২য় স্বাধীনতা শহীদ যারা
হাসান রনক
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:২৪ পিএম
২০২৪ সালের জুলাই। বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁকবদলের মুহূর্ত। শুরুটা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সে আন্দোলন ঠেকাতে তৎকালীন সরকার আশ্রয় নেয় দমনপীড়নের। শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পেটোয়া বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর। এতে নিহত হয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। মুহূর্তেই সারা দেশে আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে।
উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সারা দেশ। এমনকি আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বমিডিয়ায়। তবু তৎকালীন আওয়ামী সরকার ক্ষমতার অব্যবহার করতে থাকে।
কিন্তু বীর বাঙালি যে দমবার পাত্র নয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান দিতে থাকে নানা পেশা-শ্রেণির মানুষ। কোটার শেকল ভাঙতে স্লোগান দিতে থাকে, ‘কোটা না মেধা? মেধা! মেধা!’ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জোগাতে মাঠে নেমে পড়েন শ্রমজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণির পেশাজীবী। প্রতিবাদের কাছে বুলেটও পরাস্ত হয়, সেটা এ দেশের তরুণ প্রাণের কাছে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। যার ফলে আধিপত্যবাদী ও স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। বেকায়দায় পড়ে যায় তৎকালীন আওয়ামী সরকার। সে আন্দোলনই পরে রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতা পতন ঘটায় স্বৈরাচার সরকারের। গুঁড়িয়ে যায় ক্ষমতার দম্ভ, মসনদ। ফ্যাসিস্ট, জুলুমবাজ সরকারের পতনের বিনিময়ে প্রাণ দিতে হয় ছাত্র-জনতাকে।
জুলাইয়ের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্তাক্ত দিনের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ‘২য় স্বাধীনতার শহীদ যারা’ শিরোনামে ১০ খণ্ডের সমৃদ্ধ একটি প্রকাশনা বের করেছে; যা জুলাই ২০২৪ বিপ্লবের শহীদ স্মারক হিসেবে পরিগণিত। এ উদ্যোগের জন্য এ রাজনৈতিক দলটি প্রশংসার দাবি রাখে। সংকলনের জন্য একটি নির্মোহ, ইতিহাসনির্ভর ভূমিকা লিখেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তার লেখাটির মধ্যে আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের করুণ চিত্র উঠে এসেছে নিপুণভাবে।
উন্নত বাঁধাই, মানসম্মত কাগজে ছাপা ১০ খণ্ডের এ গ্রন্থে সূচিবদ্ধ হয়েছে ৭১৭ শহীদের জীবনবৃত্তান্ত। যারা আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্মৃতিরক্ষার স্মারক হিসেবে এ প্রকাশনাটি লেখক ও গবেষকদের নানাভাবে কাজে আসবে। তা ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধরে রাখতে এমন একটি সংকলনের প্রয়োজনও অবশ্যম্ভাবী ছিল। নিঃসন্দেহে এ সংকলনটি অনেক শ্রমসাধ্য একটি কাজ। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা যায় এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। জুলাই বিপ্লবের শহীদদের আত্মা এবং স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই এ রাজনৈতিক দলটি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বটি পালন করেছে বলে মনে হয়। কেননা আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল। সঙ্গত কারণেই তথ্য আদানপ্রদানের জটিলতা ছিল।
ছাত্র-জনতার এ জুলাই আন্দোলনের কথা ভাবলেই মানসপটে ভেসে ওঠে রাজপথে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের ছবি, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ‘পানি লাগবে কারও? পানি, পানি’; শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের গিটার। বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে মাথায় গুলি লেগে প্রাণ হারানো ছয় বছরের রিয়া গোপের খেলনা। মায়ের কাছে লেখা ঢাকার গেন্ডারিয়ার শাহরিয়ার খান আনাসের চিঠি। গেন্ডারিয়া আদর্শ একাডেমির দশম শ্রেণির এ শিক্ষার্থী শহীদ হওয়ার আগে চিঠিতে লিখেছে, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেক আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য কোরে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইয়েরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, সাত বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে! একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেষ্ঠ।…’
এ কিশোরের সম্পূর্ণ চিঠি পড়ে শেষ করতে করতে বুকের মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অথচ বর্ষার বৃষ্টিতে সতেজ হওয়ার কথা ছিল বৃক্ষলতা। প্রাণপ্রকৃতি সবুজে ভরে ওঠার বদলে ২০২৪-এর বুলেটবৃষ্টিতে ভিজে রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল দেশের মাটি। বলিদান হতে হলো কত কত তাজা প্রাণ! যেকোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুই বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। এ অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের কাছে ‘জুলাই-জাগরণ’ বেদনার খতিয়ানের আরেক নাম। যে বেদনা সারা জীবন বয়ে চলতে হবে। এ রক্তাক্ত জুলাইয়ের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে প্রকাশিত হয়েছে ‘২য় স্বাধীনতার শহীদ যারা’ শিরোনামে ১০ খণ্ডের স্মারকগ্রন্থ। দুর্বার আন্দোলনের ডাকে মাঠে নেমে প্রাণ হারানো শহীদদের জীবনবৃত্তান্তে উঠে এসেছে অনেক তথ্যই; যা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।
ঢাকার কদমতলীনিবাসী আবু ইসহাক ছিলেন সৌদি আরবপ্রবাসী। ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। ফিরতি টিকিটও কেটে রেখেছিলেন। কিন্তু তার আর ফিরে যাওয়া হলো না। প্রাণ হারাতে হলো এ রেমিট্যান্সযোদ্ধাকে। ৬৬ বছর বয়সি নারায়ণগঞ্জের ভোঘাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমান। তিনি ছিলেন পেশায় দিনমজুর। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
ওয়ার্কশপের কর্মচারী শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দক্ষিণ মালধ গ্রামের বাসিন্দা শহীদ বাঁধন। মৃত্যুর সময় কতই আর বয়স ছিল। মোটে পনেরো। অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠা বাঁধনকেও প্রাণ হারাতে হয়েছে। এতে যে বিষয়টি জ্ঞাত; তা হলো দারিদ্র্যপীড়িত শহীদ বাঁধনের পরিবারের প্রত্যাশার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে সংকলনে। এ শহীদের পরিবারের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরায় যে বিষয়টি সুবিধা হয়েছে তা হলো ভবিষ্যতে কোনো হৃদয়বান মানুষ বা সংস্থা তাদের পাশে দাঁড়াতে চাইলেই এ গ্রন্থগুলো কাজে দেবে। তা ছাড়া আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ের দলিল হিসেবে ১০ খণ্ডের এ প্রকাশনাটি অনেকখানি সহায়ক বলে মনে করি। প্রায় আড়াই হাজার পৃষ্ঠার এ আকরগ্রন্থে ৭১৭ শহীদের মধ্যে ৭১২ জনের পারিবারিক অবস্থাও তুলে ধরা হয়েছে। বাকি শহীদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া গিয়েছিল। এ লাশগুলোর ক্ষতবিক্ষত ছবি অজ্ঞাতনামা হিসেবে ছাপা হয়েছে এ সংকলনে। ১০ খণ্ডের এ সংকলনটি পাঠ করলে একনজরে ভেসে ওঠে জুলাইয়ের রক্তাক্ত বাংলাদেশের চিত্র। আন্দোলনে শহীদ হওয়া এ মানুষগুলো একটি স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। তাদের অনেকের স্বপ্ন-আহ্লাদ এবং ব্যবহার করার নানান জিনিসের ছবিও ঠাঁই দেওয়া হয়েছে সংকলনে।
এখানে উঠে এসেছে আওয়ামী সরকারের শাসন ও অত্যাচারের বর্ণনা। তাই ১০ খণ্ডের জুলাই ২০২৪ বিল্পবের শহীদ স্মারক ‘২য় স্বাধীনতার শহীদ যারা’ সংকলনটি পাঠ করে শহীদদের সম্পর্কে জানা যাবে। এ সংকলনের শেষ খণ্ডটি পাঠে জানা যায়, জুলাই বিপ্লবের আরও শহীদদের তথ্য-সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে; যা নিয়ে পরে আরও খণ্ড প্রকাশ হবে বলে জানানো হয়েছে এ সংকলনে।