রেজা ফারুক
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৩০ এএম
বুলান্দ জাভীর, ১০ ডিসেম্বর ১৯৬০। প্রতিকৃতি : জয়ন্ত সরকার
অঝোর বর্ষণের পর ঝকঝকে সবুজ প্রকৃতির কান্কোয়, ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল টিনের চালের ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা রৌদ্রবিন্দুর হীরেজ্বলা দুপুরের রানওয়েতে যে রুপোর রাঙতাডোবা প্রহর যায় গড়িয়ে। ওই প্রহরের প্রতিটি স্তবকে যে গুঞ্জরন জাগিয়ে দেয় দূরের উড়ন্ত হাওয়া। সে হাওয়ার সিম্ফনি হয়েই যেন বেজে উঠেছে কবি বুলান্দ জাভীরের সদ্য রচিত কবিতাগুচ্ছের পঙ্ক্তিমালা।
বুলান্দ জাভীরের গুচ্ছ কবিতার একটি হলো ‘বৃন্দাবনী সারং ও সারেং’, যার মর্মে ব্যালেরিনার নাচের মুদ্রার মতো রিদমিক্ পঙ্ক্তিমালায় পুচ্ছজ্বলা ফিঙের মতো লাফিয়ে উঠে পাঠকের হৃৎস্পন্দনের ছায়াকুঞ্জে জাগিয়ে দেয় এক অন্যরকম ভাবালুতা!
‘কখনো কখনো মনে হয়/বহুদূর সমুদ্রের জলের ওপর/পদ্মপাতার মতো ভাসছে তোমার জলসা।’
ট্যুরিস্টের মতো এক বিকাল থেকে আরও এক বিকালের দিকে সামুদ্রিক নীল জলরাশি পেরিয়ে যাওয়ার গল্পের গহিনে বেজে কি উঠল জলপরীর জলে না ভেজা রেশমি ডানার নীল পিয়ানোর রিড! জরিপাড় ভোরের ধূসর কুয়াশার পরতে পরতে পাখির মায়াবী রোঁয়াজাগা বক্ষস্থলের ছোঁয়ায় ফোটা দেবদারুর ছায়াবীথি।
আশির দশক বাংলা কবিতার এক অনন্য দশক হিসেবে বিবেচিত। কবি বুলান্দ জাভীর এ আশির দশকেরই এক অন্যতম বিশুদ্ধ কবি। লিখছেন তিন যুগের বেশি সময় ধরে। এ সৃষ্টিশীল সময়ব্যাপে নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গের বাঁক ছুঁয়ে ছুঁয়ে নান্দনিকতার হিলস্টেশনের ওয়েটিং রুমের বার্নিশজ্বলা মর্মরেখায় এসে থামিয়েছেন তার কবিতার শাটল ট্রেন।
অনর্গল সৃষ্টির সি-বিচে সি-গালের মতো উড্ডয়নশীল তার কবিতা ইতোমধ্যে পাঠক এবং কাব্যবোদ্ধাদের আলোচনার জলসায় স্থান করে নিয়েছে। তার কাব্যরীতি, প্যাটার্ন, ইনোসেন্ট পোয়েটিক কনসেপ্ট যেন স্প্রিং-রেইনফোটা অ্যাশ্ফল্টের হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা ব্লুইশ্অ্যাশম কালারের লিমুজিনের আবছা ফাইবারের উইন্ডশিটের সানরুফের ফুলমকায় উড়ে এসে ঘুরে ঘুরে নেমে আসা এক পসলা মেঘলা সন্ধ্যার মর্মরিত জ্যোৎস্নাপুঞ্জ।
যেন মিহি বসন্তের হাওয়াজাগা মধ্যরাতের খোলা ব্যালকনিতে নিঃসঙ্গ ইজিচেয়ারের হাতলে ঝরা পাতার প্রপেলারে দূর অরণ্য থেকে ভেসে আসা আরণ্যক ঘ্রাণের হুহু শিশিরপুঞ্জ।
কবি বুলান্দ জাভীরের কবিতার চিত্রকল্প : জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতার প্রতিটি ডাইমেনশনের মধুরিমা ছুঁয়ে ছুঁয়ে হয়ে উঠেছে অনবদ্য সৃষ্টির বাস্তবরূপ।
‘হে ন্যায়বিচারক/যাতে দন্ড ভোগ শেষে ফিরে/এসে দেখি/সপরিবার পিতৃহারা সেই মহীয়সী দীর্ঘশ্বাসের/সুতো দিয়ে একটি শক্তিমান দেশের মানচিত্র সেলাই করছেন।’
এটিও বুলান্দ জাভীরের গুচ্ছ কবিতার অন্য একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি। যে পঙ্ক্তিমালার মর্মরে বেদনার্ত এক মেঘাচ্ছন্ন মুহূর্তের চিত্ররূপ চিত্রকল্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে ফুটে। এরপর অন্য এক আবেগমথিত স্যুররিয়েলিস্টিক ব্যঞ্জনাসদৃশ শব্দপুঞ্জ গ্রথিত করেছেন শেষের দুটি পঙ্ক্তিতে।
যেখানে কবি বলেছেন, ‘সুতো দিয়ে একটি শক্তিমান দেশের/মানচিত্র সেলাই করছেন।’
কী প্রবল কাব্যবোধের স্ফুরণ হয়েছে কবিতাটির অন্তরজুড়ে, পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন। ‘শুধু ওড়ে নীল প্রজাপতি/আজব কারিগর/বুকের ভেতর বানিয়েছে শীষমহল/একান্ত গোপন ঝাঁপি/খুলতেই উড়ে যায় প্রজাপতি/দল, বেদনার্ত নীল।’
এক রোমান্টিসিজম সেনসেশনের সিল্কি ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যান্ডিফোরা ফুলের নির্যাস উল্লিখিত কবিতার পনিটেলে যেন একচিলতে নীল ভেজা অন্তরীক্ষের মতো এসেছে নেমে। আর কবি বুলান্দ জাভীরের কবিতার কার পার্ক থেকে কখন যে দলছুট হয়ে বর্ষণমুখর একটি নীলাম্বর ভক্সওয়াগন বেরিয়ে গেছে লংজার্নির উদ্দেশ্যে তা কি জানে ওই বাদলাঝরা দিবসের নীলাঞ্জন ভোর।
বুলান্দ জাভীর-এর ‘নীল প্রজাপতি’ আরও একটি সাবলীল কবিতা। যে কবিতার পঙ্ক্তিতে স্কেটিং করে করে বরফজ্বলা ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির আরক্ত ছায়া গিয়ে বসেছে পাশ ফিরে স্নো-হোয়াইট পাইন গাছের হিমঠান্ডা ফরসাবুকের সন্ধিস্থলে।
কবি বুলান্দ জাভীরের নিমগ্ন ভাবনার রেণুর দৃশ্যপট অ্যাপ্লিকের মতো করে চূড়ান্ত রূপে উদ্ভাসিত করেছে। কী এক মোহাচ্ছন্নতা যে এ কবিতাগুলোর পঙ্ক্তির গহিনে অনুরণিত হয়ে বেজে চলেছে তা পাঠেই অনুভূত হয়।
যেন জলপ্রপাতের মতো অবিশ্রাম ঝরে পড়ছে মন ভালো করে দেওয়ার আশ্বাসে। মেলোডিয়াস সংগীতময়তার জাদুময় এক অনাস্বাদিত কল্পলোকের গল্প বলেছেন কবি বুলান্দ জাভীর তার সদ্য রচিত কবিতাপুঞ্জে। তার আরও একটি কবিতা হলো ‘শেষের কবিতা’ শিরোনামে।
পাতাগুলো মেলে ধরো/তুমিও জানো/আমি যখন বই এর ভেতর নামি/তখন শৈশবের বো-কাটা ঘুড়ির পিছনে/ঘোর লাগা শিশুর মতো/ছুটতে থাকি/তখন আমার চারপাশটা/রূপকথা রাজ্যের মতো/বর্ণিল হয়ে ওঠে।/অক্ষরগুলো প্রজাপতি/স্তবকগুলো গোলকধাঁধায়/হারিয়ে যাওয়ার অসীম চরণ।
যেন কবিতা নয়, কাব্যিকতার বনভূমিজুড়ে উড়ে উড়ে নেমে আসা শুভ্র প্যালিকান। আর দূরাচ্ছন্ন ফরেস্ট হিলের ফেব্রিক ডিওডোরাইজার ডোবা ডাকবাংলো থেকে ভেসে আসা এসরাজের সুরলহরী। যেন ঘাঘড়াপরা পরীর দল ওই সুরের মিহিন মাদকতায় সিক্ত হয়ে ভিজিয়ে তুলছে প্রকৃতিরও প্রাণ। আলোচ্য এ কবিতাগুচ্ছে রয়েছে আরও নয়টি স্নিগ্ধ শিশিরজ্বলা অপরাজিতার নীলাভ পাপড়ির মতো কবিতা। সব মিলিয়ে ১৩টি কবিতা কবি বুলান্দ জাভীর অতিসম্প্রতি রচনা করেছেন। এ ১৩টি কবিতা সেই রূপকথার গল্পের মলাটই যেন নতুন করে পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন গভীর ব্যঞ্জনায়। ‘কানা কবুতর ও হারিয়ে যাওয়া ধুন, নতুন বছর, ভুল নাবিক, জোনাকির বাতিঘর, বন্ধুত্বের ফল, পার্সিয়ান বিড়াল, ফটোশপ, আমি কেবল কান্নার শব্দ শুনি, প্রেমিক নাবিক।’
নামোল্লিখিত এ কবিতাগুলো নতুন করে কবি বুলান্দ জাভীরকে অ্যাস্ট্রোলোজারের মতো পাঠকের মুখোমুখি বসিয়ে দিয়েছে। কবির সাম্প্রতিক আলোচিত কবিতার পঙ্ক্তি পাখির রোঁ-এ সান্ধ্য জ্যোৎস্নারাজির মতো সময়ের পর্যবেক্ষণগুলো এত চিত্রময় আর হৃদয়স্পর্শীরূপে স্বল্পদৈর্ঘ্য ভোরের কুয়াশাহারা মেঠো পথের মতো গিয়ে মিশেছে নদীর তীরবর্তী গহিন রূপোজ্জ্বলতা ডোবা দিবসের রাঙতামোড়া অপরাহ্ণমালার কার্নিশে; যা এক অভিনব উপলব্ধি ফোটা দিগন্তের মেঘপুঞ্জের ড্রয়ারে জমা হারানো মার্বেল ফোটা কৈশোরের কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
এই হলো কবি বুলান্দ জাভীরের সদ্য রচিত কবিতাগুচ্ছের গল্পকথা। মেঘে ডোবা ঘোরের ভেতর থেকে নেমে আসা বুলান্দ জাভীরের কবিতা বরাবরই এক ভিন্নমাত্রায় পাঠককে জদুকরের মতো টেনে নিয়ে যায় ঝাপসা হয়ে আসা মায়াজাগা বিভোর বিকালের দিকে। এ কবিতাগুচ্ছের কবিতাও তাই। কবি বুলান্দ জাভীর বরাবরই প্রেম ও প্রকৃতির অন্তর্নিহিত গুঞ্জরন দক্ষ সংগীতজ্ঞের মতো কবিতার নীল লাউঞ্জে স্থলপদ্ম ফোটা রেশমি পর্দার ফিউশনে দেন জড়িয়ে। যেন চন্দ্রাঙ্কিত জাফরানি রাতের ক্যানভাসের জলরঙ ছবি! হ্যাঁ কবি। শতভাগ কমিটেড কবি বুলান্দ জাভীরের পূর্বাপর রচিত কবিতার অন্তর্জগতেও যায় পাওয়া ঝাউফুল ফোটা মন। তার তেমনই কিছু কবিতা হলো মিস্ প্যারিস, মিস্ মেলবোর্ন, ওরল্যান্দো প্রভৃতি। যে কবিতাও পাঠকের মন যায় ছুঁয়ে। কখনও বা নুয়ে এসে এক ফুঁয়ে দেয় উড়িয়ে তারই সদ্য রচিত কবিতাপুঞ্জের ‘নীল প্রজাপতি দল’। যেন ফেলে আসা কৈশোরের নির্জন মার্বেল দুপুর ইলশেগুড়ি বৃষ্টির চোখ ফাঁকি দিয়ে কিশোরীর ঝুঁটিতে ফোটা মেঘের ময়ূর দেয় উড়িয়ে। বুলান্দ জাভীরের কবিতা এমনই যা পারম্পর্যের অয়েল পেইন্টিঙে হয় আঁকা! কেননা, কবিতার প্রতি এটাই কবি বুলান্দ জাভীরের বিনম্র দায়বদ্ধতা।
পুনশ্চ : একাধারে কবি, অনুবাদক ও একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে রয়েছে তার বিপুল খ্যাতি। আশির দশকের প্রধান সারির অন্যতম কবি বুলান্দ জাভীরের রয়েছে আরও এক অনন্য পেশাগত পরিচয়। তিনি বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। উল্লেখ্য, তিনি ইতঃপূর্বে সুনামের সঙ্গে সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ নামে একজন বিজ্ঞ, সুদক্ষ ও সৎ ব্যাংকার হিসেবে তিনি ব্যাংকিং জগতে সুপরিচিত হলেও সাহিত্যাঙ্গনে সাহিত্যের মূলধারার সুপ্রতিষ্ঠিত কবি বুলান্দ জাভীর নামেই তাকে সবাই জানে।