× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চির-উন্নত সংস্কৃতির ডাক

আইয়ুব মুহাম্মদ খান

প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:২২ পিএম

চির-উন্নত সংস্কৃতির ডাক

আমাদের যেমন ‘অমর একুশের চেতনা’ আছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ আছে, তেমন আছে ‘নববর্ষের চেতনা’। যে জাতির বর্ষপঞ্জি আছে সে জাতি আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে থাকে। দিল্লির বাদশাহ আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। আকবরের তারিখ-ই-ইলাহি হলো বঙ্গাব্দের মূল। এ তারিখ-ই-ইলাহি, যার গণনার ভিত্তি সৌরবৎসর, প্রচলিত হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন অব্দ হিসেবে। এর কার্যকারিতা প্রদান করা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ধরে। তার আমলেই বাংলায় ‘ফসলি সন’-এর প্রবর্তন করা হয়। এ ফসলি সন কালক্রমে বাংলা সনে পরিণত হয়। বাংলা ভাষার মানুষের নিজস্ব বারের নাম, মাসের নাম এবং বর্ষপঞ্জি রচিত হয়। এটা খুবই গৌরবের বিষয়। কাজেই বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আমরাও ঘটা করে নববর্ষ পালন করতে পারি। বৈশাখে থেকে বাংলা সনের শুরু। পহেলা বৈশাখ আমাদের ‘নববর্ষ’ দিবস। এ নববর্ষ দিবস মানুষের হৃদয়ে বিশুদ্ধ জাতীয় রূপ ও রঙের নতুন আমেজ তৈরি করে। পুরাতন বছরের সব ভুল, অপরাধ, হতাশা-গ্লানি বৈশাখী আমেজে ধুয়েমুছে শুচি হয়। নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা-পুরোনো জরাজীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে নতুন সতেজ-সজীব এক উন্নত জীবনের ডাক দেয়। জনজীবনে আনন্দের ঢেউ বয়ে চলে। প্রবুদ্ধ মানুষের জাগ্রত জীবন প্রতি নববর্ষে নবজীবনের দ্বার উন্মুক্ত করে। দুঃখী মানুষ নতুন জীবন চায় যে জীবন সুখের প্রত্যাশা রাখে। নববর্ষের পূর্বাশার নতুন সূর্য মানুষের মনে নতুন আশা জাগায়। অতীতের আচ্ছন্নতা ও অবসাদ পরিহার করে তারা নব উদ্যমে উত্তরণের পথে এগিয়ে সফল হতে চায়। তারা আধমরা, আধভোলা বিকৃত চেতনার মানুষকে জাগিয়ে ও মাতিয়ে চিন্তা ও কর্মে উদ্বুদ্ধ করতে চায়। তারা সবাই মিলে নতুন পরিকল্পনায় নতুন ও সরস জীবন রচনা করতে চায়। নববর্ষ দিবস আমাদের মনে অনন্য এক মিষ্টি, সুন্দর শিহরন ও অনুভূতি জাগায়। ‘নববর্ষ দিবস’ বা ‘নিউ ইয়ার্স ডে’-তে মানুষের এ আনন্দানুভূতি দেখে ইংরেজ কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসন বলেছেন-

রিং আউট দি ওল্ড, রিং ইন দি নিউ,

রিং, হ্যাপি বেলস, অ্যাক্রস দি স্নো:

দি ইয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো,

রিং আউট দি ফলস, রিং ইন দি ট্রু

আমাদের জীবনের ঐতিহ্যমাখা দিনগুলো নতুন আলোয় উদ্ভাসিত ও বিশুদ্ধ করার জন্য পহেলা বৈশাখের আগমন ঘটে। গোটা জাতি তাদের পুরোনো বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নববর্ষের উচ্ছল হাওয়ায় উজ্জীবিত করে নব-প্রাণময়তায় চিত্তলোক ভরে তোলে।

আমাদের এ অঞ্চলে বাংলা নববর্ষ উৎসব পালিত হতো প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই। নববর্ষের আদি অনুষ্ঠান হিসেবে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘আমানি’ উৎসবের কথা বলেছিলেন। এটি ছিল কৃষকের উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কিষানি একটি নতুন ঘটের মধ্যে আতপ চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন এবং তাতে একটি আমগাছের কচি পাতাযুক্ত ছোট ডাল রাখা হতো। পরদিন সকালে সে পাতাযুক্ত ডাল থেকে ঘরের চারদিকে পানি ছিটিয়ে দিতেন গৃহকর্ত্রী। এতে গোটা ঘরটি পরিশুদ্ধ হলো বলে মনে করা হতো। মূলত সারা বছরের জন্য মঙ্গল কামনায় এ অনুষ্ঠান করা হতো। কৃষক যখন জমিতে হাল দিতে যেতেন, তার শরীরেও ওই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। মনে করা হতো, এতে নতুন বছরে বেশি পরিমাণ ফসল ফলবে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামীণ মেলাও অনুষ্ঠিত হতো এবং এখনও হয়। এ মেলা একদিকে যেমন নববর্ষের আনন্দ আয়োজনের জন্য হয়, অন্যদিকে গ্রামের মানুষের সাংবৎসরিক সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখারও একটি প্রধান উৎস এটি। এ ছাড়া এ মেলায় খেলাধুলারও আয়োজন হতো। এখন খেলাধুলার আয়োজনটি কমে গেছে। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, লাঠিখেলা, গরুর দৌড়, মোড়গের লড়াই, যাত্রা-জারিগান, পাঁচালি, পুথিপাঠ, পুতুলনাচ, সার্কাস ইত্যাদি বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল। এখন দিনদিন এগুলোর আবেদন হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে মানুষের হাতে নগদ পয়সা না থাকায় একসময় বাকিতে কেনাবেচা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ফসল বিক্রির টাকায় নববর্ষের দিনে দোকানির কাছে সারা বছরের বাকি শোধ করতেন গ্রাহক-অনুগ্রাহকেরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানের মালিকরা নববর্ষ উপলক্ষে এখনও ‘হালখাতা’র আয়োজন করেন। এখানে ধূপধুনো এবং রঙবেরঙের কাগজ দিয়ে দোকানপাট সাজানো হয়। আগে দোকানদার গ্রাহক-অনুগ্রাহকদের মিষ্টি, তরমুজ ও বাঙ্গি বা ফুটি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এখন কেউ কেউ বিরিয়ানিসহ নানানরকম আধুনিক খাবার দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করে থাকেন। গ্রাহকরা সারা বছরের বাকি টাকা পরিশোধ করে নতুন খাতা বা হালখাতা খোলেন।

অতীতে জমিদারবাড়িতে প্রজারা নববর্ষে ‘পুণ্যাহ’ উৎসবে যোগ দিত। সেখানেও মিষ্টি ও পানসুপারি দিয়ে প্রজাদের আপ্যায়িত করা হতো। প্রজারাও তাদের সারা বছরের খাজনা পরিশোধ করত।

পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলায় বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন কেন্দ্রীয় সরকারের বাধার মুখে পড়ে। তারা একে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে আখ্যায়িত করে। এ দেশের পণ্ডিতরা বিশেষ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখের নেতৃত্বে, সম্রাট আকবর যে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, সেটি বলেই এখানকার নববর্ষকে বাধাগ্রস্ত না করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান সরকার সে দাবি অগ্রাহ্য করে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্যে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। এটি আজকের বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ সংগঠন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে নিয়মিতভাবে দেশি সংস্কৃতির নানা উপাদান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্যভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করে আসছে। সেই নববর্ষ উৎসব বিশাল থেকে বিশালতর হতে থাকে। এখন সেই অনুষ্ঠান ধর্মবর্ণগোত্রনির্বিশেষে সব বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

নতুন আঙ্গিকে এ মহান জাতীয় উৎসবটি এখন শুধু ঢাকা শহরেই নয়, গোটা বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একসময় যা ছিল গ্রামীণ বাংলাদেশের কৃষকের ক্ষুদ্র ও সীমিত আয়োজনের কিছুটা পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান, তা এখন এ দেশের সংস্কৃতি ও জীবনদর্শনের বাঙময় প্রকাশের এক অনন্য রূপ যেমন লাভ করেছে, তেমন নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অনাসৃষ্টি, ধর্মান্ধতা, স্বৈরশাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আয়োজন করে আসছে। যার উদ্যোক্তা ছিল চারুকলার ১৯৮৬ ব্যাচ। শিক্ষার্থীদের তাৎপর্যময় মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত মুখোশ, পুতুলের প্রতিমা এবং নানা লোকজ প্রতীক, কার্টুন ও আবহমান বাংলার নানা সামাজিক-রাজনৈতিক সমালোচনার উপযোগী ভাবব্যঞ্জনার চিত্রণের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ এ দেশের সংস্কৃতির বহুত্ববাদী তথা সামগ্রিক বোধ-বিশ্বাস-বিনোদন এবং সৌন্দর্যচেতনা, মানবিক বোধ এবং শ্রেয়চেতনার এক অনুপম উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আর এজন্যই ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় ইউনেস্কোর ‘The Intergovernmental Committee’ বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে মানবজাতির মননশীল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের এক অনন্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পৃথিবীর সর্বত্র ‘নববর্ষ’ একটা ‘ট্র্যাডিশন’, এবং একটা ঐতিহ্য হিসেবেই চলমান রয়েছে। বাংলাদেশেও সেভাবেই চলছে। তবে বর্তমান প্রজন্মের মানুষকে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে পোশাক-আশাক, খাবারদাবার ও তৈজসপত্রে দেশজ মোটিফের ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। সুন্দর উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ছেলেরা-মেয়েরা দেশজ পোশাক পরছে, বিশেষ করে মেয়েরা মাটির তৈরি ও ফুলের তৈরি গহনায় বৈশাখী সাজ সাজছে। শহরের বৈশাখী মেলায় খুব সকালে মাটির শানকিতে পান্তা-ইলিশ খেতে দেখা যায়। নানা পদের ভর্তা সেখানে লক্ষ করা যায়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পান্তা-ইলিশ বৈশাখী খাবারের প্রচলনে ছিল না। তবু এটাই যেন এখন বাংলাদেশের বিশেষ করে শহুরে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে সচরাচর দেখা যাচ্ছে। এমনকি বাসাবাড়িতেও এভাবেই উদ্‌যাপিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। সেখানে পাট শাক, উচ্ছে বা করলা ভাজি, বেলের শরবত, আম ডাল, কাঁচা আম মাখানো, তরমুজ-বাঙ্গি এবং সবরি কলাও খেতে দেখা যাচ্ছে।

সে যা-ই হোক নানা দুর্বিপাক ও বিপদাপদ পার করেও এ দেশের মানুষ নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে জানে। লেজেগোবরে অবস্থা উতরে যাওয়ার সুন্দর অভ্যাস এ দেশের মানুষ পূর্বপুরুষের থেকে পেয়েছে। জীবনের যেকোনো জটিল ও পঙ্কিল পরিস্থিতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। বাংলা নববর্ষ তাদের সেই শক্তির জোগান দেয়। নতুন আশায় বুক বাঁধতে শেখায়। নববর্ষের শক্তিশয্যায় তারা তীব্র শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ায়। প্রতি নববর্ষে এ দেশের মানুষের মনেও জাগে কালবোশেখি-নববর্ষের সওগাত ও আশীর্বাদ। যেখানে তেজোদীপ্ত নতুন প্রাণের সাড়া মেলে। অতীতের সব গ্লানি-জড়তা-জীর্ণতা দূর হয়ে যায় সহসা। মনপ্রাণ নব উদ্দীপনায় জেগে ওঠে। পহেলা বৈশাখ এ দেশের মানুষের মনে নতুন কিছু সৃজনের ঝড় তোলে। তাই তো বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন,

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়! তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা