ইয়াসমীন মারি
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫ ১৬:২৩ পিএম
এটা আমার বাড়ি এবং এটা হলো বাড়ির ভেতরে আমার ঘর। ঘরটি আদৌ কোনো ঘর নয়, অনেকটা বদ্ধ কূপের মতো, যদিও উচ্চ শক্তিসম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতি ঘরটিকে আলোকিত করার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করে চলেছে। আলোর মাঝে অন্ধকার, অন্ধকার যেন দুর্ভাগা রাতের মতো কালো। জানালা গলিয়ে বাইরের দিকে তাকালে কিছুটা দূরে দেখা যায় সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ শুরু হয়েছে। ধ্বংসস্তূপ আর বাদুড়ের চিৎকার, কালো রঙের কাকের উচ্চস্বরে চেঁচামেচি। ধ্বংসস্তূপে ভূত-পেত্নী বাস করে এবং আমাদের উপহাস করে।
আমি এই বাড়িটা ভালোবাসি। বাড়ির ভেতরের নীরবতা মোহিত করার মতো, হৃদয়কে শুষে নেয় কিন্তু তারপরও বাড়িতে নিঃসঙ্গতা বিরাজ করে। নিস্তব্ধতা আমার একার সম্পদ নয়। এমনকি এই নিস্তব্ধতার ওপর আমার কোনো শাসন নেই। যেদিন কোনো মানুষ নীরবতা ধারণ করবে, সেদিন ফুল ও নাইটিঙ্গেলের লীলাখেলা বন্ধ হয়ে যাবে, মানবদেহ হবে একটি আত্মাহীন রোবট এবং জীবনের স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ আর পেছনে ফিরে তাকাবে না। প্লাটফর্ম আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে আমার এক ধরনের স্বল্পকালীন খেয়ালখুশি হয়। যেমনÑ আমি এমন একটি প্লাটফর্মে আছি, যেখানে ট্রেনগুলো কয়েক সেকেন্ড কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্য আসে। এসব সংক্ষিপ্ত সময়ে জীবনের হুড়াহুড়ি চরমে পৌঁছে। যাত্রীরা তাদের নির্ধারিত ট্রেন ধরার জন্য ছোটাছুটি করে, যেন ট্রেনে ওঠা তাদের সবকিছু এবং জীবনের মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে যারা ট্রেন থেকে নামে, তারা উঁচু গলায় কুলিদের ডাকাডাকি করে এবং প্রত্যেককেই মনে হয় তেজগাম১ বা ডাচি২-তে রূপান্তরিত হয়েছে কিন্তু তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো প্লাটফর্মে নেমে আসে নিস্তব্ধতা, আবার জমাটবাঁধা ও হিমশীতল রাতে কুঁড়েঘরের জানালার মতো হয়ে ওঠে, যেখানে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মানুষ চিৎকার-চেঁচামেচি করা থেকে বিরত থাকে, যেন চিৎকার-চেঁচামেঁচি করার জন্যও সরকারের কাছে তাদের কর দিতে হয়।
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে রয়েছে, মৃত্যুর মতো নীরবতা কিন্তু কোথায় নিস্তব্ধতা? পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এবং তারপরই গুলাব বিবি এসে আমার সম্মুখে দাঁড়ায়। আজ সে অনেক বেশি দুঃখিত, তবে শান্ত এবং কিছুই বলল না। আমিও কোনো কথা বললাম না। তথাপি আশ্চর্যজনকভাবে ঘরের ভেতর কোথাও নীরবতা নেই, মনে হলো যেন গুলাব বিবি এবং আমি চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্তরঙ্গ কথাবার্তায় মশগুল আছি।
গুলাব বিবি তার থলি থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে এবং আমার হাতে তুলে দেয়। কাগজটা ছিল রফিকের চিঠি। রফিক গত দুই কিংবা তিন বছর ধরে গুলাব বিবিকে চিঠি লেখে। আমি সবকিছু বুঝলেও রফিক এবং গুলাব বিবির সম্পর্ক নিয়ে মোটেও উৎসাহিত নই কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে এবং খুবই মনোযোগের সঙ্গে গুলাব বিবিকে পাঠানো সব চিঠি পাঠ করি। রফিকের চিঠিগুলো ছিল প্রচণ্ড আবেগময় এবং কৃত্রিমতায় ভরা।
গুলাব বিবি হলো আমার ছেলে রাজুর শিক্ষয়িত্রী। একদিন আমি গুলাব বিবির হাতের রেখা দেখেছিলাম।
‘গুলাব বিবি, তুমি রফিককে শাদি করবে।’
এক মুহূর্তের জন্য গুলাব বিবির মুখমণ্ডল আরক্তিম হয়ে ওঠে এবং পরক্ষণেই তা শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়।
‘তা কীভাবে সম্ভব!’ তার চোখেমুখে তামাম দুনিয়ার হতাশা নেমে আসে।
গুলাব বিবির চোখে অশ্রু, কিন্তু তা ছিল তার অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা এবং বেদনার অপর্যাপ্ত প্রতিচ্ছবি। এসব অস্পষ্ট এবং কালো মেঘের মতো চোখ থেকে যন্ত্রণা অশ্রু ধারায় প্রবাহিত হয় না, বরং মন থেকে সোজা হৃদয়ে প্রবাহিত হয় এবং হৃদয়, তার সীমাহীন গভীরতায়, কখনোই পরিপূর্ণ হয় না। গুলাব বিবির হৃদয় যেন এক মহাসাগর এবং মহাসাগর কি কখনও চোখের পানিতে ভরা যায়?
‘আমি কীভাবে রফিককে বিয়ে করব? ইতোমধ্যে আমার বাবা-মা আমাকে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন…’ গুলাব বিবি কথা শেষ না করে মাঝপথে থামে। তার চোখ অশ্রুতে ভয়ে যায়। অশ্রু … মুখমণ্ডল … হাতের তালু … আমি চমকে উঠি। গুলাব বিবির মুখমণ্ডল শক্ত হতে শুরু করে, আমার চোখের সামনেই পাথর হয়ে যায় এবং তারপর মাকড়সার জালের মতো রেখা ফুটে উঠতে আরম্ভ করে। জীবন, ভাগ্য, ধনদৌলত, হৃদয়, মন, বিয়েশাদির রেখা এবং অগণিত অন্যান্য রেখা।
রফিক কোথাও ছিল না, গুলাব বিবির হৃদয়ে না, এমনকি তার মনের মধ্যেও না অথবা জীবনে কিংবা ভাগ্যে। যেমন রঞ্জি … রঞ্জির কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই কুয়ার ভেতর একটা ভারী পাথর নিমজ্জিত হয় এবং পাথরটি পড়ার সময় পুনরায় নীরবতা ফিরে আসে। গভীর নিস্তব্ধতা। তারপর জীবনের প্লাটফর্মে আমি কখনোই দেখব না যে, রঞ্জি আমার কিংবা রাজুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এবং রাজুর বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি না শুনতে পাই রঞ্জুর ডাক, না বুঝতে পারি রাজু এবং তার বাবার কথা। বিষয়টি এমন যেন আমি কোনো এক অপরিচিত শহরে প্রবেশ করেছি, যেখানে লোকজন আমার ভাষা বোঝে না কিংবা আমি তাদের ভাষা বুঝি না। এমন একটি শহর কতই না আকর্ষণীয় এবং কতই না শান্তিপূর্ণ হতো!
কয়েক মুহূর্ত পরে পুরো শহর পাতলা হাওয়ার সঙ্গে মিশে যায় এবং গাঢ় নিস্তব্ধতা ভেঙে যায়। রাজু ভীষণ কান্নাকাটি শুরু করে।
ইতোমধ্যে অনেক মাস কেটে গেছে এবং এই দীর্ঘ সময়ে গুলাব বিবি দেখা করার জন্য একবারও আমার বাড়িতে আসেনি।
যদিও বিষয়টা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে অস্বাভাবিক ছিল। যেমনÑ রাজুর বাবা আমার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং রাজু হয়েছে আমার দিনের অংশ, তেমনই গুলাব বিবি আমার ঘনিষ্ঠ এবং তাকে দেখা ও তার কথা শোনা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে, সে স্কুল থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ছুটি নিয়েছে।
একদিন গুলাব বিবি অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির হয়। সে বোরকা খুলে টেবিলের ওপর রাখে এবং তারপর আমার দিকে মুখ করে মেঝেতে বসে। তার হাতে গাঢ় মেহেদির কারুকাজ এবং আঙুলে একটা আংটি চকচক করছে।
‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।’ সে কান্নাজড়িত ভেজা গলায় বলল।
‘এ তো খুবই ভালো খবর, কিন্তু তুমি … তুমি কি খুশি নও?’
‘আমি রফিককে বিয়ে করছি না।’ তার চোখে কালো সুরমা অস্পষ্ট লাগছিল।
কয়েক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
‘আমি ওকে ভুলতে পারব না। আমার মায়ের উচিত ছিল আমার কথা শোনা। তিনি আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করেছেন …’ গুলাব বিবি কান্নায় ভেঙে পড়ে। একসময় সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে এবং তখন আমি তার সামনে মূর্তির মতো বসে থাকি। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আমার মুখে কোনো ভাষা নেই।
‘আমার মনে হয় না রফিককে ভুলে যাওয়া কঠিন হবে। যখন রাজু এবং তার মতো অন্যরা তোমার জীবনে প্রবেশ করবে, তখন তুমি রফিককে সম্পূর্ণ ভুলে যাবে।’
গুলাব বিবি আমার দিকে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকায় এবং ভাবতে থাকে কী করে আমি এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বলতে পারলাম।
‘তোমার জীবনেও কী একজন রফিক এসেছিল?’ গুলাব বিবির প্রশ্নটা ছিল অপ্রত্যাশিত, আচমকা, খুবই আকস্মিক।
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি কী তাকে ভুলে গেছ?’ গুলাব বিবির কণ্ঠস্বর নরম। ‘এটা সম্ভব যে, তুমি তা পেরেছ, কিন্তু আমি … আমি ভুলতে পারব না।’ তার গলায় চরম হতাশার সুর ফুটে ওঠে।
‘গুলাব বিবি, তুমি জীবনের প্লাটফর্ম ছেড়ে যাবে, যে প্লাটফর্মে তুমি রফিকের মুখোমুখি হয়েছিলে এবং কয়েক বছরের মধ্যে দেখবে সে তোমার থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে।’ আমি জানালা গলিয়ে বাইরের ভাঙা দেওয়ালের দিকে তাকাই, কিছু অংশ ধসে গেছে এবং বাকিটুকু দাঁড়িয়ে আছে।
‘কিন্তু জীবনের যাত্রাপথের মাঝে কোনো সময় যদি আমি তার সঙ্গে একই প্লাটফর্মে পৌঁছি, তখন কী হবে?’ গুলাব বিবি জিজ্ঞেস করে, আংশিক নিজেকেই।
আমি তার প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম ছিলাম না কিন্তু অকস্মাৎ আমার মানসচোখে একটা নীল গোলাপ আবির্ভূত হয়। তেতো নীল গোলাপ। বিষের প্রতীক। বিষে ভরা। এক মুহূর্তের জন্য আমি বিষাক্ত নীল গোলাপ গুলাব বিবির মুখমণ্ডলে দেখতে পেলাম কিন্তু পরের মুহূর্তে আমি আমার মন থেকে আজেবাজে চিন্তা সরিয়ে ফেলি। একটি নীল গোলাপ, যা এক শতাব্দীতে মাত্র একবারই প্রস্ফুটিত হয়, কেউ জানে না দুনিয়ার কোন জায়গায় অথবা কখন এবং কেউ জানে না কেন প্রস্ফুটিত সেই সুন্দর নীল গোলাপে বিষ থাকে। আমার খুবই ইচ্ছে যে, আমি নীল গোলাপ দেখব। গুলাব বিবি কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। আর আমি আমার আকাঙ্ক্ষায় ডুবে গিয়ে দিন কাটাতে শুরু করি।
একদিন কোনো এক অনুষ্ঠানে আমি রঞ্জির দিকে ছুটে যাই। সে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিল। তার স্ত্রী পাশেই ছিলেন। সেই সময়ের জীবন পুরো মাত্রায় চলছিল, যে জীবন আমি অনেক আগেই ছেড়ে এসেছি। আমার মন অবশ হয়ে যায়। আমার হৃদয় এবং মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধতা। আমি আয়নার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাঁপতে থাকি এবং বুঝতে পারি যে, আমার মুখমণ্ডলে নীল শিরা ছড়িয়ে পড়ছে। আমার মুখ, আমার শরীর, আমার আমিত্ব বিষে ভরে গেছে এবং আমি আমার মধ্যে এই শতাব্দীর নীল গোলাপ দেখতে পেলাম। কতই না যন্ত্রণাময়! আমি রঞ্জির দিকে তাকাই। সে চোখ বন্ধ করে ঘরের এক কোনায় চেয়ারে বসে আছে। তার চোখেমুখে কতই না জ্বালা-যন্ত্রণা। একটি নীল গোলাপ। তবুও আরেকটি নীল গোলাপ। আমি কেঁপে উঠি।
গুলাব বিবি, রফিক, রঞ্জি, আমি এবং কে জানে আরও কত অগণিত বিষাক্ত নীল গোলাপ রয়েছে এই পৃথিবীতে … আমি কোথাও পড়েছিলাম যে, এক শতাব্দীতে মাত্র একটাই নীল গোলাপ প্রস্ফুটিত হয় … কিন্তু … কিন্তু আসলে তা নয়। এখন মনে হচ্ছে প্রতিটি শহরে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ে, পৃথিবীর এক কোণ থেকে অন্য কোণে, প্রতি মুহূর্তে নীল গোলাপ ফোটে। আসলে জীবন হলো একটা নীল গোলাপ, একমাত্র শুকিয়ে যাওয়ার জন্যই প্রস্ফুটিত হয়, ধ্বংসের জন্য সৃষ্টি হয় অথবা হয়তো মৃত্যুর জন্যই জীবনের সৃষ্টি, মৃত্যুই জীবনের প্রতিদান।
পাদটীকা : মূল গল্পে নেই কিন্তু পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো।
১ তেজগাম- উর্দু শব্দ, যার অর্থ ‘দ্রুত ধাবমান’। তেজগাম ট্রেন হলো পাকিস্তানের করাচি এবং রাওয়ালপিন্ডির মধ্যে প্রতিদিন চলাচলকারী এক্সপ্রেস যাত্রীবাহী ট্রেন।
২ ডাচি- পাকিস্তানের দ্রুতগামী ট্রেন, যা ফয়সালাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করে এবং লাহোর জংশনে শেষ হয়।
গল্পসূত্র : ‘নীল গোলাপের বিষ’ গল্পটি ইয়াসমীন মারের ইংরেজিতে ‘দ্য পয়জন অব দ্য ব্লু রৌজ’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি লেখিকা বালুচি ভাষায় রচনা করেন এবং পরে তিনি নিজেই তা উর্দুতে অনুবাদ করেছেন। পরবর্তীতে গল্পটি উর্দু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সামিনা রহমান, যা ইয়াসমীন হামিদ ও আসিফ আসলাম ফারুকী সম্পাদিত ‘পাকিস্তানি উইমেন রাইটার্সÑ শর্ট স্টোরিজ’ সংকলনে (ভারতে প্রথম প্রকাশ : ২০০২) অন্তর্ভুক্ত।
লেখিকা পরিচিতি : পাকিস্তানি নারী লেখক ইয়াসমীন মারি বালুচি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তার জন্ম, জীবন এবং সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।