× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সেলিম আল দীনের নাটকে মুক্তিযুদ্ধ

শফিক আজিজ

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪৫ পিএম

সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮)

সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট ১৯৪৯-১৪ জানুয়ারি ২০০৮)

বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামী জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ। ভৌগোলিক ও নৃসত্তাকে যদি ধরা হয় দেহ, তবে সংস্কৃতিসত্তা নিঃসন্দেহে তার আত্মা। আর এ দুয়ের মিলনেই নির্মিত হয় জাতিসত্তা। গৌড়-পুণ্ড্র-বরেন্দ্র-রাঢ়-তাম্র-সমতট-বঙ্গ-হরিকেল প্রভৃতি নামের প্রাচীন বাংলা ভূখণ্ড বিস্তৃত নেগ্রিতো-অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-আর্যমিশ্রিত নৃগোষ্ঠীর হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয় স্বতন্ত্র ও নতুন নৃ-ভৌগোলিক গোষ্ঠী বাঙালি জাতির। ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা প্রথমে আর্য পরে মাগধী প্রাকৃত, এরপরে গৌড়ী প্রাকৃত এবং আরও পরে গৌড়ী অপভ্রংশের মাধ্যমে যে বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়, সে ভাষায়-ই এ-বাঙালি নির্মাণ করে তার নিজস্ব সংস্কৃতি। এ-আত্মারূপ সংস্কৃতিই উন্মেষ ঘটায় বাঙালি জাতিসত্তার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতিসত্তার চূড়ান্ত বিকাশের সফল রূপ। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করার হাজার বছরের ধারাবাহিক সংগ্রামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশি বাঙালির সমাজজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

নাটক সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ যৌথ শিল্পকর্ম। সামাজিক ও আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার প্রভাব নাটকে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার বিশাল ক্যানভাস। বিজয় শেষে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয়ে ওঠে জাতিগঠনের। জাতিগঠনে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রধানতম ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধফেরত একদল তরুণ এটি বুঝতে পেরেই নাটক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত শিল্পসংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ও নান্দনিক মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। মূলত এ ত্রিবিধ কারণে শুরু থেকেই বিভিন্ন নাট্যকারের নাটকে নানাভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ; প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, কখনও কাহিনীর শাখাপ্রশাখায়, আবার কখনও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নাটক।

রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা নাটকের কিংবদন্তি পুরুষ সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) অধিপতি ইউরোপ-আশ্রিত নাট্যাঙ্গিক ও রীতি পরিত্যাগপূর্বক বাংলা জনপদের হাজার বছরের বহমান সমৃদ্ধ ঐতিহ্যিক নাট্যাঙ্গিকসমূহের সঙ্গে সমকালীন বোধ ও বাস্তবতার আত্তীকরণের মাধ্যমে যে নতুন শিল্পাঙ্গিক উদ্ভাবন করেন, নিঃসন্দেহে এর পশ্চাতে ক্রিয়াশীল ছিল তার প্রচণ্ড স্বাদেশিক-চেতনা আর প্রবল জাতীয়তাবোধ। শিল্পের ইউরোপীয় বিভাজন তত্ত্বের বিপরীতে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের ধারা আবিষ্কার এবং এ-ধারায় শিল্পসৃজনব্রতী এ নাট্যকার বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ আশ্লেষে, পুরাণ-ইতিহাস-ঐতিহ্য-দর্শন ও বিশ্বসাহিত্যের বিশাল ভান্ডার আত্মস্থ করে, প্রতিনিয়ত মানুষ পাঠের মাধ্যমে জীবন নিংড়ে যে লোকজীবনবর্তী বিশ্বভুবনদৃষ্টি নির্মাণ করেছিলেন, তাতে ধৃত হয়েছে এ-ভূমিলগ্ন বাঙালির যাপিত জীবন-সংগ্রাম-স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-টানাপড়েন, প্রাকৃতিক ও নিম্নবর্গের জীবনাচার এবং সংগ্রাম আর লঘু-নৃগোষ্ঠীর কৃত্য ও জীবনপ্রবাহের এপিক আখ্যান। ফলে তার নাটকে নানাভাবে ধৃত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে কেরামতমঙ্গল ও নিমজ্জন নাটকের নাম উল্লেখ করা যায়। কেরামতমঙ্গল নাটকের একিনপুর ও রাজাকার খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। নিমজ্জন নাটকে বিশ্বভ্রমণরত আগন্তুক বাংলাদেশের গণহত্যায় বিধ্বস্ত সেনেরখিল গ্রামে পাকিস্তানি আর তাদের এ-দেশি দোসরদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা জানতে পারেন তার বন্ধুর কাছ থেকে। তবে সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ নাটক দেয়াল। ১৯৭২ সালে রচিত নাটকটি অপ্রকাশিত এবং এটি খসড়া আকারে পাওয়া যায়।

উপখণ্ডসহ মোট বারোটি খণ্ডে বিভক্ত কেরামতমঙ্গল নাটকে উপকথা, ধর্মীয় মিথ আর লোকজ উপাদানের ভিত্তিতে মঙ্গলকাব্যের অনুপ্রেরণায় সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবসানলগ্নে ভারতবর্ষে সংঘটিত ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ ও ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে শুরু করে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এর অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র কেরামতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আর তার নরকযন্ত্রণাবোধের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন। তবে এর একিনপুর আর রাজাকার খণ্ডে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। একিনপুর খণ্ড প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীসৃষ্ট দোজখ। গ্রামের পথে জয় বাংলার মিছিল নেমেছে। নেপথ্যে শোনা যায় বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ। রাতে দূরাগত কামানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আজমত ডাক্তার আর তার কম্পাউন্ডার কেরামতের। পঁচিশ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা শহরে টিক্কা খান যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে তার খবরও জেনে গেছে তারা। পাঞ্জাবি সেনারা এসে পড়েছে ঝিনাই নদীর ওই পারে। মুক্তিবাহিনীও প্রস্তুত; কিন্তু তাদের হাতে অস্ত্র নেই, পেটে খাবার নেই। তবু গ্রামে গ্রামে চলছে স্বাধীনতার স্লোগান। পাঞ্জাবি সেনারা অগ্নিসংযোগে পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম; চালাচ্ছে নির্মম গণহত্য। নাটকে নাট্যকারের বর্ণনা :

‘আষাঢ়ের আকাশ ঘনিয়ে আসে কালোবরণ মেঘে। সে মেঘ বিদ্যুৎগর্ভা। কালোবরণ মেঘ রাধানগরের উপরÑ একিনপুর দক্ষিণপথে স্থির হয়ে থাকে। মানুষের আর্তনাদ ও আগুনের লেলিহান শিখাÑ মেঘের বুক স্পর্শ করে।’

গ্রামবাসী ভীতসন্ত্রস্ত, কেউ কেউ মৃত্যুপথযাত্রী। কেরামত জয় বাংলার কথা বলে তাদের সাহস জোগাতে থাকে। মৃত্যুপথযাত্রীদের ডিসপেনসারিতে সাধ্যমতো সেবা দিতে চেষ্টা করে। এদিকে পাকিস্তানপন্থি ফজল মিয়ারা ‘পাকিস্তান ভাঙলে আল্লাহর গজব নামব’Ñ এসব বলে গ্রামের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তৎপর। এ স্বাধীনতাবিরোধীরা আজমত ডাক্তার ও কেরামতের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীকে খেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। আজমত ডাক্তার ও কেরামত মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন আর অস্ত্রের অভাব নেই, কারণ ‘যমুইনার গাঙ্গে মুক্তিরা পাঞ্জাবিগরে অস্ত্রের জাহাজ লুট করছে একখান।’ আজমত ডাক্তার বলে, ‘এইবার যুদ্ধে যাওন নাগেÑ কী কস।’ কেরামত একবাক্যে রাজি হয়। তারা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে রওনা হয়।

রাজাকার খণ্ড পাকিস্তানের মাধ্যমে তৈরি হয় মৌলবাদীদের নির্যাতনের নরক। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে পড়ে কেরামত। তারা তাকে ‘শীর্ষে পাকিস্তানি পতাকা উড়ানো’ ক্যাম্পে নিয়ে আসে। রাজাকার কমান্ডার, সে হিন্দু না মুসলমান তা প্রমাণ করতে চাইলে কেরামত তাকে ধরে আনা রাজাকারদের দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই তাগোরে জিগান। ধরার নগে নগে লুঙ্গি তুইলা দেহায়া দিছি না।’ এরপর কমান্ডার তাকে জেরা করতে থাকলে সে নির্ভীক জবাব দিতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছেÑ এ প্রশ্নের জবাবে সে গতকাল খোয়াবে দেখা মুক্তিবাহিনীর বর্ণনা দিলে কমান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চা। অই অরে ওই ঘরে নিয়া ঝুলায়া রাখ। হুনতাছস না গোঙরানিÑ যা টইচ্চার চেম্বারে। শ্যাষ রাইতে জব কইরা উসকো গাঙ্গে ফালাবি।’ এভাবেই কেরামত নিক্ষিপ্ত হয় রাজাকারের নির্যাতনের নরকে।

বিশ্বশিল্পধারায় ফোররিয়ালিজমের প্রথম উদ্ভাবন ওল্ডটেস্টামেন্টের আঙ্গিকে রচিত সেলিম আল দীনের নিমজ্জন এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। ভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের মেরুদণ্ডে পেরেকে ঠুকে দিয়েছিল শহরের ডেড স্কোয়াড অব কারাভানের লোকেরা। বিশ্বভ্রমণ শেষে মৃত্যুশয্যায় শায়িত সেই বন্ধু অধ্যাপককে দেখতে এসে আগন্তুক একের পর এক বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হতে থাকেন। পৃথিবীর তাবৎ গণহত্যা উন্মোচিত হতে থাকে। আগন্তুকের এক সময়ে মনে পড়ে বাংলাদেশের সেনেরখিলের গণহত্যার কথা। বন্ধুটি ‘সেনেরখিলে গণহত্যা’, ‘এপ্রিলের দোয়েলশ্যামাডাকা ভোর এবং হত্যাভাগ্য সেনেরখিল’, ‘তারপর গুলির শব্দ’ আর ‘একটি মরচে রঙের পোড়া গাভী’ শিরোনামে ১৯৭১ সালে সেনেরখিলে সংঘটিত গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরেন।

‘ঘর ঠাসা বইয়ের এক কোনা দেখিয়ে সে বলে*

 : ঐ কোনায়* না ঐ ঐ কোনায় হ্যাঁ। পৃথিবীব্যাপী ঘটে যাওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নয় খণ্ডে লেখা। শেষ খণ্ডটা বাংলাদেশকে নিয়ে। তুমি কি জান ওখানে বাংলাদেশের সেনেরখিল বলে একটা গ্রাম আছে। এপ্রিলের এক ভোরে সেই গ্রামটা পাকিস্তানী সৈন্যরা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল* এবং দুঘণ্টার মধ্যে একশ চৌষট্টি গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল।’

‘বৃক্ষরাজি পুড়ে। গরু বাছুর পুড়ল। কিন্তু একটা মরিচাবর্ণ গাভীর পুড়ে যাবার চিত্রবর্ণনা দুই চোখের ভেতর ফটোগ্রাফ হয়ে থাকে।’

কেরামতমঙ্গলের একিনপুর আর নিমজ্জন নাটকের সেনেরখিল কোনো কল্পিত জনপদ নয়। এবং দুটি গ্রামের ঘটনাও কবিমনের সৃষ্টি নয়। নাট্যকার সেলিম আল দীন মুক্তিযুদ্ধকালে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এ-সমস্ত ঘটনা; নিজেও আজমত ডাক্তার আর কেরামতের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওনা হন। নাটকের মাধ্যমে তিনি তা তুলে ধরে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে ২৫ মার্চ কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু হলে সেলিম আল দীনের অনেক বন্ধুও খুন হন। কবি যশঃপ্রার্থী বন্ধু আবুল কাশেম ছিলেন তাদের অন্যতম। এ-সময়ে তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়ায় ছিলেন। আসন্ন গণহত্যার গন্ধ পেয়ে দুই দিন ধরে ট্রেন ও বাসে চেপে পালিয়ে এসেছিলেন ফেনীর নিজ গ্রাম সেনেরখিলে। কিন্তু দিনের বেলায় বাড়িতে অবস্থান করলেও রাতে থাকার সাহস পেতেন না। পাকিস্তানি মিলিটারিদের আক্রমণের ভয়ে মাঝরাতে প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য কোনো একটা বাড়িতে গিয়ে ঘুমাতেন। তিনি যখন সেনেরখিলে তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, তখন এপ্রিলের কোনো এক ভোরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ-দেশি দোসর রাজাকাররা গ্রামে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসেন গ্রামে। ব্যাপক ধ্বংসপ্রাপ্ত নিজের সেই সেনেরখিল গ্রামটি চিনতেই পারেননি। আগুনে পুড়ে কালো রঙের ছাইয়ে ঢাকা পড়ে আছে গ্রামটি; যেন বা ভয়ংকর দোজখ। গ্রামের চৌধুরীবাড়ির পাশের এক কৃষকের সব ঘর পুড়ে ছারখার, এমনকি আগুন থেকে রক্ষা পায়নি গোয়ালের গরুগুলোও। তার সহপাঠী কাজী মোমিনুল হক মৃত্যুমুহূর্তেও জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন এপ্রিলের এ ঘোলাটে সকালে। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি ও তাদের এ-দেশি দোসররা।

মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার স্থির সিদ্ধান্ত নেন তিনি সেদিনই। যোগ দেন সশস্ত্র সংগ্রামে। প্রথমে ট্রেনিং, এরপর সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যান ত্রিপুরা। আগরতলা, দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলুনিয়া ও হেকিমপুরে ছিলেন তিনি। কিন্তু সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সহযোগী বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কবিতা ও নাটক লেখার। তিনি তা-ই করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তাদের। মহান মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে দেশ-মাটি-মানুষ, হত্যা-নিষ্ঠুরতা, ব্যর্থতা-সাফল্য ইত্যাদি বিষয় তার মননে গভীরভাবে প্রোথিত হয়। ফলে তার নাটকে বাস্তবতার নিরিখেই নানাভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। তার মায়ের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিন দিনে ৮৫ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। সীমান্ত অতিক্রমের স্মৃতিচারণায় তিনি ‘দিনলিপি’তে লিখেছেন :

‘আমার জেঠতুত ভাইÑ হোসেন এক হাত ভাঙাÑ অন্ধকারে সীমান্তেÑ আরেক চাচাত ভাই হুমায়ুন কবিরসহ পাঞ্জাবিদের বাংকারের সামনে থেকে অন্ধকার সীমান্ত পর্যন্ত হারিয়ে ফেলা এই আমাকে প্রচণ্ড গতিতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে একিনপুরে। সে রাতে প্রায় আঠারজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমিও ছিলাম। কিন্তু জুন মাসের ঘন বর্ষণে ঘোর অন্ধকারে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। রওশন ভাই... তিনি আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সে রাতে। আমাদের দলটিতে তিন ভাগে পাঁচজনের মতো ছিলাম। সীমান্ত পাড়ি দেব। সেনেরখিল থেকে মাতুভুঁইয়া-কোরশমুন্সী-সিন্ধুরিয়া-কৈখালি-বাছাগ্রাম তারপর আছে জানা-অজানা গাঁ। আমরা উঠছি। পথে যাদের দেখিÑ নামছে। অদ্ভুত সব নতুন শব্দের অঙ্কুর দেখা দিচ্ছে তখন তাদের জনগণের ভাষায়। ডিম জালিÑ এমনি দুটো পরিভাষা। গ্রামের লোকদের লেখা তিনটি চিঠিÑ সীমান্তের এপারে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। ধরা পড়ার ভয়ে সঙ্গীরা চিঠিগুলো মুখস্থ করে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে বলেছিল। আমি তাই করেছিলাম।...।

সন্ধ্যায় কৈখালি গাঁয়ে স্থানীয় এক নেতার বাড়ি অভুক্ত আমরা প্রায় পনের-কুড়ি জন আশ্রয় নেই। খেতে বসবÑ এমন সময় খবর এলো পুরো গ্রামটাই ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। বক্তারমুন্সীর শামসু অকস্মাৎ মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে ওঠে। সে চিৎকার করেÑ ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি জড়িয়ে ধরে বলি ওকেÑ রাত অনেক বাকি পালাবার একটা পথ পাওয়া যাবে। শামসু হঠাৎ অট্টহাসি দিয়ে আমাদের সচকিত করে। আমার জেঠতপুত ভাই অসীম সাহসীÑ বীর মুক্তিযোদ্ধা হোসেন সাহস দেয়। শামসু তবু ভয় পায়। সে উন্মাদ। আমরা নীরবে কাঁদি।’

দেয়াল নাটকে একাত্তরের এক রাতের ঘটনার মধ্য দিয়ে নাট্যকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধ শক্তি দৃশ্যমান করে আমাদের বিজয়ের অবশ্যম্ভাবিতা ফুটিয়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে মধ্যবিত্তের দোদুল্যমান অবস্থান, শান্তি কমিটির প্রধানের শঙ্কা, জনগণের অধিকার নিয়ে রাজপথে বক্তৃতাদানকারী রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধশক্তি নিয়ে সংশয় ও আপসকামী মনোভাব, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন, নারী নির্যাতন, পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কিশলুর দাম্ভিকতা, মুক্তিযোদ্ধা গেরিলার রক্তশপথÑ সবকিছুই ধৃত হয়েছে নাটকটিতে। মফস্বল শহরের অদূরবর্তী একটি দালান আর তার বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ পাকিস্তানি সৈনিকদের মূল ডিফেন্সÑ বাইরে উন্মত্ত রকেট লঞ্চারের বিদীর্ণকারী শব্দÑ সন্ধ্যার পর রাত্রি; এমন পটভূমিকায় দেয়াল নাটকে নাট্যকার সেলিম আল দীন মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ প্রতিরোধের চিত্র এঁকেছেন।

একটি কক্ষে স্থানীয় সাপ্তাহিক ইনসাফ পত্রিকার দাড়িওয়ালা সম্পাদক, পিস কমিটির চেয়ারম্যান আশরাফ খান ও জনৈক তসলিমের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে মধ্যবিত্তিক দোদুল্যমানতা ও শঙ্ক ফুটে উঠেছে। অন্য একটি কক্ষে বন্দি অধ্যাপক ও উকিলের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার মুহূর্তেও তাদের আলাপচারিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধশক্তির ওপর প্রবল আস্থা লক্ষ করা যায়। উকিল বলেন, ‘মরবোই যখনÑ আমার মনে হয় তীব্রকণ্ঠে ওদের কিছু শুনিয়ে দেয়া ভালো।’ জনগণের অধিকার নিয়ে রাজপথে বক্তৃতাদানকারী রাজনীতিবিদ আজিজ যখন সারেন্ডার বন্ডের ব্যাপারে কথা তোলেন আর বলেন, ‘কি লাভ হবে। আজ নমাস যুদ্ধ চলছে। কোনো প্রতিরোধই তো ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।’

জবাবে উকিল দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘পারবে। একদিন সব প্রতিরোধ দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যাবে। একটা কঠিন দেয়াল।’ 

নেপথ্যে নারী কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে অধ্যাপক বলেন, ‘কিশলু খানের ভোজ চলছে। সভ্যতা কাকে বলে। মানবতা।Ñ বেঁচে থাকার মতো আর একটি দৃশ্যও নেই। শুধু বুলেট-রক্ত-চিৎকার।’

পাকিস্তানিরা মা-বাবা-ভাই-বোনকে হত্যা করেছে যারÑ এমন এক গেরিলাও ধৃত হয়েছে ক্যাপ্টেন কিশলু খানের ক্যাম্পেÑ যে কি না মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ওদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁতে কামড়ে গলা ছিঁড়ে মেরেছিল এক পাকিস্তানি সৈন্যকে। সেই গেরিলা নূরুল হোসেনের ডাক পড়ে কিশলু খানের জল্লাদখানায়। সে সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাদের প্রতিরোধ একদিন সফল হবেই।Ñ আসি।’

অধ্যাপক, উকিল, মাস্টার আর আগন্তুক যে কক্ষে বন্দি সে কক্ষের একটি ফোকর দিয়ে চোখ রেখে আগন্তুক দেখলেন, গেরিলা নূরুল হোসেন কিশলু খানের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত। কিশলু কেপে গিয়ে বেয়নেট আঁটা চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে এ হাত-ও হাত করতে থাকে। সহসা গুলির শব্দ। কিশলু খান গুলি করেছে গেরিলাকে। সবার ধারণা মারা গেছে সে। কিন্তু একি! গেরিলা নয়, কিশলু খানই বাঁ কাঁধ চেপে ধরে ঢলে পড়ে। ওদের দুজনের পেছনে ছিল দেয়াল। দেয়ালে আঘাত খেয়ে বুলেটটি কিশলু খানের কাঁধেই বিদ্ধ হয়েছে। রিইনফোর্স কনক্রিটের পাথুরে গাঁথুনির দেয়াল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধের প্রতীক; আমাদের ভবিষ্যৎ বিজয়ের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সম্মিলিত প্রতিরোধশক্তির জয়গাথা আর বিজয়ের ইঙ্গিত প্রকাশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাটকটি।

সেলিম আল দীনের নাটকে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি তার নাট্য রচনার শুরুর পর্বে পরীক্ষানিরীক্ষা ও নানামুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে আঙ্গিক খোঁজায় সচেষ্ট ছিলেন এবং এ-সময়ের নাটকে ইউরোপীয় প্রভাবও অল্পবিস্তর পরিলক্ষিত। অচিরাৎ তিনি ইউরোপীয় থিয়েটারের দীক্ষা পুরোপরি পরিত্যাগ করেন এবং বাঙালির নিজস্ব হাজার বছরের ঐতিহ্যময় নাট্য অভিজ্ঞান অধুনান্তিকরূপে পুনর্জাগরিত করবার প্রয়াসে নিবেদিত হয়ে এপিক আখ্যানে নাট্য রচনায় ব্রতী হন। দেয়াল শুরুর পর্বের নাটক। নাটকটি খসড়া মাত্র। নাটকটি চূড়ান্ত রূপ পেলে বা প্রকাশিত হলে এটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বলার প্রয়াস পাওয়া যেত। নাটক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা ও আঙ্গিক খোঁজায় ব্যস্ততায় এবং দ্রুত আঙ্গিক পরিবর্তনে সক্রিয় থাকায় হয়তো তিনি নাটকটি নিয়ে আর বসতে পারেননি বা বসেননি। অন্যান্য নাটকের বিস্তৃত এপিক আখ্যানে তিনি নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধ উপস্থাপন করেছেন। ইউরোপীয় আঙ্গিকে লিখলে এর এক একটি খণ্ডাংশই হতে পারত এক একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক। কিন্তু তিনি যেহেতু বাঙালির নিজস্ব নাট্যাঙ্গিকসমূহের মধ্যেই নানা ঘটনায়-কাহিনীতে তাদের যাপিত জীবনযন্ত্রণা, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-টানাপড়েন, নিম্নবর্গের জীবনাচার আর লঘু-নৃগোষ্ঠীর কৃত্য ও জীবনপ্রবাহের এপিক আখ্যান নির্মাণ করেছেন, ফলে এ এপিক আখ্যানের মধ্যেই তিনি এঁকেছেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যময় ও বৈচিত্র্যময় নানাবিধ চিত্র।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা