নাইমা সুলতানা
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৮ পিএম
রাত ২টা। জিতু খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল। কাল তার সাবমিশন। সে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারে পড়ে। এখনও অনেক কাজ বাকি তার। প্রতিবারই সে ক্লাসে খুব ভালো পারফরম্যান্স করে, কিন্তু ফাইনাল জুরির দিন কিছু একটা গুবলেট পাকিয়ে ফেলে। হয় তার পেট খারাপ থাকে, না হলে জ্বর, অথবা পিসি ক্রাশ করে, সবকিছু ঠিক থাকলে বৃষ্টি পড়ে মডেল ভিজে যায় আর না হলে শিট উল্টাপাল্টা প্রিন্ট হয়। একবার তো তার বড় আপুর তিন বছরের ছেলে তার কমপ্লিট মডেল ধরে এমন আছাড় দিল যে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। জিতুর মনে হয়েছিল মডেল না তার হৃদয়টাই বুঝি ভেঙে খানখান হয়ে গেল। নিতান্তই ছোট একটা মানুষ এ কাজটা করেছিল বলে জিতু কিছু বলতে পারেনি। আরেকবার মডেলের ওপর এক বদমাশ কাক প্রাকৃতিক কাজ সেরে দিয়েছিল, এত বাজে ধরনের দুর্ভাগ্যের কথা কারও কাছে শেয়ারও করা যায় না, শেয়ার করলে মানুষ সিমপ্যাথি দেখাবে কি, উল্টো হেসেই কূল পায় না। যেভাবেই হোক, এ সেমিস্টারের ফাইনাল জুরিটা কাল ভালোভাবে দিতেই হবে, তা না হলে তুলির সামনে তার মান-ইজ্জত কিছুই থাকবে না।
তুলি ওর এক সেমিস্টার জুনিয়র। সিএসই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। তুলিকে জিতু খুব পছন্দ করে, মানে ইয়ে টাইপ পছন্দ আর কি! মডেলটা খুব যত্ন করে বানাচ্ছিল জিতু। এমন সময় তাদের সামনের বিল্ডিংয়ের ছাদে কী যেন একটা নড়ে উঠল। জিতু ভাবল ভূতপ্রেত কি না, অনেক দিন ধরে লাইভ একটা ভূত দেখার তার খুব শখ। সে তার বিখ্যাত টর্চলাইটটা নিয়ে জানালার কাছে চলে গেল। টর্চলাইটটা তার খুব পছন্দের। গত সপ্তাহেই একটা অনলাইন শপ থেকে বিশাল ছাড়ে সে এ টর্চটা কিনেছে। কেমন যেন একটা রাজকীয় ভাব আছে টর্চলাইটটার মধ্যে। জিতু প্রথমে একবার টর্চটার সুইচ অন করল, জ্বলছিল না সেটা। তাই সে এটাকে একটা ঝাঁকি দিল, এবার জ্বলল লাইটটা। যখন পাশের ছাদে টর্চটা মারল, তখন কিছু একটা ঘটে গেল। একটা অদ্ভুত সাদা রঙের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগল, ধীরে ধীরে ধোঁয়াটা কীসের যেন একটা অবয়ব ধারণ করল। জিতু জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তার মনে হলো সে অন্য এক দুনিয়ায় চলে এসেছে। এ কী কাণ্ড! জিতু আলাদিনের অশ্চর্য প্রদীপের কথা শুনেছে, প্রদীপ ঘষলে দৈত্য বের হয়। সেই গল্পের মতোই তো মনে হচ্ছে। সত্যি সত্যি ধোঁয়াটা একটা বিশাল দৈত্যের আকার ধারণ করে ফেলল। মেঘের মতো গর্জন হলো কিছুক্ষণ, পরে বোঝা গেল দৈত্যটা কিছু বলতে চাইছে। জিতুর হাত-পা সব অসাড় হয়ে আসতে লাগল। এটা কীভাবে সম্ভব! আশ্চর্য! দৈত্য সত্যিই কথা বলা শুরু কর, এই যে জিতু সাহেব! তোমার সমস্যাটা কী বলো তো? আজকাল তো কেউ আর আমাকে ডাকে না, তুমি কী মনে করে আমাকে ডাকলে? তিন হাজার তেত্রিশ বছর ধরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলাম, এর মধ্যে তুমি হঠাৎ টর্চে ঝাঁকাঝাঁকি করে আমাকে ডেকে আনলে! আরে ভাই, আমার কি আর সেই বয়স আছে নাকি? পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতে আজকাল বড্ড কাহিল লাগে। তোমাদের নিয়ে আর পারি না। আচ্ছা যাক, ঝটপট বলে ফেলো তো মশাই তোমার তিনটা ইচ্ছা! একটু সহজ ইচ্ছা দিও। বুঝতেই পারছ, আমি একটা বয়স্ক দৈত্য। বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম গফুর। মালিকা হামিরা বহু বছর আগে আমাকে অভিশাপ দিয়ে এ খ্যাত নামটা রেখে গিয়েছিল। আমাকে তুমি মিস্টার গফুর বলে ডাকবে, ওকে? জিতু তখনও নিজের চোখ বিশ্বাস করতে পারছিল না। দৈত্য যখন সত্যিই এমন কথা বলছে, তাড়াতাড়ি তার ইচ্ছাগুলো বলে দিতে হবে। সে উত্তেজনায় কিছুই বলতে পারছিল না। অনেক কষ্টে মুখ খুলল, ইয়ে মানে... আপনি সত্যি ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন? পল্টি মারবেন না তো?
আরে জিতু মশাই, কী যে বলো! তুমি বলেই দেখো না পারি কি না। আর প্লিজ আমাকে তুমি করে বলো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি করেই বলছি। উম্ম... ওকে, আমার প্রথম ইচ্ছা, আমার কালকের জুরিটা যেন ভালো হয়।
হো হো হো... জিতু মশাই, এটা কোনো ইচ্ছা হলো? খুব মূল্যবান কিছু চাও। ধরো, মার্সিডিজ বেঞ্জ অথবা আই ফোন সিক্সটিন প্রো। কিংবা তুমি কি সিনেমার নায়ক হতে চাও? শাকিব খানের মতো? অথবা অনন্ত জলিল?
উফ না না গফুর, আমি চাই, আমার জুরি কালকেসহ সারা জীবন ভালো হোক, আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা, সিএসই ডিপার্টমেন্টে একটি মেয়ে আছে, তুলি। তাকে আমি খুব পছন্দ করি, তুলি যেন আমাকে ভালোবাসে। আর তৃতীয় ইচ্ছা, আমার যেন এক বস্তা টাকা হয়, অনেক বড় একটা বস্তা, আর বস্তার সব টাকা ১০০০ টাকার নোটে হতে হবে।
জিতু ব্রো, তুমি তুলি মেয়েটাকে পছন্দ করো, তাই না? জানো, আমিও একজনকে খুব পছন্দ করতাম, তার নাম ছিল লাইজু। আফসোস, লাইজু এখন অন্য এক দৈত্যের ঘরনি। অবশ্য জ্যোৎস্না নামে এক পরি আমাকে খুব ডিসটার্ব করত। কিন্তু তাকে আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না।
জিতু তো গফুরের কথা শুনে অবাক। দৈত্যদের মাঝেও তাহলে প্রেম-ভালোবাসা আছে! সে দৈত্যকে বলল, ভাই গফুর, আপাতত আমার এ কটা ইচ্ছা পূরণ করো। আমি এ তিনটা ইচ্ছার ব্যাপারে ফাইনাল। প্রথম ইচ্ছা, কালকের জুরি যাতে ভালো হয়। দ্বিতীয় ইচ্ছা তুলিকে যেন আমি আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাই। আর তৃতীয় ইচ্ছা, আমার যেন এক বস্তা টাকা হয়, সব ১০০০ টাকার নোট। আর কিছু লাগবে না।
ঠিক আছে বস। তোমার ইচ্ছাই আমার জন্য আদেশ। কিন্তু ইয়ে মানে একটা কথা, তুমি সব সময় একটু তারছেঁড়া কনসেপ্টে ডিজাইন করো তো, তাই তোমার ডিজাইন টিচারদের ভালো লাগে না। একবার তুমি শিং মাছের ডিমের কনসেপ্টে ডিজাইন করেছিলে, তার আগে একবার বানরের কঙ্কালতন্ত্রের কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করেছিলে। বলছিলাম কি, একটু বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করলে তোমার জুরি এমনি ভালো হতো।
জিতু মনে মনে ভাবছিল, দৈত্যের এত বড় সাহস, আমার কনসেপ্ট নিয়ে কথা বলল! সে কি জানে, এ ধরনের আনকমন কনসেপ্ট বানানোর জন্য তাকে কত পায়ের ঘাম মাথায়, না না, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়! কিন্তু মুখে বলল, ঠিক আছে গফুর, মাথায় রাখব তোমার সাজেশন। যাও, এবার কাজে লেগে যাও।
ওকে বস, আমি চললাম। তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে।
জিতু মনে মনে আকাশকুসুম ভাবতে লাগল। এবার আর কে পায় তাকে! তার জুরি এবার সবার চেয়ে ভালো হবে। তুলিকে নিয়েও আর চিন্তা নেই। দৈত্য তার লাইফটাই বদলে দেবে মনে হচ্ছে! এমন মজার একটা মুহূর্তে আম্মা খুব ডাকাডাকি করতে লাগল, ওঠ জিতু, তোর না কাল জুরি, আর একটু পরই তো সকাল হয়ে যাবে, তোর কাজ কি শেষ হয়েছে? জিতু ধড়মড় করে উঠে বসল, ওঃ মাই গড! এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল? দূর! এটা কোনো কথা হলো! কত মধুর একটা স্বপ্ন সে দেখছিল! টেবিলে বসে দেখল, মডেলের এখনও ওয়ালগুলো বসানো হয়নি, ওদিকে ড্রয়িংও তিন-চারটা বাকি। জিতুর কপালটা এবারও খারাপ!