্দিরের বারান্দায় দুটো স্তম্ভ, তার ওপর তিনটি ধনুকাকৃতি খিলান সহ সামনের দিকটা গতানুগতিক নকশায় অলঙ্কৃত, জৌলুশহীনও বটে। মাঝখানের খিলানের ওপর মার্বেল পাথরের ফলকের ওপর চার পঙক্তির সংস্কৃত শ্লোকের প্রথম পঙক্তি পড়তেই দাঁত উপড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, সেটা এরকম,  শ্রীরামপ্রতিমো মহাগুণময়স্ত্রৈলোক্যচন্দ্রো নৃপÑ। অনেক কষ্টে এগিয়ে স্তস্যাতেনৃপশেখরস্য মহিষী জ্যেষ্ঠা ধরিত্রীসুতা পর্যন্ত পড়ার পর রণেভঙ্গ দিতে হয়। পরে বহু খোঁজাখুঁজির পর শ্লোকের মতো পঙক্তিচতুষ্টয়ের অর্থ আবিষ্কার করা যায়, রামপ্রতিম মহাগুনের অধিকারী রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের জ্যেষ্ঠা মহিষী রূপকুমারী দেবী ১৬৮৩ শকাব্দে কৈলাস পর্বতের তুল্য ত্রিপুরারি শিবের এই মন্দির নির্মাণ করেন।


রূপেশ্বরের মন্দির পেরিয়ে এগিয়ে গেলে হাতের বামে সারবাঁধা পাঁচটি ছোট শিব মন্দির, পঞ্চতন্ত্র মন্দির। অসমান উচ্চতার আটচালা মন্দিরগুলোগুলো দেখে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের চত্বরে সারবাঁধা চারটি শিব মন্দিরের কথা মনে পড়ে যায়। এগুলোর ছাদ মোট ছয়টি স্তরে পিরামিডের মতো ওপরে উঠে গেছে। শীর্ষে পদ্মপাপড়ির ওপর কলসচূড়া। ঢাকেশ্বরীর শিব মন্দিরগুলোর সৌন্দর্যের তুলনায় পঞ্চতন্ত্র মন্দির অনেক সাদামাটা।


পঞ্চতন্ত্র মন্দির পার হলেই ছোট গেট দিয়ে ঢুকতে হয় বিজয় বৈদ্যনাথ আর কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দিরে। রথের চূড়ার মতো কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল প্রতাপেশ্বর মন্দির থেকেই। কাছে গেলে সেই চূড়াগুলোর সবগুলো আর দেখা যায় না। প্রতাপেশ্বর কিংবা কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দিরের চেয়ে দীনহীন বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাফলকে সংস্কৃতভাষায় যা লেখা আছে তার বাংলা সারসংক্ষেপ এরকম: কুমার শ্রীমিত্রসেনের ধর্মপত্নী শ্রযুক্তা লক্ষীদেবী পুত্রলাভের জন্য বৈদ্যনাথ শিবকে পূজা করে ত্রিলোকচন্দ্র নামের পুত্রকে লাভ করেন। তার পর তিনি কারুকার্যখচিত এই মন্দির নির্মাণ করে মহাদেবের জন্য ভক্তিস্বরূপ বিজয়বৈদ্যনাথ নামের শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন।


বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দিরের বারান্দার সামনে নানান কসরত করে ছবিটবি তুলে কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দিরের দিকে পা বাড়াই। এই মন্দিরে টেরাকোটার কিছু চমৎকার কাজ আছে। প্রায় আড়াইশ বছর আগের মন্দিরটির গর্ভগৃহের সামনে বারান্দার মতো একটা ঢালু ছাদবিশিষ্ট মণ্ডপ। ওটার তিনটি খিলানকে ধরে আছে দুটো স্তম্ভ, দুকোণে রয়েছে আরো দুটি। সেই স্তম্ভের গায়ের টেরাকোটায় ফুলের নকশা, আর নানান পৌরাণিক মুর্তি। মূল মন্দিরের কার্নিশ পর্যন্ত চাঁদওয়ারিতে অনেকগুলো খোপ, সেগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্রের মূর্তি ফলক। মানুষের নাগালের অনেক ওপরে বলে ফলকগুলো এখনো পর্যন্ত অক্ষত রয়ে গেছে। দেবালয় নির্মাণের এই স্থাপত্যশৈলী বাংলার একান্ত নিজস্ব, যার বিকাশ ঘটে হাজার বছরেরও আগে। মন্দিরের মূলগৃহে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহে পূজোর আয়োজন ইতিহাসের সাথে অন্তর্হিত হয়নি এখনও। সামনের চাতালে বট, অশ্বত্থ, নিম, খেজুর আর কাঁঠাল গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করেছে পঞ্চবটি বৃক্ষ। গাছগুলো এমন ঘন সন্নিবদ্ধ যে প্রতিটিকে আলাদা করে শনাক্ত করা বেশ কঠিন।  


সেখান থেকে বের হয়ে লালজী মন্দিরে ঢোকার মুখেই বাধা। ওটার সামনে যে চারচালা বহুস্তম্ভবিশিষ্ট নাটমন্দিরটি রয়েছে, সেটির চারপাশে হাঁটুজল, স্থির সেই জলে স্থাপনাটির প্রতিবিম্ব তিরতির করে কাঁপে। প্রথমে দেখলে এটিকে মন্দিরের স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের অংশ বলেই মনে হয়। কিন্তু অন্য দর্শনার্থীরাও যখন সেই জলমগ্ন চাতালের সামনে এসে বাধা পেয়ে কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যেতে থাকে, তখন বুঝতে পারি, কয়েকদিন আগে যে প্রবল বর্ষণে কলকাতা প্রায় ভেসে গিয়েছিল, বর্ধমানের কালনাও তার বাইরে ছিল না। সেই ভারী বর্ষণের জল মন্দিরের চাতাল ছেড়ে যেতে পারেনি, ফলে জলেভাসা মন্দিরটির স্থাপত্য সৌন্দর্য এক নতুন চেহারায় দেখা যায়। 


অগত্যা লালজী মন্দির দর্শনের বাসনা অপূর্ণ রেখে রাজবাড়ির অঙ্গন থেকে বের হয়ে আসি। রাজবাড়ির উল্টোদিকে নবকৈলাস মন্দির, লোকমুখে ১০৮ শিবমন্দির, বয়স দুইশ বছর পেরিয়ে গেছে। এটা নির্মাণ করিয়েছিলেন বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র। মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পর জুতো খুলে রাখতে হয়। অন্য সব তীর্থস্থানের মতো ঝকঝকে পাথর বাঁধানো নয়, সাধারণ সিমেন্টের খসখসে চাতালের কোথাও কোথাও হালকা শ্যাওলার পাতলা আস্তরণও রয়েছে। সেসব উপেক্ষা করেই নগ্নপদে শিবমন্দির দর্শনে নামতে হয়।          

সচরাচর শিবমূর্তি হয় কালো রঙের, কিন্তু এখানে সাদা ও কালো দুটোই দেখা যায়। বৃত্তাকার দুই সারি মন্দির, প্রতিটির ভেতর একটা করে শিবমুর্তি। বড় বৃত্তটির সাতশ ফুট পরিধিতে আছে ৭৪টি মন্দির, যার একটিতে কালো কষ্টিপাথরের, পরেরটিতে সাদা শিবলিঙ্গ, আবার পরেরটি কালো, তার পরেরটি সাদা-এমনভাবে বিন্যাস রক্ষা করা হয়েছে। ভেতরের বৃত্তের সাড়ে তিনশ ফুট পরিধিতে ৩৪টি শিবলিঙ্গের প্রতিটিই সাদা। গবেষকদের ধারণা, সাদা রঙে বিধৃত হয় ত্যাগ, আর কালোতে ভোগ। এই দুই বিপরীত বোধের ভেতর থেকে বিবেক জাগ্রত করার জন্যই এই রঙের বিন্যাস।


পুরো স্থাপনাটি এক জ্যামিতিক ছন্দে নির্মিত। পিথাগোরাসের জ্যামিতি না জানলেও এটির মূল পরিকল্পনাকারী যে সাধারণ জ্যামিতি ও ভূগোল দুটোই জানতেন সেটা বোঝা যায়। কারণ, মন্দিরের গৌরীপট্টগুলোর প্রতিটি উত্তরমুখী। এতবড় পরিধি নিয়ে বিশাল বৃত্তাকারে সাজানো শতাধিক গৌরীপট্টের প্রতিটিকে উত্তরমুখী করার জন্য যে সঠিক জ্যামিতিক জ্ঞান তিনি প্রয়োগ করেছেন সেটি বিস্ময়কর।


উত্তরমুখী গৌরীপট্ট প্রসঙ্গে গবেষকদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা স্বামীগৃহে যায় বটে, কিন্তু তাদের মনের একটা অংশ পড়ে থাকে পিতৃগৃহের দিকে। আজন্ম বেড়ে ওঠা সেই বাড়ির জন্য তাদের মন থাকে সদা উতলা। গৌরীর পিতৃগৃহ যেহেতু কৈলাসে, আর কৈলাসের অবস্থান উত্তরদিকে, তাই গৌরীর মন পড়ে থাকে উত্তরে, আর সেকারণে গৌরীপট্টগুলোর মুখও উত্তরমুখী। মন্দিরের সংখ্যা সম্পর্কে তাঁদের ব্যাখ্যা, জপমালায় যেমন থাকে ১০৮ টি বীজ, তেমনি মন্দিরগুলোও সমসংখ্যক। সে অর্থে মন্দির কমপ্লেক্সটি যেন একটি বিশাল জপমালা। এতগুলো মন্দিরে পুজো দেওয়া একজনের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই একসময় মোট বারো জন পুরোহিত নিয়োজিত ছিলেন এখানে, প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত ছিল নয়টি করে মন্দির। তখনকার হিসেবে প্রত্যেক পুরোহিতের দক্ষিণা ছিল বারো আনা। এখন কতজন পুরোহিত আছেন কিংবা তাঁদের দক্ষিণাই বা কত, সেটা আর জানা হয় না। ভেতরের বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রে একটা কূপ, ওটার ওপর লোহার জালি দিয়ে ঢাকা, অনেক নিচে জলের অস্তিত্ব দেখা যায়। এই কুয়োটির অবস্থান ও খননের কারণ সম্পর্কে রয়েছে একাধিক মত। কারো মতে এটি কেবলই বৃত্তের কেন্দ্র হিসেবে খনন করা হয়েছিল, আবার কারো মতে মন্দিরের পুজোর কাজে ব্যবহারের জন্য এটি ছিল গঙ্গাজলের আধার।


শিবমন্দির বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছি পণ্ডিত সূর্যদাস মন্দিরে। তবে এটি মন্দিরদর্শনের জন্য নয়। এটির উলটোপাশে রেলিংঘেরা একটা উঁচু চাতালের মাঝ বরাবর বিশাল এক কুলগাছ, দাবি করা হয় এটির বয়স পাঁচশ বছর। চাতালের রেলিংয়ে বসে গল্প করছিল দুই তরুণী, আমরা উঠতে গেলে ওরা বাধা দেয়, বলে, জুতো খুলে আসুন। অল্প কিছু সময় থাকবো, তা-ও জুতো খুলতে হবে? মেয়েদুটি একটু টেটিয়া আছে, বলে, যতক্ষণই থাকুন, মন্দিরে আসবেন, তার পবিত্রতা মানবেন না? অগত্যা জুতো ছেড়ে চাতালে উঠে প্রবীণ কুলতলার পাশে সাদা রং করা ছোট গুমটির মতো মন্দিরটির সামনে যাই। পাকা ঘরটির ধনুকাকৃতি খিলানের নিচে একটি মাত্র দরজা, ভেতরে একটা অনুচ্চ বেদি। তার ওপর সাদা কয়েকটা তাজা ফুল রাখা। এখানেই বহু ঘটনার পর বৈষ্ণব সাধক নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পন্ডিত সূর্যদাসের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবার। ঘরটির দরজার পাশে মার্বেল পাথরে খোদাই করা চার পঙক্তি কবিতা, সূর্যদাস পন্ডিত বিদিত সংসারে/ বসুধা জাহ্নবা দুই কন্যা যাঁর ঘরে/ একদিন নিত্যানন্দ প্রভাতে উঠিয়া,/ অম্বিকাভিমুখে যান এক ভৃত্য লইয়া। সূর্যদাসের কন্যা বসুধাকেই আসলে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন নিত্যানন্দ। কিন্তু ঘটনাচক্রে দুই মেয়েকেই তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেন পন্ডিত সূর্যদাস। বোঝা যায়, বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে সূর্যদাসের বাড়ির দিকে নিত্যানন্দের যাওয়ার বর্ণনা দেওয়া কাব্যাংশ এটি।


এখান থেকে টোটোতে কয়েক মিনিট দূরত্বে চৈতন্যদেবের বিশ্রামস্থল। গৌরীদাস পন্ডিত ও চৈতন্যদেবের সাক্ষাতের এই জায়গাটি তেঁতুলতলা মন্দির হিসেবেও পরিচিত। মন্দিরের চারপাশের দেয়ালে কাঁচা হাতে আঁকা গৌরীদাস পন্ডিত ও অন্যান্য চরিত্রের বিভিন্ন ছবি। এখানকার অবিশ্বাস্য বিশাল তেঁতুলগাছটির বয়স পাঁচশ বছরের বেশি। গাছটা এতই বয়স্ক যে বিভিন্ন ডাল থেকে বট গাছের মতো ঝুরি নেমে এসেছে। তেঁতুল গাছের ঝুরি নামতে দেখিনি আগে। গাছের নিচে নিচু একটা ছোট মন্দির, দেয়ালে সাদা সিরামিক টাইলস, ওপরের প্যানেল জুড়ে রামনাম লেখা। মন্দিরের ছোট দরজাটিতে লোহার গ্রিলের সুরক্ষা। ভেতরে আছে চারকোনা বেলে পাথরের একটা খণ্ডের ওপর চৈতন্যদেবের জোড়া পায়ের ছাপ। ওটার পেছনে সূচিকর্ম করা কাপড়ের ঢাকনাসহ কাঠের একটা চারপেয়ে আসন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র এক জায়গা এই তেঁতুলতলা মন্দির। সেই বন্ধ গ্রিলের সামনের বৃষ্টিভেজা অপরিচ্ছন্ন চাতালের ওপর উবু হয়ে প্রণামে রত এক সধবা মহিলা, পেছনে আরো দুজন অপেক্ষমান। তাঁর পায়ের পাতায় আঁকা আলতার রঙে উপেক্ষিত চাতালের ময়লা।


সেদিন ছিল ঝুলন উৎসবের দিন। তাই কালনার পথে পথে অলিতে গলিতে কিশোর কিশোরীরা কৃষ্ণ আর রাধার সাজে সেজে বসে আছে নিজেদের সাধ্যমতো সজ্জার আসনে। কোথাও সত্যিকার দোলনাও জোগাড় হয়েছে বসার জন্য। সেখানে কিশোর কৃষ্ণ আর কিশোরী রাধা বসা, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা সামনে দিয়ে পথচলতি মানুষ আর রিকশা টোটো থামিয়ে আদায় করছে চাঁদা, তাদের কিশোর কণ্ঠে তেমন জোর কোনো দাবী নেই। তাই বেশিরভাগ মানুষই ওদের বাড়ানো হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ দিচ্ছেও কিছু। আমাদের টোটোকেও কয়েকবার থামানো হলো। সামনে বসেছি বলে চাইলেই দশ রুপি করে দিয়ে দিচ্ছি। কয়েক জায়গায় ঘরের সামনে মা-মাসীরাও জড়ো হয়ে ছেলেমেয়েদের পক্ষ নিয়ে চাঁদা দাবি করছেন, সে দাবির মধ্যে  নম্রতা নেই, বেশ কর্কশ ধমকের সুরে চাওয়া। এদের কিছু দেওয়া উচিত নয়।

বৈষ্ণবদের দোল পূর্ণিমার কথা জানি, কিন্তু ঝুলন পূর্ণিমার এই উৎসবের কথা জানি কেবল রবীন্দ্রনাথের ঝুলন কবিতা পড়ে, কিংবা তাঁর গান আজ ঝুলনদিনে দোলন লাগে, তোমার পরাণ হেলে না শুনে। এখানে এই উৎসবের যা চেহারা দেখলাম তাতে রবীন্দ্রনাথের ঝুলন কবিতার চেয়ে বরং নজরুলের গানটির সাথেই বেশি মিল পাওয়া যাচ্ছিল, সোনার হিন্দোলে কিশোর-কিশোরী দোলে ঝুলনের উৎসব রঙ্গে।


এই ঝুলনযাত্রার সাথে রাখী পূর্ণিমার কি যেন একটা মিল আছে। এখানে বলে রাখা উচিত, কালনার অন্যতম একটা শিল্প হচ্ছে রাখী শিল্প। পশ্চিমবঙ্গের রাখীর একটা বড় অংশ জোগান দেয় কালনা। জানি না সেদিন রাখীবন্ধন ছিল কি না। কাউকে হাতে রাখী পরাতে দেখিনি।      

রাখীবন্ধন প্রসঙ্গে কোথাও যেন একটা ঘটনার কথা পড়েছিলাম। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন গঙ্গাতীরে। সেখানে গঙ্গাস্নান করে সবাই সবার হাতে রাখী বেঁধে দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি পরে সজনীকান্তকে বলেছিলেন, যাকে সামনে পেলাম, তার হাতেই রাখী বেঁধে দিলাম। সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ কেউই বাদ ছিল না। এক পুলিশ কনস্টেবলকে রাখী পরাতে গেলে তিনি নাকি হাতজোড় করে বলেছিলেন, হুজুর মাফ করবেন, আমি মুসলমান।  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা