× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নক্ষত্রের মৃত্যু কিংবা জীবন উদ্ভাসনের গল্প

শফিক হাসান

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৪১ এএম

আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৫ ১৫:০১ পিএম

নক্ষত্রের মৃত্যু কিংবা জীবন উদ্ভাসনের গল্প

ধ্রুব এষ ও হ‍ুমায়ূন আহমেদÑ বাংলা সৃষ্টিভুবনের দুই মহিরুহ। একজনের নাম উচ্চারণ করলেই আরেকজন চলে আসেন অনিবার্যভাবে। মুকুটহীন জাদুকর-লেখক হ‍ুমায়ূন আহমেদের অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন মহাত্মা ধ্রুব এষ। নিজেও লেখক, প্রচুর বই আছে তার, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাজোকার পরিমাণও কম নয়। কিন্তু প্রচ্ছদশিল্পী নামের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে লেখকসত্তার অনেকখানিই। এটা অপ্রিয় সত্য।

দুই লেখকের মধ্যে প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। বড় মিল হচ্ছে হচ্ছেÑ দুজনই ‘আড়ালপ্রিয়’ আবার পাঁড় আড্ডাবাজ! সেটা অন্য কোথাও নয়, নিজেদের বাসায় আড্ডা জমাতে পছন্দ করেন। হয়ে উঠেছেন আড্ডারু স্বজন-প্রিয়জনদের কেন্দ্রবিন্দু।

কথ্যভাষায় অনেক বাতচিত করেছেন। স্ল্যাংও আছে। রাবীন্দ্রিক ভদ্রলোকের ভাষা আর ‘তরল’ কিংবা ‘ভেষজ’প্রেমী শিল্পীর মুখের ভাষা এক নয়। সেটারই অনন্য নজির স্থাপিত হয়েছে ধ্রুব এষের নাতিদীর্ঘ উপন্যাস ‘মৃত নক্ষত্রের গান’-এ। এটাকে উপন্যাস বলব নাকি বড় গল্প? অথবা এ দুটোর কিছুই না। ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’ স্বপ্ন-বাস্তবের ভেতরেÑ এমনই এক মায়া, ভ্রম, বিভ্রান্তি, মোহ? ছায়া কিংবা মায়া যা-ই বলি না কেন, এ নাতিদীর্ঘ বইয়ে আলোচ্য চরিত্রগুলো বাস্তব। তারা অনেকেই আমাদের চেনাজানা প্রিয়জন। সশরীরে না চিনলেও পড়ুয়া বা দেখুয়া সমাজ তাদের নাম জানে। এ হদিসটুকুও রাখেন এরা আর দশজনের মতো নন, একটু আলাদা। অবশ্য শিল্পীকে কিঞ্চিৎ আলাদা হতেই হয়, নইলে কীসের শিল্প-সৃষ্টি, নবতর মাত্রা পাবে কীভাবে! প্রশ্ন হতে পারে, শিল্পীর জীবনপ্রণালি কতটুকু আলাদা হতে পারে। কেনই বা অন্যরকম হতে হয়, পেরোতে হয় গতানুগতিকতার বাইরের কণ্টকাকীর্ণ পথ।

মূলত ধ্রুব এষ ও তার সতীর্থ-স্বজনদের নিয়েই বেজেছে ‘মৃত নক্ষত্রের গান’। গল্পের শেষ দিকে একটা মৃত্যুর খবর মেলে বটে, লেখকের ভাষ্যেÑ ‘আমাদের নেক্সট রকস্টার পাপ্পু’। এ পাপ্পু উপন্যাস যাত্রাপথের প্রায় পুরোটাই গান শুনিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন। সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা দিকে নেতৃত্ব দেওয়ার খবরও আমরা পাই। কথা হচ্ছে, এই এক মৃত্যু দিয়েই কি বইয়ের নামকরণ সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হয়? মনে হয় না। বেশি বলা হয়েছে জীবিত নক্ষত্রের কথাই। আমরা সাধারণ মানুষ কিংবা এসব নক্ষত্র প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছি না? মানুষ মরে নানাবিধ অবহেলায়, অর্থ ও ভালোবাসার অভাবে।

এ নক্ষত্ররা আদতে কতটুকু ‘নক্ষত্র’, কেমন আলো দিচ্ছেনÑ এমন প্রশ্ন তোলা বাতুলতা বইকি। বইয়ের অন্যতম নক্ষত্র ধ্রুব এষকে এখানে পাই ‘আশান ভাই’রূপে। বাকি নক্ষত্রের অন্তত তিনজন অঙ্কনশিল্পী। এরা প্রচ্ছদ আঁকেন, ইলাসট্রেশন করেন পত্রিকা ও বইয়ের জন্য। মাসুক হেলাল, উত্তম সেন, মামুন হোসাইন থাকেন উল্লেখযোগ্য পরিসরজুড়ে। এর বাইরে একঝাঁক কবি ও লেখকের স্কেচও পাঠক হিসেবে আমরা পাই বইয়ের বিভিন্ন সর্গে। বুলবুল চৌধুরী, মাহবুব রেজা, টোকন ঠাকুর, রেজা ঘটক, পুনম, রুপাইÑ এমন পরিচিত মুখ ও নাম আসে ঘুরেফিরে। আসে নাটক ও চলচ্চিত্রের কথকতা। দশকের ছেঁড়াপাতার কিছু সান্নিধ্যও মেলে।

এ উপাখ্যানের বাইরেও মামুন হোসাইনের স্ত্রী পুনম ও মেয়ে রুপাইয়ের সঙ্গে পরিচিত। এমনকি উত্তম সেনের চরিত্রবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল। তাই ছাদ-আড্ডার মাঝেই যখন শুনি শিল্পীকে আশান ভাইয়েরা ডাকেন ‘তরলদা’ সম্বোধনে, মর্মাহত না হয়ে উল্টো ব্যাপকভাবে বিনোদিত হই।

পরিপার্শ্বের ‘নক্ষত্র’দের যতই আলো ঝলমলে দেখাক, শেষ বিচারে তারা দোষে-গুণে নিজস্ব রুচি ও জীবনবোধেরই মানুষ। দূরের নক্ষত্রের সঙ্গে পার্থক্য এখানেই। ধ্রুব এষ তথাকথিত ভদ্রলোক মুখোশ এঁটে রাখেননি। অকপটে বলেছেন প্রচুর ‘অন্ধকার-কথা’। তুবড়ি ছুটেছে স্ল্যাংয়ের। এর সবই গল্প নাকি গল্পকে গল্প করে তোলার তাগিদে রয়েছে কিছু ইল্যুশন? আমরা জানি না। জানাটা অতটা জরুরিও নয়। যেহেতু কোথাও লেখা নেই আত্মজৈবনিক উপন্যাস কিংবা ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’। বাংলাদেশের রহস্য-রোমাঞ্চ-অলৌকিক সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টরি সেগুনবাগিচায়, সেবা প্রকাশনী। আর এ সেবাশুশ্রূষার কাছের মানুষের একজন ধ্রুব এষ। সেই সুবাদে প্রহেলিকা সৃষ্টির অধিকার নিশ্চয়ই তার আছে। কিন্তু না, এটাকে অমীমাংসিত প্রশ্ন মেনে নিয়েই আমরা বরং বইয়ের শেষ ফ্ল্যাপে চলে যাই। সেখানে ব্যবহৃত মাহফুজা জেসমিনের তোলা ধ্রুব এষের আলোকচিত্রের সঙ্গে বাড়তি একটা প্রশ্নও পেয়ে যাই। ‘বিবেক কোথায়?’ এমন ঘাই-মারা প্রশ্নে তাড়িত হতে হতে পড়ে ফেলি লেখকের সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র। নাতিদীর্ঘ ফ্ল্যাপ শেষ হয়েছে এভাবেÑ ‘ধ্রুব এষ না বানিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করেন।’

বহু গল্প, জীবন-জটিলতার আখ্যান শুনতে শুনতে উপস্থিত হই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে, ৩১তম পৃষ্ঠায়। এখানে প্রথমবারের মতো উপশিরোনাম যুক্ত হয় ‘কয়েক বছর পরে যাই’। ৩৬তম পৃষ্ঠায় ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাই ‘আরো কয়েক বছর পরে যাই’। ৪৩তম পৃষ্ঠায় সপ্তম অধ্যায়ে আবার আসে ‘আরো কয়েক বছর পরে যাই’। এভাবে বছর পার করতে করতে পৌঁছাই বইয়ের শেষপ্রান্তে, ৪৮তম পৃষ্ঠায়। এবার আর অধ্যায়ের কোনো সংখ্যা নেই। তবে পূর্ববৎ বোল্ড-করা উপশিরোনাম আছে ‘আরো কয়েক বছর পরে যাই’। শেষ দুই লাইনে সেখানে লেখা হয়েছেÑ

‘আজ রবিবার। এখন সন্ধ্যা।

কেউ নাই, কিছু নাই, আর কোনো গল্প নাই।’

প্রাসঙ্গিকভাবে এবার গল্পের শুরুতে জাম্প করি আমরা। কী বলা হয়েছে সেখানেÑ

‘আজ রবিবার। এখন সন্ধ্যা।

যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে

সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া...

তেমন সন্ধ্যা নামে পৃথিবীর কোথাও এখনো।

এখানে না।’

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সঙ্গে ধ্রুব এষের নিজস্ব বয়ান মিশে গেছে উল্লিখিত পাঁচ পঙ্‌ক্তিতে। এখানকার সংগীত থামে, এমন দাবিই করেছেন লেখক। গল্পের শুরু রবিবার সন্ধ্যায়, শেষও একই সময়ে। মাঝখানের সময়টুকু জীবন-ব্যবচ্ছেদের। কেমন জীবনের গল্প বলা হয় এ পাঁচ পঙ্‌ক্তির পরে? ‘থিম’ বোঝার জন্য পরের চার পঙ্‌ক্তিতে ঢু মারা যাকÑ

‘সন্ধ্যার পরে আমরা ছাদে বসে থাকি।

ধোঁয়া ওড়াই, নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু ওড়াই।

ঝিম মারি। কথা কম বলি।

রুটিন।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা দিয়ে যে বইয়ের সূচনা, সেটার নামকরণ আবার জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে। জীবন-রবি যেখানে মিশে যায়, সেখানে বারবার ফিরে আসতেই পারে রবিবার। হানা দেয়, ডানা ঝাপটায়। জীবনের লেনদেন ফুরানো মানেই তো মৃত নক্ষত্রের গান বেজে ওঠা! জীবনসংগীতের নীরব প্রস্থান ঘটা।

এটা আপাত অগভীর কথার দীপ্তিময় উপন্যাস। এর চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা দুরূহ। কেবলই উপলব্ধি, অনুভব-এষণার। কাগজের সাহিত্য সম্পাদকের ভ্রূকুটি দেখার আশঙ্কা তাই রয়েই যায়। তাই বলে বসতে পারেন, ‘নবান্ন প্রকাশনীর এ বইয়ে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ রয়ে গেছে। সতর্ক থাকা উচিত ছিল।  অমুক প্রকাশনা থেকে কম দামে পরিপাটি বই তুলে দেওয়া হয় পাঠকের হাতে। বই আলোচনার নামে এমন অপ্রাসঙ্গিক বাতচিত না করলে কী হয়? এসব কি কেবল অকারণে শব্দসংখ্যা বাড়িয়ে আলোচনার নামে বগিজগি মার্কা কিছু একটা গছিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা!

 

মৃত নক্ষত্রের গান

ধ্রুব এষ

প্রকাশক : নবান্ন প্রকাশনী

প্রচ্ছদ : রজত

প্রকাশকাল : অক্টোবর ২০২৪

মূল্য : ১৭০ টাকা

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা