× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমি অথবা আমার ছায়া

আফসানা বেগম

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫ ১৬:২৫ পিএম

আমি অথবা আমার ছায়া

বিকট শব্দের পরপরই বাসটা থেমে গেল। থামার আগে এদিক ওদিক দুলুনি খেয়ে নিল দুবার। সিট থেকে ধড়াম করে ইঞ্জিনের ওপরে পড়লাম। চোখ কচলে উঠতে উঠতে দেখি রাস্তার বামদিকে একটা স্কুটার উল্টে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন চিৎকার করছে, যতটা উচ্চস্বরে চিৎকার করলে কথা অস্পষ্ট হয়ে যায়, তার গলায় তখন তার চেয়ে জোর বেশি। বাসের দরজা খোলা অথচ কী বলছে কিছুই বোঝা গেল না। এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরেছে লোকটা, দরদর করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। কথা বোঝা না গেলেও বুঝতে বাকি থাকল না যে বাসের ধাক্কায় স্কুটার উল্টে গেছে।

হালকা শীতে ইঞ্জিনের পাশের সিটে ওমের মধ্যে ছিলাম। সুখের স্বপ্ন আসবে বলেই হয়তো চোখ লেগে গিয়েছিল। মা আমার জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন। তাই অফিস শেষ হতেই কুমিল্লার বাসে চড়ে বসলাম। মা ছবিও পাঠিয়েছিলেন। আগের সারাটা রাত সেই ছবি নিয়ে ধ্যান করেছি। সিটে বসে দুশ্চিন্তায় ছিলাম কখন যে কোন মহিলা যাত্রী আসে আর ‘মহিলা সিট’ বলে আমাকে উঠিয়ে দেয়। টেনশনের মধ্যেও ঘুমিয়ে পড়লাম আর স্বপ্নে এলো সেই মেয়ের হাত, হাতে আঙটি পরাচ্ছি। পাঠানো ছবিটা পাসপোর্ট সাইজের মতো, হাতের কোনো বালাই নেই। অথচ স্বপ্নে হাতটা স্পষ্ট দেখলাম; সরু আঙুল, আঙটিটা আঙুলে ঢলঢল করছে। বাসের সঙ্গে স্কুটারের ধাক্কায় মনে হলো আঙটিটা আঙুল থেকে ছিটকে পড়ল। বাসটা কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে কী করবে কী করবে ভাবল। দিনের আলো পড়ে যাওয়া চওড়া রাস্তায় তখন পথচারীর চিহ্ন নেই, ডান দিকে কুমিল্লাগামী গাড়িগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছিল। উল্টে থাকা স্কুটারের ভেতর থেকে রক্তমাখা একটা হাত হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো। আমি নামার জন্য লাফিয়ে উঠলাম। রাস্তায় যে লোকটা চিৎকার করছিল সে বাসের ঠিক সামনে এসে ঘেরাওয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়াল। দৃঢ়তা দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন অনড় কোনো দেয়াল, তাকে মাড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। অথচ বাসের দরজায় আমার পা পড়তেই কী করে যেন তাকে পাশ কাটিয়ে বাসটা যেতে লাগল। দরজা দিয়ে মুখ বাড়াতে গিয়ে দেখলাম স্কুটারের ভেতরের লোকটার পায়ে ছাদের একটা রড বেঁকে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। আমার হাতটা সেদিকে উঠে গেল, সঙ্গে সঙ্গে বাসের গতিও বাড়ল, পেছন থেকে বাসের কন্ডাক্টর আমাকে টেনে ধরল।

‘কী করেন? নামেন ক্যান?’

‘বাস থামান, দেখতেছেন না লোক দুইটার কী অবস্থা?’

‘পাগল নাকি আপনে? এইখানে থামলে বিরাট গ্যাঞ্জাম হবে।’

বাসের দরজা লাগিয়ে লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। ততক্ষণে উল্টে থাকা স্কুটারটা চোখের সামনে ছোটো হতে হতে বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেল। লোকটাকে বলে লাভ নেই ভেবে দুই লাফে ড্রাইভারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘দুজন লোককে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে ভেগে যাচ্ছেন? বাস ঘোরান। তাদের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া দরকার।’

‘আপনে কী শুরু করলেন, ভাই? ওইখানে দাঁড়াইলে পাবলিকে বাস ভাঙবে।’

‘কোথায় পাবলিক? একটা মানুষ পর্যন্ত নাই তাদের হেল্প করার।’

‘তাতে কী? আমরা খাড়াইলেই চাইর দিক থেইকা মানুষ আইসা হাজির হবে।’

‘আপনি বাস ঘোরান তোÑ’ আমার হাত চলে গেল স্টিয়ারিঙের দিকে। কন্ডাক্টর পেছন থেকে এসে আমার শার্টের কলার ধরে টান দিল। আরেকজন যাত্রীসহ টেনে এনে আমাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখেন তো, আর কেউ আপনের মতো পাগলামি করতেছে? সবাই জানে খাড়াইলে কী হবে। আপনে কই যাইতেছেন? যাওয়ার তাড়া নাই? আর সবার তো আছে, নাকি?’

পাসপোর্ট সাইজে বন্দি মেয়েটির পেলব মুখটা কেন যেন হুট করে সামনে এলো তখন। আর স্বপ্নে দেখা তার আঙুল... হ্যাঁ, আমার তাড়া আছে। সব বিপ্লবই কোনো না কোনো কারণে ঠান্ডা হয়ে যায়। সামনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে হলো, কে জানে ওল্টানো স্কুটারটা কখন ফেলে এসেছি কোন দূরে! দুদিকের সব দ্রুত সরে যাচ্ছে, ইঞ্জিনের ওমে কিংবা গোলগাল একটা মুখের কারণে রাতের শুরুতে পড়া শীতের আভাস একটুও গায়ে লাগল না আমার।

‘আস্তে করেন ভাই, আস্তে...’

‘আস্তে করলে আরও বেশি ব্যথা পাইবেন তো, এক টানে রডটা বাইর করতে হবে।’

‘তাইলে হসপিটালে গিয়া বাইর করলে হয় না?’

‘কীসের হসপিটাল, স্কুটার তো ভাইঙা শেষ, কেমনে যাবেন?’

‘না না, নিয়া চলেন, ভাই, ব্যথাÑ’

‘ওই বাসে উঠাই আপনারে, একটু সহ্য করেন।’

ক্যাঁচক্যাঁচ করে ব্রেক কষল বাসটা। পাশের লোকের ঘাড় থেকে ঘুমন্ত মাথাটা ওঠালাম। দুজন মানুষের কথোপকথন চলছিল কি আমার মাথায়? একজন আমি, কিন্তু আরেকজন? অজায়গায় রাস্তায় চোখ রেখে আমি ওল্টানো স্কুটারটা খুঁজলাম। আরেকজন নিশ্চিত সে; যার পায়ে স্কুটারের ছাদের রড বেঁকে ঢুকে গিয়েছিল। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে তার কাপড়ের রঙ ঢেকে দিয়েছিল। হতাশ লাগল। স্বপ্নের মধ্যে সরু আঙুলগুলো কি আমি আর পাব না? এত রক্ত কেন চারদিকে!

হেডলাইটের আলোয় আমি রাস্তার দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। রাতেও মেরামতের কাজ চলছে। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন ঢাকায় বেড়াতে যেতাম তখনও এই রাস্তায় এমনই কাজ চলত। কোনো আমলে কখনও থামেনি, হয় এখানে না-হয় খানিক দূরে। যেন পিচ আর কার্পেটিঙের এক্সপায়ারি ডেটটা ঘন ঘন এসে যায়, আর টাকাপয়সা বিলিবণ্টনের খাত তৈরিও জরুরি নিশ্চয়। আবছা আলোয় দগদগে পিচ পড়ে থাকতে দেখে আমার মনে হলো জমাট বাঁধা রক্ত। ধুর, হচ্ছেটা কী? আপ্রাণ চেষ্টা করলাম অন্য কিছু ভাবতে। গুলিস্তান পেরোনোর সময় ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নগর ভবনটা খুব কাছে মনে হচ্ছিল। যেন হাত বাড়ালেই মাথার ওপরের ঘড়িটা ছোঁয়া যাবে। ঘড়িটাতে বিকালবেলাতেই সাড়ে এগারোটা বেজে ছিল। আমার ইচ্ছা করছিল বাস থেকে নেমে স্পাইডারম্যানের মতো নগর ভবনের ছাদে উঠে যাই। শহরের যা অবস্থা, ঘড়িটাতে আধা ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে আসি, ভবনের কাজকর্মের প্রতীকী উপস্থাপনা হতো অন্তত। আমার সত্যি বাস থেকে নেমে যেতে ইচ্ছা করল, তখনও। যে লোকটার হাত থেকে রক্ত পড়ছিল, কিছুটা মাংস ঝুলছিল নিচের দিকে, তার কী হলো? আর পায়ে রড ঢুকে যাওয়া লোকটাকে কি দোমড়ানো স্কুটার থেকে বের করা গিয়েছিল?

‘ভাই, ধৈর্য ধরেন। একটু ব্যথা পাবেন, কিন্তু আমি আপনাকে ঠিক বের করে আনব।’

‘আমি আর পারতেছি না, কাছেধারে সেইরাম দোকানপাট আছে? স্কুটারটা কাটলে বাইরাইতে পারতাম।’

‘এইখানে কোথায় কী? কাউরে দাঁড়াইতে বললেও দাঁড়াইতেছে না।’

হাত থেকে মাংস ঝুলতে থাকা স্কুটার ড্রাইভার চলন্ত গাড়িগুলোর সামনে বুক পেতে ব্যারিকেড বানাল অনেকবার। কিন্তু তাকে সামনে দেখে গাড়িগুলোর গতি গেল আরও বেড়ে। সেটা দেখে সে লাফিয়ে পিচ ছাড়িয়ে এলো, প্রতিবার আগের চেয়ে জোরে চিৎকার করে বলল, ‘খাড়াইলি না, কুত্তার বাচ্চাÑ’

‘ভাই, আপনে খামাখা ডাকাডাকি বাদ দ্যান তো, আসেন দেখি দুইজনে হাত লাগায়ে ছাদটা ভাইঙা সরাইতে পারি নাকি।’

শেষের কয়েকটা শব্দ কি আমি জোরে উচ্চারণ করে ফেলেছিলাম? পাশে ঝিমাতে থাকা লোকটা বিরক্ত হয়ে তাকাল। কিন্তু আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম না... তবে আমি কি স্কুটার থেকে লোকটাকে টেনেহিঁচড়ে বের করছিলাম? তাই হবে, কারণ চোখ খোলা থাকলেও টের পাইনি কখন শহরের কাছে চলে এসেছি। এ শহরে এখন সমস্ত মিষ্টির দোকানের নাম ‘মাতৃভাণ্ডার’। গুচ্ছ গুচ্ছ মাতৃভাণ্ডার পাশাপাশি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। মনে পড়ল পরের দিন মিষ্টি কিনতে হবে আসল মাতৃভাণ্ডার থেকে। মা আঙটি বানিয়ে রেখেছেন। আমি এর মধ্যে অন্য কিছু নিয়েই ভাবব না।

‘আরে আপনে ওইদিকে জোর লাগান নাÑ’

‘কেমন কইরা, আমার এই হাতটা তো মনে হয় ভাইঙা গেছে, জোর দিতে পারতেছি না।’

‘আমি একলা কেমনে এই রডটা ভাঙি?’

‘মরার একটা লোকও আসতে পারতেছে না? দ্যাশে যেইখানে পটকা ফুটলেও পঞ্চাশজন জড়ো হইয়া যায়।’

‘ভাই, আমি মনে হয় বাঁচব নাÑ’ নিজের শরীরের চেয়ে ছোট খাঁচায় আটকে পড়া প্রায় অচেতন লোকটি কোনোরকমে বলল।

‘আরে আপনে থামেন, দোয়াদরুদ পড়েন। এর মইদ্দে মরার কী হইল? বহুত অ্যাক্সিডেন্ট দেখছি আমি,’ স্কুটার ড্রাইভার ধমকে ওঠে। লোকটা মনে হয় চিৎকার করা ছাড়া কথা বলতে পারে না। তবু টেলিফোনের সিগন্যাল ড্রপের মতো রাস্তায় প্রতিটা দ্রুতগামী গাড়ি যাওয়ার সময়ে তার শব্দ হারায়। শীতল বাতাসের ঝাপটায় স্কুটারের ভেতরের মৃতপ্রায় লোকটির হাত-পা টানাহ্যাঁচড়া করতে গিয়ে আমাদের ঘাম ছুটে যায় কেবল। 

‘এই দেখ আঙটি। কেমন হইছে?’ মায়ের কথায় কোন জগৎ থেকে যেন আমি আছড়ে পড়লাম শোবার ঘরের বিছানায়। হাতের তালুতে আঙটি রেখে মা আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তাকান।

‘অ্যাই, কী হইছে তোর? শরীর খারাপ নাকি? এই শীতে এই রকম ঘামতেছিস?’

আমার অপ্রস্তুত হাত কপালের ঘাম মোছার জন্য উঠে যায়। কোনোরকমে বলি, ‘খুব সুন্দর হইছে মা। তোমার পছন্দ? অনেক দাম হইল, না?’

‘পছন্দ আমার। দাম হইলে হইছে। একটাই ছেলে আমার। রুবির আঙটি কিনব, শখ ছিল।’

মায়ের হাতে লালচে গোলাপি রুবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ ঘোলা হয়ে এলো। দেখলাম পাথরটার মাঝখানে আলো ঠিকরে চারদিকে আটটা সরলরেখা তৈরি করেছে, তারার মতো। এর নামই হয়তো স্টার রুবি। দেখতে একদম গাড়ির পেছনের সিগন্যাল বাতির মতো, যেন একবার ডানে আর একবারে বামে যাবে বলছে।

অসংখ্য গাড়ি চলে যাচ্ছে। শোঁ শোঁ... রাস্তায় ওল্টানো স্কুটার দ্বিধায় ফেলে তাদের। ব্রেকে পা চলে যায়। গাড়ির পেছনে দুটো রুবি জ্বলে ওঠে। আমি রুবি দেখছি আর দেখছি...

‘এই তো ভাই, হইয়া গেল, ঠিক আছেন তো?’

পায়ে রড ঢোকা অচেতন লোকটি উত্তর দিল না। ড্রাইভার বলল, ‘এই হাইওয়ের মইদ্দে এরে কান্ধে কইরা নেওয়া ছাড়া কোনো গতি নাই।’

শীতের শুকনো ধুলো ওড়ানো রাস্তায় রক্তে ভেজা শরীরটা নিয়ে আমরা দুজন হাঁটতে থাকলাম। আমার ব্যাগটা বাসেই ফেলে এসেছি। বাস কখন চলে গেছে। মনে হলো, ভালো হয়েছে, মানুষটাকে বাঁচানো ব্যাগ আগলে রাখার চেয়ে জরুরি। বহুক্ষণ হাঁটার পরে বাজারমতো জায়গা মিলল। রিকশার সিটে বসানো গেল না লোকটাকে, নিচে রাখাতে রড ঢুকে যাওয়া পা অনিয়ন্ত্রিত ঝুলে রাস্তা প্রায় স্পর্শ করে ফেলল। রাত তখন অনেক, সব দোকানের ঝাঁপি বন্ধ। গেরিলার মতো কতক্ষণ আহত যোদ্ধাকে কাঁধে নিয়ে হেঁটেছি খেয়াল নেই। রিকশায় উঠে লোকটার নাকের কাছে সেই প্রথম হাত দিয়ে সরু ধারার গরম বাতাসের অস্তিত্ব পেলাম; হ্যাঁ, লোকটা বেঁচে আছে।

‘আচ্ছা, তোর কী হইছে বল তো? মেয়ে পছন্দ হয় নাই?’

‘হইছে তো, মা। কেন?’

‘তাহলে এই মাঝরাতে বিছানায় বসে কীসের দুশ্চিন্তা করিস?’

‘আমার মন বলে লোকটা বেঁচে আছে।’

‘মানে? কোন লোকটা?’

মায়ের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। কী করে বোঝাব কাপুরুষতার কিংবা পলায়নের শাস্তি কেমন হয়? সামান্য হেসে বললাম, ‘কেউ না, মা, তুমি ঘুমাও।’

মা নিশ্চিন্ত হলেন, ‘ও, স্বপ্ন দেখে উঠে গেছিস? ঠিক আছে।’ 

কী করে ঘুমাই, কী করে ঘুমাই, একটা দোমড়ানো-মোচড়ানো স্কুটার আর একটা কাঁপা কাঁপা রক্তাক্ত হাত কিছুতেই আমাকে ঘুমাতে দিল না। সকাল এসে পড়ল। সেদিন রাতের আয়োজনের জন্য মায়ের উৎসাহ দেখে মন ঘোরানোর চেষ্টা করলাম। অথচ মা যখন পাশের বাড়ির দুজনকে নিয়ে মিষ্টির ঝুড়ি সাজানোতে ব্যস্ত, আমি দুম করে বলে বসলাম, ‘আমাকে একটু ঢাকার দিকে যেতে হবে।’

‘কী বলিস? আজ তোর পানচিনি, তা ছাড়া অফিস বন্ধ না আজ?’

মাকে কী করে বলি, অফিস তো বন্ধ কিন্তু মাথার ভেতরের চিন্তা তো বন্ধ হচ্ছে না।

‘ঠিক ঢাকায় না, মা, এই ধর, মাঝামাঝি একখানে। খুব দরকার।’

‘আচ্ছা, পানচিনিটা হয়ে যাক, তারপর যা। পাগলামি করিস না, বাবা।’

মায়ের মিনতিতে আর কথা জুটল না। যে কোমল মুখটি দেখব বলে আমি যেন কত বছর অপেক্ষায় ছিলাম, আঙটি পরানোর সময়ে তার দিকে আবেগের দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে পারলাম না। স্বপ্নে দেখা আঙুলের সঙ্গে আমার হাতের ওপরে রাখা আঙুল মিলিয়ে নিতেও ইচ্ছা করল না। বরং তার মাঝখানে বাসের কন্ডাক্টরের কথা কানে বাজল, ‘আপনার তাড়া নাই?’ হ্যাঁ, আমার খুব তাড়া আছে। আমাকে জানতেই হবে, পায়ে রড আটকানো লোকটার কী হলো। যেন আমি গেলেই সে বেঁচে উঠবে, এই ধারণা থেকে আমার মুক্তি নেই। 

খুব সকালে পৌঁছলাম সেই জায়গায়। বাস থেকে নেমে দেখলাম কিছু নেই, না স্কুটারের ধ্বংসাবশেষ, না কোনো রক্তের দাগ। যেন মরুভূমির শুষ্ক হাওয়ায় ধুলার স্তর পড়ে পড়ে সব উধাও। স্কুটার উল্টে থাকার জায়গাটায় দাঁড়ালাম। গায়ে কাঁটা দিল। কী যেন একটা মরণপণ খেলা চলছিল ওখানে, তারপর গ্ল্যাডিয়েটরকে আর দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে তাকালাম, আগের দিনের মতোই কোথাও কেউ নেই। কার কাছে জানতে চাব? কোথায় খুঁজব এখন সেই লোকদুটোকে? হাল ছাড়তে ইচ্ছা করল না। হাঁটতে হাঁটতে দূরে লোকালয় যেখানে দেখা যায় সেদিকে এগোলাম। আছে কোনো হসপিটাল বা ক্লিনিক? মানুষ দেখিয়ে দিল। সেসব জায়গায় কেউ বলতে পারল না, হাতে আঘাত পাওয়া একজন, খানিক মাংস ঝুলে ছিল আর আরেকজনের পায়ে রড আড়াআড়িÑ আমি পাগলের মতো আশপাশের লোককে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। কে যেন বলল, ‘আসছিল এমন এক লোক তার পা কাটতে হইছে। বেচারা গার্মেন্টসে কাজ করত, মেশিন তো আর চালাইতে পারবে না, বুঝলেন না?’ আমি মরিয়া হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কোথায়?’ সে ঠোঁট উল্টে জানাল, কোথায় কে জানে, সপ্তাহখানেক আগের কথা, দশ দিনও হতে পারে। দশ দিন? নাহ্, সেই লোককে খুঁজছি না। কিন্তু যাকে খুঁজছি তাকে না পেয়ে হতাশ আর ক্লান্ত আমি সকাল সকাল জমে ওঠা বাজারের এক ধারে বসে থাকলাম। এ রকম একটা ঘটনার পরে স্কুটারসহ দুটো আহত মানুষ উবে যাবে? সবচেয়ে কাছের মধ্যে এখানেই তো আসার কথা তাদের। শীতের রোদে আমার আঙুলের সরু আঙটিটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মনে হলো, এর জন্যই তো এত কিছু, এর জন্যই আমি লোকদুটোকে হারালাম। জগতে সম্পর্ক এমন এক জিনিস যা সেই বাসের কন্ডাক্টারের মতো পেছন থেকে কলার টেনে ধরে; প্রথমে মা, আর তারপর এই আঙটি। সমস্ত দোষ আপন লোকদের ওপরে দিতে পেরে কিছুটা হালকা লাগল। কিন্তু এই স্মৃতি কি আমাকে কোনোদিন ছাড়বে? বাসের সামনে একটা রক্তাক্ত লোক চেঁচিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে আর আমি মহিলা সিটে আরাম করে বসে আছি, বাস আমাকে নিয়ে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, তার আশাহত হাতটা নেমে যাচ্ছে, স্কুটারটা বিন্দু হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে... বাজারে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চটার ওপরে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। মানুষের ভিড় হালকা হয়ে এলো দুপুরে। একসময় ক্ষুধার্ত শরীরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা দিলাম। সূর্য মাথার ওপর থেকে গড়িয়ে আমার ছায়াকে তীর্যক করল। হাঁটতে থাকা ছায়ার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,

‘তোমার পায়ের রডটা বের করা গেছিল কি?’

‘হ্যাঁ, তবে অনেক জংধরা ছিল তো, আর পায়ের হাড়ও তেমন আস্ত ছিল না, তাইÑ’

‘তাই কী? পা কাটতে হলো বুঝি?’

‘সেটাই।’ 

‘আচ্ছা, তুমি কি পায়ের কোনো কাজ করতে? ধর, সেলাই মেশিন চালানো বা গাড়ি চালানো?’

‘আশ্চর্য তো, তুমি কী করে জানলে?’

আমি থমকে দাঁড়ালাম। ছায়াও দাঁড়াল। মনে পড়ল না, আমি কী করে জানলাম? আমি নড়লাম, ছায়াও নড়ল। 

‘আচ্ছা, তুমি কি ছায়ার মতোই থেকে যাবে আমার সাথে?’

ছায়া উত্তর দেয়নি বা দিতে চায়নি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা