আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৪১ এএম
হাসান আজিজুল হক। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১। প্রতিকৃতি : জয়ন্ত সরকার
২০১৪ সালের মার্চ। কলকাতা থেকে এসেছিলেন কবি মৃণাল বসুচৌধুরী, শ্যামল কান্তি দাস ও কথাসাহিত্যিক সচীন দাস। তারা হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আড্ডা দিতে চান। ১৬ মার্চ সকালে হাসান আজিজুল হকের বিহাসের বাসা উজানে আড্ডা হবে। আয়োজনের ভার আমার ওপরে। সকালে তাদের নিয়ে হাজির হলাম উজানে। সঙ্গে শ্যামল কান্তি দাসের স্ত্রী ছিলেন। তারা সবাই হাসান আজিজুল হকের পরিচিত। জমপেশ আড্ডা। শ্যামল কান্তি দাস আর সচীন দাসই হাসান আজিজুল হকের স্মৃতি নিংড়ে নেওয়ার জন্য কথা এখান থেকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হাসান আজিজুল হক অর্ধেক বলেন, অর্ধেক হাসেন। কিছুটা হাসির ভেতরেই হারিয়ে যায়। বুঝে নিতে হয়। সেদিন যেন উজানে হাসির হাট বসেছিল। টি টেবিলে মিষ্টি দেওয়া ছিল। কারও সেদিকে খেয়াল ছিল না। কী বলছেন হাসান আজিজুল হক, সবার মনোযোগ সেদিকেই। আড্ডার এক ঘণ্টার আলাপ আমি মুঠোফোনে ধারণ করেছিলাম। সেখান থেকে কপি করে শ্যামল বাবুকেও দিয়েছিলাম। অনেক প্রসঙ্গ। এ লেখা তার কিছু অংশ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের যবগ্রামে হাসান আজিজুল হকের শৈশব কেটেছে। আড্ডার শুরুতেই গ্রামের কথা।
আমাদের গ্রামের স্কুলটা কিন্তু ওই এলাকায় বিখ্যাত ছিল। তার কারণ, কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর স্ত্রীর নামে স্কুলটা। মহারানী কাশীশ্বরী দেবী। কাশীশ্বরী স্কুল। তার নামে বহরমপুরে কলেজ আছে।
Ñকাশীশ্বরী স্কুল আছে।
তাহলে দুটোই আছে। স্কুলও আছে, কলেজও আছে। কাশীশ্বরী আমাদের গ্রামের মেয়ে এবং যতদূর জানি, ওরা কাস্টের দিক দিয়ে অন্য মানে নিম্ন ছিল। ওই কাস্টের যোগ্য পাত্রী জোগাড় করা খুব মুশকিল ছিল। কাশীশ্বরী নাকি খুব সুন্দরী ছিলেন। এমনে খুব গরিব। কুঁড়েঘরেই প্রায় থাকতেন। সেই মেয়েটি পছন্দ হয়। তখন মহারাজা তাকেই বিয়ে করেন। বিয়ে করলেন যখন তখন আমাদের গ্রামে অনেক কিছু খুলে যায়। মহারাজার ভাগনে আমাদের গ্রামে এসে থাকতে শুরু করেন। এদের দানে গোটা বাংলাদেশ গড়া। দৌলতপুর কলেজেও মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর নামে একটি কোয়ার্টার আছে। শিক্ষকদের। এদিকে এসে দেখলাম তানোরের দিকেও ওদের ইয়ে ছিল। খুব বড়লোক । ওঁরা খুব দানশীল ছিলেন। বংশের মানুষগুলো এখনও বেঁচে আছেন। ওর ছেলে ছিল শ্রীশচন্দ্র নন্দী। তার ছেলে সৌমেন চন্দ্র নন্দী। আছেন তো এখনও কলকাতায়।
Ñহ্যাঁ, শিয়ালদা স্টেশনের গায়ে যে রাজবাড়িটা এখনও রয়েছে।
হ্যাঁ স্বর্ণপুরী। আমি একবার সোমেন বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। কলকাতায় গেলে মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাছাকাছি বয়স ছিল। তার ছেলে শ্রীশচন্দ্র নন্দী নাকি বাংলার সবচেয়ে সুপুরুষ বলে খেতাব পেয়েছিলেন। তার ছেলে সোমেন চন্দ্র নন্দী, তিনিই এখন জীবিত আছেন। আমার স্মৃতিটা হচ্ছে, আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন তিনি আমাদের স্কুল ভিজিটে এসেছিলেন। তখন আমাকে স্তুতি রচনা করার জন্য একটা ভার দেওয়া হলো। সেই প্রথম গদ্য লিখি আর কি। ক্লাস নাইনে। যতদূর কঠিন কঠিন শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়। সব শব্দ একখানে করে...
Ñসেই গদ্য কি আপনার কাছে এখনও আছে?
কই, নাই বোধহয়, দেখি না তো আর। এখন স্কুলে আছে কি না।... তো উনি এলেন। অসম্ভব সুপুরুষ মানুষ। অসম্ভব সুপুরুষ, বুঝলে। তা এখন কেমন দেখতে। তো তখনকার চোখ দিয়ে দেখা তো। ফিনফিনে ধুতি, পাঞ্জাবি, খুব সুন্দরÑ এলেন। তার পরে বহুলোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার স্তুতিপাঠ। একজন পাঠ করবে। তার জন্য আর দুজন লোক লাগল। স্তুতিপাঠটা আমি করলাম। আর দুজন লোক লাগল, কারণ এমন ঠ্যাং কাঁপতে লাগল। ছেড়ে দেয় তো পড়ে যাই আর কি। (এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল পড়ে গেল।)
হা হা হা দুজন দুই পাশে ধরে আছে আমাকে। আর আমি কাঁপা কাঁপা গলায়...।
Ñতখনও কোনো গল্প লেখেননি?
কোথায়?
Ñস্কুল ম্যাগাজিন ট্যাগাজিন...
স্কুল ম্যাগাজিন ট্যাগাজিন তখন ছিলও না। এইটা আমার প্রথম লেখা।
Ñগল্পটল্প কখন লিখলেন?
সে অনেক পরে।
Ñসাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চয় ছিল। তা না হলে এই যে কঠিন কঠিন শব্দ এটা পেলেন কোথায়? প্রস্তুতিটা ছিল।
দিদিকে বাবা একটা মেঘনাদবধ কাব্য এনে দিয়েছিলেন। কাব্যটি যখন পড়া হতো তখন আমিও মাঝে মাঝে থাকতাম। কঠিন কঠিন শব্দ তো মেঘনাদবধ কাব্যে প্রচুর। দিদির নাম জাহানারা নওশিন। উনিও লেখিকা কিন্তু। এখনও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে দিদির সঙ্গে টেলিফোনে এক ঘণ্টা ধরে কথা হয়। তো দিদি যখন পড়তেন। বাবা মাঝে মাঝে দুই একটা শব্দের অর্থ খুঁজেটুজে বের করে দিতেন। কাজেই সেখান থেকে আমার কিছু কঠিন কঠিন শব্দ শেখা হয়েছিল। আর সাহিত্যে আগ্রহ থাকার ফল হচ্ছে ওই যে শিবরাম চৌধুরী। এই শিবরাম চৌধুরী আমাদের ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াতেন। তার পড়ানোর মধ্যে একটা অসম্ভব রকমের সেই ক্ষমতা ছিল। কী বলা যায়, অপরের কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া আর কি। তিনি যেভাবে আমাদের পড়াতেন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো তিন মাসে ছ মাসের জন্য শরীর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ফিরে এসে বলছে কেমন অভাব বোধ করেছিলে? চোখ গেল, কান গেল, সবাই গেল। সবশেষে প্রাণ বলে তোমরা যখন ঘুরে এলে তখন আমিও একটু ঘুরে আসি। শিবরাম বাবু সেটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলতেন, ‘দোহাই প্রাণ তুমি যেও না। দোহাই প্রাণ তুমি যেও না। তুমি গেলে একদণ্ডও আমরা বাঁচব না। এ রকম করে তিনি পড়াতেন।
Ñএই যে সম্মাননাপত্র বা অভিভাষণ যেটা পড়লেন। তার কী প্রতিক্রিয়া হলো মাস্টার মশায় বা অন্যদের বা যার উদ্দেশেই পাঠ করা হলো?
মাস্টার মশায়েরা বললেন যে, আমাদের এই ছেলেটা বাংলায় খুব ভালো। আর অঙ্কে বরাবরই ফেল করে। (হাসির রোল...)
ফার্স্ট হলেও ওকে তো ফার্স্ট দেওয়া যায় না। ওকে তো বিবেচনায় পাস দিতে হয়। অথচ যে ফার্স্ট হয়েছে তার চেয়ে সে অন্তত বিশ নম্বর বেশি পেয়েছে। কিন্তু অঙ্কে চব্বিশ-পঁচিশের বেশি পায়নি। কাজেই এ ছেলেটাই হলো আমাদের রত্ন। খুব ভালো। কিন্তু অঙ্কে কাঁচা। সংস্কৃতিতেও ভালো। সংস্কৃতিতে একশর ভেতরে একশ পায়। সবই ভালো।
Ñখুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
মোটামুটি মেধাবী ছিলাম আর সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলাম। হিন্দুপ্রধান এলাকা তো! টেন পারসেন্ট মাত্র মুসলমান আর নাইনটি পারসেন্ট হিন্দু। সামাজিক মেশামেশিটা এ করম ছিলই না।
Ñতার পরেও এই যে মেঘনাদবধ কাব্যটা দিদি পড়ছেন। পড়ার মধ্যে বাবা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এবং এ পড়ার মধ্যে অনেক কঠিন কঠিন শব্দ বাবা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আপনার একটা আগ্রহ ছিল।
আগ্রহ মানে স্কুল লাইব্রেরিটা শেষ করেছি আমি আর দিদি মিলে।
Ñআপানার সাক্ষাৎকারে লেখার মধ্যে পুরোনো গান সম্পর্কে আপনার এতরকম জানা। এগুলো কি, ওই সময়...
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই সময় আমাদের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল। বাবা একটা চমৎকার গ্রামোফোন কিনেছিলেন।
Ñচোং লাগানো। দেখে মনে হতো কলের গান।
এটা আরও অনেক সুন্দর। চোংটোং কিছু ছিল না। দিদির কাছে আছে ওটা আর কি।
Ñঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনা হতো, দুই পাশে ছবি থাকত।
হ্যাঁ হ্যাঁ, হিজ মাস্টার ভয়েস, ম্যাগাফোন। বাবা প্রথম দিকে হাত দিতে নিষেধ করতেন। যখন একটু বয়স হলো তখন আর বাবা বারণ করতেন না। তখন চন্দ্রগুপ্তের পালা, শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়, পাড়ার হিন্দুদের মুসলমানদের যাদের দরকার হতো তাদের ডেকে নিয়ে এসে…
Ñথিয়েটারের গানগুলো শুনত?
ডিএল রায়ের আয়রে বসন্ত পাখা মেলে, ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে এই শুনতাম। ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে, এই সব গান। পরে তো মান্না দে গেয়েছেন। রবীন মজুমদার কিন্তু তখন ওই রেকর্ডে গানটা গেয়েছিলেন। শিশির ভাদুড়ী সেখানে চাণক্যের অভিনয় করেছেন।
Ñআপনার বাড়িতে তখন গানের একটা আবহ ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম তখন তো অনেক খ্যাতির এক রকম চূড়ান্তে, শীর্ষে, নজরুলের গান তো তখন ব্যাপক জনপ্রিয়। তার গান শুনতেন না?
বা বা তো গান তো শুনতামই। আমার বাড়িতেই প্রচুর ছিল। লম্বা রাস্তা পার হতে রাস্তার মাঝখানে কোনো ভূত দেখে ভয় পাইলে আমি চিৎকার করে গান গাইতাম। গান করতে করতে চলে যেতাম। (হাসির রোল…)
আমাদেরও হতো খুব নির্জন জায়গা দিয়ে, তারস্বরে গান গাইতাম। নিজের আত্মবিশ্বাসটা বাড়ত তখন ‘সাহারাতে ফুটল রে ফুল, রঙিন ফুলে লালা’, ‘দেখ আমিনা মায়ের কোলে দোলে শিশু’...। এটা একেবারে অবিকল মা যশোদার কোলে শ্রীকৃষ্ণ দুলছে, ঠিক সেই মিলটা না? ঠিকই। সাহারাতে ফুটল রে ফুল তার পরে খোদার প্রেমে রঙিন হয়ে... নজরুলের সমস্ত গান তখন আমার ঠোঁটস্থ। মুখস্থ বলতে পারি এবং গাইতেও পারি। এ রকম অবস্থায় হেমন্তের সেই রেকর্ডটি আর পেলাম না। একদিন বললাম হেমন্তের যা কিছু পাওয়া যায় আমাকে দাও তো। তার মধ্যে শুনেছিলাম, ‘আকাশ মাঠে ওই ঘুমায় রাতের তারা’ তো সেটা পেয়েছি। তার পরে ‘লিখিনি লিপিখানি প্রিয় তোমারে’ স্বরলিপি ছবির গান। পেয়েছি।
Ñএ রকম একটা অবস্থা চলতে চলতে হঠাৎ গল্প লেখার কথাটা মাথায় এলো কী করে?
কোথায় গল্প। তখন গল্প পড়ি। পড়তে তখন আমার এত ভালো লাগত!
Ñতখন আর গান গাইতেন না?
প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম। কাকের কণ্ঠ আমার। ওই কণ্ঠে গান হবে না।
Ñতার পরে গল্প লিখতে আরম্ভ করলেন?
সে কবে গো সে তো অনেক পরে। তার পেছনে বিরাট একটা ইতিহাস আছে। বইপড়াÑ এগুলো সব।
Ñএকটা ভিত তো তৈরি হয়েছিল। আপনি বলছেন স্কুলের লাইব্রেরির বইপত্র পড়ে শেষ করে ফেলেছেন। মেঘনাদবধ কাব্যের সেই কঠিন কঠিন শব্দ…
হ্যাঁ, স্কুলেই দস্তয়েভস্কি পড়েছি, তলস্তয় পড়েছি এত ভালো বই তখন ছিল।
Ñঅনেকেই গল্প লেখার আগে কবিতাটবিতা লিখে থাকেন…
এ অন্যায় কাজটা ক্লাস ফোরেই করে ফেলেছি। (হাসির রোল)
Ñমনে আছে কোনো কবিতার পঙ্ক্তি?
যাচ্ছে তাই সব।
Ñছড়া লিখেছিলেন ছড়া?
সেসব ওই মৃত্যুটিত্যু সব। এখন মৃত্যু চেপে বসেছে। তখন তো মৃত্যুর কোনো ব্যাপার ছিল না। কবিতাগুলো সব মৃত্যু ছাড়া কোনো কবিতা ছিল না। (চাপা হাসি) বিলাসিতা, মরণ বিলাসিতা। লিখতাম আর কি। জীবনের প্রথম বই পড়েছিলাম ‘ধ্রুব’। ক্লাস থ্রিতে। লেখকের নাম আর মনে নেই। পরে তো নজরুল ইসলামের অভিনয়ে ধ্রুব তো সিনেমাও হয়েছে। তখন ওই সমস্ত বই পড়তাম। ‘আরাকানের বিভীষিকা’ নামে একটা বই তখন পড়েছিলাম। পরে বইখানা কেউ আমাকে আর জোগাড় করে দিতে পারল না। আমার সেই বইটা দরকার এজন্য যে মাঝামাঝি থেকে বাকিটা আর ছিল না। মাঝখানে মমতা বলে ওই মেয়েটা যে দুই পাহাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ভাগ্যে যে কী ঘটল তা আর জানতে পারলাম না। খুব পড়তাম ওই সময়ের দুশ বই। ...দেবী সরস্বতী, হেমেন্দ্র কুমার রায়, সব্যসাচী, পাঁচকড়ি দেÑ নীল বসনা সুন্দরী এনেছি। সেসব বইয়ের ডিটেকটিভের ধারাই আলাদা। কোনো অস্ত্রপাতি নেই। গল্প লেখার ইচ্ছেটা তখনও হয়নি। বরং অপুর কথাÑ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এত ইমপ্রেস করেছিল যে ওইটার মতো করে গদ্য লেখাটা। লিখেছি। তো সেও একটা হতাশাজনক কাহিনী। আমার জামাইবাবুর এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার খুবই ইচ্ছে আমার ওই গদ্য লেখার খানিকটা অংশ আমি পড়ে শোনাই জামাইবাবুর বন্ধুকে। আমি একদিন শোনাতে গেলাম বড় আশা করে। দেখি তখন তার হাতে একটা নতুন চকচকে বই। বইটার নাম হচ্ছে দেশে বিদেশে। উনি তখন শুরু করেছেন আর কি। হ্যাঁ। পড়ছেন কী মজা যে পাচ্ছেন। আমি আমার লেখা একটু শোনাতে চাইলাম। বললেন, আরে ধ্যাৎ, হা হা হা আমি এখন দেশে বিদেশে পড়ছি। কী অদ্ভুত নতুন বই এই মাত্র হাতে পেলাম। যাও যাও। শুনল না। কী করব আর আমি তখন চলে এলাম।
Ñছোটগল্প কবে থেকে?
আমি একটু একটু কবিতা লিখছি। সদ্য মাইকেল পড়েছি। মিলটিল ছাড়াই গদ্য কবিতাও লিখছি। এরই মধ্যে পাসটাস করে আমাকে চলে আসতে হলো। দৌলতপুর কলেজে যখন তৃতীয় বর্ষে উঠেছি। সাতান্ন সালে আমাকে আর্মি একটা অজুহাতে তাদের কাস্টডিতে নিয়ে যায়। দৌলতপুর কলেজের ছেলেদের দুর্দান্ত বলে দুর্নাম ছিল। ট্রেনে টিকিট কাটত না। চেকারদের মারধর করত। আমি ছাত্রনেতা ছিলাম। কলেজ সংসদের সেক্রেটারি। কাজেই আমি আজেবাজে কাজ কখনও করতাম না। খুলনায় যাচ্ছি। এক পাঞ্জাবি ছিল। লোকটার সঙ্গে আমার ভালোই সম্পর্ক ছিল। সেই হারামজাদা আমাকে ইয়ে হ্যায় ইয়ে হ্যায় করে দেখিয়ে দিল। আর্মি আমাকে নিয়ে নিল। সেই আর্মির যে নির্যাতন। আমার শরীরটা বোধহয় মজবুত ছিল। সেজন্য ফিরেছিলাম।
Ñবর্ধমানে তখনও যাতায়াত করছেন?
আরে বর্ধমানে তো যাতায়াত করছিই। একষট্টিতে চলে এলাম। আমার পাসপোর্ট তো আমি রেখে দিয়েছি। ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট। এখনও রেখে দিয়েছি। আমি এখনও দাবি করতে পারি যে আমি ইন্ডিয়ান।
Ñতারপর কী হলো?
ছাত্র আন্দোলনের ফলে রাতের বেলা ছাত্ররা তিন-চারটা বাস নিয়ে গিয়ে ওদের অফিস ঘেরাও করল। তখন ওরা আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। কলেজের প্রিন্সিপাল লোকদেখানো একটা ইনভেস্টিগেশন করে রিপোর্ট দিল যে ফার্স্ট ক্লাসে উইদাউট টিকিট চলাচল। এ রকম ভয়ংকর ব্যাপার। প্রিন্সিপাল বললেন, হয় চলে যাও না হলে আমরা বের করে দিতে বাধ্য হব। তুমি নবাব পরিবারের ছেলে। কোয়ার্টারটা ছেড়ে দাও। তোমার জামাইবাবুর মেসে ওঠো। পলিটিকস করো। আমার দিদি তখন ছিলেন না। তারা আমার স্কলারশিপটাও বন্ধ করে দিল। স্কলারশিপের চিঠিটা গায়েব করে তখন আমি দৌলতপুর কলেজ ছাড়লাম। ছাড়তে বাধ্য হলাম। রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। আমার হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট ওর বন্ধু। বললেন, সাঈদ এটা কী করেছে। লিখেটিখে কাগজপত্র আনালেন। আমি বললাম স্যার, ওখানে যে বারো মাসের বেতন দিয়ে এসেছি ১০ টাকা করে। আমি তো ছাড়ব না। তখন আমার রাগটাগ খুব ছিল। গিয়ে বললাম, আপনি তো আমার স্কলারশিপ আটকে দিতে চেয়েছিলেন। পারেননি। আমি সব পেয়েছি। এখন আমি এসেছি আমার বারো মাসের ১২০ টাকা বেতন দিয়েছিলাম। এখন ওটা ফেরত দিন। তখন গাঁইগুঁই করে ১২০ টাকা ফেরত দিলেন। তারপর ওই লোক যতদিন ছিলেন আমি ওই কলেজের চাকরি ‘না’ করেছি।