নাশমান শরীফ
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৩৬ পিএম
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। চৈত্রের শেষ প্রায়। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। হয়তো বৈশাখী ঝড়ের আভাস। সন্ধ্যার আগেই আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে। আলোছায়া বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে অপলক... যেন কোনো দিন ও এমনভাবে চাঁদ দেখেনি। কালো আর ছাইরঙা মেঘেরা বাতাসের ঝাপটায় ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে চাঁদের উপস্থিতি, আবার ঠিকরে বেরিয়ে আসছে জ্যোৎস্না…
এক অপার্থিব দৃশ্য দেখছে মেয়েটি।
যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল আদিয়ানের সঙ্গে, সেদিনও এমন চাঁদ ছিল আকাশে, মনে পড়ল আলোছায়ার।
প্রকৃতি বদলায় না তেমন, কিন্তু মানুষ বদলে যায়। বেশিতো নয়, দুই বছরও হয়নি। কিন্তু মানুষটার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো, সেটি জানে শুধু আলোছায়া।
এই তো বছর দুই আগে, বড় বোনের বাড়ির ছাদবাগানে সেদিন মুগ্ধ হয়ে সন্ধ্যা আকাশের চাঁদ দেখছিল মেয়েটি। প্রতিবেশী ছেলেটি তখন পাশের ছাদে কিছু একটা করছিল।
‘এই আলোছায়া… কী কলছো তুমি ছাদে? মা ডাকছে, নিচে এসো প্লিত!’ বলল ছোট্ট তোতন।
আলোছায়া আরেকটু সময় থাকতে চাইছিল ছাদে, কিন্তু যেতেই হবে। বড় বোনকে মান্যি করে মেয়েটি আর অবাধ্য হওয়া স্বভাবও নয় ওর। ভাগনি তোতন খালার জন্য অস্থির। খালাকে সে নাম ধরেই ডাকে।
‘তোমার নাম কী? … আলোছায়া?’
‘হুম।’ বলে চমকে তাকাল মেয়েটি। পাশের ছাদে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে…
‘জীবনে প্রথম এই নাম শুনলাম। কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?’
‘কলেজে পড়ি আমি, সেকেন্ড ইয়ারে।’, বেশ গম্ভীর উত্তর আলোছায়ার।
‘আশ্চর্য! তোমার নাম যেমন আনকমন, দেখতেও তেমন তুমি… আমি তো ভেবেছি সেভেন-এইটে পড়ো।’
‘সকলেই সেটা ভাবে…’ বলতে বলতেই তোতনের হাত ধরে সিঁড়িঘরের দিকে এগোলো আলোছায়া।
তারপর খুব বেশিদিন পার করতে হয়নি। পরিচয়ের কয়েক মাসের মাথায়ই ওদের বিয়ে হয়ে যায়। আর এ বিয়েতে শতভাগ আগ্রহ ছিল আদিয়ানেরই। শুধু আগ্রহ না, খানিকটা পাগলামিই বলা চলে! নাছোড়বান্দা হয়ে গিয়েছিল আলোছায়াকে বিয়ে করবার জন্য। বাবা-মা হারা বোনের কাছে বড় হওয়া মেয়েটিকে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার একটা ছেলে এত পছন্দ করে চাইছে, তাই বয়সের পার্থক্যটা তেমন বাধা হয়নি বোন-দুলাভাইয়ের কাছে। যদিও আলোছায়া ভীষণভাবে চেয়েছিল লেখাপড়াটা শেষ করতে। কিন্তু বোনের শাশুড়ি আছেন, তিনিও চাইছিলেন তার ছেলের বোঝা কমুক। তাই আর বিয়েটা ঠেকিয়ে রাখেনি মেয়েটি।
বিয়ের পর অবশ্য আলোছায়ার ভাগ্য নিয়ে ঈর্ষান্বিত হয়েছে অনেকেই। এমন অসাধারণ ছেলে, যেমন স্বভাব তেমন ব্যবহার, তেমন রোজগার। খুব বেশি দর্শনদারি না হলেও মন্দ নয়। কিন্তু যোগ্যতার মানদণ্ডে সে অনেক ওপরে।
আলোছায়া জানে আদিয়ানকে নিয়ে কিছু বলা মানে সবাই ওকেই সন্দেহ করবে। অথচ কী করে বলবে কাকে বলবে, লোকটা মানসিকভাবে অতটা সুস্থ নয়। না হলে নিজের চেয়ে প্রায় ১০-১১ বছরের ছোট একটা মেয়েকে কী করে সারাক্ষণ দাঁতের ওপরে রাখে! যতক্ষণ বাসায় থাকবে, তটস্থ থাকতে হবে স্ত্রীকে। ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে ঠোঁট দিয়ে। যা নয় তাই বলতে থাকবে অবলীলায়।
সব করছে, বেড়াতে নিচ্ছে, গাড়ি-ফ্ল্যাট, দামি দামি শপিং করে দিচ্ছে, বোন-ভাগনিদেরও উপহার দিচ্ছে দরাজ হাতে, অথচ…
‘শোনো, তুমি দেখতেই সুন্দর, মাথায় ঘিলু নেই। মাকাল ফল আর কি। খবরদার! সন্ধ্যার পর কখনও ছাদে যাবে না। তোমার তো আবার গাছ লাগানো আর চাঁদ দেখার বাতিক আছে, ওসব ছাড়ো। তোমার বাপের বাড়ি কি ছাদ ছিল, যে ছাদ এত টানে? অবশ্য বাপ-মা তো নেই। থেকেছো তো দুলাভাই বাড়ি। না জানি বাপের বাড়ি থাকলে তুমি কী করতে…!’ আদিয়ান থামতে চায় না। অথচ অবাক বিষয় হলো ফুলের গাছগুলো সে-ই কিনে দেয়। আসলে সে শাসনে রাখতে চায় স্ত্রীকে।
আদিয়ানের বাবা বলতেন, ‘বেকুব যারা তারাই ব্যাচে বউয়ের কাছে মাথা, বুদ্ধিমানে নারী জাতির চাইপা ধরে যাতা’ বাবার কাছেই সব শেখা সব ওর।
আলোছায়ার মন কষ্টে ভরে যায় যখন ভাবে, আদিয়ান বিয়ের আগে ভাগনি তোতনকে কী ভীষণ ভালোবাসত। তখন বলত, ‘আপা, বিয়ের পরে কিন্তু তোতন আমাদের সঙ্গেই থাকবে। ও এত লক্ষ্মী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে…!’
অথচ… সেদিন তোতন বেড়াতে এসেছিল পরিবারের সঙ্গে। ওরা চলে যাওয়ার পর আদিয়ান বলল, ‘এই মেয়েটা পুঙ্গাপাকা, এসব পুলাপাইনরে সহ্য হয় না, আমার বাসায় আসে কেন এরা?’
অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল আলোছায়া, মনে মনেই বলেছিল, ‘কী বিকৃত মুখের ভাষা, হায়রে বদলে যাওয়া মানুষ! একটা শিশুর প্রতিও ঘৃণা এখন…’
আলোছায়া আকাশ না দেখে বাঁচবে কী করে! নিজে হাতে লাগানো ফুলের গাছ, আকাশই ওর বড় বন্ধু। সব অভিযোগ, চোখের পানি অভিমান এখানে। যদিও স্বামীর অন্তরালেই সব…
আজ মেঘ করেছে বেশ। হয়তো বৃষ্টি হবে। আলোছায়া অপলক চেয়ে আছে আকাশের দিখে। মেঘের ছোটাছুটি ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। ওর লাগানো হাস্নাহেনা ফুটছে আজ কদিন।
সন্ধ্যার পরই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ ও আজ পর্যন্ত ফুলের ঘ্রাণটা নিতে পারেনি। আদিয়ান সন্ধ্যার পর ছাদে থাকতে কঠিনভাবে বারণ করেছে। অন্যদিন সে এ সময় বাসায় থাকে। আজ অফিসের জরুরি কাজে ‘রাত হবে ফিরতে’, বলে গেছে।
তাইতো আলোছায়া আজ প্রাণ ভরে উপভোগ করছে ছাদ আর আকাশ।
হাস্নাহেনার গন্ধ ও শরীরে মেখে নিচ্ছে…
হঠাৎ মনে হলো একটা গরম বাতাস ওর শরীর ছুঁয়ে গেল। চমকে ফিরে তাকাল মেয়েটি।
নাঃ, কিচ্ছু না। একটু শিউরে উঠে নিজেকে সামলে নিল। এখন ও আদিয়ানের ব্যবহারের কথা ভাববে। এটা অদ্ভুত ব্যাপার, ভয় পেলে ও স্বামীর আচরণগুলো ভাবে। আর সব ভয় চলে যায়। তখন অন্ধকার নিস্তব্ধতা নিঃসঙ্গতা বড্ড আপন হযে ওঠে।
‘বুঝলে এত ন্যাকা সেজে থেকো না। আমি জানি তোমার স্বভাব কেমন। বেয়াদব অযোগ্য একটা মেয়ে। খবরদার! শাড়ি-গয়না এগুলো পরবা না। সব আলমিরাতে গুছিয়ে রাখবা। ওসব পরে নষ্ট করার জিনিস না। জিনিসের যত্ন করতে হয়, যত্ন করা শেখো…।’ আদিয়ানের এ কথার কোনো মানে বোঝে না আলোছায়া। বুঝতে চাওয়ার সাহসও নেই। বরং মৌনতাই শ্রেয় ওর কাছে।
বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়ছে। আর কিছুক্ষণ থেকেই নেমে যাবে ছাদ থেকে, ভাবল আলোছায়া।
আজকের মতো এমন অপার্থিব পরিবেশ ও বিয়ের পরে এই প্রথম দেখছে। তাই অনুভূতিটাও অনেক বেশি।
রাত প্রায় ১০টা বাজে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ। মাথাটা ধরেছে, ঠান্ডাও লাগছে আলোছায়ার, বোধহয় জ্বরটর আসবে। সন্ধ্যায় হালকা ভিজেছিল বৃষ্টিতে। একটা পাতলা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। হাতে সঞ্চয়িতা, প্রিয় কবিতা ‘নিষ্কৃতি’ পড়ছিলÑ
‘দুঃখে সুখে দিন হযে যায় গত
স্রোতের জলে ঝরে পড়া ভেসে যাওয়া ফুলের মতো
অবশেষে হলো
মঞ্জুলিকার বয়স ভরা ষোলো…’
আলোছায়া নিজেকে মঞ্জুলিকা ভাবতে ভালোবাসে। যদিও ওর এখন কুড়ি চলছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আচ্ছন্ন হলো ঘুমে। মাথার কাছের জানালাটা খোলা, হালকা পর্দা হাওয়ায় দুলছে…।
চোখ জড়িয়ে ঘুম এলো মেয়েটার।
‘কে?’ চমকে উঠল আলোছায়া। হাতটা তখনও ওর মাথায়…‘কার হাত?’ ভেবে সহসা শূন্য হয়ে গেল বুকটা।
একটা সাদা ধবধবে বুড়ো। চুল-দাড়ি সব সাদা, গায়ের রঙ হালকা গোলাপি, পান খাওয়া ঠোঁট, সফেদ মুখে নির্মল হাসি। হাস্নাহেনার সুগন্ধে ভরে আছে ঘর…
‘ভয় পেয়ো না। আমি তোমার বন্ধু হব। মনের কষ্ট দূর হবে। চোখ বন্ধ করো মঞ্জুলিকা…’ বুড়োটা কথা বলতেই পানের মিষ্টি ঘ্রাণে মোহিত হলো চারপাশ। ওর মাথার ভেতর হাত চালিয়ে আরাম দিতে থাকল বুড়ো।
‘শোনো মঞ্জুলিকা, আমি তোমার সব কথা শুনব, তোমার কাছে আসব। ইচ্ছে হলে সব কথা আমাকে বলতে পারো। এখন বলতে হবে না, তোমার তো মাথা ব্যথা করছে, আমি হাত বুলিয়ে দিই…’
‘সে কি! মঞ্জুলিকা কেন বলছেন আমাকে…?’ এটুকু বলতেই নরম তুলতুলে হাত দিয়ে বুড়োটা চেপে ধরল আলোছায়র মুখ। ও আর কিছুই বলতে পারল না। শুধু আবছা ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রইল…।
সত্যিই ভীষণ আরাম বোধ হচ্ছে। নরম হাতটা ওর চুলের ভেতর আঙুল বুলিয়ে চলেছে…। কখন চোখ বন্ধ হয়ে এলো আলোছায়ার।
হাস্নাহেনার মিষ্টি ঘ্রাণ আর বুড়োর মুখের গন্ধটা চেনা। ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটি এখনও গন্ধ পাচ্ছে…। ওর বোনের শাশুড়িমা পান খেতেন। এটা জর্দার ঘ্রাণ। চমৎকার লাগছে গন্ধটা। অবাক হলো ও, ভয় পাচ্ছে না একদম, বরং মনে হচ্ছে, এত আরাম আর ভালো লাগা আগে কখনও পায়নি।
কলিং বেলের শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল আলোছায়া। চট করেই খোলা জানালার ফাঁক গলে কিছু একটা সাৎ করে বেরিয়ে গেল, স্পষ্ট দেখল ও। হঠাৎই ভয়ে শক্ত হয়ে এলো শরীর। আদিয়ান এসেছে। এখনও ঘোর কাটেনি মেয়েটির। ভয়ে তিড়তিড় করে কাঁপছে ভেতরটা।
ও যা দেখেছে সেটা অশরীরী কিছু, জিনটিন… অথবা স্বপ্নও হতে পারে, হয়তো হেলুসিনেশন…। এসব ওর পড়া আছে গল্পের বইয়ে। ভেতরে ভেতরে নিজেকে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে আলোছায়া।
‘কী ব্যাপার এমন তব্দা খেয়ে আছো কেন? কথাটথা বলো? কী করলে সারা দিন?’ হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল আদিয়ান।
‘তুমি খেতে বসো…। তোমার দেরি দেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখেছি।’
‘এ আর নতুন কী, বিয়ের পর থেকেই তো তুমি দুঃস্বপ্ন দেখো। বাপ-মা হারা এতিম ছেলেমেয়েরা এমনি হয়। নিজে তো আর বোঝো না, আমার ঘুমের বারোটা বাজাও…’
আলোছায়া একবার ভাবছিল স্বামীকে ঘটনাটা বলবে, কিন্তু আর সাহসে কুলায় না। সত্যি বলতে কি, স্বামীর কথা শুনে এখন ওর আর ভয় করছে না। ওটা দুঃস্বপ্ন বলেই ভেবে নিল ও।
জানালার পর্দা খানিকটা সরিয়ে দিল আলোছায়া। মেঘ-বৃষ্টি কেটে গেছে, ঝকঝকে চাঁদের আলো পর্দার ফাঁক গলে বিছানায় এসে পড়েছে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করল। হঠাৎ আদিয়ান বড় করে শ্বাস নিতে শুরু করল…
‘এই, তুমি গন্ধটা পাচ্ছো? তোমার গাছে কি হাস্নাহেনা ফুটেছে? অত ওপরের ছাদ থেকে গন্ধটা একবারে ঘরেই চলে আসছে…’ আবার শ্বাস টানল আদিয়ান, ‘আরেকটা গন্ধও… ঘরে কি পানের জর্দাটর্দা আছে কোনো? এত মিষ্টি গন্ধ জর্দার। জানো? গন্ধটা না আমার দাদির কথা মনে করিয়ে দিল, বুঝলে…!’
আলোছায়া জ্ঞান হারাবে মনে হয়। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে ওর, অস্থিরতা লুকোতে চায় স্বামীর কাছে। ও-ও পাচ্ছে খানিক আগের চেনা গন্ধটা… তার মানে ঘুমের ঘোর, স্বপ্ন বা হেলুসিনেশন নয়, সে আছে ধারেকাছেই এ চৈতালি জ্যোৎস্নায়…।