পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৩৩ এএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫১ এএম
পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্যের ‘বাংলার ডাকাত’ গ্রন্থটি ১৩৭০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের পাঁচটি রচনার একটি মাণিক ঘোষের আত্মকথা। সেই রচনারই অংশবিশেষ আজকের লেখাটি। মাণিক ছিলেন নদীয়া জেলার বিখ্যাত এক ডাকাত সর্দার। ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে দেওয়া মাণিকের জবানবন্দি থেকে লেখক তুলে ধরেছেন কৌতূহলী পাঠকের জন্য। যা অতি মর্মস্পর্শী
“আমি কেন ডাকাত হ’লাম? সে আর আর কি বলবো, হুজুর! আমার বয়স যখন এককুড়ি দুই কি তিন তখন বাবা হঠাৎ খেরেস্তান হয়ে গেলেন। তা যান গিয়ে তিনি। কিন্তু বাড়ীশুদ্ধ সবাইকেই যে তিনি খেরেস্তান বানাবার তাল খুঁজতে লাগলেন। বাবার পয়সায় তখনও খাই পরি বটে বাবার জমিতেই চাষ আবাদও করি। কিন্তু পেটের জন্যে তো আর জাতধম্মো খোয়াতে পারি না। তাই বাবার বাড়ী ছেড়ে পালালাম। গিয়ে পড়লাম একেবারে সেই খিদিরপুরে। সেখানেই আমার ডাকাতিতে হাতে খড়ি।” নদীয়া জেলার নামকরা ডাকাত মাণিক ঘোষ ডাকাত-ধরা সাহেবের কাছে জবানবন্দী করে চলেছে। সে প্রায় একশ বিশ বছর আগেকার কথা। নদীয়ার কয়েকজন দুর্দান্ত গোয়ালা মিলে একটা জবরদস্ত ডাকাতের দল খুলেছিলো। তখনকার দিনের সরকারী কাগজ পত্রে নদীয়ার গোয়ালা ডাকাতের কথা বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে আছে। জেলার গাঁয়ে গাঁয়ে তারা ডাকাতি করে বেড়াত এবং সুযোগ বুঝে নৌকার ওপরও তারা চড়াও হতো। তাদের অত্যাচারের ভয়ে গায়ের লোকেরা আতঙ্কে রাত কাটাতো ও ভগবানের নাম জপ করতো। শেষে একদিন মাণিকের পাপের ভরা পূর্ণ হলো। সে ধরা পড়ে গ্যালো। তখন তার বয়স মাত্র সাঁইতিরিশ কি আটতিরিশ। এইটুকু বয়সেই সে কম সে কম আটতিরিশটি ডাকাতি করেছে ও ডাকাতদের সর্দার বলে নাম মানে দুর্নাম কিনেছে। বুদ্ধিও তার তখন যথেষ্ট পেকেছে। ধরা পড়ার পর বুঝতে আর তার বাকী রইলো না যে এবার আর জাল কেটে বেরোবার উপায় নেই। তাই সে ডাকাত-ধরা সাহেবের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করলো ও আটতিরিশটি ডাকাতির কথাই খুলে বলে গেল। সাহেব সব শুনে হয়তো তাকে রেহাই দেবেনÑএই ছিলো তার আশা। শেষ পর্যন্ত সাহেবের হাতে তার কি হাল হয়েছিলো সে পরের কথা।? এখন তোমরা মাণিকের মুখেই শোনো কয়েকটা বাছা বাছা ডাকাতির গল্প এবং ডাকাতদের হরেক রকম ফন্দী ফিকির ও সংস্কার বা কুসংস্কারের কথা। তবে মনে রেখো একশ বিশ বছর আগে দেশে তেমন ভালো পথ ঘাট ছিল না। জলপথেই লোকজন বেশী যাতায়াত করতো। বেচাকেনার জন্যে মালামালও নৌকো করেই আনা নেওয়া করতে হতো। চোর-ডাকাত ধরার জন্যে পুলিশী ব্যবস্থা যা ছিলো তাও একান্তই নড়বড়ে। তাই ডাকাতদের তখন একেবারে পোয়া বারো।
মাণিক- খিদিরপুরে তখন দু’জন নামজাদা ডাকাতের ঘাটি ছিলো। তারা হলোÑমনোহর ও কুবের। মনোহর আবার আমার একজন আত্মীয়ও বটে। একদিন মনোহর ও আমরা ক’জন মিলে নদীতে চান করতে নেমেছি। হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম যেন মনোহর ও কয়েকজনে মিলে নৌকো লুঠ করার ফন্দী আঁটছে। আমি তখন এসব কাজ কারবার কিছু বুঝি টুঝি না। কিন্তু অল্প বয়স তো বটে ; ভাবলাম দেখিই না ব্যাপারটা কি। মনোহরকে তাই শুধোলামÑ‘ভাই, নৌকো লুঠ করবে নাকি?’ মনোহর বললো-কেন? তুমি যাবে একাজে আমাদের সঙ্গে?’ আমি বললামÑ‘আমি তো জানিই না এসব কাজের রকম সকম।’ মনোহর তখন সবকিছুই আমাকে আগাগোড়া বুঝিয়ে দিলো। আমিও তাদের দলে নাম লেখাতে রাজী হয়ে গেলাম।
সাহেব- ‘এককথায় একেবারে ডাকাত বনে গেলে? আচ্ছা, বলতে পারো দিন দিন কেন ডাকাতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে?’
মাণিক- ‘তা আর বাড়বে না কেন, হুজুর! গরীব গুর্ব্বো লোকেদের ডাকাতি করা ছাড়া আর উপায় কি? বছরের পর বছর অজন্মা চলেছে। চাষীর ভাঁড়ারে যে চাল একেবারে বাড়ন্ত। তাছাড়া সকলেই তো দেখতে পাচ্ছে যে ডাকাতরা বড় একটা ধরা পড়ে না। কালে ভদ্রে যদি বা দু’এক-জন ধরা পড়ে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আর টেকে কটা?’
সাহেব- বুঝলাম! এবার তোমার ডাকাতির কথা আরম্ভ করো।
মাণিক- মনোহর ও কুবের দু’জনই ছিলো ওস্তাদ লাঠিয়াল। তাদের সঙ্গে থাকলে ভয়টা আবার কি? তাছাড়া বয়সও তখন আমার সবে কুড়ি পেরিয়েছে, ইয়া বুকের ছাতি, গায়ে অসুরের বল ; শক্ত হাতে লাঠি ধরতে পারি এবং মাছের মতো সাঁতার দিয়ে নদী এপার ওপার করি। তাই ভাবলাম না খেয়ে মরার থেকে দেখিই না একবার দুবার ডাকাতি করে। প্রথম দিকে দু-চারটে নৌকো লুঠ করে আমি হাত পাকাই। নৌকো লুঠ করার ঝুঁকি অনেক কম। নৌকোর ওপর লোকজন থাকে কম এবং গাঁয়ের লোকেরাও দল বেঁধে ডাকাতদের বাধা দিতে পারে না। আর বেগতিক দেখলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালাবার পথ তো খোলাই থাকে। এই সব কারণেই মনোহর একটি নৌকো লুঠ করার কাজে আমাকে সামিল করে নিলো। মনোহরের সঙ্গে তখন আমি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি ; আমাদের খাওয়া বা থাকার কোনো ঠিক ঠিকানাই নেই। মনোহর একদিন বিকেলে নদীর কোল ঘেঁষে বেড়াচ্ছিলো। চলন্ত নৌকোগুলির মধ্যে মালামাল কি আছে তার খবরাখবর যোগাড় করার মতলব আর কি! এমন সময় একটা নৌকো দেখে তার মনে সন্দেহ জাগে। ব্যাস, সে অমনি নৌকোর পিছু নিতে শুরু করে। বেশ খানিকটা পথ এসে দ্যাখে যে নৌকোটী বারগোড়া বলে এক জায়গায় নোঙর করেছে। নৌকোটী একটী বামুন ঠাকুরের ; ভেতরে যে মালামাল বেশ কিছু আছে এ ব্যাপারে আর তার সন্দেহ রইলো না। তবে আর কি, এবার কাজে লেগে গেলেই তো হয়! কিন্তু লোক কোথায়? সে আর এমন শক্ত কথা কি! মনোহরের ডাকে সেই রাতেই বেশ কয়েকজন লোক জুটে গ্যালো। গভীর রাতের অন্ধকারে আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। মাঝপথে একটা নৌকো থেকে লগি চুরি করলাম। কয়েকটা লগির মুখ ছু’চলো করে বাঁশের বর্শা বানিয়ে নিলাম, আর দু’চারটে-কে কেটে ছেঁটে লাঠি হিসেবে সঙ্গে নিলাম। তখন নিশুতি রাত। গাঁয়ের মধ্যে কোনো সাড়া শব্দ নেই। মাঝে মাঝে শুধু শ্যালের ‘হুক্কা হুয়া’ ডাক শোনা যাচ্ছে।
আমার তো সেই প্রথম কাজ কি না। তাই গা ছম ছম করতে লাগলোÑনা জানি কি হয়! যা হোক আমরা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এসে মাঝ রাত নাগাদ বারগোড়ায় পৌঁছে গেলাম। একে তো জমাট অন্ধকার, তার ওপরে পাড়ের গাছগাছালির কালো ছায়া পড়েছে নদীর জলে। তাই বামুন ঠাকুরের নৌকোটীকে পেরথম চোটে আমরা দেখতেই পেলাম না। কিন্তু মনোহরের চোখ রাতে যেন বাঘের মতন জ্বলতে থাকে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই বামুন ঠাকুরের নৌকোটী তার নজরে পড়ে গ্যালো। তারপরই হামলা শুরু। আমরা আচম্কা নৌকোর ওপর চড়াও হয়ে গেলাম। আমাদের দলে গুরুচরণ বলে একজন পাকা লাঠিয়াল ছিলো। মনোহরের হুকুমে তার ওপরে ভার পড়লো বামুন ঠাকুরকে কাবু করার। আর আমি তার সাথী হলাম। মাঝি মাল্লাদের ভার নিলো সর্দার মনোহর নিজে। সঙ্গে অবিশ্যি তার দলের অন্য লোকজনও ছিলো। আমরা নৌকোর ভেতরে গিয়ে দেখি বামুন ঠাকুর ঘুম ছেড়ে উঠে দাড়িয়েছে ; হাতে তার একটা বেশ মজবুৎ লাঠি। আমাদের দেখে ঠাকুর মশায় হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলোÑ‘দূর হ’ তোরা ; আমার নৌকোয় ডাকাতি করতে এসেছিস তোদের সাহস তো কম নয়।’ গুরুচরণ জবাব দিলোÑ‘ঠাকুর! লাঠি ফ্যালো। ঘণ্টা নেড়ে তুমি চুল পাকিয়েছো ; তোমার হাতে ঘণ্টাই মানায়। আমার সঙ্গে লাঠালাঠি করা সহজ কাজ নয়। বরং যা আছে দিয়ে দাও, আমরাও তাড়াতাড়ি কাজ সেরে পালাই।’ এই না শুনে রাগে বামুনের চোখ জ্বলে উঠলো। তারপর আমি অবাক হয়ে দেখি যে বামুনের হাতের লাঠি যেন উড়ে চলে এলো গুরুচরণের মাথার ওপর। গুরুচরণ কোনোরকমে এদিক ওদিক করে চোটটা এড়িয়ে গ্যালো। শুরু হলো দুজনের লড়াই। গুরুচরণের মুখে রা নেই। বামুন ঠাকুর মাঝে মাঝেই হুঙ্কার ছাড়ছেÑ‘শয়তান, আজ তোকে আমি যমের বাড়ী পাঠাবো, তবে আমার নাম।’ তার হাতের লাঠি এত জোরে ঘুরছে যে গুরুচরণ কিছু ঠাহরই করতে পারছে না। আমিও শুনছি স্রেফ সাঁই সাঁই আওয়াজ। কয়েক মিনিটের মধ্যে গুরুচরণ যেন কেমন কাহিল হয়ে পড়লো। বুঝলাম আর দেরী করলে, গুরুচরণের লাস পড়ে যাবে। তখন আমিও তার সাহায্যে এগিয়ে গেলাম। তাতেও একটুকু দমে না বামুন। বলে কিনাÑ‘আয়, তোকেই আগে সাবাড় করবো।’ হয়তো, করতোও তাই! কিন্তু আমাদের ডাক শুনে মনোহর সর্দার তখন এসে গেছে। তিনজনে মিলে বহু কষ্টে আমরা শেষে বামুন ঠাকুরকে বাগে এনে তার হাতের লাঠি ফেলে দিই। বামুন তখনও গজরাচ্ছেÑ‘লজ্জা করে না তোদের! যদি বাপের ব্যাটা হোস তবে একে একে লড়ে যা আমার সঙ্গে।’ সর্দার বললো, ‘ঠাকুর মশাই, সত্যিই তুমি লাঠি ধরতে শিখেছিলে বটে। কিন্তু এবার ভালোয় ভালোয় যা আছে সব বাড় করে দাও।’ বামুন ঠাকুর তখন নিজের পরণের কাপড়ের গেঁজ থেকে একশো পঞ্চাশ টাকা বার করে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিলো। বললোÑ‘ব্যাটাদের তোরা মরণ বাড় বেড়েছে। বামুনের টাকায় হাত! তোরা শীগ্গীরই ধরা পড়বি ও জেলে পচে মরবি!’ মনোহর হেসে বলেÑ‘ঠাকুর এই কলিকালে আর শাপমণ্যি কিছু ফলে না। তা, দেখি তোমার চালানট।’ চালানটা নিয়ে মনোহর সর্দার গম্ভীরভাবে সেদিকে খানিকট। তাকিয়ে রইলোÑযেন কতোই না সে লেখাপড়া জানে! তারপর গোটা নৌকোটী আমরা তছ্নছ্ করে দেখলাম। কিন্তু টাকাকড়ি আর কিছুই পাওয়া গ্যালো না। চার পাঁচ থলে পেতলের বাসনপত্তর ও কয়েক বস্তা নোতুন কাপড়চোপড় অবিশ্যি আমরা পেলাম। এবং তাই নিয়েই আমরা চম্পট দিলাম।
সাহেব- পুলিশ তোমাদের খোঁজখবর করে নি?
মাণিক- পুলিশ তো সাধ্যি মতো খোঁজ খবর করেই থাকে। কিন্তু আমাদের টিকির নাগাল পেলে তো? আমি একরকম গা ঢাকা দিয়েই বেড়াতে লাগলাম। লুটের মাল বলতেও আমার কাছে কিছুই ছিলো না। আমি আগে ভাগেই সে সব বিক্রিসিক্রি করে চার পাঁচ টাকার মতো পেয়েছিলাম। কিন্তু হুজুর, বামুনের শাপ ফলতে দেরী হয় নি।
সাহেব- কি রকম?
মাণিক- কিছুদিনের মধ্যেই মনোহর ও কুবের একটী মহাজনের নৌকো লুঠ করে। মহাজন থানায় নালিশ করে ও জোর তদন্ত শুরু হয়। দারোগাবাবু লোকমুখে খবর পেয়ে মনোহর ও কুবেরের বাড়ীতে খানাতল্লাসী চালায় ও কিছু কিছু লুঠের গহনাপত্তর উদ্ধার করে। ব্যাস, আর যাবে কোথায়? বিচারে এই দুই সর্দারের পাক্কা নয়-নয়টি বছর করে মেয়াদ হয়ে গ্যালো।
সাহেব- প্রথম ঘর-ডাকাতি কোথায় করলে তুমি?
মাণিক- পেরথম্ ঘর-ডাকাতি? হ্যাঁ, মনে পড়েছে হুজুর। অগ্রোদ্বীপ থানার জগন্নাথ পুরে পদ্মযোগীর বাড়ীতে যে ডাকাতি হয়েছিলো না, সেটাই হলো আমার জেবনের পেরথম ঘর-ডাকাতি। সে ডাকাতিটাও আমো করেছিলাম কেমন যেন ঝোঁকের মাথায়Ñমানে গোড়ায় আমাদেব মতলব ছিলো অন্য রকম।
সাহেব- খুলে বলো সব কথা।
মাণিক আমি তখন পোলতায়। তখনও আমার পুলিশের ভয় কাটেনি। দিনের বেলা তাই বড় একটা বার হতাম না। রেতের বেলা একদিন বেরিয়ে পড়লাম, বংশীর খবর নিতে।
সাহেব- বংশী কে?
মাণিক- ওহো! সে কথা যে বলতে ভুলেই গেছি। কয়েকদিন আগে একটা নৌকো লুঠতে গিয়ে বংশী বেচারা রীতিমত জখম হয়েছিলো। তাই বংশীর খবর নিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু করতে গেলমে এক, আর হয়ে গ্যালো আর এক। খুজে খুজে হাল্লাক হয়ে গেলাম, কিন্তু কোথায় বংশী? এদিকে তখন রাত বেশ বেড়ে গেছে; গাঁগুলিও নিঝুম হয়ে পড়েছে এবং জনমনিষ্যির টিকিটিও আর দেখা যাচ্ছে না। বনের পথ ভেঙে খরপায়ে চলেছি। হঠাৎ খেয়াল হলো-আরে, বনের ভেতরে যেন আলো দ্যাখা যায়।…