শফিক হাসান
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১৩:৩৩ পিএম
প্রায় সব মানুষের বুকে একটি নদী থাকে। সংবেদনশীল মানুষ বুকের মাঝে জিইয়ে রাখে যে নদী জন্ম-এলাকার; যেটা ভীষণ প্রিয়। তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসকূলে জন্মেছেন যারা, তিতাসপ্রেমে মাতোয়ারা থাকাই স্বাভাবিক। তিতাসের কথা বলায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে নদীবিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনমোহন ছবি, সেখানে বসেই নিভৃতে দীর্ঘকাল সাহিত্য-সংস্কৃতি সাধনা করে যাচ্ছেন একজন ‘কমবয়সি রবীন্দ্রনাথ’ ওরফে জয়দুল হোসেন।
তিতাসকে নিয়ে তিনি লিখেছেন সাড়ে চার ফর্মার আস্ত কাব্যগ্রন্থ। নদীকে বলেছেন ‘মায়ের বুকের দুধের নহর’। এর চেয়ে ধ্রুব সত্য কী হতে পারে! নদী কেন্দ্র করেই উঠেছিল সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর। নদীমাতা জল দিয়ে, পলি বয়ে এনে কৃষিপণ্য উৎপাদনেই সাহায্য করে না শুধু, ফসল-পণ্য আনা-নেওয়াসহ মনুষ্যসন্তানের যাতায়াতেও ভূমিকা রাখে। বুক পেতে দিয়ে আগলে রাখে মানুষকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনার অনুষঙ্গও নদী। নদীজলে শুচি হয় কাতারে কাতারে মানুষ। সামর্থ্যবানেরা ময়ূরপঙ্খী সাজায় নদীবক্ষে। নদীর কোনো অবদানই অস্বীকারের জো নেই।
এত উপকারী নদী কি নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী টিকে থাকতে পারছে? যৌবনবতী নদীগুলো ভাটির পথে; নদীর মৃত্যু ঘটছেই। কোণঠাসা হতে হতে খালে রূপ নিচ্ছে, দুই পারের দূরত্ব ঘুচিয়ে ভরাটও হয়ে যাচ্ছে অবশেষে। নদীকেন্দ্রিক বিস্তার হুমকির মুখে। মমতার চাদর সরে গিয়ে মাথায় পড়ছে শকুন-বাজপাখির কালো ছায়া। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সংবেদনশীল শিল্পীকে ক্ষুব্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক। তাড়না থেকেই জয়দুল হোসেন রচনা করেছেন ‘মায়ের বুকের দুধের নহর’।
দীর্ঘ-হ্রস্ব ১৬টি কবিতার সঙ্গে বইয়ে স্থান পেয়েছে ১৬টি পূর্ণপৃষ্ঠার আলোকচিত্র। কবিতাগুলো শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে ‘ছবিতা’। কাব্যর সঙ্গে ছবি যুক্ত হয়ে রূপ নিয়েছে দৃশ্যকাব্যে। তিতাস নানা ভঙ্গিমায় ধরা পড়েছে।
‘তিতাসের নামাবলি’ কবিতায় নৌকা থেকে দুরন্ত-দিগম্বর দুই শিশুর লাফঝাঁপের আনন্দঘন ছবি বাঙময় হয়ে উঠেছে। আবার ‘নদীর জন্যে আমিই নদী’ কবিতায় একজন মা সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন শিশুপুত্রকে; সামনে দেখা যায় কচুরিপানা, তিতাসের জল ও অন্য পারের গাছগাছালিসংবলিত দৃশ্য। ‘নদী ও নারী’ কবিতার ‘ইলাসট্রেশন’ হিসেবে ব্যবহৃত ছবিতে দেখা যায়, তিতাস থেকে গোসল সেরে কলসিকাঁকে বাড়ি ফিরছেন একজন পল্লীবধূ, অন্য হাতে ধরে রেখেছেন পুত্রসন্তান। পেছনে নদীতে গোসল সারছেন আরও দুজন। ‘নদীবিহীন দেশে কবি’ কবিতায় নৌকার কিনারে বসা জনৈক তরুণীর ছবি দেখতে পাই। পায়েল পরা পায়ে নদীজল স্পর্শের চেষ্টা করছেন। নদীজল ছুঁতে পারাতেও সুখ কম নয়, বিশাল আনন্দ-অনুষঙ্গ। প্রতিটি ছবিই মূর্ত করে তুলেছে তিতাসপারের জনজীবন। দেখা মিলেছে নানা আকারে-আয়তনের নৌকারও। দ্বিমাত্রিক ব্যঞ্জনায় জয়দুল হোসেনের কবিতাগুলোয় যুক্ত হয়েছে নতুন পালক।
অবগাহন করা যাক কবিতা-নদীতে। দুর্বৃত্তের কালো হাত এতটুকু ছাড় দিচ্ছে না নদীকেও। রাজনীতির নামে দখল-লুণ্ঠন চলে সারা দেশে। তিতাসের গতিধারা রুদ্ধ হওয়ার পেছনেও যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পান্ডারাই দায়ী, সেটাই উল্লেখ করেছেন কবিÑ
চলমান রাজনীতি ধ্বংস করতে হবে
তিতাসের গতিধারা প্রবাহিত তবে।
নদী দখলকারীরা অবশ্যই গণশত্রু। ক্ষেত্রবিশেষ এরা দেশবিরোধীও। এদের লোভের গ্রাসে কষ্ট পায় লাখ লাখ মানুষ, গবাদি পশুসহ হরেকরকম প্রাণী; মীনসন্তানেরা তো বটেই। নদীর দুর্দশা ও নেপথ্য কুশীলবরা ধরা পড়েছে দীর্ঘ ২১ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘তিতাসপুরাণ’ কবিতায়Ñ
রাজাকার ছিল যারা একাত্তর সালে
তারাই বাঁধ দেয় নদী-নালা-খালে
তেরোশত নদী আজ কেঁদে কেঁদে বলে
আপন প্রবাহ গতি পাব কোন কালে।
শুধু তিতাস নয়, দেশের প্রায় সব নদীই অভিন্ন দুর্ভোগের ঘেরাটোপে পড়ে আছে। নদীদস্যুদের কদর্য হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না প্রাণপ্রকৃতিও। এককালের প্রমত্ত তিতাস নদী কেন আজ গতিহারা, জীর্ণশীর্ণ? সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানও বাতলেছেন কবিÑ
ফারাক্কায় বাঁধ দিলে তিতাসে প্রভাব
পড়ে তার দুই কূলে নিকাশে অভাব।
নদী নিজস্ব পথে চলতে পারলে নাগরিকের অভাবও থাকত না আর। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের। অতীতের মতো নদীর দুই কূল ছাপিয়ে জল উপচে না পড়লেও মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফিরবে, এতে কোনো সংশয় নেই। অনিষ্টকারী হারমাদকুলকে কবি অভিশাপ দিতেও কসুর করেননিÑ
তিতাসের বুকে জল আসিবে যখন
স্বৈরাচার ভেসে যাবে জোয়ারে তখন।
নদী যখন জলে টইটম্বুর হয়ে উঠবে, তখন দুরাচারী মানুষ ভেসে যাবে জোয়ারে। এমন আশাবাদ তথা ভবিষ্যদ্বাণী ধ্বনিত হয়েছে কবির আকাঙ্ক্ষাভাষ্যে। পাশাপাশি নদীজীবীদের দ্রোহকেও বড় করে দেখছেন তিনি। দুষ্টের দমনের জন্য প্রতিবাদী ভূমিকার বিকল্প নেই।
শ্রমজীবী মানুষের বিলাসী যাপনের স্বপ্ন নেই বললেই চলে। অধিকাংশ মোটা ভাত আর মোটা কাপড়ে সন্তুষ্ট। এটুকু নিশ্চয়তা যদি কোনো সরকার দিতে পারে, নিজেদের কী অধিকার, কীইবা প্রাপ্য এমন ‘বড়সড়’ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় খুব কম প্রান্তিক মানুষই। বিশেষ করে যাদের শরীর বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে শুকায় তাদের প্রত্যাশা কখনোই অত বড় মাপে থাকে না। গ্রামবাংলার সর্বজনীন যাপিত জীবনের এমন চিত্রই এঁকেছেন মানবপ্রেমী কবি জয়দুল হোসেন। যৌক্তিক প্রত্যাশাই করেছেন কবি। নদীতে যদি জল থাকে, ফসল ফলাতে আর সমস্যা থাকে না। আবহমানকাল ধরেই এ বাংলার মানুষ পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে তবেই বসুমতীর কাছ থেকে শস্যকণা ছিনিয়ে আনার প্রয়াসী। প্রথম দীর্ঘ কবিতাটির শিরোনাম তিতাসপুরাণ। সত্যিকার অর্থেই এটি ‘পুরাণ’ হয়ে উঠে নামকরণের সার্থকতা পরিস্ফুটিত করে তুলেছে। তবে গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্র আছে বিস্তর। চিরায়তর মর্যাদা পেয়েছে এমন সৃজনকর্মও কম নেই দেশে বা বিদেশে।
তিতাসবন্দনা কবিতার অষ্টম সর্গে চলমান বাস্তবতার আরেকটি পার্শ্বচিত্র অবলোকন করেছেন কবি। তিতাসতীরের পরিপার্শ্ব বর্ণিত হয়েছে আবেগ-নিরাবেগের বোঝাপড়া দূরে সরিয়ে রেখে।
তিতাসবন্দনা কবিতার ১৩তম সর্গে কবি উল্লেখ করেছেন তিতাসপারের জন্ম নেওয়া অদ্বৈতমল্ল বর্মণ প্রসঙ্গ। তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস তুঙ্গস্পর্শী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। লেখার গুণেই নদীটির নাম শুনলে পাঠকের কানে বেজে ওঠে ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ। বোধকরি সেই মুগ্ধতা থেকেই কবি তার পাঠকদের সঙ্গে নিয়ে প্রদক্ষিণ করতে চাইছেন অদ্বৈতর জন্মস্থান গোকর্ণঘাটেÑ
নিভৃতচারিণী নদী গজমতি নাও
নিয়ে চলো ঘুরে আসি অদ্বৈত’র গাঁও।
‘তিতাসের নামাবলি’ কবিতার চতুর্থ সর্গে কবি কি পাঠককে অতীত থেকে ভ্রমণ করিয়ে আনতে চাইছেন? নইলে পাকা ধান জলে ডুবে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসে কেন? স্রোতহীন তিতাস কোথায় পাবে আগেকার সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ, লন্ডভন্ড করে দেওয়ার ক্ষমতা। কবিতা নামক অকবিতার ভিড় চারপাশে যথেচ্ছ। বিরক্ত-বিব্রত পাঠক তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, অনেক কাব্যগ্রন্থই পাঠ-স্বস্তি কিংবা নতুন কোনো ভাবনার ফুরসত দেয় না। কেবলই যেন কালির অপচয়, শব্দ ক্ষয়ের প্রতিযোগিতা! দীর্ঘ অমানিশা-যামিনী শেষে একটি যথার্থ কবিতার বই পড়ে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেলাম। পাঠান্তে মনে হয়েছে, রঙিন সময় অতিবাহিত করেছি। চিন্তারাজ্যে আলোড়ন তুলতে সমর্থ হয়েছে মায়ের বুকের দুধের নহর। পরিপাটি ছাপা, মুদ্রণ সৌকর্যসহ সবকিছুই নান্দনিক। চিন্তাশীল পাঠক নিরাশ হবেন না, দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি!