অমল সাহা
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪৪ পিএম
মানুষ যেদিন থেকে দুঃখবোধের সম্মুখীন হয়েছে বোধহয় সেদিনই সে এর থেকে মুক্তি পেতে আনন্দের পথটাও খুঁজে নিয়েছে। এ আনন্দবোধ ছিল বিভিন্ন প্রকারের। পরে ভাষার উৎপত্তি হলে এ আনন্দবোধ মানুষ নানান মাত্রায় প্রকাশ করতে থাকে। তারপর লেখার বিষয়ে বৈচিত্র্য আসে। ভাগ হয়ে যায় বিভিন্ন শাখায়Ñ প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, কবিতা, উপন্যাস, সংগীত এবং রম্য রচনা বা গল্পে। রম্য হতে পারে নির্ভেজাল হাস্যরস জোগানোর জন্য আবার কোনো উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে। যেমন কোনো বিষয়কে তির্যক ও ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করার জন্য। সমাজ, রাষ্ট্রের কোনো অবিচার বা বৈষম্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য রম্য আঙ্গিকে বিষয়ের উপস্থাপন হয়ে থাকে। ‘রম্য’ শব্দের অর্থ রমণীয় অর্থাৎ সুন্দর। পরিপাটি আনন্দময় লেখাই হলো রম্য। কিন্তু ব্যাকরণশাস্ত্রের অর্থের বাইরে গিয়ে রম্যের বর্তমান রূপ হচ্ছে, রম্য শব্দটি এমন একটি ধারণা দেয়, যেসব লেখা হাস্যরসাত্মক ও হালকা চালে তির্যক বিদ্রূপাত্মকভাবে পরিবেশিত হয় তা-ই রম্য। ইংরেজি সাহিত্যে এ ধরনের রচনাকে আবার বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন যেসব রচনা রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় উপজীব্য করে লেখা হয়েছে সেগুলোকে বলা হয় ‘জুভেনালিয়ান’। ধর্মীয় বিষয় ব্যঙ্গ করে যে রম্য লেখা হয় তাকে বলে ‘মেনিপ্পিয়ান’। যেসব রম্য রচনায় খুবই হালকা বিষয় উপলক্ষ করা হয় তাকে বলা হয়, ‘হোরাটিয়ান’। তবে আমাদের দেশে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিশেষ করে জীবনের নানা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা রম্যে রূপ দেওয়া হয়। হতে পারে সেটা ব্যক্তিগত বা সামাজিক। এখানে অনেক সময়ই লেখক নিজেকে ‘ডাউনগ্রেডেড’ বা হীন করে উপস্থাপন করেন। অর্থাৎ নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা এবং ব্যঙ্গ করে থাকেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ শিবরাম চক্রবর্তী। নিজের নামটা নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি তিনি। নিজের নাম লিখতেন ‘শিব্রাম চকরবরতি’! নাসিরউদ্দিন হোজ্জা এবং বাংলার গোপাল ভাঁড় রম্য গল্পের ভান্ডার হয়ে চিরকালই আমাদের আমোদিত করে এসেছে।
পৃথিবীর সব সাহিত্যে রম্যধারার লেখা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্যের মধ্যেই রম্যসাহিত্যের উপস্থিতি রয়েছে। বাঙালির ব্যক্তিজীবন সমস্যাসংকুল হলেও বাংলা সাহিত্যে রম্য লেখার অভাব নেই। সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বাংলা সাহিত্যের বাঘা বাঘা লেখকরা সবাই রম্য রচনা করে গেছেন। আর এর মধ্যেই কেউ কেউ শুধু রম্যধারার সাহিত্য রচনা করে রম্য লেখক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এর মধ্যে রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরাম, কালীপ্রসন্ন সিংহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে কে প্রথম রম্য রচনা করেন তা নিয়ে খানিক ‘মিষ্টি’ বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ই প্রথম রম্য রচনা। আবার কেউ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’কে প্রথম রম্য হিসেবে গণ্য করেন। তবে বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম সার্থক হাস্যরসাত্মক ব্যঙ্গ রচনা করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। তবে তিনি গল্প বা উপন্যাস নয়, লিখতেন প্রহসনের আঙ্গিকে যা পরে মাইকেল মধুসূদন দত্তও অনুসরণ করেছেন তার বিখ্যাত প্রহসনগুলো রচনা করার সময়। সে যা হোক, রম্যসাহিত্য একটি সহজপাচ্য সাহিত্যপাঠ বিধায় রম্য রচনার ধারা যুগ পার হয়ে যুগোত্তীর্ণ হয়ে আজও স্বমহিমায় বহমান।
সৈয়দ মুজতবা আলী রম্য রচনায় অদ্বিতীয়। রম্যের সঙ্গে তার সাহিত্যে পাওয়া যায় বৈদগ্ধের ছোঁয়া। তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও রসবোধ মিলেমিশে তার রচনা করে তুলেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আবুল মনসুর আহমদ যেহেতু রাজনীতিবিদ ছিলেন তার ফলস্বরূপ তার সমাজ পর্যবেক্ষণও সৈয়দ মুজতবা আলীর চাইতে ভিন্নতর ছিল। কিন্তু বৈঠকী ঢঙের লেখার জন্য মুজতবা আলী অধিকতর জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ ও ভ্রমণপিপাসু। পৃথিবীর নানান দেশে গিয়েছেন। তাই তার লেখায় পাওয়া যায অতুলনীয় বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। তাই তিনি তার সময়ে ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় এবং এখনও স্বমহিমায় উপস্থিত। সেই জনপ্রিয়তায় এখনও ভাটা পড়েনি। আবুল মনসুর আহমদ এবং সৈয়দ মুজতবা আলী দুজনই বিশ শতকের পৃথিবী প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুবার দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ সমাজকে পরম কৌতূহল নিয়ে দেখেছেন এবং সে পর্যবেক্ষণ লেখায় নিয়ে এসেছেন পরিহাসচ্ছলে, বিদ্রূপে, তিরস্কারে এবং আক্ষেপেও বটে। আদিপর্ব ধরে মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যে ব্যাপ্তিকাল তার সমাপ্তি পর্বে দাঁড়িয়ে আছেন সৈয়দ মুজতবা আলী এবং আবুল মনসুর আহমদ। এরপর শুরু হয় ভারতভাগের পর পাকিস্তান পর্বের সংক্ষিপ্ত সিকি শতাব্দী কাল। এ সময়ে সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন খানিকটা স্তিমিত। কারণ সে সময় পাকিস্তান এবং ভারত দুই জায়গায়ই কিছু কুলাঙ্গারের প্ররোচনায় উভয় রাষ্ট্র তাকে গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করতে শুরু করে। ভারতে তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। সে ব্যাপারে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তৎকালীন পাকিস্তানেও তাকে হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এ সময়ে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যা হোক সে অন্য তিক্ত প্রসঙ্গ। এ সময় সদ্যস্বাধীন দেশ পাকিস্তানে বিভিন্ন অবিচার, শোষণ, অনিয়মতান্ত্রিকতা এবং মানুষের অজ্ঞতার বিরুদ্ধে বিদ্রূপের তীব্র কশাঘাত হানেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিক এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেন্দ্রের মানুষ। ছিলেন মন্ত্রী। তাই তার দ্বারা খোলাখুলি কথা বলা বেশ সহজ ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা এ ধরনের বিদ্রূপাত্মক রচনার পরিমাণ কমে যেতে দেখি। স্বাধীনতার পরের অন্তত দেড় দশক তেমন কোনো রম্যসাহিত্য আমরা দেখি না। কারণ এ ধারার চর্চা খুব কম লেখকই করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খন্দকার আলী আশরাফ ও আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের গল্পে ব্যক্তিজীবনের নানা ক্লেদ লালসা তীব্র ব্যঙ্গবিদ্রূপে বিদ্ধ হয়েছে। খন্দকার আলী আশরাফ আবার রাজনীতি কটাক্ষ করেও রম্য রচনা করেছেন। সর্বজনপ্রিয় বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখা এ সময়টাতে তখনও অত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি পরবর্তীকালে তার বিশেষ রম্য ধাঁচের জাদুকরী লেখনশৈলীর জন্য তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি মানুষের বিভিন্ন প্রতারণা এবং ভণ্ডামি ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে তীব্র কশাঘাত করেছেন। অবশ্য এ সময়টাতে কার্টুন বিশেষ করে ১৯৭৮ সাল থেকে প্রকাশিত রম্য পত্রিকা ‘উন্মাদ’ রম্যসাহিত্যের ধারা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন ইশতিয়াক হোসেন এবং কাজী খালিদ আশরাফ। কার্টুন প্রকাশের পাশাপাশি এখানে রম্য গদ্য এবং ছড়া প্রচুর ছাপা হতো। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত এ রম্য পত্রিকাটি অর্ধশতাব্দী যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি বিরল ঘটনা। বর্তমানে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ রম্য পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন কার্টুনিস্ট ও রম্য সাহিত্যিক আহসান হাবীব। অনেক প্রভাবশালী পাক্ষিক ও মাসিক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে কিন্তু ‘উন্মাদ’ রম্য ম্যাগাজিনটি একটি মাইলফলক ছুঁয়েছে। এর পরের দশকগুলো থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আবার রম্য রচনার ধারা বেগবান হয়ে ওঠে। এর কারণ ‘উন্মাদ’-এর ধারাবাহিকতায় আরও একটি রম্য পত্রিকা বের হয়। এর নাম ছিল ‘কার্টুন’। সেটাও কয়েক বছর পর হারিয়ে গেছে। এরপর দৈনিক পত্রিকাগুলোও সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক হিসেবে নিয়মিতভাবে রম্য সাপ্লিমেন্টারি ম্যাগাজিন বের করা শুরু করে। এমনকি নিয়মিতভাবে ‘রম্য পাতা’ বা ফানপেজ প্রকাশ করা শুরু করে। বরাবরই তরুণদের মধ্যে প্রাণের জোয়ার বেশি। রসবোধও বেশি। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই তরুণরা এসব রম্য পাতাকে গদ্যপদ্য কার্টুন দিয়ে সরগরম করে তুলেছে। বর্তমান সময়ে এ ধারা অব্যাহত আছে। এ সময়ে একঝাঁক তরুণ রম্য লেখার ধারা এগিয়ে নিচ্ছেন। ব্যক্তি বা সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাবলিও বর্তমানের তরুণদের কলমে রম্য উপস্থাপনায় উঠে আসছে। বর্তমান সময়ে অনেকে শুধু রম্যসাহিত্য চর্চা করেই বিখ্যাত। এর মধ্যে আহসান হাবীব দেশবিখ্যাত রম্য লেখক। নূরুল মোমেন, বিরূপাক্ষ পাল, হানিফ সংকেত, সুমন্ত আসলাম, শায়ের খান কল্লোল, প্রভৃতি লেখক বাংলাদেশের রম্যসাহিত্যের ধারা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। উল্লিখিত লেখকদের সবারই একটি ভিন্ন কণ্ঠস্বর আছে। এ স্বল্পপরিসরে তাদের সবার লেখার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। অনুসন্ধিৎসু পাঠকরা নিশ্চয়ই সেটার অনুসন্ধান করবেন।
তবে একটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়, সেটি হলো, রম্য রচনা এবং রম্য গল্পের মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে তা সম্পাদক ও স্বয়ং রম্য লেখকরা বেমালুম ভুলে যান। সেটি হলো, সব রম্য গল্পই রম্য রচনা নয় আবার সব রম্য রচনাই রম্য গল্প নয়। সবচেয়ে ভ্রান্তির বিষয়টি হচ্ছে, রম্য গল্পকেও রম্য রচনা বলে গুলিয়ে ফেলা। গল্পে তো একটি কাহিনী থাকে এবং থাকে মুখ্য পাত্রপাত্রী বা নায়ক-নায়িকা। তাদের পরিণতি থাকে। হতে পারে সেটায় প্রচুর হাস্যরস বা ব্যঙ্গবিদ্রূপের মিশেল আছে। কিন্তু রম্য রচনায় পাত্রপাত্রী থাকলেও তাদের কোনো কাহিনীর বা পরিণতির দায়ভার বহন করতে হয় না। লেখক ইচ্ছা করলেই অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে উপসংহার টানতে পারেন।
পরিশেষে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। আমাদের দেশে রম্য লেখা বা লেখকরা কম আলোচিত হন। এর কারণ প্রথমত আমরা একটা দরিদ্র জাতি। এখানে দুঃখ ও বীভৎসতা যতটা প্রকট ততটা আনন্দ উৎসব নয়। দরিদ্রতা, মৃত্যু, ভয়, কপটতা, প্রতারণার গল্প যতটা আমাদের পাঠকের মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে ততটা আনন্দের গল্প নয়। কান্না আমাদের যতটা প্রাসঙ্গিক, হাসি ততটা নয়। এজন্য এখানে কোনো রম্য লেখক তার লেখার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন এমন ঘটনা নেই। এটা ঐতিহাসিক। এজন্য এখানে কোনো জনাথন সুইফট নেই, মার্ক টোয়েন বা রাশিয়ান ভাসিলি সুকসিন নেই।