আহসান হাবীব
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪১ পিএম
বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক খসরু চৌধুরী, সৌভাগ্যক্রমে তিনি আমার বিশেষ বন্ধুমানুষ। গম্ভীর প্রকৃতির একজন চমৎকার মানুষ। যেকোনো জটিল বই সহজ ভাষায় অনুবাদে তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রচুর বিখ্যাত বই তার অনুবাদ করা আছে। শান্ত গম্ভীর এ মানুষটি একটি লাইসেন্স করা পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করেন। তার লেখালেখির বিষয়ও কিন্তু থ্রিলার সাসপেন্স ভয়... আতঙ্ক এসব নিয়েই। কাজেই ওই ৩২ ক্যালিবারের পিস্তল নিয়ে তার চলাফেরাটা বেশ মানিয়ে যায় তার সঙ্গে। তিনি অবশ্য থাকেন নওগাঁয়, কালেভদ্রে ঢাকা আসেন। তার প্রকাশকদের সঙ্গে তখন তার যোগাযোগ হয়। তখন আমাদের সঙ্গেও তার দেখা হয়। আমাদের আদি অকৃত্রিম উন্মাদ আফিসে চলে আসেন। মানে তাকে আমরা আসতে বাধ্য করি আর কি।
আজ তাকে নিয়ে লেখার একটা বিশেষ কারণ আছে সেটা হচ্ছে ভূত। হ্যাঁ, সত্যিই ভূত। তাকে অফিসে আনতে পারলে আমরা সিনিয়র-জুনিয়র কয়েক বন্ধু একসঙ্গে হই। হাসান খুরশীদ রুমী, সাজ্জাদ কবীর (কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন), কাজী তাপস, রোমেন রায়হান, মেহেদী হক... এ রকম অনেকের নাম লিখতে হয়।
আর আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তিনি অফিসে এলেই যেন চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। তখন আমরা চেপে ধরি তাকে। খসরু ভাই নতুন ভূত দেখেছেন কিছু?
তিনি মাথা নাড়েন। মানে দেখেছেন।
-কটা?
-তা হবে গোটা ছয়েক।
পাঠক ভাবতে পারেন উন্মাদ অফিস বলে বোধ হয় ঠাট্টাতামাশা শুরু করেছি। মোটেই তা নয়, খসরু ভাই আসলে প্রায়ই ভূত দেখে থাকেন। যেন ভূত দেখা তার হবি। কিংবা উল্টো করে বললে বলা যায় ভূতেরা নিয়ম করে তাকে ভয় দেখাতে চায় সেটা ভূতদের হবি। আমরা তখন তাকে চেপে ধরি।
Ñখসরু ভাই শুরু করেন প্লিজ, দুয়েকটা নতুন ভূতের অভিজ্ঞতা শুনি। ... এখানে বলে নেওয়া ভালো আমি খসরু ভাইয়ের ভৌতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখেছিলাম তার অনুমতি নিয়েই। বইটির নাম ছিল ‘কলজে কাঁপানো ভৌতিক অভিজ্ঞতা’। যা হোক আমরা দলবেঁধে যখন ধরে বসি তাকে ‘খসরু ভাই শুরু করেন... আবহাওয়াটাও দিব্যি চারদিক অন্ধকার করে মেঘ করেছে, দিনের বেলাই মনে হচ্ছে রাত।’ আর একটু আগেই আনা হয়েছে তন্দুর, সঙ্গে গরম গরম কাবাব... আমাদের সবার প্রিয় মেন্যুই বলা যায়।
খসরু ভাই অবশ্য আমাদের অনুরোধ ফেলতে পারেন না। গল্প বলা শুরু করে দেন। আমরা মুগ্ধ আতঙ্কে তার অভিজ্ঞতা শুনি। আমি বরং এখানে তার কয়েকটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি পাঠকের জন্য।
অভিজ্ঞতা এক
খসরু ভাই তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হলে থাকেন। তখন কোনো একটা ছুটি চলছিল। সবাই হল ছেড়ে গেছে, খসরু ভাই যাননি। একদিন গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি শুনতে পেলেন হলের ছাদে কারা সব ছুটছে দলবেঁধে, তার রুমের ঠিক ওপরেও ছিল খোলা ছাদ। মানে কী? হলে তো এ সময় কেউ নেই। ছাদে কারা ছোটাছুটি করছে? খসরু ভাই অসম্ভব সাহসী মানুষ। এবং বিশালদেহী শক্তসমর্থ মানুষও বটে। তিনি বিছানা থেকে উঠে ঠিক করলেন ছাদে যাবেন। ঘটনা কী দেখতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলেন। ফকফকা ফাঁকা ছাদ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়। তখনও ছাদে কারা যেন দলবেঁধে দৌড়াচ্ছে। তিনি ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। আর কী আশ্চর্য সেই অদৃশ্য দৌড়বিদরা এক মুহূর্ত থেমে ফের তাকে কেন্দ্র করে এবার দৌড়াতে শুরু করল। কেউ পাশ দিয়ে ছুটে গেলে যে বাতাসের একটা ধাক্কা লাগে সেটা পর্যন্ত তিনি টের পাচ্ছিলেন। না তিনি সে অর্থে মোটেও ভয় পাননি। তবে তিনি ফিল করলেন এখানে তার থাকা ঠিক হচ্ছে না। তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে ছাদ থেকে নেমে গেলেন। তারপর বেশ অনেকক্ষণ ওই অদৃশ্য দৌড়বিদদের দৌড় চলছিল। এ দৌড়বিদরা আসলে কারা? এর উত্তর কে দেবে!
অভিজ্ঞতা দুই
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি ওই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেরই। এ ঘটনায়ও হল প্রায় খালি ছিল, তবে দুয়েকজন হলে ছিল। এবারেও খসরু ভাই যথারীতি হলেই ছিলেন। এক গভীর রাতে তার বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। তিনি রুমের দরজা খুলে বাইরে এসে দেখেন হলের সামনে গাছটার প্রায় প্রতিটা ডালে একটা করে মোম জ্বলছে। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এটা কার কাজ? যেভাবে মোমগুলো জ্বলছে তাতে গাছে আগুন লেগে যাওয়ার কথা। ব্যাপারটা কী? তিনি একাই দেখছেন? তার হ্যালোসিনেশন হচ্ছে। এটা পরিষ্কার হওয়ার জন্য হলে থাকা আরও দুজন ছাত্রকে ডেকে আনলেন। তারা এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কে অজ্ঞান হওয়ার দশা। আগেই বলেছি তিনি অতীব সাহসী একজন মানুষ। তিনি নেমে গেলেন নিচে। অন্য দুই আতঙ্কিত বন্ধু তাকে প্রচণ্ডভাবে নিষেধ করল নিচে যেতে। কিন্তু তিনি যেয়েই ছাড়বেন এবং সত্যি গেলেন। গাছের নিচে দাঁড়াতেই মনে হলো মোমগুলো আস্তে আস্তে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে... অর্থাৎ তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা জ্বলছে। তিনি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং এবারও তার মনে হলো তার এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না। তিনি ফিরে গেলেন।
অভিজ্ঞতা তিন
এটা অবশ্য ঠিক হলের ঘটনা নয়। খসরু ভাই কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলেন। খসরু ভাই অবশ্য দেশের ভেতর প্রচুর ভ্রমণ করে থাকেন। সে রকম গহিন এক জায়গায় একবার একাই বেড়াতে গেলেন। সারা দিন পার করে সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছালেন সেখানে। যারা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তারা রাতে তাকে একটি দোতলা কাঠের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। বাড়িটা তার পছন্দ হলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলেন বলে সেদিনকার মতো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেন।
গভীর রাতে মচমচ শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। কী ব্যপার কীসের শব্দ। দরজা খুলে কাঠের ছোট্ট বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। হতভম্ব হয়ে দেখলেন অসংখ্য বিশাল আকৃতির হাতি তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে শুঁড় দোলাচ্ছে। মাঝে মাঝে শুঁড় দিয়ে কাঠের বারান্দায় ধাক্কাও দিচ্ছে। যেন কিছু বলতে চাচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ সে বারন্দায় ছিলেন তিনি, নিজেও জানেন না।
পরদিন বাড়ির মালিকের কাছে জানতে চাইলেন এখানে হাতির আনাগোনা বোধহয় বেশ আছে তাই না?
-হাতি? হাতি কোথা থেকে আসবে!
-কেন কাল রাতে অনেক কটা হাতি আমাকে ঘুমুতে দেয়নি।
-কী বলছেন! বাড়ির মালিক হতভম্ব। এখানে হাতি আসার প্রশ্নই ওঠে না।
এ রকম অজস্র ঘটনা আছে খসরু ভাইয়ের। আমরা অবশ্য বলি ‘খসরু ভাই এবার আপনি আপনার ভৌতিক অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে একটা বই লিখুন।’ তিনি হাসেন। তার অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে আমার লেখা ‘কলজে কাঁপানো ভৌতিক অভিজ্ঞতা’ (অবসর প্রকাশনী) বইটির শেষ কপিটি তিনি চেয়ে নিয়েছিলেন। কে জানে হয়তো এবার সত্যি তিনি লিখবেন... আমরাও সে আশায় আছি। মানে নতুন করে ভয় পাওয়ার প্রস্তুতি আর কি।