× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইবনে আল-হায়সাম

ক্যামেরা যার কাছে ঋণী

সুদীপ্ত সালাম

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৩৭ এএম

আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৫ ১৩:০৩ পিএম

ঊনবিংশ শতাব্দীর ড্যাগুয়্যারোটাইপ ক্যামেরা

ঊনবিংশ শতাব্দীর ড্যাগুয়্যারোটাইপ ক্যামেরা

‘সেলেনোগ্রাফিয়া’ বা ‘চাঁদের বর্ণনা’ শিরোনামে ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে একটি বিখ্যাত বই মুদ্রিত হয়। মাইলফলক বইটি লিখেছিলেন পোলিশ জ্যোতির্বিদ জোহানেস হেভিলিয়াস। তিনি দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে চাঁদের প্রথম বিস্তারিত মানচিত্র এ বইয়ে তুলে ধরেছিলেন। সে আকরগ্রন্থের নামপত্র বা টাইটেল পেজে একটি অলংকরণ ছিল। অলংকরণে দেখা যায়, বইয়ের শিরোনামের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন জ্যোতির্বিদ। একজন ইতালির গ্যালিলিও গ্যালিলি (ডানে) এবং অন্যজন ইরাকের ইবনে আল-হায়সাম। জ্যোতির্বিদ জোহানেস হেভিলিয়াস কেন গ্যালিলিওর পাশাপাশি একজন মুসলিম জ্যোতির্বিদকে সম্মান জানিয়েছিলেন? কারণ, তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও আলোকবিদ। তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন আলো ও দৃষ্টির ব্যাখ্যায় অভূতপূর্ব অবদানের জন্য। সে অবদান এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, তাকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তার পুরো নাম আবুল মুহাম্মদ ইবনে আল-হায়সাম।

আলো নিয়ে তার সুগভীর গবেষণার ফসল ‘কিতাব আল মানাজির’ (বুক অব অপটিকস) শিরোনামে গ্রন্থ। ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত সাত খণ্ডের এ মহাগ্রন্থে তিনি চোখের দৃষ্টি এবং আলোর গতিপ্রকৃতি ও ধর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি মানুষের দেখাসংক্রান্ত প্রাচীন ধারণাগুলো চ্যালেঞ্জ করেন এবং আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের পথ সুগম করেন। এ বই লাতিন ভাষায় অনূদিত (‘দে অ্যাসপেকটিবস’) হলে ইউরোপীয় রেনেসাঁর পণ্ডিত ও শিল্পীরা ভীষণভাবে প্রভাবিত হন। তাদের মধ্যে জোহানেস কেপলার, রেনে দেকার্ত, রজার বেকন, ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস অন্যতম।

মার্কিন দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ পিটার অ্যাডামসের মতো আরও অনেকে মনে করেন, আমাদের দৃষ্টি কীভাবে কাজ করে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রথম হাজির করেছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে আল-হায়সাম। তিনিই দেখিয়েছিলেন, আলো যখন কোনো বস্তুর ওপর পড়ে তখন বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পৌঁছায়, আর তখনই আমরা বস্তুটি দেখতে পাই। শুধু তাই নয়, তিনি আলো ও রঙ নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এ দুইয়ের সঙ্গে চোখের আন্তঃক্রিয়াও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। একই বইয়ে ইবনে হায়সাম ‘ক্যামেরা’র তত্ত্বটিও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

                                                                                                                          ইবনে আল-হায়সাম

আলোকবিজ্ঞান প্রসঙ্গে ইবনে আল-হায়সামের নামটি উচ্চারিত হলেও ক্যামেরার তাত্ত্বিক আলোচনায় তার নাম খুব বেশি শোনা যায় না। সম্ভবত প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যের বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী। জ্ঞানবিজ্ঞান র্চায় প্রাচ্যের অবদান পাশ্চাত্য নানাভাবে অস্বীকারের চেষ্টা করেছে। অস্বীকার করা না গেলেও প্রাচ্যের পণ্ডিতদের নামগুলোর লাতিন অনুবাদ (নাকি বিকৃতি?) করা গেছে। ফলে নামগুলো দেখে বোঝার উপায় থাকে না কে প্রাচ্যের আর কে পাশ্চাত্যের। ইবনে আল-হায়সামের বেলায়ও তা ঘটেছে। পাশ্চাত্যে তিনি এখন ‘আলহাজেন’ নামে পরিচিত!

বলছিলাম ক্যামেরার ইতিহাস থেকে ইবনে হায়সামের নাম প্রায় উধাও। যদিও আজকের আধুনিক ক্যামেরার পেছনে ১ হাজার বছর আগের এ বিজ্ঞানীর বিশেষ অবদান রয়েছে। ক্যামেরা ইতিহাসের গোড়ার আলোচনায় সাধারণত ঘুরেফিরে আসে ইতালিয়ান রেনেসাঁর দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও শিল্পীদের কথা। তারপর স্মরণ করা হয় ফরাসি বিজ্ঞানী জোসেফ নাইসেফর নিপস, লুই ড্যাগুয়্যার, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফক্স টলবটসহ আরও অনেক বিজ্ঞানীকে। কিন্তু ক্যামেরার ইতিহাস তো আরও দীর্ঘ!

‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’ হলো আজকের ক্যামেরার পূর্বসূরি। এর অর্থ অন্ধকার কক্ষ (লাতিন)। প্রাচীনকালে একটি অন্ধকার ঘরে একটি ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে আলো ফেলা হতো। এভাবে বাইরের কোনো দৃশ্যের একটি উল্টো শুভ্র প্রতিবিম্ব অন্ধকার ঘরের (ছিদ্রের অন্য দিকের) দেয়ালে পড়ত। সূর্যগ্রহণ দেখতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। আধুনিক ক্যামেরা সে পদ্ধতি মেনেই কাজ করে। এ ‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’র উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় মোজি নামে একজন চীনা দার্শনিকের সাহিত্যে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষ থেকে চতুর্থ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত সক্রিয় থাকা এ চীনা দার্শনিকই মোহিবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। যা হোক, মোজি চোখের ক্ষতি না করে সূর্যগ্রহণ দেখার উপায় হিসেবে ‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’র কথা তুলেছিলেন। মোজির পর অনেকেই ক্যামেরা অবস্কিউরাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, তাদের একজন গ্রিক দার্শনিক ও চিন্তক অ্যারিস্টটল। কিন্তু সম্ভবত পুরোপুরিভাবে বুঝেছিলেন ইবনে হায়সাম। তিনি চোখের ওপর উজ্জ্বল আলো ও রঙের প্রভাব বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, যেহেতু উজ্জ্বল আলো চোখের যন্ত্রণার কারণ, সেহেতু চোখ বাইরে থেকে আলো গ্রহণ করে, নিজে কিছু সরবরাহ করে না। আলো কীভাবে কর্নিয়া থেকে চোখের লেন্স হয়ে অপটিক নার্ভে পৌঁছায়, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি সফল হয়েছিলেন। আলোকচিত্রবিদ্যা এ নীতিগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।

লেন্স নিয়েও তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। অনেকের দাবি, লেন্সের প্রথম বাস্তব মূল্যায়ন তিনিই করেছেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে প্রথম চশমা আবিষ্কৃত হয়, কিন্তু তার আগেই তিনি কাগজে-কলমে দেখিয়েছিলেন উত্তল লেন্স বস্তুর ছবি বড় করার ক্ষমতা রাখে।

দৃষ্টি ও আলোকবিজ্ঞানে ইবনে আল-হায়সামের ভূমিকা অপরিসীম। তাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপটিক্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক চার্লস ফ্যালকো যথার্থই বলেছেন, ‘ভিজ্যুয়াল জ্ঞান শুধু ইমেজ ও ছবির গল্প এবং প্রতীকী গুণাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আলো এবং ভিজ্যুয়াল সিস্টেমের বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত... এ ধারণা পাওয়া যায় একাদশ শতকের আরব পণ্ডিত ইবনে আল-হায়সামের কাজের মধ্যে।’

অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে ইসলামের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। আর ৬৫০ থেকে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ইরাকের ‘স্বর্ণযুগ’। তখন ছিল আব্বাসীয় খেলাফত। ইবনে আল-হায়সামের আবির্ভাব ইসলাম ও ইরাকের সেই স্বর্ণযুগে। তার জন্ম ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরায়। তিনি স্বর্ণযুগের ফায়দা পুরোপুরি নিয়েছেন, জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। প্রথম জীবনে বসরায় কাজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি বিজ্ঞানচর্চাকে করেন ধ্যানজ্ঞান। জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়েছেন মিসরের কায়রোয়। তিনি কীভাবে ইরাক থেকে মিসরে গেলেন তা নিয়ে একটি চমকপ্রদ গল্প আছে। তিনি ঘোষণা করলেন, সুযোগ পেলে তিনি নীল নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের সমাধান দিতে পারবেন। তার এ দাবির কথা মিসরে সে সময়ের ফাতেমি খলিফা (ইমাম) আল-হাকিম বি-আমর আল্লাহর কানে পৌঁছায়। সমাধান পেতে তিনি ইবনে হায়সামকে কায়রো আসার আমন্ত্রণ জানান। নীল নদে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে ইবনে হায়সাম মিসরে পৌঁছান। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে বুঝতে পারেন, এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তিনি জানতেন, মিসরের আল-হাকিমকে এ কথা বলা যাবে না। বললে তার গর্দান যেতে পারে। তিনি তখন পাগলের ভান করেন। তিনি জানতেন, খলিফা একজন পাগলকে শাস্তি দেবেন না। তাই হয়, কঠোর শাস্তির বদলে ইবনে আল-হায়সামকে গৃহবন্দি করা হয়, যাতে পাগলের কারণে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ইবনে হায়সাম টানা এক দশক কায়রোয় গৃহবন্দি ছিলেন। তবে এ বন্দিজীবন তার জন্য শাপেবর হয়। সে সময়ই তিনি লিখে ফেলেন বিজ্ঞানের প্রচলিত অনেক ধারণা ওলটপালট করে দেওয়া গ্রন্থ ‘কিতাব আল মানাজির’ বা ‘বুক অব অপটিকস’। এটিসহ তিনি কমপক্ষে ৯৬টি বই লিখেছিলেন। তার মধ্যে মাত্র ৫৫টি উদ্ধার করা গেছে। এর অর্ধেক গণিতের বই, ২৩টি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ১৪টি আলোকবিজ্ঞানের। ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কায়রোয় মৃত্যুবরণ করেন। তার সম্মানে চাঁদের একটি ক্ষতর নাম রাখা হয় ‘আলহাজেন’।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা