আলমগীর মাসুদ
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪০ পিএম
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪৯ পিএম
ধর্মনগরের বাণী শুনতে শুনতে একদিন চাঁদের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আব্বাকে ডাক দিই। চাঁদের পাহাড় বলতে সে রাওয়ালপিন্ডি। মুক্তিযুদ্ধের আগে জলের ওপর সাঁতার কেটে অথবা ভাসমান ট্রেনে মানুষ পৌঁছে যেত। এটা মুক্তিযুদ্ধের আগের কথা হলেও মারা যাওয়ার আগে দাদা মাঝে মাঝে বলতেন, তখন নাকি মানুষের এত এত পরিচয় ছিল না। পোশাকের ক্ষমতাও ছিল না। সীমানায় তারকাঁটা তো নয়ই, হোয়াইট হাউস আর বঙ্গভবন কিংবা আজকের সংসদও এতটা গুরুত্ব ছিল না। দল বলতে একগুচ্ছ শব্দ উচ্চারণ হতোÑ তুমি আমি, আমি তুমি।
জলে আর ট্রেনে উপোস থেকে আমিও পৌঁছে গেলাম রাওয়ালপিন্ডি। আব্বা কদিন আগেই করাচি থেকে বদলি হয়ে রাওয়ালপিন্ডি এলেন। একবার মায়ের মুখে শুনেছি, করাচিতে চাকরি হলে নাকি আব্বা দেশে ফেরেন না। রাওয়ালপিন্ডি আসার পর ভুলে গেছি মাড়ভাতের কথা। মা ধর্মের বাণীতে রোজ নিয়ম করতেনÑ গোটা দিনে একবারের বেশি ভাত খেলে গুনাহ হয়। তাই স্রষ্টার শাস্তির ভয়ে মা যা যা শিখিয়েছেন রাওয়ালপিন্ডি আসার পরেও তা ভুলতে পারিনি।
আব্বা সাচ্চা মানুষ ছিলেন মাঝে মাঝে এটাও মা আওড়াতেন। একদিন সন্ধ্যার পর আব্বা আর আমি রুটি খেতে বসলে মনে পড়ে মায়ের মুখ। কত সময় মায়ের উপোস থাকার কথা আব্বাকে বললে, ঠাটাপড়া বৃষ্টির মতো আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে চোখের জল ছেড়ে দিলেন। আব্বা দাঁড়িয়ে যাওয়ায় আমি আর কামড় দিইনি রুটির শরীরে। কারণ একটাই, আব্বা চোখের জল ফেলতে পারেন এই প্রথম তা খেয়াল করলাম!
ঘ. আমি কি আর এত অল্প সময়ে রাওয়ালপিন্ডি শহর চিনে উঠেছি। না, চিনে উঠতে পারিনি বলে আব্বার বন্দি জায়গা লুয়ালয় বন্দিশিবির তখনও আবিষ্কার করতে পারিনি। এ আবিষ্কার করতে না পারলেও বন্দি হওয়া আব্বার অপরাধটা জানতে পারি। আব্বা বাঙালি, বাংলা তার মাতৃভাষা এটাই তার অপরাধ। আরও বড় অপরাধ আব্বা পূর্ববঙ্গের একজন সেনাসদস্য। অতএব সব সৈন্যের সঙ্গে আব্বাও হলেন যুদ্ধবন্দি বাঙালি। মুহূর্তে অশ্রু, হাহাকার, ব্যথা আর ঘৃণিত আর্তনাদের সঙ্গে আমার ভেতর জেগে ওঠে প্রতিশোধস্পৃহা। কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আব্বাকে নজরবন্দি করে!
আজ আব্বার প্রতি আমি লজ্জিত। পাঞ্জাবিদের পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে সেদিন আমি করতে পারিনি প্রতিবাদ। আজ এটাও অস্বীকার করব না, ক্ষুধাওয়ালারা পৃথিবীতে যেমন স্বাধীনতা খোঁজে, আব্বাকে লুয়ালয় বন্দিশিবিরে রেখে সেদিন দৌড়ে পা রেখেছিলাম আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পথে।