শামস সাইদ
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪২ পিএম
বসন্তের সেই দুপুর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে। যে দুপুরের কথা বলছি তা ছিল অদ্ভুত। দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে উঠছে নিঃসঙ্গ গাছগুলো। বাতাসের শরীরে বারুদের গন্ধ। ধ্বংসাত্মক উন্মাদনার নিচে চাপা পড়ে আছে শোকার্ত আর্তনাদ। ছেলে ফেরার অপেক্ষায় বৃদ্ধা মা। জীর্ণ শরীরে পথের পাশে দাঁড়িয়ে ঘোলা চশমার ভেতর ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছেন বাবা। সেই গাছে ফুল ফোটেনি যা পুড়েছিল হিংসার আগুনে। তবু নতুন স্বপ্ন বুনেছে মালী। বাগান সাজাবে। ফুল ফোটাবে। কোকিল সুর দিয়ে সঙ্গীকে ডাকছে, সঙ্গম করবে। পথভোলা বাউল তানপুরা বাজাচ্ছে। সে সুর নির্জনতার দেয়াল ভেঙে হৃদয়ের গহিনে তরঙ্গ তুলছে। সেই দুপুরে অভিকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন ছোট চাচা। বড্ড মন খারাপ। উদাসদুপুর আরও বেশি উদাস করে দিয়েছে। তখন চিৎকার করে উঠল ঊর্মি।
ঊর্মির থেকে নয় মাস বেশি হেঁটেছে অভি। এখন তারা একই পথে স্কুলে যায়। তবু চুপচাপ থাকে অভি। শুধু পথে না, বাড়িতেও তেমন কথা বলে না। হাজারটা প্রশ্ন ঊর্মির। একটারও উত্তর দেয় না। মাকেও প্রশ্ন করে। জানতে চায় বাবা কোথায়? আসে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর কেউই দিচ্ছে না।
এক দুপুরে তারা হাঁটছিল স্কুলের পথে। একটা কুকুর হঠাৎ পথ আটকাল। ভয় পেয়ে গেল ঊর্মি। অভি সাহস দেখিয়ে বলল, আমি আছি। ভয় পাইস না। কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিল। ঊর্মি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল ভাই তাকে অনেক ভালোবাসে। তাহলে বাবার কথা বলে না কেন! ভাইয়ের হাত ধরে বলল, একটা কথা বলবি?
বিস্ময়ের চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায় অভি। জানতে চায় কী কথা?
আমাদের বসারঘরে ওই ছবিটা কার?
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অভি বলল, স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পা চালিয়ে হাঁট। ঊর্মির কৌতূহল দূর হচ্ছে না। অভির হাত ধরে থামিয়ে দিল। বল, ওই ছবিটা কার? আজ বলতেই হবে।
মাটির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে অভি বলল, বাবার। আর কিছু বলতে পারছে না। দুঃখ তার গলা চেপে ধরেছে।
কিছুক্ষণের জন্য ঊর্মি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাবার ছবি। বাবা মানুষটা একদমই অচেনা। কখনও দেখেনি। আচ্ছা বাবার ছবি আছে, বাবা নেই কেন?
জানি না। বলে পায়ের দিকে তাকাল অভি। ঊর্মি বুঝতে পারল ভাই কষ্ট পাচ্ছে। কেন কষ্ট পাবে? বাবার কথাই তো জানতে চাচ্ছে। নতুন প্রশ্ন করল না। বাবা শব্দটা গেঁথে রইল মনে।
স্কুল থেকে ফিরে সেই ছবির সামনে দাঁড়াল ঊর্মি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটে খুঁটে দেখছে বাবার মুখ। এরপর কাগজ আর রঙপেনসিল নিয়ে বসল। বাবাকে আঁকবে। অনেক দিন চেষ্টা করেও পারল না। কাগজ, কালি নষ্ট করেছে। মন খারাপ হলো। তবু থেমে যায়নি। একদিন বাবার মুখ ভেসে উঠল কাগজে। সে কী আনন্দ। ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। চমকে দেবে। সে ছবি দেখে সত্যি চমকে গেল অভি। অনেকক্ষণ পরে জানতে চাইল, তুই এঁকেছিস?
মুখে হাসি মাখিয়ে মাথা নাড়ল ঊর্মি। হ্যাঁ, বাবার মতো হয়নি?
অভি কিছু বলছে না। ঊর্মির নতুন প্রশ্নÑ চুপ করে আছিস কেন?
বাবাকে সত্যিই তুই আঁকতে পেরেছিস। কেমনে আঁকলি? না দেখলে এমন ছবি আঁকা যায় না। তোর হৃদয়ে ঠিকই বাবা আছে। না হয় আঁকতে পারতি না।
ঊর্মি ছুটে গেল মায়ের কাছে। আজ একটা কথা বলতেই হবে।
এত জোর দিয়ে কী জানতে চাচ্ছিস?
বাবাকে দেখেছে অভি?
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন মা। মনে পড়ল সেই সকালের কথা। যে সকালে স্বপ্ন আর ভালোবাসা হারিয়ে গেল কুয়াশায়। পর্দাটা সরে গেল স্মৃতির জানালা থেকে। ভেসে উঠল সেই মুখ। নিঃশব্দে গড়াচ্ছে চোখের জল। ঊর্মি অস্থির, বাবাকে দেখেছে অভি?
আঁচলে চোখ মুছে মাথা নাড়লেন মা। হ্যাঁ, দেখেছে। যে সকালে হারিয়েছে বাবা, সে রাতে খুব কান্না করেছিল অভি। শান্ত হলো বাবার কোলে উঠে। তখন ওর বয়স নয় মাস। কী বুঝেছিল জানি না। অফিস থেকে ফিরেই কোলে নিতেন বাবা। ঘুমন্ত মুখে চুমু খেতেন। শেষবার অভিই দেখেছে, আমরা দেখিনি।
অন্ধকার হয়ে গেল ঊর্মির মুখ। ভাইকে আদর করত, আমাকে করত না?
গম্ভীর মুখে মা বললেন, না।
কেন?
সেই সকালের তিন মাস পরে তুই জন্মেছিস। তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। মুখটাই দেখতে পারলেন না। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল মায়ের বুক খালি করে।
ছোট হয়ে গেল ঊর্মির মুখ। বাবা কেন হারাল? মায়ের কাছে তা জানতে চায় সে।
মা বললেন না। ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। অভিমানী কণ্ঠে বলল, তুই মিথ্যা বলছিস।
ঘাবড়ে গেল অভি। কোনটা মিথ্যা?
বাবাকে দেখেছিস। তোকে অনেক আদর করত। শেষবার শুধু তুই দেখেছিস বাবার মুখ। আমাকে নাকি বাবা দেখেনি। আদর করবে কী! হঠাৎ কান্না পেল ঊর্মির। অনেকক্ষণ কেঁদে চোখ মুছল। জানতে চাইল, কোথায় হারিয়েছে বাবা জানিস?
মাথা নাড়ল অভি। বিশ্বাস কর, আমি দেখিনি।
তুই দেখেছিস। মা বলেছে।
দুই হাতে মাথা চেপে ধরল অভি। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না। আমি শুধু জানি ওই ছবিটা বাবার।
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে ঊর্মি। মন খারাপ করে বলল, বাবাকে খুঁজে আনবি? তুই তো অনেক বড় হয়েছিস। কুকুরের সামনে দাঁড়াতে পারিস। ভয় পাস না। তাহলে বাবাকেও খুঁজে আনতে পারবি।
বোনকে সান্ত্বনা দিল অভি। কাঁদিস না। বাবাকে খুঁজে আনব।
ঊর্মির ম্লান মুখে হাসি ফুটল। সত্যি বলছিস?
মাথা নাড়ল অভি। হ্যাঁ, বাবাকে খুঁজে আনব। কিন্তু মনে তার অন্য কথা। কোথায় খুঁজবে বাবাকে? কেউ জানে না বাবার খবর। চাচা অনেক খুঁজেও পাননি। বাবা হারিয়ে গেছে। আর ফিরবে না। ঊর্মির মতো তারও প্রশ্ন ছিল। মা বলতেন বাবা আকাশে। বহুবার সে আকাশকে বলেছে ফিরিয়ে দাও বাবাকে। আকাশ শোনেনি তার কথা। একদিন ঊর্মিকে বুঝিয়ে বলবে বাবা ফিরবে না। হারিয়ে গেলে কেউ ফেরে না।
দুই.
ঊর্মির মনে নতুন স্বপ্ন। বাবা আসবে। কিন্তু বাবাকে খুঁজতে যায় না অভি। অস্থির হয়ে এক বিকালে ভাইয়ের সামনে দাঁড়াল। তুই না বলছিলি বাবাকে খুঁজে আনবি। তা যাচ্ছিস না কেন?
যাব। সে অনেক দূরের পথ। একা যেতে পারব না। ছোট চাচাকে নিয়ে যেতে হবে। চাচা সময় পাচ্ছেন না।
চাচাকে বলব আমি?
না না, তোর বলতে হবে না। আমি বলব।
এক দুপুরে গম্ভীর মুখে অভি দাঁড়াল ছোট চাচার সামনে। কী হয়েছে অভি? মন খারাপ কেন? চাচার প্রশ্ন।
ধরা কণ্ঠে অভি বলল, বাবাকে দেখতে চায় ঊর্মি। ও বুঝতে চায় না বাবা হারিয়ে গেছে। বলে খুঁজে আন। সেদিন খুব কান্না করছে। বাবার ছবি আছে। বাবা নেই কেন?
নিচু হয়ে পড়ল চাচার মাথা। আট বছরেও বাবার কথা ভুলতে পারেনি ওরা। কোনো দিন ভুলতে পারবে না। ওদের কাছে বাবা একটি শব্দ। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। অনুভূতি নেই। সেই শব্দটা জড়িয়ে অনেক প্রশ্ন। ক্রমে চাচা ডুবে যাচ্ছেন সন্ধ্যার সূর্যের মতো। অনেকক্ষণ পরে মাথা তুললেন। তার সামনে বাবাহারা এক শিশু। যে বাবার খোঁজ চায়। তোর কি মনে হয়, বাবা বেঁচে আছেন?
বেদনার্ত কণ্ঠে অভি বলল, জানি না। বেঁচে না থাকলে বাবার কবর কোথায়? নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। হয়তো পথ হারিয়ে ফেলছে। চলো, একদিন খুঁজে দেখি।
কোথায় খুঁজব?
যেখানে হারিয়েছে। তুমি না বললে অনেক খুঁজেছ, মিরপুর, রায়েরবাজার। ওখানেই চলো একদিন। না পেলেও ঊর্মিকে বলতে পারব খুঁজেছি। পাইনি। ও শান্ত হবে। একসময় ভুলে যাবে বাবার কথা। মনে করবে বাবা মানেই ছবি। জানো চাচা, ওর মনে অনেক কষ্ট। যখন কেউ বাবা ডাকে, ওর চোখ জলে ভরে যায়। এতটা দুঃখ জড়ো হয় মুখে, চোখ রাখা যায় না। বলতে বলতে কান্না করে দিল।
অভিকে জড়িয়ে ধরলেন ছোট চাচা। বললেন, আচ্ছা, কালই যাব।
আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
হ্যাঁ, তোকে নিয়ে যাব। এই খোঁজ শেষ হবে না অভি। শেষ হয়ে যাবে পথ। হারিয়ে যাবে বেলা। তবু খোঁজ মিলবে না বাবার। যা দেখবি তা আঁকড়ে ধরেই খুঁজে ফিরবি। কিন্তু বাবাকে পাবি না। এ কথাগুলো তার বুকের বেদনা আরও বাড়িয়ে দিল।
তিন
পরদিন চাচাকে নিয়ে বাবার খোঁজে বের হলো অভি। ঊর্মি আনন্দে আত্মহারা। বাবা আসবে। সে আজ খায়নি। চোখ দরজায় সাঁটিয়ে বসে আছে। কখন বেল বাজবে। জড়িয়ে ধরবে বাবার গলা। অভিকে নিয়ে চাচা এলেন মিরপুর, রায়েরবাজার। গাড়ি থেকে নেমে অনেকক্ষণ হেঁটে একটা পুকুরের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, এখানে হারিয়েছে তোর বাবা। আরও অনেকে। সেই সকাল ছিল হারানোর। শোকের। অসংখ্য মানুষ হরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না।
অভি তাকিয়ে আছে পুকুরের অল্প জলে চোখ ফেলে। কোথাও দেখছে না বাবার মুখ। অন্য কোথাও গেল কি না? তবু আঁতিপাঁতি করে খুঁজল। এরপর চোখ রাখল আকাশে, মেঘের ভাঁজে। বাবার মুখ নেই। মন খারাপ করে বলল, চলো অন্য কোথাও যাই। এখানে নেই।
অভিকে নিয়ে তুরাগপারে এলেন চাচা। নদীর পারে দাঁড়িয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভি। কেনই যেন মন বলছে ভেসে যায়নি তো বাবা। কার কাছে জিজ্ঞেস করবে। মানুষ নেই। নিস্তব্ধ এলাকা। চাচা কিছু বলছেন না। খানিক সামনে হাঁটল অভি। দেখল একটা ব্রিজ। লোহার। ভাবল ব্রিজের ওপার যাবে। ওদিকটায় থাকতে পারে বাবা। চাচাকে বলল, চলো ওপার যাই।
চাচা থামালেন। এখানে দাঁড়িয়েই তো দেখতে পাচ্ছিস। কেউ নেই।
কিছু বলল না অভি। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ওপারের সব দেখতে পাচ্ছে ঠিক। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ দেখল একজন মানুষ বসে আছে নদীর পারে। খানিক আগেও ছিল না। কী যেন বলছে মাটির সঙ্গে। জীর্ণ শরীর। মলিন কাপড়। এলোমেলো চুল। কিছুটা সাদা। বাতাসে উড়ছে। নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। লোকটা পাগল নাকি! হতে পারে। চাচার কাছে এসে বলল, চলো ওই লোকটা জানতে পারে বাবার খবর। দেখ না কী সব বলছে একা একা।
কিছুটা বিরক্ত হলেন চাচা। দেখতে পাচ্ছিস না লোকটা পাগল।
তবু যাবে অভি। তাই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন চাচা। লোহার ব্রিজ পেরিয়ে ওপার গেলেন। পাগল চুপচাপ বসে আছে হাঁটু ভেঙে। মেরুদণ্ড ধনুকের মতো বাঁকা। নদীর দিকে তাকিয়ে আছে শ্যেন দৃষ্টিতে। কথা বলছে না এখন। চাচা দাঁড়িয়ে আছেন দূরে। অভি কাছে গেল। হাতের ইশারায় বসতে বলল পাগল।
অভি বসল। গম্ভীর কণ্ঠে পাগল জানতে চাইল, এহানে আইছ ক্যা? কেউ তো আয় না। আমিও যাই না কারও কাছে। বইয়া থাহি নদীর পারে। দ্যাহি হেই দৃশ্য। যা হারায়া গ্যাছে। যা হারায়াছে তা সবাই দ্যাখতে পায় না। আমি দেখি আগুন। শুনি সেই চিৎকার।
এসব শুনতে চায় না অভি। সে জানতে চায় বাবার খবর। বলল, আমার বাবাকে দেখছেন?
হকচকিয়ে উঠল পাগল। কে তোর বাবা?
আ ন ম গোলাম মোস্তফা। আট বছর আগের এক সকালে হারিয়ে গেছে। আর ফেরেনি।
কোথায় হারাল?
জানি না। সেদিন সকালে কারা জানি তুলে এনেছে। আর ফেরেনি। শুনেছি এখানে এনেছিল। তাই এলাম। কোথাও দেখি না বাবার মুখ। না আকাশে, না জমিনে। বাবাকে দেখতে চায় আমার বোন।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পাগল। বাবা! আঃ বাবা! আমিও একজন বাবা। খুঁজছি স্ত্রী, সন্তান। কোথাও খুঁজে পাই না।
তারাও হারিয়ে গেছে? জানতে চায় অভি।
পাগল ডুবে গেল সেই রাতে। যে রাত তাকে পাগল বানিয়েছে। বলল, সেই রাতের তাণ্ডব দেখেছি আমি। যে রাতে সবাই হারায়া গ্যাছে। আগুন আয়া গিল্লা খাইছে। হারাইতে পারি নাই আমি। আজও বাঁইচা আছি।
সেই তাণ্ডবের কথা জানতে চায় অভি। কী হয়েছিল সে রাতে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সামান্য নড়ে বসল পাগল। বলল, ব্রিজের ওপার ছিল আমার ছোট্ট ঘর। বাঁশ-খুঁটির। স্ত্রী আর দুই মাইয়া নিয়া থাকতাম। একটা সাইকেল ছিল। রোজ সকালে বাইরে যাইতাম। বিদ্যুতের লাইনে কাজ করতাম। ফিরতাম সন্ধ্যা কইরা। কোনো দিন রাইত অয়া যাইত। যুদ্ধ পাল্টায়া দিল জীবন। হারায়া গেল আনন্দ। রোজগার। নিয়া আইলো ভয়। রান্ধা নাই। খাওয়া নাই। জড়োসড়ো অয়া বইয়া থাকি। কখন ওরা আয়া পড়ে। প্রাণ কাইরা ন্যায়। সেই অপেক্ষা শেষ হইলো এক রাইতে। ঘুমাইছিলাম একটু। ভাবছিলাম ওরা আইবে না। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের মাইরা কী হইবে? রাইত কয়টা কী হইছে জানি না। আমাগো আখড়াটা হঠাৎ জ্বইলা উঠল। শুনছি চিৎকার চ্যাঁচামেচি। দৌড়ায়া বাইরে নামলাম। তখন এলোপাতাড়ি গুলি। দিক করতে না পাইরা ঝাঁপ দিলাম নদীতে। ডুব দিয়ে এপার আয়া শুয়ে পড়লাম চরে। দ্যাখলাম জ্বলছে গ্রাম। সেই আগুনের মধ্যে চিৎকার করছে আমার স্ত্রী, মাইয়ারা। পারছি না ছুইটা যাইতে। একসময় সেই চিৎকার থামল। সব খাইয়া আগুন মরল। নেই আর্তনাদের শব্দ। কেউ বলছে না বাঁচাও। আমিও নড়ছি না। গাছের নিচে বয়া আছি। রাত পোহাইল, তবে পরিষ্কার হয় নাই আকাশ। দ্যাখলাম কিছু নাই। শ্মশান হয়া গ্যাছে। ছাই ওড়ছে বাতাসে। পোড়া মাংসের গন্ধ। ওপার গ্যালাম না আর। কার জন্য যাব? চোখ দুইটা ব্রিজে ঝুলাইয়া বইয়া রইলাম।
গভীর রাইতে ওরা আইল। ধইরা আনল মানুষ। চোখ বানধা। ব্রিজের ওপর খাড়া কইরা গুলি করল। চিক্কর দিয়া উঠল তারা। কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ আল্লাহ, কেউ হরি। ওই শেষ আওয়াজ। ধপাস করে লাশ পড়ছে নদীতে। আবার ট্রাক ভইরা মানুষ লয়া আয়। মরা মানুষ। ফেইক্কা ফেইক্কা নদীতে ফ্যালে। ভাইসা যায়। এই নদীতে পানি দ্যাখা যাইত না। রক্ত ছিল। লাশের ওপর লাশ ভাসত।
কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করল পাগল। তন্ময় হয়ে শুনছে অভি। কালির জামাই দৌড়াইতে শুরু করল। পালাইতে চাইল। পারল না। পুলের ওখান থেকে ধইরা লইয়া গ্যাল। ফিরল না আর। খবরও হইল না। হয়তো ভাইসা গ্যাছে। কত মানুষ লাশ হইল চোখের সামনে। মানুষ দ্যাইখা মানুষ ডরাইত। রান্ধা ভাতও খাইত পারত না। গলা দিয়া নামত না।
ধরে আসছে পাগলের গলা। বলতে পারছে না আর। খানিক পরে আবার শুরু করল। আমাগো পাশের ঘরখানা আছিল শোভার। সেই রাইতে পোলাপান লইয়া বাইর হয়া দৌড় দিছিল। পুলের ওই মুড়ায় গ্যাছে, আগুন জ্বলছে ঘরে। ভয়ে লাফায়া পড়ল নদীতে। হপায় এপার আয়া উঠছে। অমনি ধুমায়া গুলি। বাঁচতে পারল না। নদী সাঁতরাইল বৃথা। লাশ ভাইসা গেল।
সেদিন সবাইরে মাইরা ফ্যালত। যারা মাটিতে শুয়ে পড়ছিল তারা রক্ষা পাইল। গোলাপির জামাইর খুলি উইড়া গ্যাল। আঃ! ফকির চানেরে ধইরা নিল। আবার ছাইড়া দিল। ক্যান জানি মারল না।
মুখ ঘুরিয়ে বিলের দিকে তাকিয়ে পাগল বলল, এই বিলে কত লাশ ভাসছে। কত লাশ দ্যাখছি। একদিন অনেক মানুষ ধইরা আনল। ব্রিজের ওপর দাঁড় করাল, গুলি করবে। একজন ব্রিজের ওপর দিয়া লাফ দিল। তারে আর পাইল না। ভাইসা ব্রিক ফিল্ডের দিকে গ্যাল। হামাগুড়ি দিয়া উইঠা কইল, আমারে বাঁচাও, বাঁচাও। দূরের ওই বড়দেশী গ্রামের মানু নৌকা লইয়া আইয়া তারে বাঁচাইল।
সেই লোকটা আমার বাবা নাকি? প্রশস্ত মুখে জানতে চাইল অভি।
পাগল থ। তা জানি না।
উনি কোথায় আছে জানেন?
মাথা নাড়ল পাগল। না, জানি না। তবে তোমার বাবা হইব না।
কী করে বুঝলেন? হতেও তো পারে।
তাহলে বাড়ি ফিরতেন।
হয়তো পথ হারায়া ফেলছেন। তাই ফেরতে পারেননি।
এবার পাগল চুপ। ছেলে ভাবতে চায় বাবা বেঁচে আছে। স্বপ্ন দেখতে চায় বাবা ফিরবে। মিথ্যা স্বপ্ন। বেদনায় ভারী হয়ে গেল বুক। অনেকক্ষণ পরে বলল, শোনোÑ এ ব্রিজটা ছিল কসাইখানা। সারা রাত মানুষ কাটত। রাইত পোহালে সেই রক্ত ধুয়া ফ্যালত বিহারিরা। লাশ ভাইসা যাইত নদীতে। মানুষের সেই চিৎকার আজও শুনি। বাঁচাও বাঁচাও কইয়া চিৎকার করছে। বাঁচাইতে পারি নাই। ওদের মুখ হারায়া গ্যাছে আগুনের প্যাটে। ছাই হয়া গ্যাছে। নদীতে ভাসাইয়া দিছি ছাই। আকাশে উড়ায়া দিছি। তাই নদীর পাড়ে বইয়া থাহি।
এরপর পাগল উঠে দাঁড়াল। নদীর পারে নেমে এক মুঠো মাটি তুলে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। অভির চোখ পাগলের মুখে। ভাবছে মাটি দিয়ে কী করবে পাগল। সেই মাটি অভির হাতে দিল।
কী করব? জানতে চায় অভি।
বাবাকে খুঁজছ না, এই তোমার বাবা।
অভি অবাক। সে দেখছে মাটি। পাগল বলছে বাবা। কেমন কথা। পাগল বলল, তোমার বাবা মিশে আছে এই মাটিতে, পানিতে, আকাশে, বাতাসে। তুমি যেখানে যাবে সেখানে দেখবে বাবার মুখ। তোমার বাবা মানেই বাংলাদেশ।
চার.
ঊর্মি অস্থির। আজ তার মন খারাপ নেই। কত কথা বলছে। মায়ের চোখে জল। জমে গেছে বুক। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। দুপুর হারিয়েছে বিকালের পেটে। ফেরেনি অভি। মায়ের চিন্তা বাড়ছে। ছেলেটা কোথায় গেল? তখন বেজে উঠল কলবেল। দরজার দিকে হাঁটলেন মা। তারও আগে ছুটে গেল ঊর্মি। উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে সে। দরজা খুলে দেখল ভাই আর চাচা। সেই হাসিটা হারিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল ভাইয়ের গলা। কেঁদে উঠল শব্দ করে। তুই যে বললি বাবাকে নিয়ে আসবি? তা বাবা কোথায়?
কথা বলতে পারছে না অভি। চোখের জলে ভাসছে গাল। ঊর্মিও কাঁদছে। চাচার সেই পাথর মুখেও জলের স্রোত। অনেকক্ষণ পরে ঊর্মিকে ছেড়ে দাঁড়াল অভি। হাতে দিল সেই মাটির দলা।
ঊর্মি অবাক। এটা কী?
এর মধ্যে আছে বাবা। দেখবি মাটি। কিন্তু খুঁজলে বাবাকে পাবি। সবাই দেখবে না। তুই দেখবি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল মাটি আর পানি বাবার শরীর। যেখানে যাবি সেখানেই দেখবি বাবার মুখ। আকাশের দিকে তাকালে, ওই পতাকায়, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বাবা।
চোখ মুছে সেই মাটির ওপর চোখ রাখল ঊর্মি। দেখছে একটা মানচিত্র। তার ওপর বাবার মুখ। এই মাটিতেই তাহলে বাবা আছে। চুমু খেয়ে ফিক করে হেসে উঠল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন মা। ঊর্মি হাসছে! এই যে কাঁদল। তাহলে বাবাকে খুঁজে পেয়েছে!