হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:২৬ এএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৫ ১২:৫৮ পিএম
অলংকরণ : রজত
‘কবি’ উপন্যাসের নিতাইচরণ ছিল সিঁধেল চোরের ছেলে, খুনির নাতি, ডাকাতের ভাগনে। এ বংশের ছেলে কবি হয়ে গেলে গ্রামের ভদ্রজনেরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল, ‘চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল।’ কবির এ নিতাইচরণ ছিল বাস্তব চরিত্র। এ তথ্যের সত্যতা মেলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যয়ের স্মৃতিগ্রন্থ ‘আমার জীবন-সাহিত্য’-এ। নিতাই হিন্দু সমাজের পতিততম স্তরের ডোমবংশের ছেলে। ডোম সম্পর্কে লেখকের বর্ণনায়, ‘এ ডোমেরা বাংলার বিখ্যাত লাঠিয়ালÑপ্রাচীনকাল হইতেই বাহুবলের জন্য ইহারা ইতিহাসবিখ্যাত। ইহাদের উপাধিই হলো বীরবংশী। নবাবী পল্টনে নাকি একদা বীরবংশীরা বীরত্বে বিখ্যাত ছিল। কোম্পানী আমলে নবাবী আশ্রয়চ্যুত হইয়া দুর্ধর্ষ যুদ্ধব্যবসায়ীর দল পরিণত হয় ডাকাতে। পুলিশের ইতিহাস ডোমবংশের কীর্তিকলাপে পরিপূর্ণ।’
ডোম ডাকাতদের কথা পাওয়া যায় হাসান আজিজুল হকের ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ আত্মজীবনীতে। এ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘রাস্তার পাশে মজা দিঘির জলে যেমন পদ্মবন আছে, তার উঁচু পাড়ের মাথার ওপর তেমনি কালীমন্দিরও আছে। ফাবড়া মারা ডাকাত যেমন জঙ্গলে আছে, তেমনি খাঁড়া হাতে কালীভক্ত বাগদী ডোম ডাকাতরাও আছে। ও রাস্তায় কে আসবে?’ এমনই গা ছমছমে এক দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন লেখক তার এ স্মৃতিকথায়।
কবি উপন্যাসের ডাকাত বংশের ছেলে নিতাইয়ের কবি বনে যাওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করলেও চোর, ডাকাত ও দস্যুদের কাহিনীর প্রতি মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে। পাঠকের পাঠাভ্যাস শুরু হয় মূলত দস্যুদের গল্প পড়ে। আবার নিরক্ষর মানুষেরও মুখে মুখে ফেরে ডাকাতদের জীবনকথা। কেননা বাংলার প্রতিটি অঞ্চলেই রয়েছে এমন দুর্ধর্ষ চোর-ডাকাতের গল্প। অনেক ডাকাতের জীবনকথা হয়ে উঠেছে কিংবদন্তি।
মোহাম্মদ আবুল কাশেমের লেখা ‘দস্যু বাহরাম’, রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের কথা বাঙালি পাঠকমাত্রই জানা। অনেক ডাকাতকে নিয়ে রচিত হয়েছে কিচ্ছা, জারি ও পালা। মৈমনসিংহ গীতিকার চন্দ্রাবতী রচিত ‘দস্যু কেনারামের পালা’র কথা উল্লেখ করা যায়। আবার নেজাম ডাকাতের পালার কথা কে না জানে। ‘নেজাম ডাকাতের কাহিনী’ নামে বুলবুল চৌধুরীর একটি উপন্যাসও রয়েছে। পাবনার সবুর তালুকদারের জারি, যা বাঙালির মুখে মুখে প্রচার হয়েছে। কেননা রোমাঞ্চকর এবং রোমহর্ষক এ-জাতীয় বইয়ের কাটতি ছিল তুঙ্গে। বিক্রি হতো বিভিন্ন গ্রামীণ মেলায়, ওরস-উৎসবে, হাট-গঞ্জে, লঞ্চঘাটে, বাসস্টান্ডে, রেলস্টেশনে এমনকি মাজারেও। দস্যু ডাকাতদের কাহিনী কিচ্ছায় অনেক ক্ষেত্রে নাম চরিত্রের হেরফের হয়েছে এই যা, তবে বিষয় আঙ্গিকতা অভিন্ন। ‘রঘু ডাকাত’ উপন্যাসের প্রিন্টার্স লাইনে লেখা ‘শরচ্চন্দ্র সরকার সংকলিত’। এতে বোঝা যায় এ বইয়ের কাহিনী লেখকের মৌলিক রচনা নয়। রঘু নামে বিখ্যাত এক ডাকাতের অস্তিত্ব ছিল। যাকে নিয়ে তৈরি হওয়া গল্পের ডালপালা জোড়া দিয়ে তিনি এ কাহিনীর বিন্যাস ঘটিয়েছেন। রঘু ডাকাত নিয়ে প্রচুর রচনা রয়েছে সাহিত্যে।
চলনবিলের হান্ডিয়াল গ্রামে মুঘলদের একটি কাচারি ছিল। বিলপারের মানুষের থেকে আদায় করা খাজনা দিল্লির মসনদে পৌঁছাত না। কেননা সে সময় চলনবিলের আয়তন এত বিস্তৃত ছিল যে নৌকায় নিরাপদে ফেরা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। এ বিল তখন ছিল সাগরসমান। চলনবিলের আরেক নাম কালীদহ সাগর বা ক্ষীরনদী সাগর। এ অথই সমুদ্র পাড়ি দিতে বুক ধড়ফড় করত। মুঘল জমাদারদের অর্থ কেড়ে নিত এ অঞ্চলের ডাকাতরা। চলনবিলের রামা, শ্যামা ও বেণী রায় নামে তিন দুর্ধর্ষ ডাকাতের গল্প এখনও কিংবদন্তি। ১৮২৮ সালের ওয়াল্টার হ্যামিল্টনের ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, হান্ডিয়াল গ্রামের চারদিকে ঘন জঙ্গল ও জনশূন্য মাঠ ছিল। যেখানে ডাকাতের নিরাপদ আশ্রয় এবং উপযুক্ত স্থান! চলনবিল অঞ্চলের ডাকাত নিয়ন্ত্রণ করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬ দাঁড়ের ছিপ নৌকা এবং পুলিশ-জমাদারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এ অঞ্চলের ডাকাতরা ছিল ভয়ংকর প্রকৃতির, পুলিশ-গোমস্তাদের তারা ভয় পেত না।
ইতিহাসে উল্লেখ আছে, বেণী রায়ের ডাকাতি দমন করতে এ অঞ্চলে মুঘল সেনাপতি মানসিংহের আগমন ঘটে। বেণী রায় ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ। তার বাড়ি তাড়াশের কহিত গ্রামে। সংস্কৃতজ্ঞ বেণী রায় ‘পণ্ডিত ডাকাইত’ নামেও পরিচিত ছিল। কররানি রাজবংশের দুর্ধর্ষ সেপাই কালাপাহাড় গৌড় বাদশাহের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। এজন্য তাকে হিন্দু-সমাজচ্যুত করা হয়। পরে তিনি কঠোর সমাজ-শাসনের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। অন্যদিকে বেণী রায়ের পত্নীকে পাঠান সেনাপতিরা অপহরণ করেছিল। কিন্তু এজন্য তিনি ধর্ম ত্যাগ করেননি। তবে সংসারত্যাগী হয়ে চেলা বা শিষ্য জোগাড় করে ডাকাত দল গঠন করেন। চলনবিলের মধ্যে কহিত গ্রামে কালীমূর্তি গড়ে সেখানে মুসলমানদের ধরে বলি দিতেন। এজন্য সে জায়গাটি ‘পণ্ডিত ডাকাইতের ভিটা’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে পরিচিত ‘শয়তানের ভিটা’ নামে। বেণী রায়কে বাগে আনা মুঘলদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। বেণী রায় এবং তার দুই প্রধান শিষ্য যুগল কিশোর সান্যাল এবং চণ্ডীপ্রসাদ রায়কে জমিদারি দিয়ে মানসিংহের ভাই ভানুসিংহ একটি সমঝোতা করেন। চণ্ডীপ্রসাদ রায়ের সন্তানরাই ছিলেন শাহজাদপুরের পোতাজিয়ার রায় জমিদার। বেণী রায়কে নিয়ে সত্যরঞ্জন রায় ‘বেণী রায়’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন। চলনবিলের ডাকাত ও জমিদারদের নিয়ে ‘অমানিশা ও রক্তজবা’ নামে উপন্যাস লিখেছেন সাইফুল ইসলাম। প্রমথনাথ বিশীর লেখা ‘চলন বিল’ উপন্যাসে এ অঞ্চলের ডাকাতির কাহিনী রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘চলন দিনমানে অন্ধকারÑকুহেলিতে, বিষবাষ্পে এবং মেঘে : চলন বিল রাত্রিবেলা আলোকিত, শত শত আলেয়ার দ্যুতিতে এবং নিশাচর ডাকাতের ক্ষিপ্রতর ছিপ নৌকার শিকারসন্ধানী দীপ্তিতে; এখানে বিনা মেঘে বৃষ্টি নামে, বিনা ঝড়ে ঢেউ ওঠে, বিনা ঢেউয়ে নৌকা তলাইয়া যায়, আর বিনা সঙ্কেতে কাল বৈশাখীর ঝঞ্ঝার অতর্কতায় দুঃসহ দিগন্তর হইতে ডাকাতের ছিপের বহর নিশ্চিন্ত যাত্রীর ঘাড়ের উপরে আসিয়া পড়ি সর্বস্ব কাড়িয়া লইয়া লুটিয়া পুটিয়া পালায়, যাত্রীর দিকে হাহাধ্বনিকে ডাকাতের হাসি ধিক্কার দিতে থাকে, মানুষের শিকার এখানে মানুষ, পশুতে মানুষে মৈত্রী করিয়া এখানে মানুষ শিকার করিয়া ফেরে। এখানকার সমস্তই বিচিত্র!’
এ উপন্যাসে জোড়াদিঘির মাঠ নামে একটি গ্রামের কথা উল্লেখ আছে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায়ও জোড়াদিঘির মাঠের নাম আছে। এ কবিতাটিও ডাকাত নিয়ে লেখা। ‘রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে/রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।/সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,/এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।/ধূধূ করে যে দিক-পানে চাই,/কোনোখানে জনমানব নাই,/তুমি যেন আপন-মনে তাই…’ হতে পারে এ কবিতার জোড়াদিঘি কবির কল্পনাপ্রসূত।
চলনবিল অঞ্চলে ডাকাতির মালামাল বিক্রি এবং রাখার জন্য থালৎদার থাকত। থালৎদার থেকে অনেকেই জমিদার হয়েছে। প্রমথনাথ বিশীর লেখায় উল্লেখ আছে, ‘এই চলন বিলে রাজশাহী পাবনা অঞ্চলের বহু লোকে ডাকাতি ব্যবসা করিত। তার মধ্যে বহু জমিদার বংশের পূর্বপুরুষ ছিল। তাদের দশটা ব্যবসায়ের মধ্যে ইহাও একটা ব্যবসা, একমাত্র ব্যবসা নয়।’ কালীনাথ চৌধুরীও বলেছেন, ‘রাজশাহী ও পাবনায় এক শ্রেণীর ভদ্র হিন্দু চৌর্যবৃত্তি করিয়া অঢেল ধন সম্পত্তির মালিক হইয়া উঠিয়াছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাহাদের অনেকেই জমিদারী ক্রয় করিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। পরে তাহারা কুলীন বলিয়া নিজেদের মহিমা প্রচার করিত। পাবনা সলপের সান্যাল পরিবার, হরিপুর চৌধুরী পরিবার প্রভৃতি এই শ্রেণীর জমিদার।’
শওকত আলীর ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এ দেখা যায় দস্যুপনা আর অত্যাচারের চিত্র। তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কালে দেশ। সেই পটভূমি নিয়ে লেখা এ উপন্যাসের এক জায়গায় আছে, ‘দস্যু এবং রাজ পুরুষদের উপদ্রব এমনই প্রবল যে বণিকের পক্ষে তিষ্ঠানো কঠিন। দস্যুরা কিছুই বলে না, আকস্মিকভাবে আসে এবং পণ্যসামগ্রী লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। কখনও কখনও প্রহারও করে।’
সেকালে পথিকের আতঙ্ক ছিল ঠগী। ধোঁকাবাজ, প্রতারক গোষ্ঠী সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় শ্রীপান্থের লেখা ‘ঠগী’ গ্রন্থে। বইটির ভূমিকায় শ্রীপান্থ লিখেছেন, ‘এই বইয়ের স্থান কাল পাত্র কিছুই কাল্পনিক নয়। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র, এমনকি পরিবেশ এবং সংলাপও ঐতিহাসিক সত্য। অবশ্য উদ্ধৃতিগুলি কোন কোন ক্ষেত্রেÑশব্দ নয়, বক্তব্যের দিক থেকেই আক্ষরিক। যে সব পুঁথিপত্র এবং রিপোর্টের ভিত্তিতে এ-কাহিনী রচিত হয়েছে।’ ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল ঠগীরা। ১৮৩০ সালেই ঠগীরা প্রায় ৩০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানির ‘তারিখ-ই-ফিরুজ শাহী’ গ্রন্থে ঠগীদের কথা প্রথম জানা যায়। এ ঠগীরা উত্তর ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত, পথে যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত। তারপর সময়সুযোগ বুঝে যাত্রীদের মেরে ফেলে সবকিছু লুট করত।
ডাকাতদের আত্মকথা নিয়ে পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য ‘বাংলার ডাকাত’ নামে একটি বিশদ বই লিখেছেন। লেখক সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে নদীয়া জেলার ডাকাত মানিক ঘোষ এবং মায়াকুল গ্রামের বিষ্ণু ঘোষ, রংপুরের পচাগড় থানার সনাতন সর্দারের কথা লিখেছেন। এ সনাতন সর্দারের আস্তানা ছিল ভেতরগড় নামে এক জঙ্গলে। রাণাঘাটের রানা সর্দার নামে আরও এক ডাকাতের জীবনকথাও তিনি লিখেছেন। কথিত আছে, রাণাঘাটের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতাও এ ডাকাত সর্দার রানা। খুলনা অঞ্চলের আরেক বিখ্যাত ডাকাত অভয়ানন্দ স্বামী। যিনি ঠাকুর ডাকাত নামে পরিচিত ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা ‘বাংলার ডাকাত’ দ্বিতীয় খণ্ডে মনোহর ডাকাতের কথা উল্লেখ আছে। এ মনোহর ডাকাতের কথা আবার পুলিশের কাছে জবানবন্দিতে বলেছিলেন ডাকাত বিষ্ণু ঘোষ। যোগেন্দ্রনাথও ইতিহাস, সরকারি দপ্তরে প্রাচীন দলিলপত্র, বিভিন্ন জেলার ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর-রাজকর্মচারী এবং পুলিশের বর্ণনা থেকে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখেন এ বইটি। এ গ্রন্থে বীরাঙ্গনা দয়াময়ী, গোপী ডাকাতসহ অনেকের কথাই তুলে ধরেছেন।
চোর-ডাকাতের ধর্ম নেই। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখু চরিত্রে। ডাকাত দল বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। এগারো জনের মধ্যে একমাত্র ভিখু কাঁধে বর্শার খোঁচা খেয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসে। সে রাতটি দশ মাইল পথ অতিক্রম করে অর্ধেক শরীর কাদায় ডুবিয়ে শরবনের মধ্যে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে। পরের রাতে আরও নয় ক্রোশ পথ হেঁটে ভিখু চলে যায় চিতনপুরে। আশ্রয় প্রত্যাশা করে পেহ্লাদ বাগদীর কাছে। পেহ্লাদ তাহাকে আশ্রয দেয় নাই। ভিখু তার কাঁধটা দেখিয়ে বলে, ‘ঘাও খান সহজ লয় স্যাঙ্গাৎ। উটি পাকবো। গা ফুলবো। জানাজানি হইয়া গেলে আমি কনে’ যামু? খুনটো যদি না করতিস্-
‘তরেই খুন করতে মন লইতেছে পেহ্লাদ।’
‘এই জন্মে লা, স্যাঙ্গাৎ।’ শেষে মাইল পাঁচেক উত্তরে এক বনে ভিখুর আশ্রয় হয়। সে ব্যবস্থাও করে দেয় পেহ্লাদ।
গহিন অরণ্যে ডাকাত ভিখুর খাবারের জোগানও আসে পেহ্লাদের কাছ থেকে। অথচ ভিখু খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলে মরণ কামড়টা দিল পেহ্লাদের ওপর। আদিম নেশায় মত্ত হয়ে হাত বাড়ায় পেহ্লাদের বউয়ের দিকে। এ তথ্য জানার পর পেহ্লাদ ও তার বোনের স্বামী ভরত মিলে ভিখুকে মেরে আধমরা করে ফেলে দেয় বাড়ির বাইরে। রাতের অন্ধকারে ভিখু কোথায় চলে গেল, কেউ তা জানতে পারেনি। কিন্তু দুপুর রাতে পেহ্লাদের ঘরে আগুন দেয় ভিখু। তার ভাবনা ছিল পেহ্লাদ শোধ নেবে। কিন্তু সর্বস্ব হারিয়েও পুলিশের টানাটানির ভয়ে মুখ ফুটে পেহ্লাদ অভিযোগ পর্যন্ত করে নাই। এখানেই ভিখুর শেষ নয়। সে পুলিশের ভয়ে শহরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি। খেয়ে পরে তার দিনরাত কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার জেগে ওঠে তার আদিম নেশা। হাত বাড়ায় ভিখারিণী পাঁচীর দিকে। তৎসময়ে ভিখারিণী অন্যজনের হয়ে গেছে। ভিখু তা মেনে নিতে পারে না। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ভিখু। পাঁচীর শয্যাসঙ্গী বসিরকে খুন করে আবার এই স্থান ত্যাগ করে।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ছিলেন মহকুমা শাসক। জেলখাটা দুর্ধর্ষ এক ডাকাত সর্দারের সাজা হয়। তখন ওই ডাকাত দস্যুপনা ছেড়ে সৎপথে ফিরবেÑএ উদ্দেশে ক্ষমা চাইলেন মহকুমা শাসকের কাছে। এরপর তিনি তার নিজের ছেলেকে দেখভাল করার দায়িত্ব দিলেন। সেই ডাকাতই ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুর শৈশবের নিত্যসঙ্গী। জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী ওই সর্দারের কাছে শুনেছেন দস্যুবৃত্তির রোমাঞ্চকর কাহিনী। কীভাবে সর্দার অন্ধকার রাতে মশাল হাতে নিয়ে ঘুমন্ত গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ করত। আরও কত কত গল্প। যা শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতেন বালক জগদীশচন্দ্র। ডাকাত সর্দার হয়ে ওঠেন খুব বিশ্বস্ত। একবার নৌপথে জগদীশচন্দ্র বসুর পরিবার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। তখন রক্ষা করেন সেই ডাকাত সর্দার।
এভাবেই বাংলা সাহিত্যে বারেবারে ডাকাত ও দস্যুদের কথা এসেছে নানারূপে। যেখানে তাদের নৃশংসতার সঙ্গে উঠে এসেছে অতিমানবিকতারও গল্প।