ফারুক মাহমুদ
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৩৩ পিএম
পহেলা বৈশাখ নানা শব্দে, নিঃশব্দে আমাদের জানিয়ে দেয়Ñ ‘নব আনন্দে জাগো’। আমরা তা-ই করি, মেতে উঠি নতুনের আবাহনে। এ দিনটি প্রতিদিনের মতো একটি দিন হয়েও যথেষ্ট আলাদা, হাসিখুশি, রঙিন।
বাঙালি যুগ যুগ ধরে নানা আয়োজনে ‘বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করে আসছে। বাঙালি ব্যবসায়ীদের কাছে এ দিনটির রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। এরা ঘটা করে এ দিন ‘হালখাতা’ উৎসব করে থাকেন। কেউ কেউ এটাকে ‘গদিসাইত’ বলে থাকেন। সারা বছর ব্যবসায়ে যে বাকিবাট্টা পড়ে, চৈত্রসংক্রান্তির দিন অর্থাৎ বছের শেষ দিন হিসাবনিকাশ পাকা হয়ে যায়। পরদিন সব বাকি উশুল করে নতুন হিসাব খোলা হয়। হালখাতার দিন লেনদেনের টাকা সিন্দুকে তোলা হয় না, আয়োজন থাকত সে টাকা প্রদর্শনের। গদিতে থাকে ‘বগিথালা’। এতে টাকার স্তূপ। গদিতে নতুন তাকিয়া, নতুন শামিয়ানা। রঙিন কাগজের নিশানে গদিঘর সাজানো। থাকে অঢেল মিষ্টির ব্যবস্থা। ব্যাপারীরা আসেন, নতুন হিসাব খোলেন, ভরপেট মিষ্টি, মসলাদার পান, সুগন্ধি তামাক, সবারই খোশমেজাজ। হাসি-কলরব আর নানা সৌরভে গদিঘর ম-ম করতে থাকে।
এখনকার মতো আমাদের সময়ে তো ডেকোরেটর ছিল না। প্রায় সব অনুষ্ঠানের আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হতো। প্রতি বছর দরকার হয়, তাই আমাদের বাড়িতেই তোলা থাকত শামিয়ানা, বগিথালা, প্লেট, গ্লাস, চামচ ইত্যাদি। বাহারি মোমদানি, ঝাড়বাতি, আগরদানি, পানদানি, ডাবর, নলের হুঁকাÑ আরও কত কি! সারা বছর তোলা থাকা এসব লোয়াজিমা ধোয়ামোছার কাজ শুরু হলে গদিসাইতের আনন্দ আসন্নÑ আমরা জেনে যেতাম। বড়দের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতাম।
পহেলা বৈশাখের দিন ঘুম ভাঙত খুব ভোরে। গোসল করতাম সুগন্ধি সাবান মেখে। নতুন পোশাক, টেরিকাটা চুল, চোখে সুরমা-আতর মেখে তৈরি। নাশতা হতো পান্তাভাত দিয়ে। তখন তো আর ইলিশ মাছের প্রচলন শুরু হয়নি। আলু, বেগুন ভর্তা থাকত। থাকত ‘সাত আনাজের ভাজু’। এরপর শুরু হতো পাড়া-বেড়ানো। মা পইপই করে বলতেন, আজ কোনো দুষ্টুমি নয়।
আমাদের এক প্রতিবেশী দাদি, তার ঘরের উছারায় জলচৌকি পেতে বসতেন, সামনে বড় আকৃতির কাঁসার ডেগ। কাঠের ‘হাতানি’ দিয়ে ডেগের পেটে নাড়াচাড়া করছেন। ছেলে-বুড়ো সারিবদ্ধ দাঁড়াচ্ছে। সবার হাতের কোষে দিচ্ছেন ঘন-তরল এক ধরনের পানীয়। রহস্যময় এ পানীয়টা দাদি নিজেই তৈরি করেন। বেশ স্বাদ। টক-নোনতা-মিষ্টি স্বাদ। দাদি বলতেন, এ শরবত খেলে সারা বছর রোগবালাই দূরে থাকবে। আমরা অত শত বুঝে কী হবে! অসীম আনন্দে খেতাম। পাড়ার দুষ্টু কোনো ছেলে শরবত খাওয়ার লোভে দ্বিতীয়বার এলে দাদি তার ঘোলাটে চোখে ঠিক চিনে ফেলতেন। ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলতেন, এই রহমতি, শরবত একবারই খেতে হয়। বেশি খেলে অনিষ্ট হবে।
আগেভাগে দুপুরের খাবার খেয়ে যেতাম গদিসাইতের অনুষ্ঠানে। আমাদের কাছে অনুষ্ঠান হলো যত ইচ্ছা মিষ্টি খাওয়া। নিজেদের গদি তো আছেই, যেতাম অন্যদের গতিতেও। এ গদি-ও গদি ঘুরে ঘুরে মিষ্টি খাওয়াটাই আসল উদ্দেশ্য। অন্যরাও আসত আমাদের গদিতে।
তখন আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ যায়নি। গরমে একটু আরামের জন্য গদিঘরে ‘টানাপাখা’ থাকত। একটা বড় কাঠের দণ্ড। আংটা দিয়ে ঝোলানো। এতে ঝুলে থাকত প্রশস্ত লালশালু কাপড়। লম্বা দড়ি। এক প্রান্ত পাখার সঙ্গে বাঁধা। অন্য প্রান্ত অদূরে টুলে বসা একজনের হাতে, তালে তালে টানছেন। টানাপাখা দুলছে, বাতাস হচ্ছে। পাখাটানা লোকটাকে আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকত। এক কাজ কতক্ষণ আর করা যায়! দেখি, তন্দ্রায় তার চোখ বুজে আসছে। তবু ঠায় বসে পাখা টানছে তো টানছে।
বৈশাখী মেলা বাঙালির চির-ঐতিহ্য। আমরা বলতাম ‘পরব’ বা ‘বান্নি’। সম্ভবত পার্বণ থেকে পরব এবং বাণিজ্য থেকে বান্নি শব্দ এসেছে। বাংলা সনের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিন বান্নি শুরু হয়ে চলত সপ্তাহজুড়ে। তবে পহেলা বৈশাখেই বান্নি বেশি জমত, কত লোকের সমাগম। কত বিচিত্র পসরা। অধিকাংশই কুটিরশিল্প। আমার একটি পদ্য আছ, ওটায় বৈশাখী মেলার বর্ণনা এ রকমÑ
আলতা সাবান কাঠের ঘোড়া/নকশীহাঁড়ি পুতল জোড়া, আয়না কাঁকই রঙিন চুড়ি/মাঞ্জাসুতো লাটাই ঘুড়ি, নাগরদোলায় ফোকলা হাসি/ঘুরছে লাটিম বাজছে বাঁশি, বাঁশের খাঁচায় টিয়ে পাখি/পুচ্ছ নাচায় উঠছে ডাকি, মন্ডা মিঠাই মুড়কি নাড়ু/মাখনা বাদাম রূপার খাড়ু, কুলফি মালাই তিলের খাজা/কদমা আচার পাঁপড় ভাজা, বানর নাচন সাপের খেলা/আমার ছিল বোশেখমেলা
আমাদের এলাকায় বৈশাখী মেলা বসত, জায়গাটার নাম পঞ্চবটী ঘাট। পাঁচটি বটের সমাহারকে বলে পঞ্চবটী। ওখানে পাঁচরি নয়, একটা প্রবীণ বটগাছ ছিল। এর নিচে এবং আশপাশের নদীঘাট এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেলা বসত। অদূরে ছিল ইটের বিশাল বেদি। পরে জেনেছি এটি শ্মশান। একবার সাহস করে শ্মশানে ঢুকেছিলাম। দুটি চুল্লি। মড়া পোড়ানোর কিছু আলামত দেখলাম। দেখলাম দেয়ালে মানুষের নাম লেখা। শ্মশানঠাকুর জানালেন, যারা এখানে পুড়ে ছাই হয়েছে, তাদের স্বজনরা মৃত ব্যক্তির নাম লিখে রাখেন। তাদের বাসনা, নামটা অন্তত লেখা থাকুক।
জনবসতি থেকে অনেকটা দূরে ছিল এ পঞ্চবটী ঘাট। খেতের আল, বিরান প্রান্তর পেরিয়ে মেলায় যেতে হতো। পরে বৈশাখী মেলা বসত রেলওয়ে মাঠে। নদী ভাঙনে সে মাঠ গেল। পরে মেলা বসত ‘গাছতলা ঘাট’ নামে একটা আমবাগানে। এখন আর জানি না আমাদের এলাকার বৈশাখী মেলা কোথায় বসে। আদৌ বসে কি না!
সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। চিরবাঙালির বৈশাখী উৎস-অনুষঙ্গেও নানা পরিবর্তন এসেছে। গ্রামের বৈশাখী মেলা ছিল কুটিরশিল্পনির্ভর। এখন অনেক পণ্যই শহরে উৎপাদিত। তখন বৈশাখী মেলায় এমন সব পণ্যের সমাহার ঘটত, যেগুলো বছরের অন্য সময় তেমন চোখে পড়ে না।
দলবেঁধে বৈশাখী মেলায় যাওয়াটা রেওয়াজ ছিল। আমরাও তা-ই করতাম। ইচ্ছে হতো মেলার পণ্যের সব জাতই কিনে নিই। হতো না। গাঁটে আর কত পয়সা থাকে! ঘরের পাল্লা বা খুঁটিতে লম্বা ছিদ্র করে এতে সারা বছর এক পয়সা-দুই পয়সা করে জমাতাম। মেলার সময় সেই জমে ওঠা পয়সাই সম্বল। কিছু কিনি আর না কিনি, ছোট একটা চাকু ফিবছরই কিনতাম। কুড়ানো আম কাটার জন্য হাতির দাঁতের বাঁটের (আসলে প্লাস্টিক) চাকু কেনার মধ্যে একটা বাহাদুরি ভাব থাকত। কোমরে তাগা বেঁধে চাকুটা ঝুলিয়ে রাখতাম। বন্ধুরা দেখবে, বাহবা দেবে এতেই তো আনন্দ!
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নৌকাবাইচ হতো। বিপুল সজ্জিত ছিপ নৌকা। একেক নৌকার মাল্লাদের পোশাকের রঙ, বৈঠার রঙ আলাদা। ঢোল-করতাল বাজিয়ে ‘হেইও হু’ তালে নৌকা ছুটতে। নদীর দুই পারে হাজারো মানুষের ভিড়। আনন্দ-উত্তেজনায় কেউ কেউ ছোট নৌকা নিয়ে নদীতে নেমে আসত। দূর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা ক্ষিপ্র গতিতে আসছে, যেন রঙিন আলোকরেখা। কে হারে! কে জেতে! সে কি উত্তেজনা, উল্লাস!
ঢাকার জীবনে বৈশাখী মেলা দেখছি। একসময় পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এ মেলা বসত। এখনও বসে। ঢাকায় বাংলা বর্ষবরণের প্রধান আকর্ষণ রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান।
ছায়ানটের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত। রমনা উদ্যানের অশ্বত্থ গাছের নিচে ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাত, ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে হয়েছিল প্রথম অনুষ্ঠান। পঞ্চবটী বলতে অশ্বত্থ, বট, বিল্ব, আমলকী ও অশোক বোঝায়। ভালো শোনায় বলে অনুষ্ঠানস্থলের নাম করা হয় বটমূল। ১৯৭১ সালে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিটি পহেলা বৈশাখেই নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়ে আসছে সুরের মূর্ছনা আর কথামালায়।
ঢাকা নগরবাসীর বাংলা নতুন বছর বরণের আরও একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেবারই এ উৎসব সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এর পর থেকে এটি বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এ আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।
বাঙালির জীবনে রয়েছে নানা উৎসব। কোনোটা ধর্মীয়, কোনোটা সামাজিক, কোনোটা রাজনৈতিক। বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানমালাই হচ্ছে সব বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। এটি চিরবাঙালির ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে অনন্তকাল প্রবাহিত হতে থাকবে।