× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ওহ! আমার দাদি

মূল : সুহেইর আবু অকসা দাউদ, অনুবাদ : মাসুদুল হক

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৩০ পিএম

ওহ! আমার দাদি

একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল, আর মাটির রাস্তা ধরে গড়িয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানি যা পাচ্ছিল সব টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। যেন এ প্রলয়ংকর বৃষ্টির দৃশ্য তৈরি করেই আল্লাহ তুষ্ট নন, তার সঙ্গে বজ্রঝড় আর দমকা হাওয়া ছড়িয়ে দিলেন; যা রাস্তার লাইটপোস্ট আর মহল্লার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সরু সরু পাতার খেজুর গাছগুলো উপড়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল।

তীব্র শীত ছিল, আর আমার দাদি বসে ছিলেন ঘরের এক কোণে, ধূপকাঠির পাশে, যেটা কেউ জ্বালায়নি। তিনি কাঁপছিলেন তার কালো উলেন শালে মোড়ানো অবস্থায়। মাঝে মাঝে তিনি বলছিলেন, ‘হে মেরি, যিশুর জননী, আমাদের রক্ষা করো!’

আমরা সব বাচ্চারা জড়ো হয়েছিলাম কংক্রিটের খাটের ওপর, বড় জানালার কাছে; যেটাকে আমরা ডাকতাম ‘রহস্যের দরজা’। আমরা তাকিয়ে ছিলাম বাইরের পৃথিবীর দিকে, যেটা এক রাতেই রূপ নিয়েছিল একটা ভয়ংকর দৃশ্যে। পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তা, কাদাপানি, বজ্রপাত আর বিদ্যুতে আলোর ঝলকানি। সব মিলিয়ে এক ভয়ের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু আমাদের সেই ভয় দাদির পুরোনো আতঙ্কের কাছে কিছুই না। তিনি ভয় পেতেন প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেই। ভয় পেতেন, যেন এ মাস তাকে ধরে ফেলবে, ঠিক যেমন প্রবাদে বলা হয়। প্রতি বছর ‘ধোঁকাবাজ ফেব্রুয়ারি’ এলেই, সে নাকি ‘এক চোখের পলকে হুসেইনের মাকে নিয়ে যায়,’ দাদি হাতে তসবিহ গোনেন সাতবার, না হয় সত্তরবার প্রার্থনা করতেন, যেন বলছেন, ‘দয়া করো ঈশ্বর, এবার যেন আমাকেও হুসেইনের মায়ের মতো না বানাও।’

এ প্রার্থনার জোরেই বোধহয় আমার দাদি অনেক বছর ধরে স্থির ছিলেন, যেন একটা জলপাই গাছের মতো, যখন তার চারপাশে মানুষ জন্ম নিচ্ছে আর মারা যাচ্ছে, দেশ সৃষ্টি হচ্ছে আর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হচ্ছে আর নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে। আমার দাদি ঠিকই ছিলেন তার ভুলোমনা স্বভাবে, যিনি কেবল একটা জিনিস নিয়েই চিন্তিত থাকতেনÑ ভয়ংকর ফেব্রুয়ারি মাস!

বিকাল ৩টার কাছাকাছি সময়, সে সময়টা যখন আমার মা শহর থেকে প্রতিদিন তার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসতেন। আমরা জানালার বাইরে গুমরে তাকিয়ে থাকতাম, মায়ের জন্য দুঃখ অনুভব করতামÑ এ ভয়ংকর দিনেও তাকে কী সহ্য করতে হচ্ছে তা ভেবে। আগুনের তাপে আমাদের পুরোনো বাড়ির দেয়ালগুলো কালচে হয়ে গিয়েছিল, আর রঙ খসে পড়ছিল। কংক্রিটের খাটটা ছিল মর্গের ফ্রিজের মতো ঠান্ডা। আমরা পাঁচজন ছিলাম, ক্ষুধায় কাতর, কিন্তু খাবারের চেয়েও জরুরি ছিল মায়ের নিরাপদে বাড়ি ফেরা।

ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে মা শহরে একটা নতুন কাজ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, গ্রামের কিছু মহিলার সঙ্গে। বাসস্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত কাদায় ভরা লম্বা একটা মাটির রাস্তা ধরে তাকে হাঁটতে হতো। পথে অন্যদের বাড়ির চালার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি একটু থামার অপেক্ষা করতেন। মাঝে মাঝে দেখা যেত, বৃষ্টি আর থামছে না, আর মা এক ভয়ংকর দিনের মুখোমুখি হচ্ছেন। আমি তখনও বুঝতাম না সেই অভিশপ্ত যুদ্ধ আর মায়ের কাজে যাওয়ার মধ্যে কী সম্পর্ক আছে। কিন্তু মাকে প্রতিদিন কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে রান্নাঘরে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পরিশ্রম করতে দেখে আমি নিশ্চিত ছিলাম রাজনীতির সঙ্গে গরিব মানুষের ভাগ্যের একটা ভয়ানক যোগ আছে।

আমাদের মা কাজ শেষে যখন বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতেন, একটা পাহাড়ের মতো অটল, যাকে বাতাসও নড়াতে পারত না; আমাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে যেন আমাদের ছিনিয়ে নিতেন। তার ব্যাগভর্তি হাত, পুরো শরীর ভেজা। চুল থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত কাদামাখা। আমরা দরজার দিকে দৌড়ে যেতাম তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এমনকি আমার দাদিও, যিনি চুপচাপ বসে থাকতেন, চাদরের নিচ থেকে জেগে উঠতেন, তার শরীরটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। তিনি কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এই যে এলি, এই যে এলি। এত দেরি হলো কেন? ভাবলাম আর ফিরবি না…’

আমার মা তার দিকে এক ধরনের ভর্ৎসনামূলক দৃষ্টি ছুড়ে যেন চোখে চোখে বললেন, ‘ঈশ্বর আপনাকে মাফ করুন, শাশুড়ি মা!’

কিন্তু মা কিছুই বললেন না, শুধু ভেজা কোটটা খুলে নিলেন। আমরা তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে নিলাম, ছেঁড়া হাতব্যাগটা নিয়ে যার যার দিকে দৌড়ে গেলাম। কেউ তোয়ালে আনতে গেল, যাতে মা মুখ আর চুল মুছতে পারেন, কেউ ঘরের চটি আনল, আর কেউ এক গ্লাস পানি। তারপর আমরা সবাই তাকে ঘিরে বসলাম, এক আনন্দময় প্রশান্তিতে ডুবে। তার মুখটা যেন গোলান মালভূমির একটা লাল আপেলের মতো ঝকঝক করছিল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা খেয়ে নিয়েছ?’

‘আমরা তো ক্ষুধার্তই না!’ সাহস করে সবাই একসঙ্গে জবাব দিলাম।

তারপর মা রান্নাঘরের কোনায় রাখা ফ্রিজটার দিকে গেলেন, যা চুলার পাশে ছিল, আর এমন এক মজার খাবার রান্না শুরু করলেন, যার স্বাদ আমি আজও ভুলিনি।

বাড়িটা হঠাৎই যেন একটুখানি স্বর্গে রূপ নিল। জীবন আর উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল, বাইরের জগতে কী ঘটছিল তা পুরোপুরি ভুলে গেলাম আমরা। মা কোনায় জমানো শুকনো কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালালেন। বাবা, যিনি প্রতি সপ্তাহের শেষে বাড়ি ফিরতেন, যাওয়ার আগে কাঠগুলো জোগাড় করে গিয়েছিলেন। তিনি দূরের এক শহরে কাজ করতেন।

দাদি আবার নিজের জায়গায় গুটিশুটি মেরে বসলেন, চাদরের নিচে চলে গেলেন। ততক্ষণে ফেব্রুয়ারি মাসটা তার মন থেকে হারিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে আমরা একটু জোরে হাসলে তিনি আবার গর্জে উঠতেন, ‘হাসার সময় মুখে হাত দে! দাঁত বের করে হাসা মেয়েদের মানায় না!’

যখন আমার শিক্ষক দেখলেন আমি হাসার সময়, কথা বলার সময় কিংবা মুখে একটু হাসি ফুটলেই মুখের ওপর হাত চাপা দিই, আশ্চর্য তিনি তখন রেগে চিৎকার করে উঠতেনÑ ‘মুখের ওপর থেকে হাতটা সরাও!’ এ দুই ঘটনায় আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম!

কোনো দিন মা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই জন্মেছিলি ইসরায়েলের সামরিক শাসন শেষ হওয়ার কিছুদিন পর,’ সেদিন তিনি আমাকে আরও জানিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের নাকাবার পরের সময়টার কথা, যখন নতুন ইসরায়েলি সরকার তাদের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি নাগরিকের ওপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়, যদিও তারা ইসরায়েলের নাগরিক হয়ে গিয়েছিল। ‘আবহাওয়াটা তখনও এমনই ছিল। হাসপাতালে আমাকে দেখতে কেউ আসেনি, এমনকি তোমার বাবাও না। বরফ পড়ছিল, আর কেউ এতটুকুও কষ্ট করে ফোনে বলতেও চায়নি যে, আরেকটা মেয়ে হয়েছে, অভিনন্দন!’ এ কথা বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আবার বলেন, ‘তাই আমি মাথার ওপর কম্বল টেনে দিয়ে কেঁদেছিলাম।’

আমার মনে পড়ে গেল, আমার ভাইয়ের জন্মের সময় কী হয়েছিল। যখন পরপর চারটা মেয়ের পর অবশেষে একটা ছেলে এলো। সেদিন স্কুল ছুটির পর দেখি, স্কুল গেটের দুই পাশে দুই ফুপু দাঁড়িয়ে আছেন যেন পুলিশ, সবার হাতে মিষ্টি দিচ্ছেনÑ শিক্ষক, পথচারী কাউকেই বাদ দিচ্ছেন না।

সেদিন প্রচণ্ড গরম ছিল, আর আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, দেখি বাকি ফুপুরা দাদির নেতৃত্বে মুরগি জবাই করছেন, পালক তুলছেন, এক বিশাল ভোজের প্রস্তুতি চলছে সেই গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা উদ্‌যাপনে। এমনকি আমার মা, যিনি সেদিনই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, সিঙ্কে দাঁড়িয়ে বাসন ধুচ্ছিলেন। তার চোখেমুখে ক্লান্তি ফুটে ছিল, কিন্তু কখনও একটা অভিযোগও করেননি।

আমার মা সামরিক শাসনের দিনগুলো নিয়ে আরও কথা প্রায়ই বলেন : ‘সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের একটুও স্বস্তি মেলেনি, কিছুই বদলায়নি। এমনকি মৃতেরাও কবরের ভেতর শান্তিতে নেই।’

কিন্তু আমার দাদি এতে খুব একটা প্রভাবিত হন না, বরং রাগ করে বলেন, ‘এখন আবার মৃতদের টেনে আনছো কেন?’

এভাবেই চলছিল মা আর দাদির মধ্যে কথাবার্তা, এতটাই যে কেউ খেয়ালই করল না বৃষ্টি থেমে গেছে, সঙ্গে ঝড়ও। কেউ দেখল না আকাশে মেঘ সরে গেছে আর রোদ উঠেছে, যা বাড়িটার পুরোনো দেয়ালগুলো এমনভাবে আলোয় ঝলমল করাচ্ছে যেন সেটা কোনো প্রাচীন ধনসম্পদ, যেন কোনো এক জাদুতে হঠাৎ দিনের পরিণতি বদলে গেছে।

আমরা কেউ খেয়াল করিনি আমাদের পুরোনো প্রতিবেশী হেঁটে আসছেন, তার লাঠি সামনে রেখে, যতক্ষণ না তিনি ডাক দিয়ে আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন। তখন আবার আমরা দৌড়ে গেলাম, তার জন্য একটা চেয়ার আনতে যাতে উনিও আগুনের পাশে বসতে পারেন। তার গলার জোরালো আওয়াজ, যা তার বার্ধক্যের সঙ্গে একদম বেমানান ছিল, তা দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর গুণগান করি। কে ভাবতে পারত, এমন একটা সকাল থেকে এমন একটা দুপুর হবে!’

তারপর, কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি আবার বললেন, ‘যে ফেব্রুয়ারিকে খামখেয়ালি বলেছে, সে মিথ্যে বলেনি।’

আমাদের এ প্রতিবেশী তার প্রবাদের গল্পের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার কাছে গল্প আর প্রবাদবাক্যের যেন শেষ ছিল না, আর তিনি সব সময় বলতেন, জীবনই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। তার এক অটল বিশ্বাস ছিল, যা তার জন্মলগ্ন থেকেই তার মধ্যে ছিল; যখন তিনি এ পৃথিবীকে চোখে দেখেছিলেন তার শকুনের মতো ধারালো চোখে। যে চোখ কেবল একবারই অশ্রু ঝরিয়েছিল। সেটা ছিল সেই সময়, যখন তারবিখা গ্রাম সাত দিন সাত রাত ধরে জ্বলেছিল, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের সীমান্তঘেঁষা কয়েকটি গ্রামে হামলা চালাল। তারবিখা, যেখানে ছিল জলপাই, তামাক আর নানা রকম গাছগাছালি, গরু আর শুকনো তামাকপাতার ফসল; সেই গ্রাম যেখানে তিনি দেখেছিলেন কীভাবে গ্রামের মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে, আর আগুনের শিখায় পুড়ে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধা পঙ্গু মহিলা, যার কণ্ঠস্বর এখনও তার কানে বাজে, মহিলা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘মুহাম্মদ!’

আর যেদিন তিনি পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, ইগ্রিট নামে পাশের গ্রাম থেকে; যেটা ছিল তার নিজের গ্রাম, যখন আরব লিবারেশন আর্মি, যাকে আমাদের এ প্রতিবেশী কটাক্ষ করে বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়া সেনা’, হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, সেদিন থেকে তিনি আর কখনও রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা রাখেননি। বরং তিনি তার এ বিশ্বাস আঁকড়ে ধরেছিলেন, ‘যদি আল্লাহ থাকেন, তবে আমরা অবশ্যই ফিরব। একটুও সন্দেহ নেই।’

সেই প্রতিবেশী ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো। তিনি একজন তরুণের মতো চওড়া-ছিপছিপে গড়নের ছিলেন, যদিও তিনি পরতেন হাত্তা এবং ইকাল, সেই ঐতিহ্যবাহী মাথার কাপড় ও দড়ি যা এখন আর আমাদের গ্রামের মতো জায়গায় কেউ পরে না।

তার ছিল গল্প বলার এক অসাধারণ দক্ষতা এবং বিশেষ করে তার তারবিখা ও ইগ্রিট নিয়ে বলা গল্পটি আমাকে মুগ্ধ করত। তার এক অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল যে মানুষ চিরকাল শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাপ্য ফিরে পায়, হাজার প্রজন্ম লাগলেও। এ বিশ্বাস গল্পটির একটি প্রাকৃতিক উপসংহার এনে দিত, যা শেষ হতো আনন্দ আর সুখে।

এ গল্প শুনলে আমার দাদি বলতেন, ‘ইসরায়েলিরা অন্যদের চেয়ে ভালো। অন্তত তারা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেয়।’ তিনি আরও জোর দিয়ে বলতেন, ‘তুর্কিদের চেয়ে তারা ভালো, যারা আমাদের গাধার পিঠে চড়তে বাধ্য করেছিল; এবং ইংরেজদের চেয়ে ভালো, যারা এ দেশের তরুণদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল।’

কিন্তু আমাদের সেই প্রতিবেশী একমত ছিলেন না।

তিনি বলতেন, ‘ইসরায়েলিরা সবচেয়ে নির্দয় ও নির্মম, কারণ তারা কোনো অনুগ্রহ করে না, যদি না সেটা তাদের নিজের লাভে আসে। আর তারা সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দিয়েও লাভবান হয়।’ ইতিহাসের বই পড়া বা অতীতের কিছু জানার তার প্রয়োজন ছিল না, কারণ তিনি নিজেই সবকিছু দেখেছিলেন : কীভাবে গর্ভবতী নারীদের পেট কাটা হয়েছিল; কীভাবে মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, আর পুরুষদের জীবিকা উপার্জনের পথে হত্যা করা হয়েছিল; কীভাবে শিশু আর বৃদ্ধেরা দেয়ালের ধারে হাত তোলা আর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত, তাদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির প্রতীক্ষায়। এবং কীভাবে ‘মাঠে ফলাতে হলে অনুর্বরটিকে মেরে ফেলো’ নীতির আওতায় গোটা গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, কিছু মুছে ফেলা হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে, আর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়। আর বাকিটা ইতিহাস।

আমার দাদি হঠাৎ সবকিছু মনে পড়ে যাওয়ার মতো করে কেঁদে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘ঈশ্বর আমাদের প্রতিশোধ নেবেন,’ আর এটাই ছিল প্রথমবার যখন আমি তাকে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি উচ্চগ্রামে উচ্চারণ করতে শুনেছি।

আমাদের সেই প্রতিবেশী তা নিশ্চিত করলেন, হ্যাঁ, ঈশ্বর সেই সমস্ত দুর্ভাগা মানুষের প্রতিশোধ নেবেন, যারা কোনো পাপ বা অপরাধ করেনি এবং ইতিহাস সব সময় জনগণের পক্ষেই থাকে। তারপর প্রতিবেশী চলে গেলেন, আর যেহেতু তখন অনেক রাত, আমরা ঘুমাতে গেলাম। প্রথমে দাদি ঘুমাতে পারলেন না, বুকে হাত গুটিয়ে ধরে একই কথা বারবার বলতে লাগলেন, যেন একটা ভাঙা রেকর্ড : ‘ঈশ্বর মহান। তিনি প্রতিশোধ নেবেন।’

কিন্তু সে রাতেই, ফেব্রুয়ারি মাস দাদিকে নিয়ে নিল। তিনি চুপচাপ নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন, শান্ত ও সন্তুষ্ট; যেন শেষ দিনগুলোতে তিনি নিজের ভবিষ্যৎ দেখে ফেলেছিলেন। তার সাদা চুলের বেণি বালিশের ওপর ঝুলে ছিল, আর তার হাত দুটো ছিল বুকে জড়ানো; যেমনটি আমি তাকে তার শেষ মুহূর্তে দেখেছিলাম।

সেদিন এক অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, যখন সবাই দাদির মৃত্যুর শোক পালন করতে জড়ো হয়েছিল, আমি নিশ্চিত ছিলাম আমি দেখেছি দাদির ঠোঁট নড়ছে, আর আমি আরও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম যে তিনি আগের রাতের সেই শেষ কথা আবারও মুখে মুখে বলছিলেন।

(আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ : নাশওয়া গোয়ানলক)

 

সুহেইর আবু অকসা দাউদ

লেখক পরিচিতি

সুহেইর আবু অকসা দাউদ একজন ফিলিস্তিনি লেখিকা, যিনি পশ্চিম গালিলির মিইলিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং Palestinian Women and Politics in Israel বইটির লেখিকা। তিনি জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে কোস্টাল ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটিতে রাজনীতির অধ্যাপিকা হিসেবে কর্মরত। সুহেইর আবু অকসা দাউদ আরবি, হিব্রু ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ ও মতামত-নিবন্ধ রচনা করেছেন এবং আরবিতে চারটি কাব্যগ্রন্থ ও বেশ কিছু গল্প প্রকাশ করেছেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা